অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ৩০, ২০২৪
১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ৩০, ২০২৪
১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যাহিদ সুবহান -
তীর্থের কোকিল

তিনতলা হাসপাতালের দোতলায় সাজুর বিছানা। জানালার পাশে সবুজ দেবদারু গাছ। আকাশে রোদ আর মেঘেদের লুকোচুরি, চড়ুইভাতি চড়ুইভাতি খেলা। সূর্যের আলো দেবদারু গাছের পাতাকে ছুয়েছে। সে আলো এসে পড়ছে তার চোখে। চোখগুলোও যেন বৃষ্টিভেজা এ পাতাদের মতোই সবুজ হয়ে উঠছে। জীবনের এই পড়ন্তবেলায় বিছানায় একা একা শুয়ে শ্রাবণের এই বিকেলে তার মনে পড়ে দিনশেষে ঘরে ফেরা শাদা বকেদের কথা। বড্ড অসুখ তার; দুরারোগ্য অসুখ! সাতাশ বছর আগের কোনো এক শ্রাবণের পড়ন্ত বিকেলে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ঘর ছেড়েছিল সাজ্জাদ চৌধুরী সাজু। আর ফেরেনি। সেদিনের বৃষ্টি প্রকৃতিকে নতুন করে তুলেছিল আর সাজুকে দিয়েছিল নতুন পথ, নতুন জীবন।

দাঙ্গাবাজ লোকটা একদিন হঠাৎ শহর থেকে উধাও হয়ে গেল। অহরহ হল্লার শহরটাতে নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছিল সেদিন, কিন্তু তা ছিল অদৃশ্য। কেউ হয়তো খুশি হয়েছিল। লোকটা মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। কারও সাথে সামান্য কথা কাটাকাটি হলেই চড়াও হতো। কোনো কারণ ছাড়াই মারপিট। এমন অবস্থা হয়েছিল যে সাজু নামটা উচ্চারিত হলেই মানুষের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ত। কেউ কেউ লোকটার হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ায় হৃদয়ে চোট পেয়েছিল কি না জানা যায়নি।

সাজুর এই উচ্ছৃঙ্খল জীবনের ব্যাপারে একেকজন একেক রকমভাবে। কেউ কেউ বলে, অল্প বয়স, একটু পাগলামো তো করবেই। কেউবা মন্তব্য করে, বড় ঘরের ছেলে, বংশের ধারা তো একটু থাকবেই। কেউ কেউ বলে ফেলে, ‘হবে না? বাপ তো শত কোটি টাকা রেখে গেছে। সব তো টাকার গরম!’

বাপটা মরার পর সাজুর বড় ভাই বিজু বাপের রেখে যাওয়া ব্যবসাটাকে দেখে। পুরোনো ব্যবসাটা বুদ্ধি খাটিয়ে, পরিশ্রম করে জোড়াতালি দিয়ে ভালোই চালাচ্ছে। সে খুব হিসাবি মানুষ। হিসেবের বাইরে এক টাকাও খরচা করার জো নেই। এই শহরে সুনাম আছে বেশ। অথচ সাজু উল্টো। বাপের রেখে যাওয়া টাকাগুলো ওড়াচ্ছে দেদারসে। কোনো হিসাবনিকাশ নেই। সারাক্ষণ বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা। ইদানীং নাকি টুকটাক নেশাও করছে বদ বন্ধুদের সাথে মিশে। বিজুর কাছে সব খবরই কিছু কিছু পৌঁছায়, কিন্তু সে কিছু বলে না। আদরের ছোট ভাই বলে কথা। আর বড় বোনেরও বারণ আছে।

বায়োস্কোপের রিলের মতো একটা একটা করে পুরোনো দিনের বিশেষ স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে আসে সাজু চৌধুরীর। কী দাপুটে জীবন ছিল! শহরের নামি স্কুলে পড়েছে। কলেজে দোর্দণ্ড দাপট নিয়ে চলেছে। সারাদিন হইহই রইরই করে কেটেছে কলেজ জীবন। কলেজে ওরাই সব। কলেজের সব দলের ছাত্র নেতারাই ওকে সমীহ করে। কিছু বললে কিংবা আবদার করলে কলেজ প্রশাসন ওদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। এত গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে এমন জাতীয় কথা উঠলে, সকলে বলে, ‘আরে, সাজু ইকরাম চৌধুরীর ছেলে না, ওর কথার বাইরে যাওয়ার কী দরকার!’

শুধু স্মৃতি নয়, কিছু মুখও ভেসে আসে জীবনের বায়োস্কোপের এই রিলে। শিপ্রা আর সাজুর সম্পর্কটা ছিল ওপেন সিক্রেট। ওদের জুটি দেখে ঈর্ষায় অনেকে জ্বলত। যেদিন বাড়ি থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে আসে, সেদিন শিপ্রা শুনেছিল সব। কী এক অজানা কারণে সেদিন সেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সাজুর থেকে। সে রহস্য এখনো উদ্ধার করতে পারেনি সাজু। জীবনের এই পড়ন্ত সময়ে ভেসে আসে শুভ্র কচি কুমড়োর মতো মায়াবী মুখটা, কী সজীব, সতেজ, নিষ্পাপ!

বাড়ি ছেড়ে আসার ঘটনাটা সাজুর জীবনকে অন্যমুখী করে দিয়েছিল। বাপটা মরে যাওয়ার পর বড় ভাইটা সংসারের হাল ধরল। ব্যবসার সব কিছু তার হাতে তুলে দেওয়া হলো। এছাড়া উপায় কী! সাজুর মধ্যে তো তেমন ভারত্ব আসেনি। আর বিজু সর্বক্ষণ বাবার সাথে থেকেই ব্যবসা শিখেছে। বড় বোনের বিয়েটা বাবাই দিয়ে গেছেন। ঢাকার এক বনেদি পরিবার, শিল্পপতির ছেলে। তাদেরও সব এলাহি ব্যাপার।

দিন দিন সাজুর উৎপাত বাড়ছে। সামান্য বিষয় নিয়ে এর-ওর সাথে মারামরি, ভাঙচুর তার নিত্যদিনের ঘটনা। ইদানীং নেশাও করে বরে শোনা যায়। বিপদের জগতে পা বাড়িয়েছে সে। বখাটে কিছু বন্ধুর পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাওয়ার জো তার। নেশা করে চুপি চুপি বাড়ি ফেরে রাত করে। বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে। খাওয়ার ঠিক নেই, ঘুমানোর ঠিক নেই, শরীরে কোনো যত্ন নেই।

একদিন বড় ভাইয়ের মুখোমুখি হতে হয়। আগেই সব কিছু বড় ভাইয়ের কানে যায়। কিছু বলা হয়ে ওঠে না। আদরের ছোট ভাই তো। আবার বড় বোনের বারণ। সে তো সাজুর এসব অপকর্মের কথা বিশ্বাসই করতে চায় না। বড় ভাই বিজু খুব বিরক্ত হয়ে ওঠে। সেদিন বিকেলে দুজনই বাড়িতে ছিল। সাজুর ডাক পড়ে বড় ভাইয়ের ঘরে। কী কথা হয়, জানা যায়নি। আধাঘণ্টা পর চোখ লাল করে বড় ভাইয়ের ঘর থেকে বের হয় সাজু। বোঝা যায় এ সংসার বড্ড অপিরিচিত হয়ে উঠেছে তার কাছে। তাকে দেখা যায় বাড়ির বাইরে পা বাড়াতে, এক কাপড়ে। নতুন এক জীবন, নতুন পথ, নতুন এক পৃথিবীর খোঁজে। এ পথে শেষ জানা নেই তার।

সকালেই রাউন্ড দিয়ে গেছে ডাক্তার। সাজুর কাছে এলেই ডাক্তারদের মুখ কেমন যেন কুঁচকে যায়। শ্রাবণের পৃথিবী আঁধার করা মেঘ যেন জমে তাদের চোখে-মুখে। কোনো সুখবর নেই! ডাক্তাররা হয়তো চাইছেন তাকে হাসপাতাল থেকে বিদায় দিতে। অথবা চাইছেন জানালার বাইরের দেবদারু গাছটার সবুজ পাতাদের ছোঁয়া আর শ্রাবণের মেঘেদের এই লুকোচুরি দেখতে দেখতেই লোকটা পরপারে পাড়ি জমাক।

সাজুর পৃথিবীটা ছোট হয়ে গেছে। এই পৃথিবীর বাসিন্দা এখন চারজন। সাজু, ওর বউ সোনিয়া আর ফুটফুটে দুটো মেয়ে। বউটা অসুস্থ রোগী টানতে টানতে নিজেই রোগী হওয়ার জো। ওর চেহারা দেখলে বিশ্বাসই হয় না গাঁয়ের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে এই সোনিয়া। গৃহস্থের মেয়ে সে। ধৈর্য আছে। কিন্তু তারও তো শেষ আছে নাকি? সামনে মেয়ে দুটোর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। নিজেকে নিয়ে আর ভাবনার সময় কই?

সাজুর কলেজের সহপাঠী রফিক ওকে আশ্রয় দিয়েছিল। ওদের বাড়ি শহর থেকে অনেক দূরে। যেদিন এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বির হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসেছিল, তখন রফিক এগিয়ে এসে জানতে চেয়েছিল, কী হয়েছে। খুব লাজুক আর নিভৃতচারী রফিক সাজুকে নিয়ে গিয়েছিল ওদের বাড়িতে। তবে সাজুর শর্ত ছিল কাউকে বলা যাবে না ওর অবস্থান। এই শহরের মানুষগুলোর সাথে আর কোনো সম্পর্ক নয়। পাওয়া-না পাওয়ার হিসাবনিকাশে ব্যস্ত এই ইট-কংক্রিটে ঘেরা মানুষগুলো। ওদের হৃদয় কংক্রিটের মতোই শক্ত। হিসাব ছাড়া এরা একটু হেসেও কথা বলে না।

রফিকদের বাড়ির গোলাঘরে থাকার জায়গা হয় সাজুর। রফিক তার শর্ত মেনেছিল। সাজুর খোঁজ আদৌ কেউ নিয়েছিল কিনা জানা যায়নি। গ্রামের ছোট বাচ্চাদের পড়িয়ে পড়িয়ে দিন যেতে থাকে ওর। একসময় গ্রামের হাইস্কুলের শিক্ষকের দায়িত্ব কাঁধে পড়ে। সাজুর আচরণ আর মেধায় খুশি হয়ে এলাকার মানুষ সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্কুলটার দায়িত্ব ওর কাঁধে তুলে দেয়। এলাকার মানুষ একরকম জোর করেই সাজুর সাথে সোনিয়ার বিয়ে দেয়। সোনিয়ার বাবা আপত্তি করেনি বরং খুশিই হয়েছে। গ্রামের মানুষগুলো নরম মাটির মতো। সাজুও এই নরম মাটির মানুষগুলোর সাথে নিজের নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে চায়। তাই সেও আর কিছু বলেনি।

একমাত্র বড় বোনটা ছাড়া কেউ সাজুকে দেখতে আসেনি। পৃথিবীর এক কোণে পড়ে থাকা মানুষটার খোঁজ নেওয়ার মানুষ নেই। সাজু ইদানীং কারও অপেক্ষায় থাকে। আবারও একটা নতুন পৃথিবীর খোঁজ করতে চায় মনটা। শরীরটা আর পারে না। একসময় সাজুর চোখ দুটো স্থির হয়ে আসে। তিনটি নারী কণ্ঠ চিৎকার করে কান্না করতে থাকে। হাসপাতালের বাইরের বৃষ্টিভেজা সবুজ সতেজ গাছের পাতার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় সাজুর চোখ দুটোতে। সে ছায়ায় সবুজ হয়ে উঠেছে ওর চোখ দুটো। শ্রাবণের এই বিকেলে আকাশে শাদা তুলোমেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। মেঘ আর রোদের এই লুকোচুরি খেলার ছবি সাজুর চোখে দেখা যাচ্ছে কিনা কেউ খেয়াল করেনি। শুধু কান্নার শব্দ বাড়তে থাকে!

 

Read Previous

মুদ্রিত দুঃখের ধারাপাতে

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৫ম সংখ্যা (অক্টোবর-২০২৩)

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *