অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৮, ২০২৪
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৮, ২০২৪
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বাতী চৌধুরী -
ক্ষেত্রজ

তুমি কি কুন্তী হতে চাও?

কেন আমি কুন্তী হতে যাব কেন? আমি তো লোপামুদ্রা। আমি তো আমার নিজের জন্য একটি সন্তান চাই! কুন্তী তার সন্তানকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমি তাকে আমার কাছেই রাখব।

তুমি কি গূঢ়োৎপন্ন সন্তান নিতে চাও?

হঠাৎ এই কঠিন শব্দের অবতারণা! কী বলতে চাইছ?

তুমি শব্দটার মানে জানো না?

জানলেই কী আর না জানলেইবা কী?

এরকম শব্দ শাস্ত্রে ও পুরাকালের কাহিনীতে আছে। তোমার মনোভাব বুঝে আমার সেসব কথা মনে পড়ছে আর কি!

রাখো তোমার শাস্ত্র আর কাহিনীর কচকচানি। রাখো তোমার কঠিন কঠিন শব্দ বলার পাণ্ডিত্য। আমি শুধু আমার নিজের একটা সন্তান চাই। যে আমার রক্ত-মাংসে জাত হবে। আমার জেনেটিক ধারণ করবে। আমি মরে গেলেও আরও বহু বহু বছর তার রক্তধারা বেয়ে আমার বংশগতি আরও দূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বেঁচে থাকবে। তা ভবিষ্যতের কথাও না হয় থাক। আমার বর্তমানকে যে প্রাণের স্পন্দনে, হাসি কান্নায় ভালোবাসায় সবসময় ভরিয়ে রাখবে— সবচে বড় চাওয়া হলো আমার এই। তাই আমার যখন সক্ষমতা আছে; একটি সন্তান যে করেই হোক আমার চাই। ব্যস।

তোমার চাওয়াতে আমার তো কোনো আপত্তি নেই। আমি জানতে চাইছি কোন প্রক্রিয়ায় তুমি সন্তান ধারণ করবে?

কোন প্রক্রিয়া মানে কী? সারা পৃথিবীর সব সন্তান যে প্রক্রিয়ায় তার মায়ের গর্ভে সঞ্চারিত হয় সেই প্রক্রিয়াতেই আমার সন্তানও আমার গর্ভে সঞ্চারিত হবে।

আরে আমিও তো সেটাই জানতে চাইছি, প্রক্রিয়াটা কী? দুনিয়ার আরও হাজার হাজার সন্তানের জন্মদানের প্রক্রিয়া আর তোমারটা এক হবে কী করে?

কী বলছ তুমি? আয়নার প্রতিবিম্বে যাকে দেখা যায় তার দিকে চোখ পাকিয়ে ধমকায় লোপামুদ্রা।

এই তুমি কাকে চোখ পাকাও? এ্যাঁ! আমি কি ভুল বলছি নাকি? প্রতিবিম্ব এবার লোপামুদ্রাকে ধমকায়।

তা কী করব আমি? তুমি আবোলতাবোল বলে আমাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছ। শোনো, দুনিয়াতে সন্তান জন্মের প্রক্রিয়া প্রাকৃতিকভাবে একটাই হয়। হ্যাঁ বছর দশেক হলো শুনছি যে কৃত্রিম পদ্ধতি অর্থাৎ টেস্টটিউব বেবি জন্ম হচ্ছে এই পৃথিবীতে। এমনকি পাশের দেশ ভারতেও হচ্ছে এবং শুনতে পাচ্ছি উন্নত দেশে গর্ভধারণে অক্ষম বা অনিচ্ছুক নারী অন্য কারও জরায়ু ভাড়া করেও নিজের ডিমে সন্তান ফুটাচ্ছে। তবে আমাদের দেশে তো সে সুযোগ নেই। আমি তাই সেই আদিম প্রক্রিয়াতেই সন্তানের জন্ম দেব। তা রইল বাকি বীজ। সে আমি না-হয় পছন্দমতো কোনো একজন বীজদাতা খুঁজে নেব। তুমি এতক্ষণ ধরে এত জিলাপির প্যাঁচ প্যাঁচাচ্ছ কেন সে কি আমি বুঝিনি ভাবছ? শোনো, আমার সংস্কারমুক্ত মন। আমি দেখেছি ঘরে কখনো বীজ না থাকলে আমার মা প্রতিবেশি কাকিমা দিদিমাদের কাছে থেকে লাউ, শশার বীচি এনে নিজের বাড়ির মাটিতে পুঁতে দিয়েছে। দিব্যি চারা গজিয়েছে। বেড়া দিয়ে, মাচা দিয়ে, জল দিয়ে, সার দিয়ে সে গাছে ফসল ফলিয়েছে আমার মা। প্রতিবেশি সকলেই। আমিও না-হয় তাই করব।

বাহ্ মানুষে আর চারাগাছে মিলিয়ে দিলে?

দিলাম। দুটোরই প্রাণ আছে। জীবন আছে। খাদ্য গ্রহণ করে, বংশ বৃদ্ধি করে আর মরে যায়। তাহলে মেলালে সমস্যাটা কী? এবার যাও তুমি। আউট!

ছায়া মিলিয়ে যায়।

ডাইনিংয়ে বসে বড় মগ থেকে ছোট দুটো মগে কফি ঢালতে ঢালতে লোপামুদ্রা রায় সাগ্নিকের মুখের দিকে পলকহীন চোখে চেয়ে থাকেন। একমাস পর বাড়ি ফিরেছে ছেলেটা। একমাস আগেও তার মুখটা ক্লিন শেভ ছিল। এখন কি সাগ্নিক দাড়ি রাখবে নাকি শেভ করার সময় পায়নি বলে দাড়ি বড় হয়ে গেছে? পাতলা নরম দাড়িতে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। ও মুখ দেখতে দেখতে আরেকটা মুখের কথা মনে পড়ে লোপামুদ্রার। সেই মুখটাই যেন কপি পেস্ট করা। সেই বাম গালে তিল, জোড়া চিকন ভুরু। সাগ্নিকের মুখের দিকে তাকালে সবসময়ই হুবহু আরেকটা মুখ মনে পড়ত। আজও পড়ল। ত্রিশ বছরের সাগ্নিক। লোপামুদ্রার একান্ন বছর বয়সে জন্ম দেওয়া প্রথম ও একমাত্র সন্তান। ছেলেকে মানুষ করতে চাকরি এবং সম্ভাব্য পদোন্নতি ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই ছেলে এত বড় হয়ে গেছে আর তিনি এখনও বেঁচে আছেন! তিনি দেখছেন আর ভাবছেন ছেলের সারা চোখে মুখে দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত অভিব্যক্তি ছড়িয়ে রয়েছে। তাতেই তার সুন্দর চেহারা যেন আরও ঝকঝক করছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে লোপামুদ্রার মন মুগ্ধতায় ভরে থাকে।

মায়ের মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকা দেখে সাগ্নিক বলে, আমার মুখে অমন করে তাকিয়ে তুমি কী দেখ মা?

বোকা ছেলের কথা শোন দেখি! আরে পাগল ছেলে, তোর মুখে তো তোকেই দেখি! কফির কাপে চুমুক দিয়ে সেটা টেবিলে রেখে ছেলে এবার মাকে দুহাতে জড়িয়ে চুমু খায়।

হুম! আমি পাগল ছেলে, আমি বোকা ছেলেই বটে কিন্তু আমার মা-টা যে একটা মস্ত পাগল আর একটা মস্ত বোকা সেটা কে বোঝাবে?

আচ্ছা!

কফি খেতে খেতে ছেলে মায়ের এই খুনসুটি চলতেই থাকে। এর মাঝেই ছেলের পিঠে হাত রেখে লোপামুদ্রা বলেন, হ্যাঁরে খোকন, স্বাহা মেয়েটা আমার কথা কিছু বলে না?

কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে সাগ্নিক মাকে উল্টো প্রশ্ন করে— এ কথা বলছ কেন? ও কি তোমাকে ফোন-টোন করে না নাকি?

করে না তো! তাই তো জানতে চাইলাম।

তাই? সাগ্নিক যেন একটু ক্ষেপেছে। বলে— মেয়েটির আস্পর্ধা কেমন দেখো! তোমাকেও ফোন করে না? দাঁড়াও এখুনি বোঝাচ্ছি। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে সে।

রোসো বাবা, রোসো। সে তোমার সাথে যোগাযোগ রাখছে কিনা সেকথা বলো। আশি বছরের এই বুড়িকে তার মনে না থাকলেও চলবে।

দ্যাখ মা, আমাকে রাগিও না। যে কোনো মানুষের পক্ষেই তার আত্মীয়স্বজন এমনকি চেনাজানা সত্তর আশি বছরের ব্যক্তির খোঁজ খবরটাই আগে নেওয়া কর্তব্য। আমি তো নিই। আর সে তার হবু শাশুড়ির খোঁজ নেবে না? তাহলে আমার প্রতি তার কীসের ভালোবাসা বলো? আমি তো আমার মা-বাপসহ অন্যান্য সকল প্রিয়জনকে নিয়েই নাকি? আমাকে ভালোবাসলে আমার সকলকে ভালোবাসতে হবে।

এই দুই হাজার ঊনিশ সালের শেষে এসে ডিজিটাল যুগের ছেলের মুখে এসব কথা? পাগল ছেলের কথা শোনো। আরে তোর মা যদি ডাইনিও হয় তাও তাকে ভালোবাসতে হবে বুঝি? লোপামুদ্রা ছেলের কথায় আহ্লাদিত হন কিন্তু তা বুঝতে না দিয়ে কপট রাগ দেখান।

আমার মা মোটেই ডাইনি নয়। এমন মা পৃথিবীতে কমই আছে। মাকে আবার দুহাতে জড়িয়ে রাখে সাগ্নিক। আর যদি সে ডাইনিই হয়, তো ডাইনির ছেলেকে ভালোবাসবে কেন? ডাইনির ছেলে তো অসুর হওয়ার কথা তাই না?

আরে পাগল, কেউ কি মা বাবা দেখে কারও প্রেমে পড়ে? তুই কি স্বাহার বাবা-মাকে দেখে তার প্রেমে পড়েছিস বল? আচ্ছা ওসব বাদ দে। স্বাহা আমার যথেষ্ট খোঁজখবর নেয়। শুধু গত দুদিন ওকে আমি ফোনে পাচ্ছি না। এখন তোরা কবে বিয়ে করবি বল? আমার বয়স আশি পেরিয়ে একাশিতে পড়ল বলে। আর কতদিন বাঁচব আমি? তোদের নিয়ে একসাথে কটা দিন থাকার যে খুব সাধ রে বাপ!

সে কি মা? স্বাহার সাথে গত দুদিন আমারও দেখা হয়নি। ফোনেও কথা হয়নি। দু একবার ফোন করেছিলাম কিন্তু নেট ছিল না একবারও। আমি ভাবছি ওই হয়তো ফোন করবে। কিন্তু কাল পরশু এত কাজের চাপ ছিল যে রাতে শুধু তিন চার ঘণ্টা ঘুমোবার ফুরসত পেয়েছি।

রাখ আমি ফোন করছি। লোপামুদ্রা নিজের ফোনের স্ক্রল করতে না করতেই দেখেন স্ক্রিনে সেই স্বাহা নামটাই ভেসে উঠল।

স্বাহা কল রিসিভ করলে লোপামুদ্রা বলেন, কী গো মেয়ে, ব্যাপার কী তোমার? দুদিনেও বুঝি মায়ের খবর নেওয়ার সময় মেলেনি?

স্বাহা অভিযোগের উত্তর না দিয়ে পাল্টা অভিযোগ করে— দেখ মা তোমার ছেলে দুদিন ধরে আমার খোঁজ নেয়নি। আমি কেন তার মায়ের খোঁজ নেব বলো?

এ্যাই মেয়ে! মারব থাপ্পড় একটা। আমি বুঝি খালি সাগ্নিকের মা? তোর মা নই? আচ্ছা আমার কথা শোন, এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আর শুনব না। সাগ্নিক বাড়ি এসেছে। তুমিও আস। আমি আর কাউকে দূরে দূরে রেখে মরতে পারব না। খুব শিগগির দুজনের চার হাত এক করে আমি মরতে চাই। কাল এস। সামনে প্রথম যে দিনটা শুভ আছে সেদিনেই শুভকাজ আমি সম্পন্ন করব। কাল তোমার বাবা-মাকেও নিয়ে আসবে সাথে করে। কীভাবে কী হবে আমরা কালই ঠিক করে নেব কেমন?

মা!

হ্যাঁ বলো।

তোমার ছেলে আমাকে বলে যায়নি কেন?

সে না-হয় তাকেই জিজ্ঞেস করো মা!

ঠিক আছে, কিন্তু ও এখন কোথায়?

এই যে আমার কোলের কাছে বসে আছে। দাঁড়াও ওর কান মলে দিচ্ছি।

তাই দাও। যেমন কর্ম তেমন ফল।

মা লাগছে।

বেশ হয়েছে। ওপাশ থেকে স্বাহার কণ্ঠ থেকে রিনিঝিনি হাসির ঝংকার ভেসে আসে। তাতে কপট রাগ দেখিয়ে লোপামুদ্রা বলেন, না বেশ হয়নি। তোমার জন্য আমার এত বড় ছেলের কান মলেছি। এবার যদি না আস তো আমি নিজে গিয়ে তোমার কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনব।

না বাবা, আমি কান টানাটানি পছন্দ করি না। আমি কালই আসছি।

অ! তা অন্যের কান টানলে তো বেশ মজা পাও দেখছি?

স্বাহা তার বাবা-মাকে নিয়ে এসেছিল। সামনের সপ্তায়ই বিয়ে। অমনি সাগ্নিক তার ছোট পিসিকে নাইওর আনতে চলে গেল। পিসিও ভাইপো অন্তপ্রাণ। পিসিদের আরও দুই দাদার ছেলে থাকা সত্ত্বেও ভাইপো বলতে যেন এই সাগ্নিক। বড় দুজন নেই আছেন শুধু ছোট পিসি সুপর্ণা। ওঁরও শরীর ভালো নয় খুব একটা। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই করছে। তাও ভাইপোর বিয়ে বলে কথা। কতকিছু যে নিয়ে এসেছেন। ওঁর নিজের ছেলেদের সেই কবে বিয়ে হয়েছে এখন তো নাতি নাতনিরাই বিয়ের জন্য রেডি। ইতোমধ্যে একজনের তো বিয়েও হয়ে গেছে।

সুপর্ণা তাঁর লাগেজ ব্যাগ ব্যাগেজ খুলছেন আর বিড়বিড় করছে— ভাইস্তারে ভাইস্তা সময়মতো জন্ম নিলি না। সময়মতো পৃথিবীতে এলে আমরা সবগুলো ভাইবোন মিলে তোর বিয়েতে কত রঙ্গ করতাম। আর আজ সেই তোর বিয়ে হচ্ছে কিন্তু কী, তোর বাপ জ্যাঠা পিসি কেউ রইল না। তাও তোর ভাগ্য ভালো যে তোর মা আর আমি এখনো আছি। সবচে কষ্ট লাগছে তোর বাবার জন্য। একমাত্র ছেলের বিয়ে দেখে যেতে পারল না।

ননদের কথা শুনে লোপামুদ্রার আজও মনে মনে হাসি পায়। সারাটা জীবন কাকের মতো কোকিল ছানাকে তা দিয়েছে ওরা। কাক তো একসময় বুঝতে পারে যে এত আদরের ছানা ওদের নয় কিন্তু সুপর্ণা ও তার বোনেরা কোনোদিন জানতেও পারল না আদরের ভাইপোটি তাদের কেউ নয়।

পঁয়ত্রিশ বছর আগের সেই বিকেলের ছবিটা এখনো ঝকঝক করে। শশাঙ্কর সাথে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল। যখন কিনা মনে মনে সেই শশাঙ্ককেই খুঁজে ফিরছিল লোপামুদ্রা। খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছিল শশাঙ্ককে। গত বিশ বছর ধরে ছেলেটার সাথে তার বন্ধুত্ব। এমন বন্ধু সচরাচর পাওয়া যায় না। তার নিজেরই বয়সী কিন্তু ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সে লোপার থেকে একটু আগেই বিয়ে করেছে। অল্প বয়সী বউ যখন যা মনে চায় কেবল বায়না করে। শশাঙ্ক ভালো পদেই চাকরি করে। কিন্তু ঘুষ খায় না। অবৈধ রোজগারের ধান্ধাই নেই। নিজ বেতনের উপর টেনেটুনে চলার চেষ্টা করে। শুধু অবুঝ বউয়ের বায়না মেটাতে গিয়ে তার প্রাণ কণ্ঠাগত হয়। এজন্য সে কাউকে দোষারোপ করতে পারে না। এমনকি বউ মায়াকেও নয়। কারণ ভুল সে নিজে করেছে। মায়াকে সে নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছিল রূপসী দেখে। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে যে সংসার চালাতে শুধু রূপবতী বউ কোনো কাজেই লাগে না যদি তার বুদ্ধি বিবেচনা ও কাণ্ডজ্ঞান না থাকে। কাজেই ভুলের খেসারত তাকে জীবনভর দিতে হবে সেটা শশাঙ্ক বুঝে গেছে। যদিও গত দশ বছর দেখা সাক্ষাৎ হয়নি বললেই চলে। মাঝে মাঝে চিঠিপত্রের আদান প্রদান হতো। তখনো মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের অবলম্বন এই চিঠি। টেলিফোন আর কজনের বাড়িতেই ছিল? অফিসের ফোনে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা সততার পরিচয় হতে পারে না। তাই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দুজনের কেউই সে সুযোগ নেয়নি। বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল এক শহরে পাশাপাশি অফিসে কর্মস্থল হওয়ার সুবাদে এবং বলাই বাহুল্য তারা দুজন তখন প্রত্যেকেই বিবাহিত। প্রেম বা পরকীয়া এরকম কোনো ভাবনাও মাথায় আসেনি কখনো। ছেলেতে মেয়েতে শরীরী সম্পর্ক ছাড়া নিখাদ বন্ধুত্ব হয় না এমন ধারণাকে তারা অতিক্রম করতে পেরেছিল। ব্যক্তিগত গোপন কিছু বিষয় ছাড়া তারা নিজেদের সুখ দুঃখের কথা অকপটে প্রকাশ করত। কিন্তু দুজনের যে কিছু গভীর গোপন দুঃখ ছিল তার কোনো আভাস কেউ কখনো কাউকে দেয়নি। বন্ধুত্বের বিশ বছরের মাথায় দীর্ঘ দশ বছরের অদর্শনের পর পেশাগত কারণেই রাজধানী শহরে এসে দুজনের আকস্মিকভাবে দেখা হয়ে গেলে তারা সিদ্ধান্ত নেয় আজ আর তারা দুজন বাড়ি যাবে না। একসাথে কোথাও বসে চা খাবে আর ফেলে আসা দিনের গল্প করবে। পুরানা পল্টনের একটি রেস্টুরেন্টে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই লোপামুদ্রা বলল, আপনাকে বিমর্ষ লাগছিল কেন?

সে কথা? ও থাকুক।

থাকবে কেন?

সে অনেক কথা এখানে বলা যাবে না।

চলুন রমনা লেকে যাই। লেকের জলের দিকে চেয়ে থাকলে আপনার মন ভালো হয়ে যাবে।

সত্যি সত্যি লেকের পাড়ে গিয়ে শশাঙ্কর মন ভালো হয়ে গেলে সে বলে, একটা ধন্যবাদ পাওনা হলো। দিতে পারি? নেওয়া যায়? শশাঙ্ক এভাবেই কথা বলে। কোনো সম্বোধন মানে আপনি তুমি কিছুই বলে না।

সে দিতেই পারেন আর আমিও সেটা নিতে পারি। তবে আজ আমার এই শুকনো ধন্যবাদে পোষাবে না। আমি যদি অন্য কিছু চাই আপনি দিতে পারবেন?

কী সেটা? আমার কিন্তু অদেয় কিছু নেই। বললেই হয়।

আজকের রাতটা যদি আমরা দুজন একসাথে কাটাই আপনার আপত্তি আছে?

লোপামুদ্রার চোখে চোখ রেখে শশাঙ্ক অপলক চেয়ে থেকেছিল অনেকক্ষণ। তারপর মৃদু হেসে বলেছিল, সে আমার সৌভাগ্য।

তখন শরৎকাল। বিকেলের আকাশটা নীল সাদায় যেরকম মাখামাখি হয়েছিল তেমনি রাতের চন্দ্রালোক হোটেলের জানালা গলে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছিল। তবু সেই চন্দ্রাহত রাতে হোটেলের ঘরে তুমুল বৃষ্টি নেমেছিল। সকালে বিদায় নেওয়ার সময় লোপামুদ্রা বলেছিল, এই একরাতের স্মৃতি নিয়ে আমি জীবনের বাকি রাতগুলো উদযাপন করব নিজের সাথে অভিসার করে।

আজ থেকে ঊনপঞ্চাশ বছর আগে যখন বিয়ে হয়; জরায়ুর স্বাধীনতা শব্দটার সাথে তখনকার বত্রিশ বছরের তরুণী লোপামুদ্রা রায় নামের আজকের একাশি বছরের বুড়িটির কোনো পরিচয় ছিল না। তবু কেন যেন মহাভারতে পড়া কুন্তীর পুত্রগণ কিংবা কুন্তীর শ্বশুরদের জন্মবৃত্তান্ত তাকে তীব্রভাবে আঘাত করেছিল। কুন্তীর বর পান্ডু এবং তার শ্বশুর বিচিত্রবীর্যরা বীর্যহীন ছিল অথচ স্ত্রীর জরায়ু বৈবাহিক অধিকারে তাদের আপন ক্ষেত্র সেই অধিকারে কুন্তী মাদ্রীর কিংবা অম্বিকা অম্বালিকার গর্ভজাত সন্তানগুলো ওদের ক্ষেত্রজ সন্তান হিসেবে কুরু বংশের পরিচয় পেল এটা তরুণী লোপামুদ্রার পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর ছিল। সেই কৈশোর থেকেই মহাভারত পড়া হয়েছিল লোপামুদ্রার। মহাভারত পড়তে বসলে পাশের ঘরের রসিক দিদিমা ঠাকুরমা বলত, তা মহাভারত পড়ছিস পড়! কিন্তু এটা হচ্ছে আঠারো পুঙ্গার কাহিনী।

পুঙ্গা যে জারজ শব্দের আঞ্চলিক রূপ সেকথাও সেই দিদিমা ঠাকুরমারাই বলেছিল। কৈশোরে জন্মের প্রক্রিয়ার গোপন রহস্যটা ভাসা ভাসা বুঝলেও তারুণ্যে যখন সবটা বিষয় পরিষ্কার হলো তখনই মনের মাঝে প্রশ্নটা উঠেছিল। তার মনের প্রশ্নটা ছিল এরকম যে ক্ষেত্রজ সন্তান হিসেবে যখন কোনো সন্তানকে পরিচিতি পেতে হয় তবে সে তো মায়ের সিদ্ধান্তেই হওয়া উচিত এবং তাতে মায়ের স্বত্বই কেবল থাকা উচিত? কারণ জরায়ু যদি ক্ষেত্রই হয় তো ঐ ক্ষেত্রটি শুধুই নারীর; অন্য কারওর নয়। অতএব সেই ক্ষেত্রে সন্তান ধারণ করতে যদি কোনো মায়ের ইচ্ছা হয় তবে কার বীজ সে গ্রহণ করবে সেটাও সিদ্ধান্ত নেবে মা। মাকে বিবাহ করা অক্ষম পুরুষটি নয় এবং অতি অবশ্যই ঐ পুরুষটি তার পিতৃত্ব বা বংশ রক্ষার চাহিদা বা ইচ্ছা পূরণের নিমিত্ত অন্য পুরুষের সন্তান ধারণের জন্য জোর করে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। তবে হ্যাঁ, সে ঐ সন্তানকে নিজের সন্তানরূপে গণ্য করতেই পারে যেমন কোনো নারী তার বরের বিবাহিত অন্য নারীর সন্তানকে গণ্য করে। লোপামুদ্রার আরও মনে হয়েছিল যখন কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর জরায়ুকে নিজের ক্ষেত্র হিসেবে দাবি করে তখন ক্ষেত্রের বা জরায়ুর আসল মালিক একজন নারী আর মানুষ থাকেন না তিনি ক্রীতদাসী বা জড়পদার্থে রূপান্তরিত হন। কিন্তু কথা হলো, ক্রীতদাসী হলে পুরুষটি তাকে কোন মূল্য দিয়ে কেনেন? কেনাবেচার প্রথম শর্ত যদি মূল্য হয় তবে তো পুরুষটিই নারীর পিতার কাছে বিক্রীত হন। কেন না প্রায় প্রত্যেক বিবাহিত নারীর পিতা কন্যার বরকে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী টাকাপয়সা সোনাদানা ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দিয়ে থাকেন আর বর সেটা হাত পেতে গ্রহণ করেন। অথচ কী পরিহাস, শুধু নারী হওয়ার কারণেই এখানে একটা অদ্ভুত ও উল্টোনীতি বিরাজমান। ক্রেতার নিকট থেকে কোনো মূল্য ছাড়া উল্টো মূল্য দিয়ে অমূল্যে বিক্রি হয়ে যান নারী।

ঊনপঞ্চাশ বছর আগের বিবাহিত জীবনের প্রথম রাতটির কথা মনে পড়ে লোপামুদ্রার। ফুলশয্যার রাতটি বর-কনে দুজনের জন্যই হয় অনেক আকাঙ্ক্ষার রাত। কতদিন কতরকমভাবে এ রাতকে নিয়ে লোপামুদ্রাও স্বপ্ন দেখেছে। কল্পনায় কতভাবে রাতটাকে সাজিয়েছে। কিন্তু যখন সে রাত এল তখন সে রাত অমাবস্যার গাঢ় অমানিশা ঢেলে দিল। লোপা জানল আলোকময় এক নির্বীজ অক্ষম পুরুষ।

তাহলে বিয়ে কেন তুমি করলে? প্রশ্নটা ঠোঁটের কোণে আসার পরও জিভ দিয়ে ভেতরে ঠেলে দেয় লোপামুদ্রা। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে সে। আলোকময় চুপ করে থাকে।সে কি কিছুটা অনুতপ্ত? লজ্জিত? কিন্তু মুখে প্রকাশ করল না কেন? নাকি লজ্জা বা অনুতাপ প্রকাশের ভাষা তার জানা নেই? নাকি তা প্রকাশের কোনো গরজ নেই! কিছুই বুঝতে পারেনি লোপামুদ্রা। তার চোখে ঘুম আসে না। সে ভাবে আজ রাতে তো তাদের ঘুমিয়ে থাকার কথাও ছিল না। ছিল দুজন দুজনকে গভীরভাবে চেনা জানার রাত। অথচ কী হয়ে গেল। কেউ কারও দিকে তাকাতেও পারছে না। সারাটা রাত লোপার মাথায় হাজারো প্রশ্ন এসে ভিড় জমাল। কত যে ভাবনা এসে পোকার মতো কামড়াতে থাকল তার ইয়ত্তা নেই। এ জীবন কি সত্যি যাপন করা যাবে? তাহলে কীভাবে? একজন রক্ত-মাংসের মানুষের প্রাত্যহিক কামনা-বাসনার টুঁটি কতটা চেপে রাখা যাবে? সেটা কি আদৌ সম্ভব? নিজের সাথে এর আগে তো এ নিয়ে বোঝাপড়ার অবকাশ মেলেনি। সে কি তাকে ত্যাগ করবে? কিন্তু লোকে যখন প্রশ্ন করবে, কেন? জবাবে কি বলতে পারবে যে লোকটি অক্ষম পুরুষ! তাদের পারিবারিক সামাজিক যে শিক্ষা সংস্কারে সে বড় হয়েছে তাতে এসব কথা কি মুখ ফুটে বলতে পারবে? নাকি কাউকে কিছু না বলে অফিস থেকে ট্রান্সফার নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে? জীবনের আগামী ‍দিনগুলো নিয়ে এরকম কত পরিকল্পনাও মাথায় এল। এই প্রশ্ন, ভাবনা ও পরিকল্পনার আবর্তে একটা ঘোরের মাঝেই কেটে গেল বহু বহু দিনের আকাঙ্ক্ষার সেই ব্যর্থ রাতটা।

রাত পোহালে সে বিছানা ছেড়ে একটা চেয়ারে ঝিম মেরে বসে থাকে। সকাল বেলা নতুন বউকে তখনো কেউ ডাকতে আসেনি। কী করবে সে বুঝতে পারছিল না। লোকটি বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। লোপামুদ্রা চেয়ে চেয়ে দেখে। ওর কপালে গাঢ় চিন্তার একটা রেখা। কাল সারাদিন ঐ রেখাটা যে ছিল না তা মনে পড়ছে তার। তাহলে লোকটির ভেতরেও অনেক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়েছিল কাল রাতে? হঠাৎ লোপার মনের ভেতরটা ঝড়ের পরে উথালপাতাল ঢেউ থেমে যাওয়া নদীর বুকের মতো শান্ত হয়ে গেল। আর তখনি মনে হলো সারারাতের এত ভাবনা হয়তো একটু বেশিই বাড়াবাড়ি ছিল। তার মনে হলো এটা কোনো সমস্যা মানে অসুখও তো হতে পারে! হয়তো এটা সাময়িক। হয়তো এ সমস্যার সমাধান আছে। চিকিৎসা করালে সেরে যেতে পারে। এসব নিয়ে এত ব্যাকুলতার কোনোই কারণ নেই সম্ভবত। জীবনের বসন্ত সেই কবেই তো এসেছে। নিষ্ফল সেই অনেকগুলো রাত যেভাবে কেটেছে আরও কিছু রাত সেভাবেই কেটে গেলে ক্ষতি তো কিছু নেই। দুটি নর-নারীর কাছাকাছি থাকা তো কেবল একটি বিষয়ের উপর নির্ভর করতে পারে না। লোকটার সাথে চেনাজানা হোক, দেখা যাক না সে মানুষটা কেমন। সারাটা জীবন কাটানোর জন্য সে মানুষটা কেমন আগে সেটাই তো জানা জরুরি!

আশ্চর্য বিষয় যে, আলোকময় চায়ের টেবিলে এমন সহজ স্বাভাবিক আচরণ করল, যেন রাতে কিছু হয়নি। শুধু লোপার চোখে চোখ রেখে কথা বলছিল না সে। রুটি তরকারি সন্দেশ মিষ্টি আর চা খেয়ে সে বেরিয়ে গেল। অবশ্য যাওয়ার আগে লোপাকে ডেকে বলেছিল— লোপা, আমি বেরুচ্ছি।

এর দুদিন পর রাতে বাড়ি ফিরে সে এক কৌটা ট্যাবলেটসহ প্রেসক্রিপশনটা দেখাল লোপাকে। জানাল ডাক্তার বলেছে ওষুধ খেলে তার সমস্যা সেরে যাবে। লোপাও ভেবেছিল চিকিৎসা ও ওষুধে এই সমস্যা সেরে যেতেই পারে। যাই হোক, মনের ভেতর আর কোনো অশান্তি রইল না বরং সেদিন রাতের মানসিক অস্থিরতার কথা ভাবতেই ভীষণ লজ্জা হলো।

লোপা দেখে আলোকময় ঘরে যখন আসে তখন তার গা ঘেঁষে বসে। হঠাৎ একটু জড়িয়ে ধরে আলতো হাতে। আচমকা লাজে রাঙা হয়ে দুটো একটা চুমুও খায়। ভালোবাসার এই স্পর্শে বিগলিত হয় লোপা। এই একটু হাসি, একটু স্পর্শ, একটু আদর, তাতেই লোপা মধুরতম জীবনের স্বাদ পায়। আলোকময় দুচারদিন বন্ধুদের বাড়ি নিয়ে যায়। কোনোদিন নিয়ে যায় শহর ছাড়িয়ে ছায়াঢাকা পথ দিয়ে একটা শালবীথির কাছে নদীর পাড়ে। নদীর বুক চিরে সাদা পাল তোলা নৌকা ভেসে যায়। সেসব আর নদীর উপর ঝুলে থাকা মস্ত নীলাকাশ দেখে তারা। বেলাভূমিতে খঞ্জন পাখির নৃত্য দেখে আর বনের ভেতর পাখিদের মধুর কূজন শুনে মৌন হয়ে। তাদের ভাষাহীন মুখের কথা যেন পরস্পরের শিরায় শিরায় শোণিত প্রবাহের সাথে ধ্বনিত হয় আর যেমন নদীর বুকের কথা আকাশ বুঝে নেয় তেমন করে লোপাও যেন আলোকময়ের হাতে হাত রেখে সে মৌন-মূকের সকল কথা তার সূক্ষ্ম অনুভূতির তারে তারে শুনতে পায়। সেদিন তাদের সামনে প্রবহমান কানায় কানায় পূর্ণ নদীর বুকের মতো তার বুকও ভরে উঠেছিল সুখে ও আনন্দে। সন্তুষ্টির চরমে পৌছে সে ভেবেছিল এইটুকু প্রাপ্তিতেই চলে যাবে গোটা জীবন আর কিছু চাওয়ার নেই। কিন্তু আজ এবং সেদিনের পরেও লোপামুদ্রা প্রশ্ন করেছে নিজেকে; আলোকময় কি সে ভাষা বুঝেছিল? হয়তো বুঝেছিল। হ্যাঁ, বুঝে ছিল যে সেকথা আলোকময় দুচারদিন বলেছে। পিঠে হাত রেখে, ঠোঁটের আলতো স্পর্শে আদর করতে করতে সে বলেছিল— বুঝেছি, তোমার বেশি কিছুর প্রত্যাশা নেই। শাড়ি, গয়না, অট্টালিকার মহার্ঘ্য জীবন নয় তুমি চাও একটু আদর সোহাগ আর ভালোবাসা। শুধু এইটুকু জেনো লোপা, আমি কখনো তোমার অমর্যাদা করব না। তোমাকে হেলাফেলা করব না। পুরুষালি নিয়ন্ত্রণের নামে যে অত্যাচার আর দশজন পুরুষ করে, আমি ভুলেও তা করব না।

এটা সত্যি যে আলোকময় কখনো লোপামুদ্রাকে পুরুষালি নিয়ন্ত্রণ করেনি। কখনো শারীরিক অত্যাচার করেনি। এমনকি বকাঝকাও করেনি। কিন্তু হেলাফেলা করব না বলা কথাটা বোধহয় রাখেনি সে। এমনকি মর্যাদার কথাটাও রাখতে পেরেছে বলা যায় না। শুধু কি বকাঝকা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা বা শারীরিক নির্যাতন করাই অসম্মান? কারওর সাথে যখন একটা সম্পর্কের দায়বদ্ধতা থাকে তখন তার ইচ্ছা, তার চাওয়া-পাওয়াকে সম্মান বা মর্যাদা না দেওয়াটাও কি এক ধরনের অসম্মান বা অমর্যাদা নয়? যখন কোনো একজন পিপাসার্ত হয়ে কারও কাছে পানি চায় সে যদি তা না দেয় বা কোনো কথাই বলে না তখন সেই পিপাসার্ত মানুষের কি অসম্মান হয় না? হয়তো বলা যায় তার ঘরে যদি পানি না থাকে তো সে কীভাবে দেবে? সে অন্য জায়গা থেকে পানি জোগাড় করে দেবে বা চেষ্টা করবে নয়তো তার বিকল্প কিছু দিয়ে সান্ত্বনা দেবে। আলোকময় কখনো সে চেষ্টাও করেনি। তার শারীরিক অক্ষমতা ছিল। তাও তো ডাক্তারের চিকিৎসায় কিছু পরিবর্তন এসেছিল। কিন্তু সেই চিকিৎসার বিধান বছর দুয়েকের মধ্যেই ছেড়ে দেয় সে। ওষুধ খাওয়ার কথা বললে সে কোনো কথা না বলে বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছে। অথচ হঠাৎ কখনো বলা নেই, কওয়া নেই, একটা শক্তিবর্ধক ট্যাবলেট কিনে এনে খেয়ে তাড়াহুড়ো করে ‍শুধু নিজের ইচ্ছে চরিতার্থ করত। তাতে লোপার ইচ্ছে পূরণ হলো কিনা জিজ্ঞাসাও করেনি। লোপা শেষে এটা মেনেও নিয়েছিল যে, জীবনের ঐ পর্বটা না হয় থাক। একজনের শারীরিক অক্ষমতার জন্য তো কাউকে দায়ী করা যায় না। জীবনের নানান সময়ে কত দুর্ঘটনা ঘটে। তাতে কেউ তার একটি হাত, পা, শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি বা বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে বলে সংসারের লোক যদি তাকে ফেলে না দিয়ে সহানুভূতি দিয়ে আগলে রাখে তাহলে শুধু যৌন অক্ষমতার কারণেই বা কাউকে ফেলে দেওয়া যায় কী করে? যদিও এরূপ অবস্থায় কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর শারীরিক অক্ষমতার বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারবে না। সে সাথে সাথেই তার জীবনে হয় কোনো স্ত্রী না হয় অন্য নারী জুটিয়ে নেবে এবং এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজও পুরুষটারই পাশে থাকবে আর অশক্ত নারীকে হয় ছুড়ে ফেলে দেবে নয়তো করুণা করে যদিবা তার স্থান এই সংসারে দিয়েও থাকে তবে তার ভাগ্যে দাসী-বাঁদীর চেয়ে বেশি কিছু মর্যাদা জুটবে না। কিন্তু আর দশটা স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনে একজন পুরুষের যে মর্যাদা থাকে লোপামুদ্রা আলোকময়কে ততটাই মর্যাদা দিয়েছিল। তাকে কখনো অবজ্ঞা, অনাদর ও অবহেলা করেনি। উল্টোদিকে আলোকময় লোপার সাথে যা করেছে তাকে অবজ্ঞা ছাড়া কিছুই বলা যায় না। আলোকময়ের না হয় শারীরিক অক্ষমতা ছিল কিন্তু লোপার তো ছিল না। একজন রক্ত-মাংসের স্বাভাবিক মানুষের শারীরিক চাহিদাকে অস্বীকার করেছিল আলোকময়। সে লোপার চাহিদা পূরণ করার কোনোই চেষ্টা করেনি। লোপামুদ্রা একটা সময় গিয়ে বুঝেছিল যে আলোকময়ের শারীরিক অক্ষমতার চেয়ে মানসিক অক্ষমতাই বেশি। আর শারীরিক অক্ষমতার পেছনেও তার মানসিক অক্ষমতাই দায়ী ছিল। তার প্রচণ্ড ধৈর্যের অভাব ছিল। ছিল সবকিছুতে তার তাড়াহুড়া। যৌনজীবন বলতে তো শুধু সঙ্গম নয়। একটুক্ষণ মুখোমুখি বসে, হাতে হাত রেখে, হেসে কথা বলা বা কখনো হাতে হাতে রেখে পাশাপাশি চলা, একটু অকারণ স্পর্শ, একটু আলিঙ্গন, চুম্বন, একটু কোথাও ঘুরতে যাওয়া এসব করার জন্য তো আর এনার্জি ট্যাবলেটও লাগে না! তার জন্য মানসিক ইচ্ছেটাই যথেষ্ট। কিন্তু আলোকময়ের সেই মানসিক ইচ্ছেটাও বছর কয়েক পরে মরে গিয়েছিল। ঘরে এসে খেয়েই সে বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে পড়ত আর একটু পরই নাক ডাকা শুরু করে দিত। লোপামুদ্রা আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে অনেকদিন জোর করে তার দিকে পাশ ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে আর কোনোদিন ফেরাতে পারলেও সে বিরক্ত হয়ে খুব তাড়াহুড়ো করে লোপার ঠোঁটে আর দুই গালে দায়সারা নিরাবেগ তিনটি চুম্বন দিয়ে একপাশে ঠেলে দিয়ে বলত, যাও। তারপর আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ত। কিছুদিন পর এভাবে চেষ্টা করে পাশ ফেরানোতেও ক্ষ্যান্ত দিয়েছে লোপামুদ্রা। প্রতিদিন রাতে একরাশ অভিমান নিয়ে সেও পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে। কিন্তু একদিনও আলোকময় লোপাকে জড়িয়ে ধরে কাছে টানার চেষ্টা করেনি। এমনকি প্রচণ্ড শীতে একই লেপের ভেতর শুয়েও সে লোপাকে জড়িয়ে ধরেনি। অভিমান অপমান ভুলে শারীরিক আবেগে কখনো কখনো লোপামুদ্রা যখন তাকে পেছন থেকেই জড়িয়ে ধরেছে তাও প্রায়শই আলোকময় বিরক্তি প্রকাশ করেছে। লোপামুদ্রা প্রশ্ন করেছে, তুমি কি আমার ভাসুর ঠাকুর? তোমার সাথে আমার যে সম্পর্ক তাতে যদি আমার এ অধিকারটুকুও না থাকে, যদি আমার কামনা বাসনা পূরণ করার দায় তোমার না থাকে তবে আমরা এ কীসের সম্পর্ক বয়ে বেড়াচ্ছি? আলোকময় কোনো উত্তর দেয়নি। রাতশেষে তার সেই স্বাভাবিক জীবন, প্রয়োজনীয় কথাবার্তা। দুনিয়া শুদ্ধ লোক জেনেছে তাদের কী মধুর দাম্পত্য! কারণ তাদের সম্পর্কে কোনো ঝগড়া নেই, উচ্চবাচ্য নেই। মনে না করবেইবা কেন?

অথচ সকালবেলা স্নান না করে রান্নাঘরে যেতে শাশুড়ির ঘোরতর আপত্তি। শাশুড়ির এমন আপত্তির কারণ জানা ছিল বলে কতদিন লোপার ঠোঁটের আগায় তার মোক্ষম জবাব এসে ফিরে গেছে যে দুজন নারীপুরুষ পাশাপাশি রাত কাটালেই অশুচি হয়ে যায় না যদি অশুচি করার জন্য যে সক্ষমতা লাগে সেটা না থাকে। কিন্তু শাশুড়ি বয়স্ক মানুষ। গুরুজন। তাকে মুখের ওপর এমন কথা কি বলা যায়? তাও এই প্রহসন তার ভালো লাগেনি। শাশুড়ির বিরক্তিকে তোয়াক্কা না করে সে রান্নাঘরে গেছে। চা বানিয়ে খেয়েছে। শাশুড়ি খায়নি। বলেছে তাহলে আপনারটা নিজেই বানিয়ে খান আর না হয় যখন আমি স্নান করব তখন আপনার চা দেব।

এই অপমানিত জীবন থেকে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা অনেকবারই করেছে লোপা। তার মনে হয়েছে আলোকময় তাকে ভালোবাসে না। কেন ভালোবাসে না, কেন তার প্রতি এই অনাদর অবহেলা তার উৎস খুঁজেছে। কিন্তু কিছুই খুঁজে পায়নি। না, আলোকময় অতীতেও কাউকে ভালোবাসেনি। বর্তমানেও তার জীবনে অন্য কোনো নারীর ছায়াও নেই। আবার লোপামুদ্রার প্রতি যে তার কোনো ঘৃণা বিদ্বেষ আছে তাও তো নয়। লোপামুদ্রার যে কোনো সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়েছে সে। বলা যায়, সংসারের সব ব্যাপারে লোপামুদ্রার কথাই শেষ কথা। আবার তার নিজের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার বেলায়ও লোপমুদ্রার থেকে পরামর্শ নিয়েছে। লোপামুদ্রা অদ্ভুত এই মানুষের ততোধিক অদ্ভুত আচরণে কখনো অনেক দুঃখ পেয়েছে, বারবার আহত ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। কিন্তু আবার জীবনের অন্য কোনো কোনো জায়গায় তার অত্যন্ত কোমল সংবেদনশীল ও মানবিক আচরণে অভিভূতও হয়েছে, বিহ্বল হয়েছে। তবু অনেকবার তাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। তবে সেটা তার শারীরিক অক্ষমতার কারণে নয় তার মানসিক অক্ষমতার কারণে। যখন ভালোবাসা ও মায়া মমতাহীন মরুময় জীবনটা দুঃসহ ঠেকেছে তখন বহুবার সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে অফিস থেকে ট্রান্সফার নিয়ে বহুদূর চলে যাবে। কিন্তু কোথায় যাবে? কতদূর যাবে? সবখানেই প্রশ্ন উঠবে। যখন সেখানে নিরবধি সে একা একা দিন যাপন করবে। তখন লোকজন প্রশ্ন করবে তোমার কি কেউ নেই? বাপের বাড়ি থেকে প্রশ্ন করবে তুমি একা কোথায় থাকো? চেনা বন্ধুজন আর শ্বশুরবাড়ির আর সব লোকেরা যারা প্রত্যেকে তাকে অন্তর থেকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, বিশ্বাস করে আর সম্মান করে তাদের সে কী বলবে? আসলে সমাজবদ্ধ জীবনে বাস করে এই অসম্পূর্ণ সমাজের পশ্চাদপদ প্রশ্নকে সবসময় এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তাছাড়া যতই সে আধুনিকা হোক এই সংস্কার সে এখনো ত্যাগ করতে পারেনি, যাকে কেন্দ্র করে তার এই সংসার যাপন আদতে সে যে তার কেউ না, খামোকাই তার জন্য সে কেবল সং সেজেছে, ওখানে সারবস্তু কিছু নেই তাই সারহীন সং সেজে আর এই জীবন টেনে নিতে পারছে না, তাই সে মুক্তি চায়, সহজ এই কথাটা বলে বেড়াবে! কিন্তু জীবনের সকল ক্ষেত্রে স্মার্ট লোপামুদ্রার জিহ্বা একথা বলতে অসার হয়ে যায়। আর বলতে না পারার ক্রোধ বছরের পর বছর তাকে কুঁরে কুঁরে খেয়েছে। দুয়েকদিন ক্রোধান্ধ হয়ে সে আলোকময়কে অপমান করেছে। আবার অপমানের আঘাতে আহত আলোকময়ের বিমর্ষ মুখ দেখে তার হৃদয় করুণায় বিগলিত হয়েছে। শেষপর্যন্ত সে নিজেকে নানাভাবে বুঝিয়েছে; যে চোখের সামনে অনেক মেয়ে আছে যারা নিত্য লাথি-ঝাঁটা খেয়ে জীবন পার করছে, অপমান লাঞ্ছনা প্রহার সহ্য করেও মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে; তার অবস্থাত এমন নয়! হ্যাঁ এটা ঠিক যে সে চাকরি করে। খাওয়া পরার জন্য সে আলোকময়ের উপর নির্ভরশীল নয় তাহলে কেন এই পড়ে থাকা? কিন্তু লোপামুদ্রা হিসাব করে দেখেছে চাকরি না করা মেয়েগুলোও ভাত কাপড়ের জন্য তাদের পুরুষের উপর নির্ভশীল নয়। তাদের দয়াতে তারা বাঁচে না। সংসারে যত কাজ করে ঐ মেয়েরা সেসবের তুল্যমূল্য হিসাব করলে মেয়েদের কাছে তাদের পরিবার ও তার কর্তা পুরুষের অনেক ঋণ থাকে। লোপামুদ্রা নিজেকে বলে ঐসব মেয়েদের মতো আমারও ঐরকম নির্যাতন ভাগ্যে লেখা থাকতে পারত। আর এখানে তো শুধু একজন মানুষের অক্ষমতা আর এই গোপন অবহেলা ও অমর্যাদা। তাও সর্বক্ষেত্রে নয়। আবার ওকে ত্যাগ করে এখন তো আর তার পক্ষে নতুন কারও সাথে সংসার পাতার আকাঙ্ক্ষাও নেই। এছাড়া একটা বিয়ের মাধ্যমে একটা ছেলে বা একটা মেয়ে তো শুধু নির্দিষ্ট একজনকে নিয়েই সংসার পাতে না বা সম্পর্কে জড়ায় না ঐ ছেলে বা মেয়েটির সংসারের আরও অনেকের সাথেও নানান সম্পর্কে জড়িয়ে যায় যেমন লোপামুদ্রা আলোকময়ের পরিবারের অনেকের সাথে অনেক মধুর সম্পর্কের বন্ধনে জড়িয়ে গেছে। তাই একজনের জন্য অন্যদের ত্যাগ করতেও বড় বেধেছে।

শেষপর্যন্ত সবকিছু চুপ করে মেনে নিয়ে লোপামুদ্রা এ সংসারেই পড়ে রইল। তবে এককোণে নয় অনেকটা জায়গাজুড়ে এবং আরও বেশি দাপটের সাথে। তাও আলোকময়কে কোনো না কোনোভাবে শায়েস্তা করার ইচ্ছেটা পুষে রাখল মনে। একদিন বলা যায় মজা করেই সে বলেছিল, তোমার চোখের সামনে কোন একটা ছেলেকে নিয়ে এসে প্রেম করব, আদর সোহাগ করব। তোমার সহ্য হবে তো?

আলোকময় কেবল চুপ করে শুনেছে। কোনো উত্তর দেয়নি। কিন্তু তাতে লোপামুদ্রার রাগ আরও বেড়েছে। তা এই যে সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে তা রাগে নয় দুঃখে। কেন না জীবনে সে তার উৎস থেকেও তেমন একটা ভালোবাসা পায়নি। ভাইবোনগুলোর ও তাদের ছেলেমেয়েদের ভালোবাসা কেমন যেন আলগা ছাড়া। বাইরের যেসব মানুষের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল, দেখেছে সে যতটা দিয়েছে বিনিময়ে ততটা পায়নি। আলোকময়ের জন্য এতটা ত্যাগ করার পরও সে তাকে একটু ভালোবাসতে পারল না, একটু আদর সোহাগ দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারল না?

তাই সারা জীবনভর সবখান থেকে কোনো কিছু না পাওয়ার গভীর বেদনা থেকেই সে প্রতিজ্ঞা করেছে একটি সন্তানের জন্ম দেবে। আর আশা করেছে নিজের রক্ত মাংস দিয়ে কাউকে তৈরি করলে সে নিশ্চয় তাকে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করবে না। কিন্তু সন্তান যে চাই তার বীজ কোথায় পাবে? কার কাছে থেকে সংগ্রহ করবে সন্তানের বীজ? এই প্রশ্নে সে প্রথমে দিশেহারা বোধ করে। আদিম পদ্ধতিতে সন্তানের জন্ম দেবে বলে সে তো আর যে কারওর সাথে আদিম মিলনে যুক্ত হতে পারবে না। এমন কেউ দরকার যার সাথে তার বন্ধুত্ব আছে যে সসম্মানে তার ইচ্ছের মর্যাদা দেবে এবং তার নিজেরও কোনো গ্লানি, অপমানবোধ বা ঘেন্না হবে না। ঠিক তখনি শশাঙ্ক শেখরের নামটি মাথায় আসে। তার কাছে থেকেই সে বীজ আনবে। কারণ তার মতো শতভাগ ভালো মানুষ সংবেদনশীল বন্ধু আজকের জগতে কজন আছে সে জানে না। কিন্তু এখন শশাঙ্ককে কোথায় পাওয়া যায়? গত দশ বছর শশাঙ্কর সাথে যোগাযোগ নেই। দশ বছর আগে পাশপাশি অফিসে চাকরির সুবাদে তার সাথে পরিচয় এবং অন্তরঙ্গতা হয়েছিল কিন্তু শশাঙ্ক এমন একটা মানুষ তার সাথে কথা বলার সময় মনে থাকে না সে নারী নাকি পুরুষ। এছাড়া তার মিষ্টি স্বভাব ও আচরণে এমন একটা ব্যাপার আছে যে তাকে নির্ভর করে সবকিছু বলা যায়। আর কী কাকতালীয় ঘটনা এই সময় রাজধানীতে একটি চারদিনের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের ডাক পড়ে। সেই প্রশিক্ষণে গিয়েই আচমকা শশাঙ্কর সাথে লোপামুদ্রার দেখা হয়ে যায়। কিন্তু সেবারের দুজনের অন্তরঙ্গতায় বৃষ্টি নামলেও কোনো ফসল ফলেনি। যে ‍উদ্দেশ্য নিয়ে সে শশাঙ্কর সান্নিধ্য চেয়েছিল তা এভাবে বিফলে যাওয়ায় লোপামুদ্রা অনেকটাই হতাশ হয়েছিল। তারপর একদিন টেলিফোনে তার উদ্দেশ্যর কথা জানায় সে শশাঙ্ককে। শশাঙ্ক হেসে বলেছিল সে কথা তখনি বললে হতো। একদিনের মিলনেই যে সন্তান উৎপাদন হয়ে যাবে তেমনটি তো নয়। এরপর আরও কয়েকবার তারা সময় হিসাব করে মিলিত হয়েছে। তাতেও কিছু হয়নি। হতাশ হয়ে লোপামুদ্রা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল কিন্তু আবার একটা ব্যক্তিগত কাজে সেই রাজধানীতেই দুজনের দেখা হয়ে যায়। তখন লোপামুদ্রার পঞ্চাশ চলছে। সেবার শশাঙ্কর অনুরোধেই তারা একান্তে থেকেছিল। তাই সন্তানের আশা আর সে করেনি। তবু সেদিন শশাঙ্ক প্রথম তাকে ‍তুমি করে বলে, পঞ্চাশেও তুমি মোটেই ফুরিয়ে যাওনি লোপা। শুনে আনন্দ হয়েছিল তার। হেসে বলেছিল, শশাঙ্ক! কোনো কিছু তখনই ফুরায় যখন তার ইউজ হয়।

হ্যাঁ তাই তো। শশাঙ্কও হেসে বলেছিল। আর সেবারই ঢাকা থেকে ফিরে একমাস পরে সে তার নিজের ভেতর অন্য কোনো প্রাণের অস্তিত্ব টের পায়।

খবরটা শুনে আলোকময় প্রথমে একটু চমকে উঠেছিল। এক সকালে লোপামুদ্রা যখন বলল, জানো আলোকময় আমার একটা সুসংবাদ আছে। আজ চুড়ান্তভাবে নিশ্চিত হলাম যে আমি প্রেগন্যান্ট হয়েছি। তখন।

তবে সে তার চমকানোকে মূহূর্তের মাঝে লুকিয়ে ফেলেছিল। লোপামুদ্রা বলেই যাচ্ছিল— জানো, আমার একটা বন্ধু আছে— শশাঙ্ক, যে খুব ভালো মানুষ, সৎ ও হৃদয়বান। একটা সন্তান জন্ম দিতে আমি তার সাহায্য চেয়েছিলাম। তার সহযোগিতাতেই আমি মা হতে চলেছি। আলোকময় এমনিতেই দশটা কথা বললে তবে একটা কথার উত্তর দেয়। সেদিনও দিল না। প্রথমে একটু চমকে উঠেছিল তারপর চুপ করে রইল। তবে তার মুখ দেখে লোপার মনে হয়েছিল সে খুব অপমানিত বোধ করেছে।

লোপা বলেছিল, বুঝতে পারছি তোমার অপমান লাগছে। বউ তোমার অথচ সন্তান অন্য কোনো পুরুষের বীর্য থেকে জন্মাচ্ছে। কিন্তু বলো তোমার অপমান হওয়ার সত্যি কি কোনো কারণ আছে? বছরের পর বছর তোমার অপমান অবহেলা সহ্য করার পর আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আচ্ছা একটা কথা বলো, তোমার না হয় শারীরিক অক্ষমতা ছিল, আমার তো ছিল না, তাই না? তা আমারও যে চাহিদা ছিল তার কোনো দাম দিয়েছ কখনো? আমার কষ্ট-যন্ত্রণা একদিনের জন্য কি বুঝতে চেষ্টা করেছ? না, বরং তুমি আমার চাওয়া-পাওয়াকে সবসময় অবহেলা করেছ। আরে বাবা, কেউ যদি ক্ষুধার্ত হয়ে কারও কাছে ভাত মাংস খেতে চায় তবে ভাত মাংস না থাকে ডাল রুটি তো দিতে পারে? তাও যদি না পারে দুগাল মুড়ি বা জল-বাতাসাও দিতে পারে নাকি? কিন্তু গত একুশটি বছর তুমি আমাকে নিরম্বু উপোস রেখেছ আলোক। তবু আমি কখনো তোমাকে অপমান অবহেলা করিনি। তোমার খাবার, তোমার আরাম আয়েশ, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আমি তোমার থেকে বেশি ভেবেছি এবং যত্ন নিয়েছি। যা স্বাভাবিক সম্পর্কের ভেতরে থাকা কোনো দায়িত্বশীল বরও তার বউয়ের কাছে থেকে সবসময় পায় না। ভেবে দেখো যদি এর উল্টোটা মানে আমার বেলায় যা হলো, তা যদি তোমার বেলায় হতো তাতে তুমি কী করতে? নিশ্চয় আরও একটা বিয়ে করে নিতে আর আমাকে ফেলে দিতে না হয় ঠেলে দিতে অথবা অন্য নারীতে আসক্ত হতে। তাই না? কিন্তু আমি তার কিছুই করিনি। আমার প্রবৃত্তি হয়নি। তোমার অক্ষমতা জানার পরও তোমাকেই ভালোবেসেছিলাম, তাই তোমাতেই নিমগ্ন হতে চেয়েছিলাম। শরীর ছাড়াও মানুষকে ভালোবাসা যায়। নিঃস্বার্থে সারাটা জীবন তোমায় ভালোবেসে আমি তার প্রমাণ দিয়েছি। তবে সেই শরীরহীন ভালোবাসাও একটু নৈকট্য চায় আলোকময়। সেই ভালোবাসাও একটু শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ চায়। আমি শব্দ, গন্ধ স্পর্শাতীত ভালোবাসা নিয়ে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কী দুসঃহ যন্ত্রণা যাপন করেছি তুমি উপলব্ধিও করতে পারোনি। আমার হাসির জবাবে তোমার ‍মুখের একটু হাসি, আমার চোখে চেয়ে তোমার চোখের একটু ইশারা অহর্নিশ আকাঙ্ক্ষা করেছি, এসব কিছুই কি দেওয়ার ক্ষমতা তোমার ছিল না? ছিল কিন্তু তুমি দাওনি। হয় তুমি অন্য মানুষের প্রয়োজনটাই বোঝ না, কারণ তোমার মন প্রতিবন্ধী, তোমার ইচ্ছা প্রতিবন্ধী, তোমার বোধশক্তি জড়। তাই তোমার জন্য আমার করুণা হয়েছে, মায়া হয়েছে। আমি তোমার এসমস্ত অপরাধ বা ত্রুটি যাই বলি না কেন ক্ষমা করে দিয়েছি বারবার। কিন্তু উল্টোটা হলে তুমি কী করতে? আসলে এরকম হলে তোমরা দুনিয়াসুদ্ধ লোককে আমার অক্ষমতার কথা জানাতে। আমি তোমার অক্ষমতার কথা কাউকে বলিনি। অথচ তোমার মা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়াপড়শী আমাকে বাঁজা মেয়ে ভেবেছে। না আমি আমার বাঁজা অপবাদ ঘোচাতেও সন্তান ধারণ করিনি। জীবনের মধ্যগগনে এসে এত নিরানন্দ জীবন, এত শূন্যতা আর আমি বয়ে বেড়াতে পারছিলাম না। এই পঞ্চাশ বছর বয়সেও দেখো আমি কী দারুণ সুস্থ। ঘরে বাইরে সমানে দৌড়াচ্ছি ক্লান্তিহীন। তাও আমার প্রেসার, সুগার সবকিছু নর্মাল। আমার একটু জ্বরজারি পর্যন্ত হয় না। এখন না হয় পেশাগত কারণে আমার একটা বাইরের জগৎ আছে। যদি আমি আরও অনেকদিন বাঁচি যখন অবসরে চলে যাব তখন এত শূন্যতা ও রিক্ততার হাহাকার নিয়ে আমি কীভাবে বেঁচে থাকব? এই বয়সে মানুষের ঘরে নাতিপুতি আসে তাদের নিয়ে তারা বুড়ো বয়সের পুতুলখেলা খেলে। আমার তো আর সে ভাগ্য হবে না। তাই আমার একটা রক্ত-মাংসের জীবন্ত পুতুল দরকার, যে তিলে তিলে বড় হবে আর তার বেড়ে ওঠার সমস্ত আনন্দ নিয়ে আমার শূন্যতা ভরিয়ে তুলব। সেজন্য আমি গর্ভ ধারণ করেছি। কিন্তু তুমি যদি আমাকে এতটুকু আদর-সোহাগ, ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে রাখতে তাহলে আমার কোনো সন্তান না হলেও চলত। একটা মানুষ কেন সারাজীবন তার বুকে মরুভূমি বয়ে বেড়াবে বলো? তবে একটা কথা, তুমি চিন্তা করো না; আমার সন্তান আমার একক পরিচয়েই জগতে পরিচিত হবে; তাতে যত প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হোক না কেন। আমি আমার সন্তানের মিথ্যা কোনো পিতৃপরিচয় দেব না আর তোমাকে সেজন্য যাতে বিব্রত না হতে হয় সে পথও আমি খুঁজে নেব।

আলোকময় তার স্বভাবসুলভ মৌনতা নিয়ে যে কাজ করছিল সেভাবেই করে যেতে থাকল। তবে ভেতরে ভেতরে সে ভীষণ ভেঙে পড়ল। সে হঠাৎ উপলব্ধি করল বাইরের জগতে এমনকি লোপা ছাড়া ঘরের ভেতরেও তার যে ভালো মানুষের ইমেজ বা মুখোশ আছে সেটা খুলে যাবে। একটি মিথ্যা ফ্রেমের ভেতর তাদের যে নির্ঝঞ্ঝাট দাম্পত্য জীবনের ছবি মানুষের মনের দেয়ালে বাঁধানো আছে তার সবকিছু ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। আলোকময় জানে সংসার জীবনের এই মিথ্যে অহংকারটুকু ছাড়া তার আর কিছু নেই। এখন এইটুকুও যদি না থাকে জগতে সে মুখ দেখাবে কেমন করে? একটু একটু করে ক্ষয়ে যাওয়া জীবনে যে গভীর খাদ সৃষ্টি হয়েছে সেই খাদের কিনারে দাঁড়ানো তার পায়ের তলার মাটিটা এই বুঝি ঝুপ করে পড়ে গেল!

ভেতরের এই ক্ষরণ আলোকময়কে বিচলিত করে তোলে। কিন্তু তাকে সে প্রকাশ করতে দিল না। একটা নির্বিকার ভাবের আড়ালে সে যেমন করে তার সুখ দুঃখ যন্ত্রণা হতাশাকে ঢেকে রাখে এখনও তাই করল। কিন্তু আজ লোপামুদ্রার কাছে কিছুই যেন সে আর লুকাতে পারল না। তার এই লুকোচুরি সবটা তার কাছে ধরা পড়ে গেল। তবে তার জন্য আলোকময়কে সে আর কিছু বলল না। লোকটার জন্য তার মনে বিস্তর করুণা জন্ম নিল।

লোপামুদ্রার শাশুড়ি তখন আর জীবিত নাই। তাই নিজের গর্ভধারণের বিষয়ে সত্য-মিথ্যা কাউকেই কিছু জানানোর দরকার পড়েনি তার। বিকালে জা-এরা এল তাকে অভিনন্দন জানাতে। এর মাঝেই ড্রয়িংরুমের টেলিফোন সেটটা বেজেই চলেছে। দেশের তিন প্রান্ত থেকে তিন ননদ ফোন করে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। তারা উচ্ছ্বসিত। তারা আনন্দিত। এতদিন পর ভাইয়ের সন্তান আসছে। এই সময় কী করা উচিত, কী করা উচিত নয় সে বিষয়ে তারা ভাইবউকে নানা রকম পরামর্শ দিতে লাগল। লোপা সকলকে শুধু প্রশ্ন করল, তোমরা কী করে জানলে? ওরা বলল তাদের ভাই পিতা হওয়ার আনন্দ সংবাদ চেপে রাখতে পারেনি। ফোন করে জনে জনে খবরটি দিয়েছে। রাতে কিছু বলার আগেই আলোকময় হাঁটু গেড়ে লোপার হাত দুটি ধরে বলল, সারাজীবন তুমি আমায় করুণা করে গেছ আর একটু দয়া করো!

কী দয়া করব বলো? চলে যাব? আমার মুখ আর দেখবে না তাই তো?

না না! অমন কথা মুখেও এনো না। আমাকে ছেড়ে তুমি কোথাও যাবে না।

আলোকময় তখনো লোপামুদ্রার পায়ের কাছে হাত জোড় করে বসে আছে।

প্রয়োজনে ভালোই তো অভিনয় করতে পারো। ছলাকলায় যে তুমি অপারঙ্গম নও তা এর আগেও তুমি আমায় বুঝিয়েছ! সত্যি! সারা দুনিয়া কেবল মেয়েদের ছলাকলার কথাই বলে সেটা প্রশংসা হোক বা নিন্দা হোক। কিন্তু পুরুষরাও যে প্রয়োজনে অষ্টকলা বা ষোলকলা নয় বত্রিশ রকমের মহাকলাবিদ্যা দেখাতে পারে সেটা কেউ বলে না।

তা বলো কী দয়া করব? কী দয়া চাও তুমি!

তুমি তোমার সন্তানের ভাগ থেকে আমাকে বঞ্চিত কোরো না। আমি তোমার পেটের সন্তানকে এখনি দত্তক নিতে চাই। ওর নামের সাথে তুমি পিতা হিসেবে আমার নামটা জুড়ে দিও প্লিজ!

বলছ কী তুমি? লোপা বলে, দয়া চাওয়ার নামে কি এবার প্রকারান্তরে আমাকে দয়া করতে চাইছ তুমি?

না না, লোপা, তোমাকে দয়া দেখানোর মতো ধৃষ্টতা আমার নেই। আমি তো নিঃস্ব! ভিখারি! দুনিয়ায় আমার মতো কাঙ্গাল যে আর একটা নেই, তা তোমার থেকে আর কে ভালো জানে? শুধু তোমার সন্তানের নামের সাথে পিতা হিসেবে আমার নাম যুক্ত করে আমি আরও কিছুকাল বেঁচে থাকতে চাই যেমন করে আর দশজন পিতা বেঁচে থাকে।

লোপামুদ্রা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ঠিক আছে। তুমি নিজে থেকে যখন চাইছ এ সন্তানের পিতা হবে তবে তাই হোক। কিন্তু আলোকময়, নামে আর কদিন বেঁচে থাকে মানুষ? দুনিয়ার সেরা বিখ্যাত লোকও একদিন বিস্মৃত হয়ে যায়। তাঁর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়। আসলে মানুষ তো বেঁচে থাকে তার বংশগতির মাঝে। কেউ জানে না কিন্তু বেঁচে থাকে। লক্ষ লক্ষ প্রজন্ম পরেও সে বেঁচে থাকে। তোমার জিন তো তোমার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যাবে তাই না? তুমি জীববিদ্যার ছাত্র। তুমি সেটা আমার থেকেও ভালো জানো ঠিক কিনা?

আলোকময় মাথা নাড়ে। ঠিক। কিন্তু কাজ নাই আমার বংশগতির বেঁচে থাকার। তুমি শুধু তোমার সন্তানের পিতৃত্ব বহন করার অধিকার আমাকে দাও। ওটুকু যদি পাই আমি আমার ভাগ্য মানব।

হ্যাঁ তা তো বটেই। তবে এ আমারও সৌভাগ্য নইলে এই একান্ন বছর বয়সে কেউ কি গর্ভধারণ করতে পারে? হয়তো জীবনের সকল বঞ্চনা প্রকৃতি এই সময়ে পুষিয়ে দিতে চাইল।

তারপর যথাসময়ে সাগ্নিকের জন্ম হলো। আলোকময় যেন অন্য মানুষ। এখন সে হাসে, কথা বলে এবং অফিসের পরের সবটুকু সময় বাড়িতে থাকে। কেবল সাগ্নিক সাগ্নিক। সত্যিকারের বাবাও বোধহয় এতো আদর যত্ন করতে পারে না তার সন্তানকে। এত আদর-যত্ন পেয়ে সাগ্নিকও বাবা অন্তপ্রাণ। তার যত কথা, যত আব্দার বাবার কাছে। তবু সাগ্নিকের মুখ লোপামুদ্রাকে প্রতিমুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় শশাঙ্কর কথা। শশাঙ্ক জেনেছিল সাগ্নিকের কথা। সে বলেছিল ছেলের ওপর তো আমার কোনো অধিকার নেই। ওকে জন্ম দিয়েছ তুমি, লালন করেছ তুমি। ও শুধু তোমার। আর আলোকময়বাবু তার স্নেহ ভালোবাসা আদর যত্ন দিয়ে সাগ্নিকের পিতৃত্ব কিনে নিয়েছেন। ভালোই তো হলো।

সেই সাগ্নিকের আজ বিয়ে। গত ত্রিশটি বছর সাগ্নিক ভরিয়ে দিয়েছে লোপামুদ্রার জীবন। তার সকল অপ্রাপ্তি সকল অতৃপ্তি ঘুচিয়ে দিয়েছে সাগ্নিক। বছর পাঁচেক আগে আলোকময়ও পৃথিবীর অপারে চলে গেছে। আর কোনো আক্ষেপ নেই লোপমুদ্রার। এখনো তিনি কর্মক্ষম। ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে ঘরদোর বিছানা গুছিয়ে পরিপাটি হয়ে সোফায় বসে প্রার্থনার মতো করে ভৈরবী রাগের ভজন শোনেন। তারপর খবরের কাগজ পড়েন নিজের হাতে বানানো চা কফি খেতে খেতে। তখন গৃহকর্ম সহকারী মেয়েটা আসে। সে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে বাসন-কোশন কাপড়চোপড় ধুয়ে মুছে মাছ তরকারি কুটে দেয়। তিনি স্নান সেরে একটু দুধ মুড়ি ফল খেয়ে রান্না করেন। ছুটির দিনে ছেলেও এসে হাত লাগায়। ইদানীং বছর খানেক হলো পেশাগত কাজে ছেলে বড় শহরে থাকে। তবু যখন সে বাড়িতে থাকে মায়ের সকল কাজের সঙ্গী সে। অন্যদিন দুপুরে পাড়াপড়শী দু একজন আসে। লোপামুদ্রা রান্না করতে করতে গল্প করেন। তা নাহলে অডিও প্লেয়ার বাজিয়ে গান শোনেন। লালনগীতি, রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীত। কখনো আধুনিক বা ক্ল্যাসিক্যাল। মুড অনুযায়ী যখন যা শুনতে ভালো লাগে। দুপুরের খাওয়ার পর একটু গভীর বিশ্রাম। বিকালে কখনো কখনো আশপাশের বাড়িতে বেড়াতেও যান। না হলে বই পড়েন বা গান শোনেন। রাতে দুপুরে রান্না করা সব্জি দিয়ে গৃহকর্মী মেয়েটির বানানো রুটি আর দুধ খান। তারপর রাতভর গভীর ঘুম। ছকে বাঁধা জীবন। এই বয়সেও তাঁর প্রেসার নরমাল, ডায়াবেটিক নেই, পেটে গ্যাস বা বদহজম নেই। চমৎকার হাসিখুশি জীবন।

লোপামুদ্রা ভাবেন কুন্তীর জীবন কোনকালেই মসৃণ ছিল না। কিন্তু আমি তো একটা মসৃণ আনন্দময় জীবন কাটিয়ে দিলাম। একাশি বছর বয়সে দিব্যি সুস্থ আমি। ছেলে বিয়ে করছে পরিণত বয়সে। যদি ওরা সন্তান নেয় আমি নাতি-নাতনিও দেখতে পারি। যদি আরও বছর দশেক বাঁচি নাতি-নাতনি বড় হয়ে যাবে। তাদের সাথেও আমার একটা আনন্দঘন জীবন হবে। যে জীবন হতে পারত সবটা বঞ্চনার, নিরানন্দ অন্ধকারের সে জীবনে এত আনন্দ, এত আলো ঝলমলে! নিজের সাফল্যের কথা ভাবতে ভাবতে লোপামুদ্রা অভিভূত হয়ে যান। তবে এই ভাবনার মাঝখানে হঠাৎ একটা সূক্ষ্ম কাঁটার মতো কিছু প্রশ্ন যেন তাকে খোঁচা দেয়— আমি কি প্রতারণা করলাম? আমি কি কাউকে ঠকালাম? কিন্তু কাকে ঠকালাম কার সাথে প্রতারণা করলাম? সন্তানের জন্ম পরিচয় লুকিয়ে রেখে কি সন্তানকে, নাকি নিজেকে প্রতারণা করলাম? আমি তো নিজেকে খুব সাহসী, প্রথাভাঙা মানুষ মনে করে আত্মতৃপ্তি পাই, তাহলে সাহস করে সন্তানের আসল পিতৃপরিচয় কেন জানাতে পারলাম না কাউকে। তবে কীসের সাহস আমার? এও তো এক ধরনের চৌর্যবৃত্তি!

লোপামুদ্রার ভেতর থেকে আজও একজন বেরিয়ে আসে। তবে এবার সে লোপামুদ্রার প্রতিপক্ষ হয়ে মুখোমুখি নয়। বরং সে যেন পক্ষ হয়ে পাশে দাঁড়ায়। তারপর কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বলে, তোমার কাছে তো কেউ জানতে চায়নি তোমার সন্তানের পিতা কে? তাহলে কেন বলবে? তোমার তো সত্য জানানোর প্রয়োজন পড়েনি। সাগ্নিকের পিতার নাম আলোকময় সেন; সে তো আলোকময় চেয়েছিল এবং চেয়েছিল সে নিজের স্বার্থে কারণ সে পিতা হতে চেয়েছিল। প্রকাশ করলে যে আলোকময়ের সত্যও প্রকাশ হয়ে যেত। তাতে কী হতো? পৃথিবী, সমাজ, পরিবার কিংবা সাগ্নিকের কোনো লাভ হতো? সন্তানের জন্মে একটা শুক্রকীট দিলেই কি কেবল পিতৃত্বের দায় মিটে যায়? পিতাও হয়ে উঠতে হয় সন্তানের জন্মের পর দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে। আলোকময় ভালো বর বা প্রেমিক হতে পারেনি কিন্তু সত্যিকারের পিতা হয়েছিল। সাগ্নিককে পরম যত্ন ও মমতায় বড় করে পিতৃত্বের দায় সে মিটিয়েছে। কিন্তু তুমি সাগ্নিকের মা। লোপামুদ্রার মনের ভার নামে।

হ্যাঁ, আমি সাগ্নিকের মা। আমি গর্ভধারণ করেছি। আমার প্রয়োজনে। যেমন একজন কৃষক ফসল ফলায়। কোথাকার বীজ কেউ সেটা জানতে চায় না। জমিটা কী রকম, ফসল কেমন সেটাই মানুষ দেখে। নারী জীবন্ত মানুষ। তার জরায়ুকে যদি জমি বলে স্বীকার করেও নিই তবে নারীই এই জমির মালিক। তাই ফসলের মালিকানা শুধু তারই। আমি একক দায়িত্বে একক সিদ্ধান্তে এই সন্তানের জন্ম দিয়েছি। এ সন্তান শুধূই আমার আর কারও নয়। কাজেই জবাবদিহির প্রশ্নই নেই।

লোপামুদ্রা মনে করেন এ তার ক্ষেত্রজ সন্তান। যদিও এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ছাঁচে আজও কোনো সন্তানের পিতৃপরিচয় মুখ্য। কিন্তু এসব তন্ত্র আজও হাজার হাজার বছরের পুরনো জগদ্দল পাথরের মতো মানুষের মনে বসে থাকলেও চিরদিন যে এরকমই থাকবে সে তো নয়। আর যদিবা থাকেই তাতে তার কী? তার এবং তার মতো কারওর কি দায় এই সমাজব্যবস্থা মেনে নেওয়ার, কী দায় এইসব সামাজিক নিয়ম মেনে জীবনটাকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়ার? মানুষ অমৃতের সন্তান। জীবন থেকে সে চেষ্টা করবে অমৃত আহরণের। লোপামুদ্রা মনে করেন তিনি তাই করেছেন। তিনি আরও মনে করেন সন্তানের জন্ম তার মা কীভাবে দিয়েছেন সেটা জানাও বোধহয় সন্তানের প্রয়োজন নয়। যে জানা জীবনকে জটিল করবে তা এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম। তিনি কোনো ভুল করেননি। কাউকে ঠকাননি। না নিজেকে, না কাউকে।

আলোকময় নিজের স্বভাবে হোক বা ভাগ্যের ফেরে হোক সেও তো বঞ্চিতই ছিল। সাগ্নিকের পিতৃত্ব তাকে আমৃত্যু আনন্দ দিয়েছে। ছেলের কোলে মাথা রেখে তার প্রশান্তির শেষ নিঃশ্বাস লোপামুদ্রার চোখে ভাসে। লোপামুদ্রা আজও মনে করেন তার সিদ্ধান্ত সকলকেই আনন্দিত করেছে। জীবনকে মহিমান্বিত করেছে। গুনগুন করে তিনি গেয়ে ওঠেন— জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ…।

 

+ posts

Read Previous

প্রখ্যাত তাজিক কবি লায়েক শের আলির কবিতা

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৪র্থ সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *