অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৩, ২০২৪
২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৩, ২০২৪
২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নাহার আলম -
ধনদাসের রজনিচর

E:\Anupranon Antorjal\Anupranon Antorjal_5th Issue\Illustration_Antorjal 5\Part_1\Antorjal 5th Issue- Alonkoron, Part-1\Choto Golpo-22\choto golpo 13.jpg

বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাগানে আলো জ্বলছে। কিন্তু ঘন কুয়াশায় সে আলো বেশিদূর ফোকাস করতে পারে না। শীতের রাত। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও শোনা যায় এক ঘরে আলাদাভাবে থাকা পরস্পরের। মেয়েটি দম চেপে অপেক্ষা করে রাত বাড়ার। খাটে শোয়া মানুষটির কখন নাক ডাকার শব্দ শুনবে। ঘুমে কী বিশ্রী-মতো ঘড়রঘড় ঘড়রঘর শব্দে যেন সারা ঘর কাঁপতে থাকে। সারাদিন কর্মক্লান্তির পর ঘুমোতে গেলে মেয়েটির মেজাজ বিগড়ে যায়, কিন্তু টুঁ শব্দটি করার জো নেই। অধীর অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে মেঝেতে শুয়ে আছে। সপ্তাহখানেক ধরেই এই অপেক্ষা তার। কিন্তু সঠিক সময়টা যেন সুযোগ মতো আসছে না। তাই অপেক্ষাই একমাত্র ভরসা। মাঘী অমা গেল গতরাত। দূরের পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং ঢং শুনে বুঝে গেল রাত তিনটে এখন। ভোরের আলো ফোটার আগেই কাজটি করতে চায়। খাটে শোয়া মানুষটির নাক ডাকার বাজে আওয়াজটি আজ আর সে ঘড়ির শব্দে ভাঙল না। মেয়েটি বুঝল। গভীর ঘুম। উঠে দাঁড়াল। চেনা ঘর। জিরো পাওয়ারের লাইটের আবছা আলোয় টিপটিপ করে উঠে রান্নাঘর থেকে গতমাসেই শান দেওয়া বটিটি হাতে তুলে নিল। বেড়ালের মতো নিঃশব্দে মেঝে থেকে তার বালিশটি খাটের মানুষটির মুখে শক্ত করে চেপে ধরল। গায়ের জোরে তার দু’হাতের ওপর নিজের পা’দুটো চেপে ধরেছিল যাতে ছাড়াতে না পারে। বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর নিথর হলে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। স্থির পাথরের মতো জড়বৎ দেহটি তখন। এবার নিশ্চিন্ত হয়ে এলোপাথাড়ি বটির ঘা দিতে থাকে সারা গায়। উন্মাদের মতো ফালা ফালা করে কাটে দেহটিকে। রক্ত ফিনকি দিয়ে দিয়ে মেয়েটির সারা শরীরে মুখে হাতে মেখে সয়লাব। বিছানা মেঝে রক্তে গড়াগড়ি। খাটের গায়েও রক্তের অসংখ্য দাগ। বীভৎসতার নেশা চেপেছে যেন। কোপাতেই থাকে পাগলের মতো। কোমর ছাড়ানো হালকা কোঁকড়ানো ঘন চুলেও রক্তে মাখামাখি হয়ে জটের মতো দলা পাকিয়ে গেছে। রক্তখেকো এক ডাইনি পিশাচের মতো লাগছে। হলিউডের দুর্ধর্ষ থ্রিলার মুভি ‘ভেনজেন্স ইজ মাইন’ (১৯৭৯)-এর সেই কারাবন্দি নায়ক আসামির মতো কিংবা ‘দ্য সাইলেন্স অব দ্য লাম্বস’ (১৯৯১)-এর সিরিয়াল কিলার নায়কের মতো যে কিনা শিকারদের যন্ত্রণা দেওয়াতেই আনন্দ খুঁজত। তাদেরও হার মানিয়ে গেছে নৃশংসতায় মেয়েটি। ঘণ্টাখানেক বা তার কিছু বেশি সময় ধরে চলল এ নারকীয় নৃশংসতা। তারপর রক্তমাখা বটি উঁচিয়ে শুকিয়ে যাওয়া রক্তে জট পাকানো এবড়োথেবড়ো খোলা চুলে সটান দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল।

মেইন গেটের পাশের রুমেই দারোয়ান সুমন শুয়েছিল। বিকট এক ঘটাং ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে মাত্রই লেগে আসা ঘুমটা টুটে গেল। প্রথমে ঠাহর করতে পারল না বিষয়টি কী হতে পারে। শীতের রাত। লেপ মুড়ি দিয়ে গায়ে ওমটা গাঢ় হয়ে এসেছিল। তখনই এই উৎপাতে মেজাজটা খানিকটা বিগড়েই গেল। পরক্ষণেই তড়াক করে লাফিয়ে দরজা খুলে বাইরে তাকাতেই দেখল গেটটি হাট করে খোলা। কে গেল এই মাঝ রাত্তিরে? গেটটা লাগিয়ে বাড়ির গ্যারেজে ঢুকে দেখল গাড়ি তো আছে। তবে? এবার শংকা ভয় একসাথে মনে ভাসছে। অন্ধকার রাত। গেটের কাছে ফিরে এল আবার। ভালো করে পরখ করতে চাইছে। নিয়নের আলো জ্বলছে গেটের দু’মাথায়। তারপরেও টর্চ ফেলে গেটের হুক দেখে আঁতকে উঠল। তাতে তাজা রক্ত লেগে আছে। হাত মোজায় জড়ানো নিজের হাতের দিকে তাকায়। সেখানেও রক্ত। ভিজেও গেছে। কিন্তু ঘোরের মধ্যে তা মালুম করতে পারেনি। এবার সত্যিই ভয়ে তার গা হিম হয়ে আসে। কিন্তু তাদের ভূত চতুর্দশীর পূজো তো হয়ে গেছে প্রায় দু’মাস হলো। তবে এখন কেন ভূতের উৎপাত? দ্বিধা জমছে। এটি কি তবে ভুতুড়ে কোনো কাণ্ড? নাকি খুনের মতো কোনো ব্যাপার? এমন সব ভাবনার ঘোরে কেটে গেল আরও আধঘণ্টা মতো সময়। বাড়ির দোতলা যেখানে মালিক থাকেন সে রুমে আলো জ্বলছে। বাটন ফোনে সময় দেখল। চারটা কুড়ি মিনিট। বুঝল, মালিক শেষরাতের নামাজ মানে তাহাজ্জুদ পড়তে উঠেছেন। আগে তেমন ধর্মকর্ম করেননি। করোনার বছর থেকে নামাজ পড়ছেন। মালিকের স্ত্রী মিতাকে অবশ্য নামাজ শুরু থেকেই পড়তে দেখেছিল সুমন। সুমন এখানে আছে তা প্রায় চার কি পাঁচ বছর হলো। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। মালিককে ডাকবে? ভাবতে ভাবতে আবার গেটে আলো ফেলে দেখার চেষ্টা করল। একই রকম রক্তমাখা। এখন শুকিয়ে রঙের মতো দাগ লেগে গেছে। হাত দিয়ে স্পর্শ করল। শিওর হয়ে এবার কল করল মালিককে।

সুনসান রাত। অমাবস্যার অন্ধকারে নিজের ছায়াকেও আন্দাজ করা যায় না। এই হিম শীতে রাতের পাখিগুলোরও তেমন সাড়াশব্দ নেই। গাছের ডালে ঘন পাতার আড়ালে ঠোঁট বুকে গুঁজে ঝিম মেরে ঠাঁয় বসে আছে। মাঝে মাঝে কালো ছোপ বাদামিরঙা রাতচরা পাখির একটানা চৌঙ্ক চৌঙ্ক চৌঙ্ক-স্বরে বেশ কিছুক্ষণ ডেকে আবার থেমে যায়। ডাকার সময় এ ডাল ও ডালে চরে বেড়ায়। একা নয়, জোড়ায় বা দলবদ্ধভাবে ভয়ংকর আওয়াজ তোলে। কোড়া, প্যাঁচার ডাকও আসছে তবে অনেকটা দূরের আওয়াজ।

রাত প্রায় সাড়ে চারটা। এলার্ম শুনে ঘুম ভেঙে গেল মিতার। ভেঙেছে তৈমুর খানেরও। নামাজের জন্য উঠে এল। জেগেই ছিল। অজু করতে যাবে এমন সময় সুমনের ফোন। রিসিভ করেই খান সাহেব বললেন, কী ব্যাপার সুমন, এত রাতে কল করলে কেন? কিছু হয়েছে? আবার শরীর খারাপ হলো?

জানেন, সুমনের বারোমাসি পেটের ব্যামো। ক্রনিক ডিসেন্ট্রি। এই ভালো তো এই মন্দ। তবুও অসহায় ও খুব অনেস্ট বলেই তাকে রেখেছেন। মিতার বাবার বাড়ির একই গাঁয়ের লোক।

না না ছার-বাবু, মুই ঠিকই আছম্। একটা সব্বনাশ হয়িছে। গেটে অক্তের দাগ নাগি আছে। আইতে হামি তো ভালো করিই গেট নাগাছম্। ঘণ্টাখানিক আগত্ গেটে জোর শব্দ শুনিয়া হামি বাইরে আসি দেখম্, গেটটা হাট করি খোলা আছম্। ওই ছিটকিনিত্ অক্ত নাগা, আস্তার মধ্যিও অক্তের ম্যালা দাগ আছে।

দম না ফেলেই একটানা কথাগুলো বলে থামল সুমন। হাঁপাচ্ছে, বেশ বুঝতে পারল ওর কাঁপা কাঁপাস্বরে।

কী? রক্ত? তুই ঠিক দেখেছিস তো?

হা হা, মুই ঠিক দেখিছম্।

হতবাক খান সাহেব বুঝতে পারলেন না। কী হতে পারে। তার চেহারায় চিন্তার ছাপ দেখে মিতা বলল, কী বলল সুমন? কী হয়েছে, রক্ত? কীসের রক্ত? কোথায় রক্ত!

গেটে নাকি রক্তের দাগ লেগে আছে আর গেটটাও খোলা ছিল। বলতে বলতে গায়ে চাদর জড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেন।

হায় আল্লাহ! কী বলছ তুমি? বাইরে বেরোতে দেখে মিতা বাধ সাধল— দাঁড়াও। রক্ত মানে তো খুনের মতো কিছু। রাতটা ভোর হতে দাও।

কী পাগলের মতো বলছ তুমি? আমার গেটে রক্ত! আর আমি চুপ করে ঘরে বসে থাকব? আগে স্পটে গিয়ে তো দেখি ঘটনাটা কী। তারপর…।

খান সাহেবের কথার মাঝখানে থামিয়ে মিতা বলে উঠল, থানা-পুলিশ এসবে আমার অসম্ভব রকমের ভয় হয়। কথায় বলে, বাঘে ছুঁলে এক ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা! একে তাকে ওকে করতে করতে চোদ্দো নয় ছাব্বিশ গোষ্ঠীকে ধরে টান মারবে।

বলছে আর সদর দরজা দু’হাত আগলে দাঁড়িয়ে আছে। খান সাহেব তাকে কিছু না বলে একপাশে সরিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

শহরের বড় রাস্তা ধরে হা হা হা… হা হা হা… হা হা হা এক বীভৎস রকম উচ্চস্বরে হাসছে আর সমুখ দিকে শহরের আরও গভীরে যেদিকে ঢাকাগামী হাইওয়ে চলে গেছে সেদিকে দৌড়োচ্ছে মেয়েটি। ঊর্ধ্বশ্বাসে। ডানহাতে উঁচু করে ধরা রক্তাক্ত বটিটি। হাসির শব্দগুলো দৌড়ানোর ফলে কেমন অদ্ভুত ভাঙা ভাঙা শোনাচ্ছে। তার সে শব্দে রাস্তার কুকুরগুলো সমস্বরে ঘেউ-উ-উ ঘেউ-উ-উ করে পেছনে তাড়া করতে শুরু করল। গাছের রাতের পাখিগুলো সরসর শব্দে উড়ে গেল। অনেকটা দূর এসে হাসির শব্দ থেমে গেল। দৌড়োচ্ছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। একদিকে। মহাসড়কের দিকে প্রায় পাঁচ-ছয় কিলো দৌড়ে গিয়ে বড় রাস্তার কাছে ঝোপের পাশে দড়াম করে পড়ে গেল। তার কিছু দূরেই ছ’সাত জনের একটি গাঁজাখোর ও জুয়াড়ির দলের ভররাত আড্ডা শেষে ঝিমোচ্ছিল প্রায় সবাই। রাস্তার অন্য পাশটিতে ভ্রাম্যমাণ বনিতার সাথে পালা করে তিনজন সিমেন্টের কাগজের ওপর শেষ আরেক ধাপের কাজ সারতে যাচ্ছিল। ঠিক এমন সময়ই দড়াম শব্দ তার সাথে ধাতব কিছুর আওয়াজে সবার মনোযোগ থমকে গেল। ভোর হয়েছে ঠিকই কিন্তু ঘন কুয়াশায় তখনও সূর্যের আলো ওঠেনি। রাস্তার দুপাশ থেকে দলবলে সব বেরিয়ে এসে সে ভয়ানক দৃশ্যে চোখ ছানাবড়া। সাধারণ পথচারীরাও এসে মিশেছে ভিড়ের মাঝে। সে ভিড়ের কেউ একজন জরুরি সেবা ট্রিপল নাইনে কল করে জানানোর আধঘণ্টা পরই পুলিশ ভ্যান এল। সারা গায় রক্তমাখা অচেতন মেয়েটিকে এবং পাশেই ছিটকে পড়া রক্তাক্ত বটিটি তুলে নিয়ে সাঁই করে চলে গেল। গন্তব্য হসপিটাল।

সিজোফ্রেনিয়া অনেকটা বিকারগ্রস্ততার অনুরূপ। কিন্ত মেয়েটি সেরকম কোনো রোগী নয়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকরা এদের নীতিজ্ঞানহীন মানুষ বলে আখ্যা দেন। উনবিংশ শতকে ইংরেজ চিকিৎসক ভালো-মন্দের হিতাহিত জ্ঞানশূন্যতাকে ‘নৈতিক উন্মত্ততা’ নামকরণ করেছেন। সাইকোপ্যাথ আর খুনি এক কথা নয়। একজন মানুষ কেন খুনি হয়ে ওঠে? কখন তার মাঝে এমন জেদ চাপে? কেন অপরাধ করে? এমন সব প্রশ্নের হাজারটি কারণ যেমন আছে, তেমনই আছে সমপরিমাণ না হলেও তার জবাব বা নিরাময়ও। কেউ পরিস্থিতির চাপে আবার কেউ বা জিনজনিত কারণেও এর শিকার হয়। প্রথমটি নিরাময়যোগ্য হলেও দ্বিতীয়টিতে নয়। তারা অপরাধপ্রবণ মানসিকতা থেকে বেরোতে পারে না। টানা তিনদিন অচেতন থাকার পর মেয়েটি এখন নির্বাক। ফুল ট্রমাটাইজড। মেয়ে নার্সকে দেখলেই তেড়ে আসছে মারতে সে মেয়েটি। দাঁত কিড়মিড় করে চোখ মুখ ভয়ংকর মেজাজি করে তোলে। হাতের স্যালাইন, ক্যানলা, ক্যাথেটর সব টেনে খুলে ফেলে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে এমন অস্বাভাবিক আচরণই করছে। তাকে দেখভালের জন্য বিশেষ নার্সকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। হাত-পা একরকম বেল্ট বাঁধা। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল টিমের সাইকোলজিস্ট আইডিন্টিফাই করলেন এবং ওপরের কথাগুলো বললেন। তার হিস্টরি জানার চেষ্টা করেও ব্যর্থ। কারণ, সে কোনো কথাই বলেনি আজ প্রায় দশদিন গত হলো। এখন চিকিৎসা চলছে পুলিশ পাহারায়।

পরপর লাগোয়া নয়, ভাড়া দেওয়া ঘরগুলো। মাঝে ফুলবাগান আবার বাড়ি এভাবেই সাজিয়ে করেছেন। যাতে এক ঘর থেকে আরেক ঘরের প্রাইভেসি বজায় থাকে আবার একইসাথে দেখতেও বেশ ভালো লাগে। ভেতরে গেলে মনে হবে ছোটখাটো কোনো রিসোর্ট। আদতে তা নয়। বাড়ির মালিক রিটায়ার্ড ব্যাংকার তৈমুর খান বেশ শৌখিন মানুষ। প্রায় এক একর জায়গা নিয়ে শহরের একপাশে বাড়ি করেছেন। খুব আধুনিক মডেলের বাড়ি। ছাদের বিল্ডিংয়ের কারুকাজ নজরকাড়া। সামনেই বড় লেন। মাঝে রঙিন ইট-সুরকির বড় ছাতার নিচে পাতা সিমেন্টের আধফালা চাঁদ আকৃতির সেন্টার টেবিলের চারপাশ ঘিরে হেলান দেওয়া ছ’খানা চেয়ার। এক সাইজের সবুজ ঘাসে পরিপাটি করা মধ্য আঙিনাটা। সে আঙিনার বুকচিরে লাল ইটের হাঁটা পথ। প্রাচীর দেয়ালের অনেকটা অংশজুড়ে বিশাল বাগান। তাতে ফলজ, বনজ, ওষুধিসহ নানা রং-বেরঙের ফুল-লতাপাতারও গাছ-গাছড়া আছে। নিজেই যত্ন নেন। হাত লাগায় মিতাও। বাগান ও মাঠ পরিষ্কার করার লোক আছে। দারোয়ান কাম পরিচ্ছন্নতা কর্মী সুমন পাল। সপ্তাহে তিনদিন সে বাগানের মাঠের পরিচর্যা করে। বিনিময়ে আলাদা মাইনেও পায়। এ সময় তার বউ রূপসী পালও হাত লাগায়। নিঃসন্তান এই ব্যাংকার দম্পতি। সময় কাটান গাছ-পাখিদের সাথেই। বাগান করা আর দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো তার নেশা। তার থ্রি ফ্ল্যাটেড চারতলা দালানের কিছু অদূরেই টিনশেড হাফ বিল্ডিংয়ের বেশ ক’খানা ঘর। দু’কামরা, তিন কামরার ঘরও আছে। কলেজপড়ুয়া কিছু মেয়েদের নিবাস মানে মেস হিসেবে ভাড়া দেওয়া সেসব। বছরখানেক হলো তিন কামরার এক বাসায় ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ মহিলা সাথে যুবতী এক পরিচারিকা নিয়ে উঠেছে। মহিলাটি প্রবীণ হলেও বেশ শক্তপোক্ত গড়নে, চলনে-বলনেও। শুরুর ক’মাস তাকে বেশ মিশুকে, সামাজিক বলেই মনে হয়েছিল সেখানে ছাত্রীনিবাসে বাসরত সবার। এমনকি মূল বিল্ডিংয়ের সবার সাথেও তার সমান ভাব ভালোবাসা। মেসের ছাত্রীদের সাথে পিকনিক করা, একসাথে দলবেঁধে সিনেমা হলে যাওয়া। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো। ভালো কিছু রান্না হলে সব মেসে অল্প হলেও পাঠানো। এসব কাজে প্রথম দিকে সবার মন জয় করে নিয়েছিল। পরে পরে কেমন তার বেখাপ্পা আচরণে মেসের ছাত্রীরা ক্ষুব্ধ তার প্রতি। কিন্তু সে মহিলা অতি ধুরন্ধর। বাসার মালিক দম্পতির সাথে তার এতটাই অমায়িক বিনয়ী আর মিশুকে ভাব যে, তার বিষয়ে এমন নেগেটিভ কথা তারা মানতে তো নয়ই, বিশ্বাসই করেন না। কয়েকবার দু’একজন তার বিরুদ্ধে নালিশ নয় কিছুটা অসঙ্গতির কথা জানাতে গিয়ে উল্টে তাদেরই হেনস্থা হতে হয়েছিল। মালিক তৈমুর খান বলেছিলেন, ‘তিনি তোমাদের মায়ের মতো। তিন কুলে তার কেউ নেই। তাকে নিয়ে কেন এমন বাজে বকছ তোমরা? তিনি যথেষ্ট ভদ্র এবং সামাজিক মানুষ। যাও, আর কখনো কারও সম্পর্কে কিছু না জেনে এমন কথা বলবে না। তোমাদের বয়সটা কম। তাই বোধ-বুদ্ধিও নেহাত কম। আমি মানুষ চিনি। দীর্ঘ চার, সাড়ে চার যুগ নানারকম মানুষ নিয়েই কাজ করেছি। পাবলিক ফাংশনে কাজ করে মানুষ চেনাটা শিখেছি। যাও, পড়াশোনায় মন দাও।’

এমনভাবে বোল্ড হওয়ার পর আর কেউ কখনই সে ভুলটি করতে যায়নি। কিন্তু মেনেও নিতে পারছিল না কেউই সে মহিলাকে। তার নিষ্ঠুরতাকে। ছাত্রীরা ভোরেই জাগে কোচিং, প্রাইভেটে ছোটাছুটির জন্য। আজ আর কারও বেরোনো হলো না। পুলিশ এসে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ইতোমধ্যে খবর হয়ে গেছে সে মহিলা খুন হয়েছে নিজ ঘরে। আর সেই মেয়েটি উধাও। লাশ নিয়ে যায় পুলিশ। সে ঘরটিকে সিলগালা করে। তদন্তের স্বার্থে সবাইকে আলাদা আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ছাত্রীরা মনে মনে খুশি হয়। কিন্তু অনাথ মেয়েটির পরবর্তী দুর্দশার কথা ভেবে কষ্টও পায়।

মহিলাটি মেয়েটির ওপর অকথ্য নির্যাতন করত। কোথাও গেলে তাকে ঘরে রেখে বাইরে তালা দিয়ে যেত। কারও সাথে কথা বলতে দিত না। সারাক্ষণ একটা না একটা কাজের মধ্যে রাখত। মহিলার ভয়ে মেয়েটি সবসময়ই কুঁকড়ে থাকত। তালাবদ্ধ অবস্থায় জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। কাঁদত। সে ফাঁকে মেসের কেউ কেউ আলাপ জমাত। তখনই জেনেছিল তার করুণ ইতিহাস। সৎ মায়ের ঘরে জায়গা ছিল না। বাবা ছিল মদখোর। টাকার লোভ দেখিয়ে সে মহিলা তাকে নিজের কাছে নামমাত্র দামে সারাজীবনের জন্য কিনে নিয়েছিল দাসী হিসেবে। সৎ মা বেচে দিল। অরণখোলা গ্রামে ছিল সে মহিলার শ্বশুরালয়। তিন ছেলে স্বামী নিয়ে সংসারী। মহিলা ছিল অত্যন্ত রুক্ষ মেজাজি। স্বাধীনচেতা নয় বরং স্বৈরিণী স্বভাবের। স্বামী সন্তান, সমাজ সব কিছুকেই থোড়াই কেয়ার করা ছিল তার বদস্বভাব। শুরুতে অনেক নিন্দা মন্দও শুনতে হয়েছে কিন্তু তার মুখের বাজে ভাষা ও ব্যবহারের জন্য পরে তার কাছে কেউ ঘেঁষত না। কেউই লাগতে যেত না। তার কারণে পরিবারটি প্রায় একঘরে মতো জীবন যাপন করত। সে বাড়ির চার-পাঁচ ঘর পেরিয়েই সে মেয়েটির বাবার বাড়ি। সাত বছর বয়সে তাকে কিনে এনেছিল। দীর্ঘ দশ বছর কেটে গেছে তার নির্যাতনের যাঁতাকলেই। এখন সে সতেরো বছরের যুবতী। তার যখন দশ বছর বয়স তখন তার বাবার মৃত্যু হয়। গ্রামে থাকা সত্ত্বেও তাকে একবার বাবাকে শেষ দেখাটি পর্যন্ত দেখতে যেতে দেয়নি। উড়নচণ্ডি মহিলা স্বামীর মৃত্যুর পর গ্রাম ছেড়ে এ শহর ও শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকত। স্বামী ছিল প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তার পেনশনের পুরো টাকা তার নামেই নমিনি করা। বিয়ের প্রথম দিকে নিজেও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে কাজ করেছিল। তার ও স্বামীর পেনশনের মোটা টাকায় সে নিজের মতো করে বেখাপ্পা বেয়াড়া জীবনযাপন করতে শুরু করে। ছেলেরা বাধা দিলেও কান লাগায় না। মহিলাটি খানিকটা লেসবিয়ান স্বভাবেরও। প্রায় রাতে সে মেয়েটিকে উত্যক্ত করত। কেনা দাসী। যা ইচ্ছে তাই করত। না বলার সুযোগ ছিল না তার। মেয়েটি নীরবে সহ্য করত। ভুলবশত কোনো খাবার নষ্ট হলে বা ভাত-তরকারি পুড়ে গেলে সেদিন সারাদিন তার খাবার বন্ধ থাকত। মারধর তো চলতই। ব্যবহার্য অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়েও কার্পণ্য করত। গালমন্দ তো সারাক্ষণের সঙ্গী ছিল মেয়েটির। পাপ আর অভিশাপ নিজেই প্রতিশোধ নিতে জানে। মুখে মধু অন্তরে বিষ ছিল ওই মহিলার সহজাত স্বভাব। বছরের পর বছর অত্যাচারিত হতে হতে বোবা নিরীহ মেয়েটি যে কিনা সাত চড়ে রা করতে জানত না সেই-ই কিনা তাকে এতটা নির্মমভাবে কোপাল! ছাত্রীরা মনে মনে খুশিই হয় আবার মেয়েটির জন্য মায়াও হয়। পুলিশি তদন্ত চলে। আসে যায়। জিজ্ঞাসাবাদও চলে। ঢিমে তেতলা তালে। বাদী হয়ে দাঁড়ায় সরকারি উকিল। আসামির নিখোঁজের কারণে মামলাটি এগোতে পারে না। তবুও নামমাত্র চলতে থাকে জেরা, তদন্ত। চাপাস্বরে নিজেদের মধ্যে ছাত্রীরা আলোচনা করে। বিষয়বস্তু একটিই। ওই মেয়েটি যে তাদেরই বয়সের ছিল। কেমন আছে সে? কোথায় আছে? বেঁচে আছে তো? নাকি মরে গেছে!

প্রশ্নগুলো ঘরময় ঘুরপাক খায় আর বুমেরাং হয়ে হয়ে তীরের তীক্ষ্ন ফলার মতো বুকে মনে মগজে এসে বিঁধে যায়। বিকট রকম প্রতিধ্বনিতে ঘরের চার দেয়াল যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে। সেই সাথে কাঁপে ব্যথাতুর এক বেদনায় তাদের হৃদয়ও।

 

+ posts

Read Previous

ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি 

Read Next

লর্ড ডানসানি’র সাতটি উপকথা

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *