অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৯, ২০২৪
১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৯, ২০২৪
১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আবদুল মতিন -
দাম্পত্য

রোজকার দিনের মতোই অফিস থেকে বাসায় ফিরতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা খুঁজছি। করোনা মহামারির সময়টাতে মতিঝিল টু মিরপুর সহজেই তিনশ টাকায় যাওয়া-আসা করা যেত। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় এখন আর এ ভাড়ায় যাওয়া-আসা কল্পনা করা যায় না। আজকে মনে হয় ওরা সবাই সভা করে একজোট হয়ে মাঠে নেমেছে, যেন অধমের পকেটের শেষ কড়িটুকু না খসিয়ে ছাড়বে না। কী করা যায় ভাবছি এমন সময় একটা অটো সামনে এসে দাঁড়াল।

—কই যাইবেন?
—মিরপুর।
—চারশ পঞ্চাশ লাগব।
—চারশ দেব।
—আর বিশ টাকা দিয়েন।

অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারলাম, চারশতেই কাজ হবে। মনে মনে বললাম, তুমি বাবা তাহলে ওদের দলে নেই। একটু ভাব নিয়ে বললাম, আমার এক দাম।

—ইচ্ছা করলে দিতে পারতেন।
—সে অন্যদিন দেখা যাবে, আজকে কোনো ইচ্ছেই করছে না।
—তাইলে আর কী করন যায়, উঠেন।

উঠে বসলাম। আজকের দিনটাই যেন মিস্টার জট এন্ড লেট। বাসা থেকে বের হয়ে যানজটজনিত কারণে অফিসে পৌঁছাতে লেট, কাজের জটের কারণে দিন শেষে অফিস হতে বের হওয়াতে লেট, এখন ফিরতি যাত্রায় আবারও যানজটজনিত লেট।

ট্রাফিক সিগনালের সামনে অপেক্ষায় বসে আছি; বসে আছি বললে ভুল হবে, আসলে নেট ব্রাউজিং করছি। নেটের এই দুনিয়ায় এখন সময় কাটানো কোনো ব্যাপারই না। ঢাকার যানজট আমরা নিরসন করতে পারিনি, তাই যানজট নামক ব্যাধিটি সহনীয় করতে নেট আমাদের সহমর্মী হয়েছে— বেঁচে থাকো বাবা নেট, যুগ যুগ ধরে।

নেটের দুনিয়ায় গুগলমামা তো এক মহাজ্ঞানী, মহাজন। তো গুগলমামার আস্তানায় ঢোকে এদিক ওদিক নেট ব্রাউজিং করে যাচ্ছি— কী করিলে কী হইতে পারে, আশি বছরের যুবক বয়সে আমার মাঝে কোন সুপ্ত প্রতিভাগুলো বিকশিত হইতে পারে ইত্যাকার হাবিজাবি। এমন সময় হঠাৎ ধপাস— মগ্নতায় ছন্দপতন। নব ছন্দে তাল কেড়ে নিয়েছে সিএনজি চালক। দেহের অঙ্গভঙ্গির সাথে তাল রেখে চলছে তার খিস্তি-খেউর।

সিএনজি চালক তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তৃতীয় কোন এক জনকে বলে যাচ্ছে :

ওই হারামজাদী রে আমি ক্যান ডিভোর্স দিমু। ওই খানকি বেটি কি ভাবছে ওর চালাকি আমি বুঝি না? ওর মায়ে ছিল একটা… আর এইরকম একটা মহিলার মাইয়ারে বিয়া করাডাই হইছে আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল।

এক লাখ টেকা কাবিন দিয়া ওরে আমি বিয়া করছি, এইডা হইছে এই ভুলের একটা খেসারত। …আমি যদি বাপের পোলা হই, তাইলে ওরে আমি …কইরা ছাড়ুম।

ভাবলাম ওকে এখন থামানো দরকার। এমনিতেই সিগনালের অপেক্ষায় মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে, এর মধ্যে এমন অকথ্য বয়ান ভালো লাগছে না।

ধমক দিয়ে বললাম, এই থামো। বিষয়টা কী, বউয়ের উদ্দেশ্যে এমন সুমিষ্ট ভাষণের কারণ কী?

ধমক দিয়েছিলাম বটে তবে কাজ হবে, তা আশা করিনি। কিন্তু কিছুটা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, কাজ হয়েছে। সে আমার কথা শুনেছে।

আমার ধমকে সে সাথে সাথেই ফোন রেখে দিয়ে বলল, সরি স্যার, আসলে মেজাজটা আওলা-ঝাওলা হইয়া গেছে। ছোডো মাইয়া ছাওয়ালডা বাড়িতে মা’র লাইগ্যা কান্তে কান্তে বেহুঁশ, আর আমার হারামজাদী বউ অবুঝ মাইয়াডারে ফালাইয়া রাইখা চইলা গেছে। …স্যার আমার কাহিনীডা আপনারে খুইল্যা কই, এর পরে আমারে একখান বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েন।

ড্রাইভারের কথা শুনে আমার ছোটো বেলার শোনা কথা মনে পড়ে গেল।

গ্রামদেশে একটা কথা চালু আছে, ‘ডাল দিয়ে ভাত খাও, সোজা রাস্তায় হাঁইটা যাও’। অর্থাৎ সহজ-সরল জীবন যাপন করো, কারও সাত-পাঁচে যেয়ো না, তাহলেই জীবন সুখময়।

ছোটবেলার শোনা কথার ব্রত ধরেই কারও ব্যক্তি জীবনে নাক না গলিয়ে, সাদা ভাত আর ডাল-পাতা খেয়ে পরিবার নিয়ে বেশ সুখেই আছি। কারও ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানে আমি বড়োই আনাড়ি। হেনকালে আমার সিএনজি ড্রাইভারের সালিশ-পরামর্শের আবেদনে প্রমাদ গুনলাম। তারপরও নিজের আনাড়ি অবস্থাটা ঢেকে বিজ্ঞের মতো বললাম, শোনো, যার যার ব্যক্তিগত বিষয় তার নিজ থেকে সমাধান করাই উত্তম; তারপরও তুমি যেহেতু পরামর্শ চাচ্ছ, তাহলে বলো, শুনি কী বুদ্ধি-পরামর্শ দেওয়া যায়। তবে শর্ত হলো বউকে গালি দিয়ে তার সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না।

আমার কথায় সে একটুখানি লজ্জিত হয়েছে মনে হলো। হেসে দিয়ে বলল— স্যার, আমার এই একটাই দোষ, মাথাডা যখন আওলায়া যায় তখন মুখটাও একটু বেফাঁস হইয়া যায়। তয় আমি কইলাম কোনোদিনই বউয়ের গায়ে হাত তুলি না। হাত তুলব ক্যান, মাইয়ামানুষ রে আল্লায় বানাইছে দুর্বল কইরা, দুর্বলের উপরে হাত তোলা কোনো বাহাদুরি কাজ না। যে পুরুষমানুষ বউয়ের গায়ে হাত তুলে হেয় একটা…।

সিগনালে অপেক্ষার ধৈর্য পরীক্ষায় ততক্ষণে পাস করেছি। ট্রাফিক পুলিশ ভাই হাতের ইশারায় জানান দিল— যান, এবারের মতো ছেড়ে দিলাম।

ড্রাইভারকে বললাম, আজাইরা প্যাঁচাল বাদ দিয়ে আসল কথায় আসো। সামনের দিকে নজর ঠিক রেখে কথা বলো, আর কাহিনী সংক্ষেপ করো।

—জি স্যার, সংক্ষেপ কইরাই কই। স্যার, বর্তমানে আমার বয়স ধরেন গিয়া তিরিশ অইব। লেখাপড়া করছি ধরেন ক্লাস নাইন পর্যন্ত। তো ক্লাস নাইনে যখন উঠছি তখনই একদিন হঠাৎ মা মইরা গেল। মা মারা যাওনের পিছে পিছেই বাপে করলো দ্বিতীয় বিয়া। অভাবের সংসারে অশান্তি আছিল আগে থাইক্যা, বাপের দ্বিতীয় বিয়ার পরে সেইটা আরো বাইড়া গেল। কী করন যায়, দিশা পাইনা। একদিন হঠাৎ কইরা মাথায় আসলো— শ্যালার লেখাপড়ার গোষ্ঠী কিলাই। যেই ভাবা সেই কাজ। একদিন লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়া, দুই পাউ সম্বল কইরা, এক কাপড়ে ঢাকার শহর আইয়া পড়লাম।

বললাম, ক্লাস নাইনে পড়ার বয়সে একা ঢাকা শহরে চলে এলে, এর আগে কখনো এসেছিলে নাকি!

—স্যার, ঢাকার শহর এর আগে খালি নামে শুনছি, এই প্রথম আইলাম। কিছুই চিনি না, জানি না। কী করমু, কই যামু কোনো কিছুর দিশা পাই না। এই ভাবনার মধ্যেই দুই দিন চইলা গেল কমলাপুর রেল ইস্টিশনে। কোনো খাওয়া নাই, ঘুম নাই। শেষে সাইদাবাদে এক মটর গ্যারেজে কাম পাইয়া গেলাম পেটে-ভাতে। এই গ্যারেজেই কাম করত আর একজন, আমার চেয়ে বয়সে একটু বড়। হের লগে বন্ধুত্ব হইয়া গেল। এক সময় কাম শিখলাম। এই মটর গ্যারেজেই দৈনিক মজুরিতে চাকরি নিলাম। কাম করি, আর একটু ফাঁক-ফোকর কইরা আমার এই বন্ধুর লগে এইদিক-সেইদিক ঘোরাঘুরি করি। একদিন বন্ধু কইল, চল আমাগো গ্রামের বাড়িতে বেড়াইয়া আসি, ঢাকার কাছেই নরসিংদী।

জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার বাড়ি কোথায়?

—বর্তমানে আমার বাড়ি পঞ্চগড়। পঞ্চগড় বাড়ি হইলেও আমার পূর্বপুরুষরা ছিল ঢাকার, সেই জন্য আমার কথা কওনের ঢং কিন্তু ঢাকার মতন। শুনছি আমার বাবার দাদারা নাকি নরসিংদীর মানুষ আছিল। তয় এখন নরসিংদীতে আমার গোষ্ঠি-গাওয়াল কে আছে, কই আছে কিছুই জানি না। অবুও বাপ-দাদার পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে বেড়ানোর কথা শুইনা মনটা আনন্দে নাচন দিয়া উঠল, তাই খুশিতে রাজি হইয়া গেলাম।

ড্রাইভারের তথাকথিত সংক্ষীপ্ত বয়ানের ফিরিস্তি দেখে আবারও প্রমাদ গুণলাম। এ কাহিনী আমার যাত্রাপথের সীমানার মধ্যে সমাপ্তিরেখা টানতে পারবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করলেও তার মাঝে সে চিন্তার ছিটেফোঁটা আছে বলে মনে হলো না। সময়জ্ঞানের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করেই সে বলে চলল,
বন্ধুর বাড়ি দুইদিন বেড়াইলাম। বন্ধুর মার লগে পরিচয় হইলো, খালা বইলা ডাকি। বন্ধুর বাড়িতে পরিচয় হইল আর একজনের সাথে, সে হইলো বন্ধুর ভাগ্নি— সেই এখন আমার স্ত্রী। খুব আদর যত্ন করল খালায়। কিন্তু এর মধ্যেই প্যাঁচ খাইয়া গেলাম। বন্ধুর ভাগ্নিটা মাশাল্লাহ বেসম্ভব সুন্দরী। বয়স কম হইলেও কথাবার্তায় টেটনা। আমারও তো বয়স কম। কম বয়সে যা হয় আরকি— বন্ধুর ভাগ্নিরে মনে ধইরা গেলগা।

—দুই দিনেই মনে ধরে গেল, দারুণ তো! ঠিক আছে, তারপর কী হলো?

—বেড়ানো শেষে ঢাকায় চইলা আইলাম, কিন্তু কামে-কাজে মন বসে না, খালি বন্ধুর ভাগ্নির মুখ চোখে ভাসে। এর মধ্যে বন্ধুর নিকট থাইক্যা ভাগ্নির আরো কিছু খবর নিলাম। জানতে পারলাম, সে এতিম একখান মাইয়া। বাপে ছিল নেশাখোর, বাদাইম্যা; তার উপরে জুয়া খেলার অভ্যাস। নেশাখোর, জুয়াখোরের কাছে সংসার কি আর সংসারের দায়িত্বইবা কী, তার বুঝ কিছু আছেনি! কিন্তু একটা কাজে সে নাকি খুব ওস্তাদ আছিল, যখন তখন কারণে-অকারণে আমার শ্বাশুরি রে সে পিটাইত। শ্বাশুরিও নাকি ছিল বদমেজাজি, গায়ে-গতরে না পারলেও মুখে তার উসুল নিত। সংসারে আছে তিন পোলাপাইন, তারা দুই জন মিল্যা হইলো পাঁচ। সংসারে আয়-রোজগার নাই, পাঁচজন মানুষের ভাত-কাপড়ের জোগান নাই। সব সামাল দেওনের লাইগ্যাই কোনো দিশা না পাইয়া আমার শ্বাশুরি নাকি একদিন অন্ধকার জগতে পাও দিছিল। এই নিয়া একদিন স্বামী-স্ত্রীতে বেদম ঝগড়া আর মাইরপিট শুরু হইলে এক পর্যায়ে আমার শ্বাশুরি বাড়ির তন জনমের লাইগা বাইর হইয়া গেছিল। এর পরে কোনো একদিন নরসিংদী রেল ইস্টিশনের কাছেই রেলের তলে মাথা দিয়া মইরা গেল। তার কয়দিন পর এক রাতে শ্বশুরও ঘুমাইতে গিয়া আর জাগনা হইল না। আমার বন্ধু সরাসরি এইসব কথা আমারে জানাইছিল, কারণ সে বুঝতে পারছিল আমি তার ভাগ্নির মধ্যে ডুইবা গেছি। শেষে আমি তারে দোষ না দেই, এই ভাবনাতে আগেভাগেই জানাইয়া দিল আরকি।

ড্রাইভারের প্রেমকাহিনী এগিয়ে চলল। আমি নিরস বদনে তার একমাত্র শ্রোতা। আমার বদন নিরস নাকি রসে টইটম্বুর সেটা দেখার তার সময় নাই— যাত্রাপথের সময়টুকুতেই এ কাহিনী তাকে শেষ করতে হবে।

সে বলে চলল, বন্ধুর মুখে এই কাহিনী শুইন্যা কিছুদিন মনটা একটু চুপসাইয়া থাকল, কিন্তু বেশিদিন তা ঠাঁই নিল না। আস্তে আস্তে দেখি মন খালি ওই ছ্যামরির পাশ দিয়া ঘোরাঘুরি করে। এর মধ্যেই একদিন আমার বাপেও দুনিয়া ছাইড়া চইলা গেলগা। আমি দেখলাম ওই ছ্যামরি আর আমার মধ্যে একটা মিল হইয়া গেছে, হেরও বাপ-মায় নাই আমারও নাই; আমরা দুইজনই এতিম। সিদ্ধান্ত নিয়া ফেললাম— যাই আছে কপালে, ওরেই বিয়া করুম।

—বাহ! ইন্টারেস্টিং বলেই মনে হচ্ছে। এরপর!

—যেই ভাবা সেই কাজ। এক শুক্কুরবারে বন্ধু রে না জানাইয়া চইল্যা গেলাম নরসিংদী। খালা রে মানে বন্ধুর মায়ে রে সরাসরি কইলাম— খালা, আমি আপনেরে নানি বানানোর সিদ্ধান্ত নিছি। আপনে রাজি থাকলে এখনই কাম সাইরা ফেলতে চাই।

খালায় কয়, এইডা আমি তখনই বুঝবার পারছিলাম আর তখন থাইক্যাই তোমারে নাতজামাই বানাইমু বইলা ঠিক কইরা রাখছিলাম। এখন তুমি যখন নিজেই জালে ধরা দিছ, তাইলে আর দেরি করুম ক্যান? বাপ-মা মরা নাতনিডা রে বিলাইতে পারলে আমার মাথা থাইক্যা একটা বড় বুঝা নাইমা যাইব। ওর বড়ডা রেও আমিই বিলাইছি। সবার ছোডডা হইল ছেড়া পোলা। হেইডা থাকে তার চাচার সংসারে। হেইডারে নিয়া চিন্তা নাই।

কাহিনী যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করানো দরকার, তাই তাকে ট্র‍্যাকে ফিরিয়ে আনার জন্য নিজেকেই উদ্যোগ নিতে হলো। বললাম— বিয়ে কবে করলে তাই বলো।

—এই সময়েই স্যার। দুইদিনের মধ্যে কাম হইয়া গেল। বিয়া শেষে বেশিদিন দেরি করি নাই, বউ রে ঢাকায় নিয়া আসলাম। যাত্রাবাড়িতে এক টিনশেড বাসায় একরুম ভাড়া নিয়া সংসারজীবন শুরু করলাম। এর মধ্যেই বড় পোলাডা হের মায়ের পেডে আসল। আমার খুশি তখন দেখে কে! আমি করলাম কি…।

আমরা ততক্ষণে বিজয় সরণির ট্রাফিক সিগনাল পার হওয়ার জন্য তেজগাঁও ফ্লাইওভারে অপেক্ষা করছি। এখানে বলে রাখা দরকার, এই ঢাকা মেগাসিটিতে জায়গায় জায়গায় ট্রাফিক সিগনালের ডিভাইসগুলো কেবল নগরের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজই করে যাচ্ছে। এদের আসল কাজটি যে কী, তা বোধহয় আমরা ভুলেই গিয়েছি। আমরা এখন ট্রাফিক সিগনাল বলতে ট্রাফিক পুলিশ ভাইয়ের হাতের ইশারাকেই বুঝে থাকি। এহেন আজগুবি সিগনাল তো যন্ত্রচালিত ডিভাইসের সিগনাল না যে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর গ্রিন, রেড বা ইয়েলো হবে। এই সিগনালের সময়সীমা ট্রাফিক পুলিশ ভাইয়ের মেজাজ-মর্জির উপরে নির্ভর করে একেক দিকে একেক রকমভাবে নির্ধারিত হয়। এর ফলে যে দিকে অপেক্ষাকৃত বেশি সৌভাগ্যবানেরা অবস্থান করেন, তাদের অপেক্ষার পালা সংক্ষিপ্ত হয়ে যায় আর আমার মতো পোড়াকপালেরা যে দিকে থাকে তাদের অপেক্ষার পালা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে।

ড্রাইভার তার ভাষায় সংক্ষিপ্ত বয়ানে সুবিশাল কাহিনীর এস্তেমাল করে যাচ্ছে। সে বলে, তয় বউ নিয়া নতুন জীবন ভালায় ভালায় কাটতে লাগল। ততদিনে গ্যারেজের কাম ছাইড়া ভাড়ায় সিএনজি চালাইতে শুরু কইরা দিলাম। এতে গ্যারেজে কাম কইরা যা পাইতাম, তার চাইতে বেশি আয় রোজগার হইতে লাগল। এর মধ্যেই বড় পোলাডা জন্ম নিল। পোলাডার বয়স যখন তিন বছরের মতন, তখন বউ কয় পোলা বড় হইবার লাগছে। সংসারে যা রোজগার হয়, তা দিয়া বাসা ভাড়া আর খাওন-খরচ মিটায়াই তো সব শেষ। এক টাকাও তো জমা নাই।

আমি বলি— এইতে আমার কি করনের আছে? যা কামাই করি তাই সংসারের পিছে ঢাইলা দেই, নাকি অন্য কোনখানে ঢালি? জীবনে কোনো দিন খারাপ জায়গায় যাই নাই, নিশার মধ্যে যা আছে, একটু বিড়ি সিগারেট খাই, এই তো।

বউ কয়— রাগ কইরো না। একটা চিন্তা আমার মাথায় আইছে, আমারে তোমাগো দেশের বাড়ি পাঠায়া দেও। ঢাকায় তুমি একটা ছোটো রুম ভাড়া কইরা থাক। বাড়িতে তোমার যা মন চায় পাঠাইও। তুমি যা পাঠাইবা তা থাইকা আমি যেমন কইরা পারি, কিছু না কিছু জমা করমু।

—চিন্তা কইরা দেখলাম, বউ তো ভালা কথা কইছে। এই দিকে বাপ মইরা যাওয়ার পরে সৎমা ও সোজা পথে আইসা গেছে। আমিও যেমন পারি তা দিয়া সৎমা রে সাহায্য কইরা থাকি। সৎমায়ের তরফে কোনো বাচ্চা-কাচ্চা আছিল না। আমার নিজ মায়ের পেটের ছোডো ভাইয়ের সংসারেই সে এখন থাকে। বউডারে যদি মায়ের কাছে পাঠায়া দেই, তাইলে আমিও নিশ্চিন্তায় থাকতে পারি।

…পুরো রাস্তার জ্যাম ঠেলে ততক্ষণে আমি আমার বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। কিন্তু আমার গাড়িচালকের প্রেমকাহিনীর যে বয়ান চলছে তাতে বাকি রাস্তায় এর সমাপ্তিরেখার দেখা পাওয়ার কোনো আলামত দেখতে পাচ্ছি না। এতে আমি যে একটু আধটু স্বস্তি বোধ করছি না, তা কিন্তু নয়। কারণ কাহিনী শেষে তাকে এর সম্ভাব্য সমাধানের পথ বাতলে দিয়ে তার স্ত্রীকে পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাকে বর্তমান সংকট হতে উদ্ধার করার একটা প্রস্তাব শুরুতেই সে দিয়ে রেখেছে। কিন্তু এ কাজে আমার পারদর্শিতার দৌড় কতটুকু তার বিবরণ প্রথমেই দেওয়া হয়েছে। তারপরও নিজেকে দোষমুক্ত রাখার মানসে বললাম— শোনো, কাহিনী যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত করো, আমার রাস্তা কিন্ত আর বেশি নেই।

সিএনজিচালক আমার কথা শুনলেও এটাকে সতর্কবাণী হিসেবে নিয়েছে বলে মনে হলো না। সে বলল, এই তো স্যার, শেষ কইরা আনতেছি।

—তয় স্যার, বাপের ভিটায় কোনো রকমে ছোট একখান ছনের ঘর তুইলা বউ রে বাড়িতে পাঠায়া দিলাম। আগে যা কইছিলাম, একটুখানি পান-বিড়ি খাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো বাড়তি খরচের নিশা নাই। যা রোজগার করি তা থাইক্যা নিজের যা না অইলেই চলে না তা রাইখা বাকিটা বাড়িত পাঠায়া দেই। আমার বউ করে কি, আমি যা পাঠাই যেমন ধরেন দশ টেকা পাঠাইলে পাঁচ টেকা জমায়, বিশ টেকা পাঠাইলে জমায় দশ টেকা। এইভাবে জমতে থাকল। একদিন বউ কয়, যা জমছে তার সাথে ব্যারাক (ব্র‍্যাক এনজিও) সমিতি থাইক্যা একটা লোন লইয়া একটা উন্নত জাতের গাই গরু কিনুম। বললাম, সমিতির লোন নিলে নাকি বাড়ি-ঘর বেইচাও শোধ করন যায় না। বউ কয় আমি ঠিকমতই শোধ করুম, তুমি চিন্তা কইরো না। বললাম, ঠিক আছে তুমি পারলে লোন কর। বউ লোন নিল। হাতের জমানো টেকা আর লোনের টেকা মিলায়া গাই-গরু কিনল। দুধ বেঁচে আর ব্যারাক সমিতির কিস্তি দেয়।

এইভাবে একদিন বউ কইল, লোন শোধ হইয়া গেছে।

এখন ভাবতাছি, একটু বড় কইরা লোন নিমু। তা দিয়া বাড়িতে একখান বড় কইরা টিনের চৌচালা ঘর করুম। আমি দেখলাম, বউ পারবে। বললাম, তুমি পারলে করো। বউ আবারও লোন করল। একদিন হেই লোন শোধও করল।

এর পরে একদিন বউ কইল, খুশির খবর আছে— তোমার বউ আবারো পোয়াতি হইছে। কী আর বলমু স্যার, যেন সবকিছু সিনেমার মতন হইতে থাকল। একদিন দুই নম্বর ছাওয়ালডাও জন্ম নিল— মাইয়া ছাওয়াল। বউ এখন টেকা জমায় আর ধানি জমি কিনে। আমার বউয়ের খাটা-খাটনি দেইখা আশে-পাশের লোকজন হিংসা করে। আমিও বউয়ের উপরে বেজায় খুশি। মাসে একবার কইরা বাড়িতে যাই, দুই/তিন দিন থাইক্যা ফুরফুরা মেজাজ লইয়া ঢাকায় আইসা কাম শুরু করি। তয় এর মধ্যেই একটা ভুল কাম করছিলাম বইলা এখন আমার মনে হয়। ভুলডা অইল গিয়া দুইটা ইস্মার্ট ফোন কিনছিলাম, একটা নিজের লাইগ্যা আর একটা বউয়ের লাইগ্যা। পরথম পরথম বাড়তি খরচ করছি দেইখা বউ একটু রাগ করলেও পরে দেখি ইস্মার্ট ফোন পাইয়া সে বেজায় খুশি। সে খেতের পাকা ধানের ছবি পাঠায়, পুকুরথন বড় মাছ উঠাইলে তার ছবি তুইল্যা পাঠায়, ছাওয়ালগো সাথে লইয়া ভিডিও কল দেয়— আরও কত কী! আমি ঢাকায় বইসা থাইক্যা এইসব ছবি দেখি আর মনে বেজায় ফুর্তি লইয়া সিএনজি চালাই…

—এ তো দেখছি, সবই তোমার খুশির খবর। খারাপটা হলো কীভাবে?

—আমার তো একসময় চাল-চুলা কিছুই ছিল না। মাত্র দশটা বছর। এর মধ্যেই এখন আমার চারটা দুধের গাইসহ গোয়ালে দশটা গরু। বাড়িতে পুকুর কাটছি, পুকুরভর্তি মাছ। বছর বছর ধানি জমি কিনি। এককথায় স্বপ্নের সুখী সংসার ছিল। আর এসব কিছুই সম্ভব হইছিল আমার বউয়ের পরিশ্রমের কারণে। কিন্তু স্যার আমার এই সুখের সংসারে কেমনে যে আগুন লাগছে কিছুই বুঝবার পারতেছি না।

খেয়াল করলাম, ততক্ষণে ড্রাইভারের গলা ধরে এসেছে।

ধরা গলায় সে বলতে লাগল, বছরখানেক বা তার চাইতে কিছু বেশি সময় আগে থাইক্যা দেখি বউয়ের মধ্যে কেমন কেমন জানি পরিবর্তন শুরু হইছে। বড় পোলাডা ইস্কুলে পড়তেছিল। বউ এর ইচ্ছায় হে রে আল্লার কালাম মুখস্ত করানির লাইগ্যা হেফজখানায় দিয়া দিছিলাম। সেইখানেই তার থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা। আগে বউ প্রত্যেকটা দিন পোলাডারে নিজের হাতে রান্না করা খাবার খাওয়াইয়া আইত। কিন্তু একদিন দেখি কী, সে আর পোলার লাইগ্যা খাবার লইয়া যায় না। সংসারের কাম-কাজেও দেখি আগের মতন মন নাই। খালি দেখি বইসা বইসা ঝিমায় আর বিছানায় শুইয়া ঘুমায়। ছোডো অবুঝ মাইয়াডার দিকেও দেখি কোনো খেয়াল নাই। গরু, বাছুরগুলি না খাইয়া দিন পার করলেও এইসব কিছুই সে দেখে না। আগে যেমন প্রত্যেকদিন মোবাইলে ভিডিও কল দিত এখন আর তা করে না। কী হইছে কিছুই বুঝতে পারি না, জিগাইলে কোনো কথার উত্তর দেয় না। বাড়িতে আমি আসলাম কি আসলাম না, তার কোনো হিসাবকিতাব তার মধ্যে দেখি না। এই রকম কইরাই গেল গিয়া দশ মাস। মাস দুই আগে বাড়িত আইয়া দেখি, গোয়ালের দুইডা গরু কি জানি কি হইছিল, মইরা গেল। কিন্তু এই নিয়া তার মধ্যে কোনো আক্ষেপের ছিটাফোঁটাও নাই। কত আর সওন যায়, কন! ঐ দিন নিজেরে সামাল দিতে না পাইরা বউ রে কিছুটা, আসলে কিছু বলাটা ঠিক না, বেশ ভালাই মারধোর করছি। কিন্তু কইলাম, এই পরথম বউয়ের গায়ে হাত তুললাম।

আমি বললাম, প্রথমবার হোক আর শেষবার হোক বউকে বকাঝকা করা, গায়ে হাত তোলা, এসব কোনো বাহাদুরি কাজ নয়। এসব করে বউয়ের প্রতি তুমি চরম অন্যায় করেছ।

আমার কথা সে শুনল কিনা, বোঝা গেল না। সে তার কাহিনীই বলে যাচ্ছে।

সে বলল, রাইতে বকাঝকা কইরা সকাল বেলাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়া চইলা আসলাম। ঢাকায় আইসা ভাবলাম, বউডারে ঢাকায় আইন্যা একজন ডাক্তার দেখাইতে অইব। কিন্তু কি ডাক্তার দেখাইমু, তা তো বুঝবার পারি না। এরে তারে জিগাই। এইভাবে সপ্তা খানেক চইলা গেল। একদিন বাড়িত তন ছোড ভাইটা ফোন দিয়া কইল, ‘ভাবি রে কোথাও খুঁইজা পাওয়া যাইতাছে না’।

মনে করলাম, এইদিক সেইদিক কোনো কামে গেছে হয় তো। কিন্তু ঐদিন রাইত দুইটায় ছোড ভাইটা যখন আবার ফোন দিয়া কইল, ‘ভাবির এখনতরি খবর নাই’, তখন তো মনের মধ্যে একটু চিন্তা ঢুইকা গেল। …কই যাইবার পারে, কিছুই বুঝবার পারি না। যাওয়ার একমাত্র জায়গা ছিল তার নানির কাছে, কিন্তু সে তো দুনিয়া ছাইড়া চইলা গেছে আরও পাঁচ বছর আগে। নানি চইলা যাওয়ার পরে এই পাঁচ বছরে সে একদিনের জন্যেও নরসিংদী যায় নাই। তারপরেও সন্দেহ দূর করনের লাইগা নরসিংদীতে হের ছোটো ভাইয়ের কাছে ফোন দিলাম। নাহ, সেইখানে যায় নাই। বড়ই চিন্তায় পড়লাম। ঘুম থাইক্যা উইঠাই বাড়িতে চইলা গেলাম। বাড়িতে যাইয়া এইদিক সেইদিক খুঁজি। মনের সন্দেহ দূর করনের লাইগা এইখানে সেইখানে ফোন দিয়া খোঁজ করি, কিন্তু কোথাও তার খবর নাই। গ্রাম তো আর শহরের মতন জায়গা না যে ইচ্ছা করলেই যে কোন জায়গায় লোকাইয়া থাকতে পারে। অবশেষে খোঁজাখুঁজির কাম বাদ দিয়া পোলা দুইডারে আমার সৎ মায়ের কাছে রাইখা আবার ঢাকা শহর আইসা কামে লাইগা গেছি। যদিও জানি এই ঢাকায় হের আসার কোনো কারণ নাই, তারপরেও গাড়ি চালাই আর মনে মনে এই ঢাকা শহরে হেরে খুঁজি।

কাহিনী সংক্ষিপ্ত করানোর জন্য আবারও হস্তক্ষেপ করলাম। বললাম, শেষপর্যন্ত কোনো খোঁজ কি পেয়েছ?

—শেষে হেরে পাওনের আশা একরকম ছাইড়া দিছিলাম। এরমধ্যে মাসখানেক অইব, সে আমার ছোড ভাইরে ফোন দিছিল। ফোন দিয়া কয়, সে আর এই সংসারে থাকব না। সে আমার কাছে কাবিনে লেখা দেনমোহরের এক লাখ টেকা উসুল চায়।

কই থাইক্যা ফোন দিছে, কোন জায়গায় কার লগে থাকে, কিছুই কয় না। আমি ফোন দিলে ধরে না, ধরলেও ভালো-মন্দ কিছুই কয় না। দেনমোহরের এক লাখ টেকা এখন আমার কাছে তেমন কিছু না। তারে কইলাম— ঠিক আছে, তুমি আইসা এক লাখ টেকা নিয়া যাও। কিন্তু সে কয়, তারে আগে তালাক দিতে অইব, তারপরে সে আইসা টেকা নিয়া যাইব। আমি কইলাম, আমি ক্যান তালাক দিমু, আমি কি কোনোদিন কইছি যে তোমারে তালাক দিমু? এই কথার কোনো উত্তর সে দেয় না।

একটু আগে সে আমার ছোটো ভাইয়ের কাছে ফোন দিয়া কয়, তারে তালাক দিয়া এক লাখ টেকা পাঠায়া না দিলে সে আমারে নারী নির্যাতনের মামলা দিব। এখন বুঝবার পারতেছি, হারামজাদি কারও লগে ভাইগ্যা গেছে। কিন্তু কার লগে যাইতে পারে, এমন কাউরে সন্দেহ করবার পারতেছি না। সন্দেহ করমু ক্যামনে— ছাওয়াল পাওয়াল, গরু-বাছুর, খেতখামার ছাড়া হের মনে আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। বাড়ির মানুষ, পাড়ার মানুষ কেউ বলতে পারতেছে না যে কোনোদিন কেউ হেরে কারও সাথে কাম ছাড়া বাড়তি কথা কইতে দেখছে। হায় রে হতভাগী, আমার কথা না হয় বাদ দিলাম, তোর নিজের হাতে গড়া এই সুখের সংসার, এই পোলা মাইয়ার কথাডা একবারও তোর মনে আইল না!

সে কাঁধে ঝোলানো গামছায় চোখ মোছে। সিএনজি চালকের প্রেম পর্ব ও তার পরবর্তী কাহিনীর পথপরিক্রমা শেষ না হলেও আমার যাত্রাপথের শেষ সীমানায় ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছি। এতক্ষণ ধৈর্যশীল শ্রোতা হিসেবে যে গুরুদায়িত্ব পালন করেছি, তার এক্ষুনি অবসান ঘটাতে হবে। তাই তার কথার মাঝখানে আমাকে বাম হাত ঢোকাতেই হলো। বললাম, আমাকে মাফ করো, আমি আর তোমার পুরা কাহিনীর শ্রোতা হিসেবে থাকতে পারলাম না।

অতঃপর বাধ্য হয়ে তাকে থামতে হলো। কথা থামিয়ে সে বলল— স্যার, এহন আমি কী করুম, একটা বুদ্ধি-পরামর্শ দেন দেহি।

অনেক কষ্টে সমাধানসূচক বাক্য একটা গল্পের মাঝখানেই ঠিক করে রেখেছিলাম, যা তাৎক্ষণিকভাবে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করল। বললাম, কেউ যদি মন থেকে চলে যায়, তাকে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। তুমি আর কী করবে, যদি পারো ভুলে যাও।

সে বলে, কিন্তু স্যার আমি ওরে ভুলতে পারুম না, ওরে আমি এখনো ভালোবাসি।

বললাম, যদি বউয়ের প্রতি তোমার ভালোবাসা সত্যি হয়, তাহলে এই ভালোবাসার কারিশমায় একদিন সে হয়তো তোমার কাছে ফিরে আসতে পারে। যদি তখন তুমি তাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকো, তাহলে অপেক্ষায় থাকো, সে আসবে। এই বলতে বলতে আমি আর প্রতি উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজ ডেরার উদ্দেশে পা বাড়ালাম। পেছন থেকে শুনতে পেলাম, ‘আপনার কথাডা যেন আল্লাহ কবুল করে’।

নিজ ভবনে ঢুকতে ঢুকতে ভাবতে লাগলাম, কেন এমন হয়! একজন নারী এতদিন তার সমস্ত সত্তা দিয়ে মনের মতো করে একটা সংসার সাজিয়েছে। সাজানো সংসারে এখন তার উপভোগ করার পালা। অথচ নিজের হাতে গড়া সংসার দূরে ঠেলে দিয়ে কেন সে পালিয়ে গেল! অপর পক্ষে অন্যজন রাগ, দুঃখ, অপমান ভুলে কেন তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে!

আন্দাজ করি এর পেছনে আপাতদৃষ্টে যে কারণ দেখা যাচ্ছে, তাতে এটাকে পরকীয়াই বলা যায়। কিন্তু এটাই কি একমাত্র কারণ! হতে পারে এ সিএনজি চালকের নানাবিধ অত্যাচার সে এতদিন সহ্য করে টিকেছিল, যা সিএনজি চালক আমার কাছে গোপন করেছে। আমার এ ধারণা যদি সত্যিও হয়, তাহলেও স্ত্রীর প্রতি তার অন্তরে লালিত ভালোবাসা দেখে ওর প্রতি আমার কেমন যেন মায়া হতে লাগল। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে বললাম— হে পালনকর্তা, ওর দোষ-ত্রুটি যাই থাকুক, স্ত্রীকে ফিরে পেতে সে তোমার উপর পূর্ণ আস্থা রেখেছে। তার মনোবাসনা কবুল করার জন্য তোমার প্রতি যে ফরিয়াদ সে করেছে, তা পূরণ হলে তো তোমার কোনো ক্ষতি দেখছি না। তাহলে দাও না ওর মনোবাসনা পূরণ করে!

পালনকর্তার নিকট ওর হয়ে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মনের ইচ্ছাটুকু জানান দিয়ে নিজের ঘরে ঢোকার কলিং বেলে টিপ দিলাম।

 

আবদুল মতিন : জন্ম ময়মনসিংহ জেলার উচাখিলা নামক গ্রামে। গ্রামের স্কুলেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক, অতঃপর ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী আনন্দমোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাৎস্য বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। পেশায় ব্যাংকার। ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড-এ কর্মরত।

ব্যাংকারের কঠিন, নিরস ও চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিয়োজিত থাকার কারণে পেশার বাইরে সাহিত্য সাধনার মতো কাজের জন্য সময় বের করা খুবই দুরূহ ব্যাপার, তথাপি লেখালেখি করেন নিজের সাহিত্য রসের তাড়না থেকেই। নিজের খেয়ালে লিখেন গল্প, কবিতা, ভ্রমণকাহিনী ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে। ইতোমধ্যে 'অনুপ্রাণন প্রকাশন' হতে 'ক্রোধ' নামে তার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে।

ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই কন্যাসন্তানের জনক।

Read Previous

প্রখ্যাত তাজিক কবি লায়েক শের আলির কবিতা

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৪র্থ সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *