অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৮, ২০২৪
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৮, ২০২৪
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সজল দেউরী -
চোষক নগরী

চৈত্রের মাঝামাঝি, সূর্যটা ঠিক মাথার ওপরে অবস্থান করছে। এমনই এক দ্বিপ্রহর বেলায় লোকমান তার যাত্রীবাহী রিকশাটি বাইশমাইল মোড়ে এনে থামাল। কোথাও বাতাসের লেশমাত্র নেই। অনাবৃষ্টি আকাশ থেকে যেন আগুন ঝড়ে পড়ছে। প্রচণ্ড তাপের দাবদাহে লোকমানের সমগ্র্র শরীর ঘামে এতটাই ভিজে গেছে, যেন সদ্য নদীতে ডুব দিয়ে এসেছে। রিকশা দাঁড় করানোর সাথে সাথেই রিকশায় বসা যাত্রীটি লোকমানকে উদ্দেশ্য করে বলল— এই মামা, রিকশা দাঁড় করালা কেন, আমাকে আরও একটু সামনে দিয়ে এসো।

যাত্রীর কথা শুনে লোকমান পিছন ফিরে ক্লান্তি মাখা মুখে মৃদু হেসে বলল, আর কই যামু স্যার? এইডাই তো বাইশমাইল, আপনি না কইলেন বাইশমাইল যাবেন?

যাত্রীটি রিকশায় বসা অবস্থায় কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে আশপাশের পরিবেশ পরীক্ষা করে বলল, হুম…। বলছিলাম, ভাবছিলাম এখান থেকে রিকশা পাব। কিন্তু দেখছ না আর কোনো রিকশা নেই এখানে।

ক্ষণেক বিরতি নিয়ে পকেট থেকে টিস্যু বের করে কপালে জামা ঘাম মুছে পুনরায় বলল— মামা, তুমি একটা কাজ কর, আমাকে স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত একটু দিয়ে এসো।

লোকমান রিকশা থেকে নেমে রিকশাটিকে ভালোভাবে দাঁড় করিয়ে গলায় ঝোলানো মলিন গামছাটি দিয়ে শরীরের ঘাম মুছতে মুছতে ক্লান্তিময় স্বরে বলল— না স্যার, আমি আর যামু না, মাফ করেন আমারে। বলে হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল কোথাও ছায়া আছে কিনা। লোকমানের কথা শুনে যাত্রী কিছুটা ধমকের সুরে বলল, যাবা না মানে! তাহলে আমি যাব কীভাবে এত রোদে? দেখছ না এখানে আর কোনো রিকশা নেই, চলো…।

লোকমানের সারা শরীর থেকে ক্লান্তির ছাপ ফুটে ফুটে পড়ছে। ক্লান্তিময় সুরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, না-রে স্যার, আমি আর যামু না, হাইওয়েতে রিকশা নিয়ে উঠলে পুলিশ ধরে। পকেটে যা থাকে সব রাইখা দেয়। তারপর আবার মারে, না-হয় গাড়ির পাম ছাইড়া দেয়।

এসব বলে পুনরায় কপাল ও ঘাড়ের ঘাম মুছে নিল। লোকমানের কথা শুনে যাত্রী বিরক্তির স্বরে বলল, আরে চল ব্যাটা, পুলিশ ধরলে আমি দেখব, গরমে এমনেই শেষ, আর মেজাজ খারাপ করিস না।

লোকমান এবার কিছুটা অনুরোধের সুরে বলল, না স্যার, আমারে মাফ করেন, আমি আর যামু না। আমার শরীরে আর কুলাইতে পারতাছি না। আমার হাত-পা কাঁপতাছে।

লোকমানের কথায় যাত্রীটি এবার পুরোপুরি মেজাজ হারিয়ে ফেলল। অতি রুক্ষ স্বরে বলল, তোদের রিকশাওয়ালাদের এই একটা দোষ, যেই দেখছ আর কোনো রিকশা নেই অমনি ভাড়া বাড়ানোর ধান্দা! ফালতু লোকজন, মন চাইতাছে ঠাটাইয়া একটা চড় মারতে।

এরপর কিছুটা বিরতি নিয়ে, পকেট থেকে আরেকটি টিস্যু বের করে কপালে জমা হালকা ঘামটুকু মুছে পুনরায় বলল, চল, বিশ টাকার ভাড়া ত্রিশ টাকা দেব। আর কোনো কথা বলবি না, চল….।

এমনিতেই গরমে শেষ, তারপর মেজাজটা আরও গরম করে দিয়েছে। লোকমান এবারও না করবে, ঠিক তখনই মনে পড়ল মেয়ের কথা, সকালে বাসায় যাওয়ার পর মেয়ে তার বইয়ের জন্য কান্নাকাটি করছে, বাসাভাড়াও সব জোগাড় হয়নি। বাড়িওয়ালা আজকের মধ্যে বাসাভাড়া না দিলে বাসা ছেড়ে দিতে বলছে। লোকমান পুনরায় শরীরের ঘাম মুছে বলল, স্যার, একটু নামেন, গদির মধ্যে পানি আছে, একটু খাইয়া নি।

লোকমান পানি খেয়ে শরীরের নিষেধ সত্ত্বেও সৃতিসৌধের উদ্দেশ্য রিকশার প্যাডেল মারা শুরু করল। ক্লান্তিময় শরীরে মাত্র পাঁচ মিনিটের রাস্তা পনেরো মিনিটে পাড়ি দিয়ে সৃতিসৌধের বিপরীতে জয়া রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়াল।

এই রিকশা আবার থামালা কেন, ওপার যাবা না?

লোকমান ঘাম মুছতে মুছতে কিছুটা বিরক্তির স্বরে বলল, কী বলেন স্যার, দেখছেন না ঐ পুলিশ। ওপার গেলেই ধরবে। এইটুকুই তো রাস্তা, একটু ওভারব্রিজটা পার হইয়া যান না। যাত্রী লোকমানকে জোরে একটা ধমক মেরে বলল, এই ব্যাটা, আমি কি করব না করব তুই শিখাইয়া দিবি নাকি? ওপার দিয়ে আয়।

লোকমান ধমক খেয়ে অনেকটা চুপসে গেল। আমতা আমতা করে বলল, স্যার দেখছেন না পুলিশ… স্যার।

এবার একটা থাপ্পড়ই খাবি, শুরু থেকে বেয়াদবি করে চলছ। এই পুলিশ আছে তো কি হইছে, বলছি না আমি আছি। তুই চেনো আমারে? চল…।

লোকমান আর কোন কথা না বাড়িয়ে রিকশায় প্যাডেল মারা শুরু করল। হঠাৎ-ই একজন পথচারী লোকমানের রিকশা লক্ষ না করেই দৌড়ে রাস্তা পার হতে গেল। লোকমান পথচারীকে দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করলেও, শেষ রক্ষা হলো না। পথচারী রিকশার সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে রাস্তার উপর পড়ে গেল। লোকমান রিকশাটিকে কোনোভাবে দাঁড় করিয়ে তাড়াহুড়ো করে পথচারীকে টেনে তুলতে লাগল। রাস্তার পিচের ঘষায় পথচারীর শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিড়ে গিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল। রক্ত দেখে লোকমান আরও ঘাবড়ে গেল। লোকমান পথচারীকে টেনে তুলে হাত পা ধরে বারবার ক্ষমা চাইতে লাগল। যদিও এ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে লোকমানের বিন্দুমাত্র দোষ নেই। মুহূর্তের মধ্যেই কিছু লোক লোকমানকে ঘিরে ধরল। বিভিন্ন জনে নানান ভাষায় তাকে গালিগালাজ দিতে শুরু করল। হাজারো কথার তীব্র বাণের মধ্যে একটি কথার বাণ লোকমানের হৃদয়ে খুবই বিঁধল। ভিরের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠল, দেখেন না চোখের কী অবস্থা, নেশা কইরা গাড়ি চালালে এক্সসিডেন্ট তো করবেই।

লোকমান কখনো কোনো নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে না। এমনকি কেউ কোনোদিন তাকে একটা বিড়িতেও টান দিতে দেখেনি। নেশা বলতে তার একটাই, সেটা হলো, তার শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও সন্তানদের সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করা। চোখ রক্তজবার মতো লাল হওয়ার কারণ হলো, সে সারারাত ঘুমায়নি। রাতভর রিকশা চালিয়েছে। সকালবেলা বাসায় গিয়ে কিছু পান্তা ভাত খেয়ে পুনরায় বেরিয়ে পড়েছে। তিন মাস ধরে বাসা ভাড়া বাকি, গত তিন মাস ধরে রিকশা চালিয়ে যা জমিয়েছে, তা সবই মেয়ের স্কুলের বেতন দিতে চলে গেছে। এদিকে বাড়িওয়ালা গতকাল এসে শেষ ওয়ার্নিং দিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এই টাকার পৃথিবী তাকে সারারাত ঘুমাতে দেয়নি। লোকমান ঘাড় ফিরিয়ে দেখল কথাটি যে বলেছে, সে আর কেউ নয়, তার যাত্রী! যার কারণে সে এই পরিস্থিতিতে পড়েছে।

এরপর কি হলো আশা করি তা আর বিস্তারিত বলার দরকার নেই। কেননা, বাঙালি মারার মতো কোনো সামান্য ইস্যু পেলে কতটা পৈশাচিক আত্মা ধারণ করে তা কম-বেশি সবারই জানা।

লোকমানের যখন জ্ঞান ফিরল, তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করল থানার বারান্দায় একটি বেঞ্চের উপর পরে থাকা অবস্থায়। চোখ মেলে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিকে তাকিয়ে, নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করল। আর্তনাদের স্বরে বলে উঠল, কই আমি, এডা কোন জাগা! ‍কিন্তু আশপাশে কাউকেই দেখতে পেল না। কারও কোনো সাড়াশব্দও নেই। লোকমান উঠে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু যেই উঠতে যাওয়ার চেষ্টা করল, লোকমান দেখল তার ডান হাত নাড়াতেই পারছে না। শরীরের দিকে চোখ বোলাতেই দেখল সারা শরীরে রক্তের দাগ। এ দৃশ্যে লোকমান কিছুটা জ্ঞানশূ্ন্য হয়ে গেল। আস্তে আস্তে তার সবকিছু মনে পড়তেই দুচোখ গড়িয়ে অশ্রুধারা নেমে এল। কিছুক্ষণ পরে পাশের রুম থেকে একজন পুলিশ বেরিয়ে এসে লোকমানের পাশে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ লোকমানকে চোখের দৃষ্টি দিয়ে পরীক্ষা করে পুনরায় রুমের মধ্যে চলে গেল। লোকমান কিছুই বলল না, সেভাবেই পড়ে রইল। একটু পরেই সেই পুলিশটির সাথে আরও একজন পুলিশ বেরিযে এল, এসে লোকমানের পাশে দাঁড়াল। দ্বিতীয় পুলিশটি প্রথম পুলিশটিকে বলল, তোল শালাকে।

প্রথম পুলিশটি লোকমানকে টেনে তুলে বেঞ্চের ওপর বসিয়ে দিল। দ্বিতীয় পুলিশটি পুনরায় লোকমানকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে প্রথম পুলিশকে বলল, শালা রে বিদায় কর।

বলে রুমের মধ্যে হাঁটা দিল। লোকমান এতক্ষণে মুখ খুলল— স্যার, আমার রিকশা? আমার রিকশা কই?

দ্বিতীয় পুলিশটি পিছনে ফিরে একটা ধমক মেরে বলল, ভাগ শালা, মরতেছে আবার রিকশা খুঁজতেছে। পরে দেখা করিস। এখন ভাগ।

বলে রুমের মধ্যে চলে গেল। লোকমান রিকশা ছাড়াই বাড়ির উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ল।

লোকমান কীভাবে যে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাল নিজেও জানে না। তবে যখন বাড়ির দরজায় পৌঁছাল তখন অনেকটা রাত হয়ে গেছে। দরজা খুলে লোকমানকে আবছা আলোতে দেখেই লোকমানের স্ত্রী হাঁক ছাড়ল, এতক্ষণে তোমার আওয়ার সোমায় অইছে… না। কই ছিলা এতক্ষুন? দুপারে না তোমার সদায় কিন্না দিয়া যাওয়ার কতা আছিল?

বলতে বলতে লোকমানের স্ত্রী চৌকির এককোণে গিয়ে বসল। কিছুটা বিরতি নিয়ে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল, মাইয়াডা হেই স্কুল দিয়া আইয়া হইতে কান্দা শুরু করছে, বই নাই দেইক্কা নাকি পড়া পারে নাই, এর জন্নে নাকি হারা ক্লাস দাঁড় করাইয়া রাকছে। ওদিকে পোলাডা খালি ভাত দেইক্কা খায় নাই, রাইতেও কিছু না খাইয়াই কানতে কানতে ঘুমাইয়া পরছে। আল্লায় সব আমার কপালে ল্যাকছে…।

লোকমান কোনো জবাব না দিয়ে চৌকির ওপর গিয়ে ধপাস করে পড়ে গেল। এতক্ষণে আবছা আলোর কারণে লোকমানকে স্পষ্ট দেখতে পায়নি স্ত্রী। লাইটের আলো লোকমানের গায়ে পড়তেই চিৎকার দিয়ে উঠল, হায় আল্লাগো… এ কি অবস্থা তোমার! কিছু কও না ক্যা, কী অইছে তোমার? ওরে আল্লাহ রে…। লোকমান কথা বলার সকল শক্তি হারিয়ে জড় বস্তুর ন্যায় পড়ে রইল।

একটু পরেই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। লোকমানের এগারো বছরের মেয়ে রুবি লোকমানের মাথায় তেলজল দেওয়া বাদ দিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দেখে বাড়িওয়ালা দাড়িয়ে আছে। রুবিকে দেখে বাড়িওয়ালা জিজ্ঞেস করল— কী হয়েছে রে, এত চেঁচামেচি কীসের?

দরজা খোলাই ছিল, তাই রুবির উত্তরের অপেক্ষা না করেই ভেতরে চলে এল। ততক্ষণে লোকমানের জ্ঞান ফিরেছে। বাড়িওয়ালাকে দেখে লোকমান ও তার স্ত্রী দুজনেই করুণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। বসতেও বলল না। সেও কিছু বলল না, কিছুক্ষণ লোকমানকে চোখের দৃষ্টিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বেরিয়ে গেল। তবে মুখমণ্ডল দেখে এটা স্পষ্ট বোঝা গেল, ভাড়া না পেয়ে সে খুবই রুষ্ট। বাড়িওয়ালা চলে যাওয়ার পরে এতক্ষণে মনে পড়ল তার কোমরে যে টাকা বাঁধা ছিল। বাসাভাড়া ও মেয়ের বই কেনার। কোমরে হাত দিতেই আঁতকে উঠল। ভালো করে খুঁজেও কোমরের কোথাও টাকার সন্ধান পেল না। ভিরের মধ্যে তাকে যখন কতগুলো হিংস্র হাত একের পর এক আঘাত করছিল তখন হয়তো কেউ আত্মসাৎ করেছে, না হয় কোথাও পড়ে গেছে। টাকা না পেয়ে লোকমান পুনরায় বোবা হয়ে গেল। সারারাত লোকমান ব্যথার জ্বালায় ঘুমাতে পারল না, সাথে বাসার কাউকে ঘুমাতেও দিল না।

কাকডাকা ভোরেই লোকমানের স্ত্রী বেরিয়ে পড়ল টাকার সন্ধানে। ভরসা একটাই, গ্যরেজের মালিক আক্কাস চাচা। গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পর থেকই লোকমান আক্কাস মিয়ার রিকশা চালায়। কিন্তু যতটা আশা নিয়ে লোকমানের স্ত্রী গ্যারেজের কাছে ছুটে এল, ঠিক ততটাই হতাশ হয়ে গেল। গ্যারেজের গেট তালা দেওয়া। গ্যারেজের আশপাশ সব ফাঁকা, কোথাও মানুষের টুঁ-শব্দও নেই। কী করবে কিছুই মাথায় আসছে না। আক্কাস মিয়ার বাসাও চেনে না। হতাশ হয়ে সেখানে বসেই গ্যারেজের মালিকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরে গ্যারেজের ভেতর থেকে গেট খোলার আওয়াজ হলো। গেট খোলার আওয়াজ পেয়ে লোকমানের স্ত্রীর মনে কিছুটা স্বস্তি এল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। গেট খুলে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধ। বৃদ্ধটি গ্যরেজের নিরাপত্তা প্রহরী। লোকমানের স্ত্রীকে চিনত। এর পূর্বে অনেকবারই এসেছে লোকমানের জন্য দুপুরের ভাত নিয়ে বা অন্য কোনো কারণে। নিরাপত্তা প্রহরী অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল— মা, তুমি এত সকালে, এখানে!

তারপর লোকমানের স্ত্রী আসার কারণ ও লোকমানের পরিস্থিতি সবিস্তারে বর্ণনা করে বলল। সব শুনে নিরাপত্তা প্রহরী মনে মনে কিছুটা অবাক হলো। কেননা, গতকাল আক্কাস মিয়া লোকমানকে নিয়ে আলোচনা করেছিল। সেখানে তিনি বলেছেন, লোকমান নাকি রিকশা লাগিয়ে দিয়ে রিকশা রেখে পালিয়েছে। লোকমান যে এক্সিডেন্ট করছে, এবং তার অবস্থা যে এত খারাপ, তা তো উল্লেখ করেননি। উল্টো গালাগালি করেছেন রিকশা থানায় নিয়ে যাওয়ার কারণে। নিরাপত্তা প্রহরীর কাছ থেকে গ্যরেজের মালিকের বাসার ঠিকানা নিয়ে লোকমানের স্ত্রী তার বাসায় চলে গেল। মালিকের বাসার গেটের সামনে গিয়ে দেখে এখানেও একই অবস্থা, মূলগেট আটকানো। কয়েকবার থাক্কা দেওয়ার পরে সিকিউরিটি এসে জিজ্ঞেস করল, কাকে চাই? লোকমানের স্ত্রী আক্কাস মিয়ার বাসায় যাওয়ার কথা বললে সিকিউরিটি স্পষ্ট জানিয়ে দিল, এত ভোরে তাকে কিছুতেই ভেতরে যেতে দেবে না।

লোকমানের স্ত্রী অনেক অনুরোধ করার পরেও সিকিউরিটি তাকে ভীতরে প্রবেশ করতে দিল না, তবে তার হৃদয়টা একটু সদয় হলো। সে শান্ত গলায় লোকমানের স্ত্রীকে বলল, দ্যাখো বোন, আমি যদি তোমাকে এত সকালে ঢুকতে দিই, আর তোমার কারণে যদি তাদের ঘুমের সমস্যা হয়, তাহলে আমার চাকরি থাকবে না।

সিকিউরিটির অপারগতা লোকমানের স্ত্রী বুঝতে পারল। ফলে বাইরে বসেই তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। সময় তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চললেও আক্কাস মিয়ার পরিবারের ঘুম ভাঙছে না। অবশেষে দীর্ঘ অনুনয়-বিনয় শেষে সিকিউরিটির মন গলল। ভেতরে প্রবেশ করতে দিল। বাসার দরজায় কয়েকবার থেমে থেমে কলিং বেল দিলেও কারও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। নিরুপায় হয়ে লোকমানের স্ত্রী পরপর কয়েকবার কলিং বেল চাপার পরে মানুষের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল। ভেতর থেকে একজন হাঁকডাক দিতে দিতে দরজা খুলল।

কে রে এত ভোরে বেয়াদবের মতো কলিং বেল চাপে! কে?

লোকটি আক্কাস মিয়া, তবে আক্কাস মিয়া যে সময়টিকে ভোর বলছেন, সেটি মোটেও ভোর নয়। ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় সাড়ে নয়টা। লোকমানের স্ত্রী কিছুটা অনুতাপের স্বরে বলল— চাচা, আমি বড় নিরুপায় হয়ে বারবার কলিং বেল চাপছি।

তারপর আসার কারণ উল্লেখ করতেই আক্কাস মিয়া চোখের ঘুমকে নিমিষেই বিদায় দিয়ে লোকমানকে কিছুক্ষণ গালিগালাজ করে নিল। তারপর কিছুটা বিরতি নিয়ে বলল, যাও লোকমানকে গিয়ে বল, আজকের মধ্যে যেন আমার রিকশা থানা থেকে ছাড়িয়ে এনে দিয়ে যায়।

লোকমানের স্ত্রী কোনো অপমানই গায়ে মাখল না। পুনরায় কাতর স্বরে তার আসার কারণ জানাল। আক্কাস মিয়া এবার লোকমানের স্ত্রীকে একটা ধমক দিয়ে, যা দূর হ, বলে মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে চলে গেল। ফলে খালি হাতেই সেখান থেকে তাকে ফিরতে হলো।

গ্যারেজের মালিকের কাছ থেকে খালি হাতে ফিরে, প্রতিবেশীর দ্বারে দ্বারে ঘুরে হাজার পাঁচেক টাকা ধার করে যখন বাড়ি ফিরল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়। বাসায় ফিরে দেখে লোকমানের অবস্থা আরও খারাপ। তাড়াহুড়ো করে লোকমানকে নিয়ে ছুটল হাসপাতালের উদ্দেশে। সাথে নিল রুবিকে, আর ছয় বছরের পুত্র রহিমকে রেখে গেল বাসা পাহারার জন্য। অবশ্য এছাড়া উপায়ও নেই। এ শহরে আত্মীয়-বান্ধব বলে যা আছে তারা সবাই টাকার নগরীতে টাকা কুড়াতে ব্যস্ত। আশপাশের দিকে তাকিয়ে দেখার সময় কই। টিকিট কেটে ইমার্জেন্সি বিভাগে নিয়ে গেলে সেখানে গিয়ে শোনে বড় ডাক্তার চলে গেছেন, আগামীকাল দুপুর ১২টা নাগাদ আসবেন। এক তরুণ শিক্ষানবিস ডাক্তার লোকমানকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লোকমানের স্ত্রীকে ডেকে ধমকের সুরে বলল, এতক্ষণ কী করেছেন? আঘাত দেখে তো মনে হয় দুই-তিনদিনের পুরোনো।

ধমক শুনে লোকমানের স্ত্রী কিছুটা চুপসে গেল। তরুণ ডাক্তারটি লোকমানের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তার পরিস্থিতি দেখে শান্ত গলায় বলল, দেখুন আপনার রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, স্যার তো চলে গেছে, আজ আর তাকে পাওয়া যাবে না। এখন হয় আপনারা এখানে ভর্তি করে কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করুন, না-হয় বাইরে কোথাও নিয়ে যান। কিন্তু রোগীর যা অবস্থা, কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।

তরুণ ডাক্তারের কথা শুনে লোকমানের স্ত্রী শিশুর মতো কান্না জুড়ে দিয়ে বলল— স্যার, তাইলে এহন কী করমু…।

ইমার্জেন্সি রুমের মধ্যে থাকা আরেকটি যুবক লোকমানের স্ত্রীর কাছে এগিয়ে এসে, ডেকে বাইরে নিয়ে গেল। তিনি বাইরে ডেকে নিয়ে লোকমানের স্ত্রীকে পরামর্শ দিল সানমুন ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এ-ও বলল এখানের বড় ডাক্তার এখন সেখানেই আছে, আর তার রেফারেন্সে গেলে চিকিৎসায় কিছু ছাড়ও দেবে।

এই মুহূর্তে লোকমানের স্ত্রীর কাছে লোকটিকে ফেরেশতাসম মনে হলো। হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে, তার কথামতো লোকমানকে সানমুন ক্লিনিকেই নিয়ে গেল। ক্লিনিকে গিয়ে দেখে যুবকটির কথা সত্য, হাসপাতালের ডাক্তার সেখানেই রোগী দেখছে। ডাক্তার লোকমানকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানাল লোকমানের একটি হাত ভেঙে গেছে এবং মাথায় আঘাত লাগছে, এমআরআই করতে হবে। এদিকে লোকমানের স্ত্রী যে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে এসেছিল তা প্রায় শেষ। লোকমানের স্ত্রী ডাক্তারকে জিজ্ঞস করল— স্যার, এই এমআরআইতে কয় টাহা লাগতে পারে?

বেশি না। মাত্র পনেরো-বিশ হাজার টাকা লাগতে পারে।

ডাক্তার পরবর্তী রোগীকে আসার জন্য নির্দশ করল। টাকার অঙ্ক শুনে লোকমানের স্ত্রীর অন্তরাত্মা উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে গেল। অনুনয়-বিনয় শেষেও যখন দেখল টাকা ছাড়া ভবের তরী পার করা সম্ভব না, তখন চিকিৎসা না নিয়েই হাতের ব্যান্ডেজ ও অল্প কিছু ওষুধ নিয়ে বাসায় ফিরে আসতে হলো।

দিন ছয়েক পরে রিকশার মালিক এল লোকমানের বাসায়। জানাল, থানা থেকে রিকশা ছাড়িয়ে আনতে তার বিশ হাজার টাকা লেগেছে, যার সবটাই লোকমানকে দিতে হবে। হুকুম জারি করল সব টাকা তাকে এখনই পরিশোধ করতে হবে।

এদিকে লোকমান কাজে বের না হতে পারায়, বাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ল। লোকমানের শারীরিক অবস্থাও দিন দিন খারাপের দিকে। লোকমানের বিয়ের সময় যেটুকু সোনার গহনা পেয়েছে তা বাড়িওয়ালার কাছে বন্ধক রেখে কোনোরকম বাড়িওয়ালার মুখটা বন্ধ করতে পেরেছে। লোকমানের সংসারের বর্তমান অবস্থা এখন এমন, যে ঘরের সমগ্র মাটি ফুড়লেও একটি কানাকড়ি বের হবে না। রিকশার মালিক টাকা না পেয়ে নানা কুবাক্য প্রয়োগ শেষে দশদিনের সময় বেঁধে দিয়ে বিদায় নিল। তার সাথে হুমকি দিয়ে গেল, দশ দিনের মধ্যে টাকা না দিলে কীভাবে টাকা আদায় করতে হবে সে কৌশল তার জানা আছে।

এক মধ্যাহ্ন দুপুরে রহিম লোকমানের চৌকির আশপাশে ঘুরছে আর কঁদছে। তার ক্ষুধা লাগছে, ভাত খাবে। মা কেন আয় না, মা কেন আয় না এই বলে চিৎকার করে করে বাড়ি এক করে ফেলছে।

লোকমান অসুস্থ হওয়ার পর থেকে লোকমানের স্ত্রী যে বাসায় কাজ করে, সেখান থেকে তাকে যে খাবার দেয় তা বাড়িতে নিয়ে এসে চারজন মিলে কোনোভাবে দুপুরের বেলা চালিয়ে নেয়। প্রতিদিন দুপুরের দিকে কাজ থেকে ফিরে এলেও, আজ দুপুর গরিয়ে বিকেল হয়ে এলেও তার দেখা নেই। কিছুক্ষণ পরে লোকমানের স্ত্রী বাসায় ফিরল। রহিম মাকে দেখে কান্না বাদ দিয়ে দৌড়ে কাছে গিয়ে বলল, এতকুনে আওনায় ক্যা? খিদায় যে আমি মইরগা যাই দ্যাহো না, দ্যাও ভাত, দ্যাও। আইজগো সব ভাত মুই-ই খামু, কেউ রে দিমু না।

লোকমানের স্ত্রী রহিমকে বুবের মধ্যে ঝপটে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। লোকমান কাঁপতে কাঁপতে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে বলল, আরে কী অইছে, আগে ওরে ভাত দে। কোন সময় অইতে ভাত ভাত কইরা কান একদম ঝালাপালা হইরা ফ্যালছে। মাইয়াডারে কইলাম কয়ডা চাউল ভাইজগা দেতে, কয় চাউল নাই। কইলাম কয়ডা কচুগাছ আইনা জাল দিয়া দেতে, হেয়াও নাকি পায় নায়।

লোকমানের স্ত্রী পুনরায় হাউমাউ করে কান্না করে উঠল। তারপর যা বলল, তার সারংশ হলো, সে যে বাসায় কাজ করে সেখানে নাকি আজ বড় বড় তিনটা মাছ কাটছে, সব মাছ ফ্রিজে রেখে সেখান থেকে দুই টুকরা মাছ বাড়ির উদ্দেশ্যে ব্যাগে রাখলে, মালিক ব্যাগ চেক করার সময় দেখে ফেলে। ফলে চোর অপবাদ দিয়ে লোকমানের স্ত্রীকে মারধর করে কাজ থেকে বের করে দিয়েছে।

সব শুনে লোকমান নিশ্চুপ হয়ে সেভাবেই বসে রইল। টুঁ শব্দও করল না।

পাশের বাসা থেকে কিছু চাল ধারে এনে তা রান্না করল। রান্না করতে করতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এল। রান্না শেষে সবাই মিলে যখন খেতে বসল, ঠিক এমন সময় বাইরে থেকে কয়েকজন লোক লোকমানের নাম ধরে হাঁকডাক শুরু করল। হাঁকডাক শুনে রুবি খাবার রেখেই গিয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলে দেখে আক্কাস মিয়াসহ কয়েকজন লোক দরজার সামনে দাঁড়ানো।

রুবিকে দেখে রুক্ষ ভাষায় জিজ্ঞেস করল, তোর আব্বা কই? ঘরে?

রুবি ঘাড় নেড়ে জবাব দিল, হুম।

লোকমানও খাবার রেখে একটি লাঠিতে ভর দিতে দিতে রুবির পেছনে এসে দাঁড়ালো। লোকমানকে দেখেই উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠল, এই হারমজাদা বাইরে আয়, তোর না দশদিনের মধ্যে টাকা দিয়ে আসার কথা, আজকে বারোদিন হয়ে গেলেও টাকা দিয়ে আসিসনি কেন?

বলেই লোকমানকে শার্টের কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এলে। শার্টের কলার ধরে টান দেওয়ার ফলে, লোকমান হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। পুত্রকন্যার সামনে মান অপমান, শরীরে যন্ত্রণা সবই ভুলে পড়ে থাকা অবস্থায়ই আক্কাস মিয়ার পা জড়িয়ে ধরে অনুনয়ের স্বরে বললতে লাগল, চাচা, আমারে আর কয়ডা দিন সোমায় দ্যান, আমি আমনার সব টাহা দিয়া দিমু, চাচা… সব টাহা দিয়া দিমু।

লোকমানের স্ত্রী-ও লোকমানের সাথে এসে অনুনয়-বিনয় শুরু করল। কিন্তু কিছুতেই পাষাণের মন গলাতে পারছে না। অবশেষে লোকমান তিনদিনের সময় ভিক্ষা চাইলে, তাতে রাজি হলো। তবে এই অনুনয়-বিনয়ের মাঝে লোকমানকে একপশলা মারধরেরও শিকার হতে হলো। তবে আক্কাস মিয়া যাওয়ার আগে এটা স্পষ্ট হুমকি দিয়ে গেল তিনদিনের মধ্যে তার কাছে টাকা না পৌঁছালে তার স্ত্রী কন্যাকে সে তুলে নিয়ে যাবে।

আক্কাস মিয়া চলে যাওয়ার পরে কেউই কারও সাথে কোনো কথা বলল না। সবাই নিশ্চুপ হয়ে যে যার মতো বসে রইল। কতক্ষণ যে এমন কাটল তার ঠিক হিসাব নেই। নীরবতা ভেঙে লোকমান ফোনটি হাতে নিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে বাইরে গেল। কিছুক্ষণ পরে বাহির থেকে এসে স্ত্রীকে ডেকে বলল, তুই কাইল বাড়ি যাবি, বাড়ি যাইয়া রফিক চাচার ধারদা টাহা লইয়া আবি।

লোকমানের স্ত্রী লোকমানের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, রফিক চাচার ধারদা টাহা আনমু মানে, হে কি টাহা দেবে নাকি। আর টাহা দেলেও কবে জাগা ল্যাইক্কা দ্যাও। জানো না হের খবর? একটি গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে লোকমান বলল, টাহা কি আর এমনে দেবে, পুবধারের ঐ পাঁচকাডা…।

পৈত্রিক ভিটা বিক্রর কথা মুখে আসতেই লোকমানের হৃদয় দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগল। কী! জাগাই তো মোট সাত কাডা, হেয়াদ্দা পাঁচকাডা ব্যাচলে পোলাডার পরে কি অবে? লোকমান তার স্ত্রীকে একটা ধমক মেরে বলল, তোরে যা কইছি তুই হেইয়া হর। কয় টাহা দেবে? এহন কইছে পোঞ্চাশ আজার দেবে, আর বাকি টাহা রিজিস্ট্রির সোমায় দেবে।

পরের দিন লোকমানের স্ত্রী গ্রামে গিয়ে কয়েকজন লোককে সাক্ষী রেখে রফিকের কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে ঢাকায় ফিরে এল। লোকমান টাকা পেয়ে একে একে সবার দেনা পাওনা পরিশোধ করে দিল। সবার দেনা পাওনা শোধ করা শেষে এক রাত্র বেলা লোকমান তার স্ত্রীকে ডেকে বলল, সব গুছা, কাইল-ই চইলগা যামু।

লোকমানের স্ত্রী লোকমানের দিকে কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কই যাবা!

লোকমান কিছুটা ক্ষোভের স্বরে বলল, কই যামু, গেরামে, এই নিষ্ঠুর শহরে আর না, অনেক অইছে।

লোকমানের স্ত্রী কিছুই বলল না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে অশ্রু বিসর্জন করল, তারপর স্বামীর সাথে গোছানো শুরু করল।

পরের দিন ভোরে সবকিছু গুছিয়ে যখন বের হওয়া সময় হলো তখন রহিমকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। রহিম ঘুম থেকে উঠে যখন দেখল ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে বের করছে, তখন জিজ্ঞেস করল— আব্বা, তোমরা কোতায় যাও?

যখন শুনল সবাই মিলে বাড়ি যাচ্ছে তখন রহিম গোঁ ধরল, সে যাবে না।

আব্বা, মুই যামু না, কয়দিন পর না মোর পরীক্ষা। পরীক্ষা দেওয়া লাগবে না? পরীক্ষা দিয়া মোর ফাস্টো অওয়া লাগবে না! তোমরা যাও, মুই একলাই থাকতে পারমু।

ছেলের কথা শুনে লোকমান দু-চোখের অশ্রুধারা ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ উদাস ভঙ্গিতে চেয়ে রইল। তারপর সবকিছু নিয়ে বাসে উঠল। বাস চলতে চলতে যখন রুবির স্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন স্কুলের দিকে চোখ পড়তেই লোকমান হু-হু করে কেঁদে উঠল। বাসটি যতই সামনের দিকে এগোতে থাকল, লোকমানের স্বপ্নগুলো ততই পিছু হাঁটতে থাকল।

সজল দেউরী : জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৯৮, পিরোজপুর। বাবা অমল দেউরী, মা সন্ধ্যা রাণী। তিনি দাউদপুর পল্লীমিলন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে এইচএসসি ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক (সম্মান) শেষ করে, ঐ বিভাগেই স্নাতকোত্তর-এ অধ্যয়নরত আছেন। ইতোমধ্যে তার বেশকিছু কবিতা, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ বিভিন্ন সাময়িকী ও লিটলম্যাগে প্রকাশিত হয়েছে।

 

Read Previous

প্রখ্যাত তাজিক কবি লায়েক শের আলির কবিতা

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৪র্থ সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *