অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ২, ২০২৪
১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ২, ২০২৪
১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জাহাঙ্গীর সেলিম -
নাসিফের প্রকৃতি পরিচয়

নাসিফের বয়স চার। এ বয়স থেকেই তার জানার আগ্রহ বা কৌতূহল একটু বেশি। কথাবার্তা ভালোই শিখেছে। কোনো কিছু বলা হলে প্রশ্ন জুড়ে দেয় ‘কেন’? সুযোগ পেলেই সকলকে একই প্রশ্ন কেন। বারবার ‘কেন’ শুনে তার পিতা-মাতা ও অন্যান্য স্বজন বিরক্ত হয়। অনেক সময় ধমক দিয়ে তাকে চুপ করানো হয়। কিন্তু আমি কোনো সময় তাকে হতাশ করি না। তার প্রশ্ন বুঝতে চেষ্টা করি। তার মতো করে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি। যদিও অনেক সময় যুৎসই উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় না। তার সাথে খেলা করি— ঘুরতে নিয়ে যাই। এ কারণে আমার কাছে ছুটে আসে এবং থাকতেও তার ভালো লাগে। তার পরিবেশ তাকে খাঁচায় বন্দি করে রাখে। কেননা ঢাকায় বদ্ধঘরে বসবাস। আলো বাতাস অনেক সময় ঢোকে, অনেক সময় ঢোকে না। একটু বারান্দা থাকলেও চার দিকে বড় বড় দালান। ফলে আকাশ দেখার সুযোগ থাকে না। মেঘের ডাক শুনতে পায়, কিন্তু বিজলি চমকানো দেখতে পায় না। কা কা ডাক শুনতে পায়— দেখতে পায় না। ঘর থেকে বাহির হওয়া মাত্র রাস্তায় যানবাহন দেখতে ব্যস্ত থাকে। কারণ ঘরে নানা ধরনের ও সাইজের খেলনা গাড়ি তার সবসময়ের সাথী । একটু খোলামেলা স্থান বা বড় রাস্তায় দাঁড়ানোর সময় অনন্ত আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। কোনো কোনো সময় পাখি উড়তে দেখে, উড়োজাহাজও চোখে পড়ে। আরও দেখে লোকজনের চলাচল, গা ঘেঁষে ছুটে চলা, ধাক্কাধাক্কি, ছোট-বড় গাড়ির ভিড়, বিকট গাড়ির হর্নে হকচকিয়ে মুখ লুকায়। এতসব দেখে প্রশ্নের পর প্রশ্ন— ‘কেন’?

একটা গাড়ি আর একটা গাড়িকে ধাক্কা দিচ্ছে কেন? গাড়ি এত জোরে হর্ণ বাজাচ্ছে কেন? লোকজন হাঁটছে কেন?

চৈত্র মাসে ঢাকায় বেশ গরম। সূর্যের তাপও বেশি থাকে। এ মাসের শেষ দিকে দেশের একদম উত্তরে অনেক দূরের পথ তেঁতুলিয়ার উদ্দেশ্যে সস্ত্রীক রওনা হলাম। নাসিফ ও তার মা আমাদের সাথী হলো। যাব নাসিফের নানাবাড়িতে। সন্ধ্যার আগে কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছালাম। স্টেশনের ছাদ বেশ উঁচু ও ছাদে তখন অনেক ঝলমলে বাতি জ্বলছে, লোকজনের ছোটাছুটি, কোলাহলে মুখরিত। নাসিফের প্রথম এত উঁচু ছাদ দেখা এবং সেখান থেকে চোখ সরে না-পলকও পড়ে না। তাকে ঠেলে প্ল্যাটফর্মে নেওয়া হলো। প্ল্যাটফর্মে পোঁছে সব থেকে বেশি অবাক করে লম্বা প্ল্যাটফর্মের ছাদ— ‘এত লম্লা (লম্বা) ঘর!’

অনতি দূরে একটা ট্রেন টানা ‘পোঁ’ শব্দ করে ছেড়ে গেল। নাসিফের দৃষ্টি এড়ায় না— ‘ওটা কী গেল?’

—ওটা ট্রেন।

ট্রেনের কথা তার মনে পড়ে গেল, ছবির বইয়ে ট্রেনের ছবি দেখেছে, টিভিতেও ট্রেন দেখেছে। কিন্তু এই প্রথম ট্রেন দেখে বলে— আমারও একটা ট্রেন আছে।

আমি বললাম— এবার সত্যিকারের ট্রেন দেখ।

—‘ট্রেন কোথায়, আমি উঠব।’ এ কথা বলে প্রশস্ত ও লম্বা প্ল্যাটফর্মে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। তাকে থামানো যায় না। দৌড়ানোর আনন্দ পেয়ে বসেছে। তাকে সঙ্গ দিতে গিয়ে আমি কুলিয়ে উঠতে পারি না। এ সময়ে একটা ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে দেখা যায়। আমি তাকে কাছে টেনে বলি— ঐ যে একটা ট্রেন আসছে। তবে ‘পোঁ’ করে জোরে শব্দ করবে, ভয় পেয়ো না। বেশ জোরে ‘পোঁ’ শব্দে ইঞ্জিনটা গর্জন করে আমাদের কাছে এসে থামে। কিন্তু ‘পোঁ’ এবং চলতে থাকা ইঞ্জিনের টানা শব্দে নাসিফ ভয় পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি তার ভয় ভাঙাতে চেষ্টা করে বললাম— একটু পরে আবারও এ ইঞ্জিনটা ‘পোঁ’ করে চলে যাবে। চল কাছে গিয়ে ইঞ্জিনটা দেখে আসি। ভয়ে ভয়ে সে আমার সঙ্গে গেল।

ইতোমধ্যে যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে ব্যাগ ও মালপত্র সাথে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। পিঁপড়ার সারির মতো লোক চলে যাচ্ছে। সমপরিমাণ যাত্রী ট্রেনে উঠার জন্য অপেক্ষা করছে। এ সময় আরও একটা ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে নাসিফের ভয় কেটে গেছে। দুই প্ল্যাটফর্মের মাঝে দাঁড়িয়ে লোকজনের নামা ও উঠা দেখতে ব্যস্ত। নাসিফের বিস্ময়— এত লোক!

আমরা সদলবলে ট্রেনের কামরায় উঠে পড়লাম এবং জানালার ধারে আসন পেলাম। নাসিফ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে লোকজনের ছোটাছুটি, ট্রেনে ওঠা-নামা, কুলিদের বিকট শব্দে ট্রলি ঠেলা, ফেরিওয়ালাদের দেখতে ব্যস্ত। সব কিছুই তার কাছে নতুন। কিছুক্ষণের মধ্যে ‘পোঁ’ শব্দ করে আমাদের ট্রেনটা ছেড়ে দিল। নাসিফের সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি— ‘বাবা, ট্রেন চলা শুরু করেছে। কী মজা!’ সে তার পিতাকে ‘আব্বু’ ডাকে, আর আমাকে ‘বাবা’ বলে।

ট্রেন ক্রমেই দ্রুত গতিতে চলা শুরু করে। প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে রেললাইনের দু’পাশে দোকানপাটের উজ্জ্বল আলো, বহুতল দালানের সারি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর লোকালয় ছেড়ে নিঝুম অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। মাঝেমধ্যেই ‘পোঁ’ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। চলার পথে কোনো কোনো স্টেশনে কিছুক্ষণের জন্য বিরতি। যাত্রী ওঠানাম করে। এরকম এক স্টেশনে বিরতির সময় সামনের দিক থেকে ধেয়ে আসা ইঞ্জিনের তীব্র আলো দেখতে পেয়ে নাসিফ বলে— ‘বাবা আরও একটা ট্রেন আসছে।’ প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকার সময় বাদাম, ঝাল চানাচুর, চিপস, মাথায় পানির বোতল ও অন্যান্য জিনিস বিক্রেতাদের ছোটাছুটি করতে দেখা নাসিফের কাছে এক নতুন ভুবন। এবার ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার অনেক্ষণ পর সে কামরার মধ্যে নিজেই ছোটাছুটি শুরু করে দিল। সে বুদ্ধিমত্তার সাথে দু’পাশের হাতল ধরে চলাচল করছে। এ বয়সের ছেলের চলাচল করতে দেখে অন্য যাত্রীরা অবাক— ‘বাবু পড়ে যাবে, ব্যথা পাবে, মায়ের কাছে গিয়ে বস।’

—‘না, আমি পড়ব না। হাঁটতে মজা লাগছে।’ জীবনের প্রথম ট্রেনে চলাচল। একটু একটু করে বুঝতে শিখছে। ফলে কোনটাতে আনন্দ সে ভালো করে জানে। এদিকে রাত ঘনিয়ে আসছে। যাত্রীদের ঘুমানোর সুবিধার্থে কামরার মধ্যে কয়েকটি লাইট জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে কামরায় আলো কমে গেছে। এ অবস্থায় নাসিফ মার কাছে যায়। সে তখন যথেষ্ট ক্লান্ত, ঘুম ও ক্ষুধায় পেয়েছে। তার মা তাকে কিছু খাইয়ে দেয়। সে সজাগ হয়ে থাকার চেষ্টা করে, ঘুমাতে চায় না। কিন্তু শরীরে তার কুলালো না— ঘুমিয়ে পড়তে হলো।

সকালে ঘুম থেকে জেগে নাসিফ দেখে ট্রেন দ্রুত গতিতে চলছে। ততক্ষণে জানালায় চোখ রেখে বলে— ‘কী সবুজ মাঠ! সবুজ জঙ্গল!’ লোকজনের চলাচল চোখে পড়ে। মাটির রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়ি দেখে বলে— এটা কি গাড়ি?

—এটা গরু গাড়ি।

—ঢাকায় দেখি না কেন?

—গ্রামে মাটির রাস্তায় চলাচল করে। শহরে চলাচল করতে পারে না।

—কেন পারে না?

—শহরে গরু গাড়ি চলতে দেয় না।

—কেন দেয় না?

এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন, চুপ থাকতে হলো। এক সময় ট্রেনটা আমাদের জায়গামতো পৌঁছে গেল। তারপর ছোট বাহনে করে কয়েকটি ছোট নদী, খাল, ঝোপঝাড়, গাছগাছালিতে ভরা ছোট বনানী, সবুজ ধানখেত দেখতে দেখতে নিরাপদে তেঁতুলিয়ায় পৌঁছলাম।

সময়টা চৈত্রের শেষ দিক হলেও তেঁতুলিয়ার আবহাওয়া শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। ঠাণ্ডা বাতাস, রোদের তাপ নেই। রাতে চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমাতে হয়। কেননা ইতোমধ্যে কয়েকবার যথেষ্ট পরিমাণে বৃষ্টি হয়ে গেছে। শান্ত প্রকৃতি, গাছ গাছালিতে ভরা। কোনো কোলাহল নেই, ছোট পরিসরে পাকা রাস্তা থাকলেও যান চলাচল কম। লতাপাতা, ঝোপঝাড় সব মিলে সবুজ বনানী। পাখির অভয়ারণ্য বলা যায়। প্রচুর পাখির কলকাকলিতে মুখরিত । আম-কাঁঠালের গাছের সংখ্যাও অনেক। ঝরেপড়া মুকুল গাছতলার মাটি ঢেকে দিয়েছে। গাছে থোকায় থোকায় ছোট ছোট আম ঝুলে রয়েছে। গাছের নিচে ঝরেপড়া মুকুল ও আম গড়াগড়ি করছে।

নাসিফের নানা বাড়ি বেশ বড় পরিসরে। প্রশস্ত টিনের ঘরদোরসহ টানা বারান্দা। চারদিকে ঘর, মাঝে বেশ বড় উঠান। টিনের চালায় সশব্দে আম ঝরে গড়িয়ে পড়ে। ঘরে থাকতে হঠাৎ এ ধরনের শব্দে নাসিফ ভয় পায়। তার অহেতুক ভয় ভাঙানোর প্রয়োজন মনে করে তাকে নিয়ে উঠানে দাঁড়ালাম। টিনের চালার ওপর আমের ডাল বিস্তৃত। চালার ওপর চোখ রাখতে বলি। অল্প সময়ের মধ্যে একটি আম ঝরে টিনের চালা বেয়ে পড়তে দেখা গেল। এর রেশ কাটতে না কাটতে আরও একটি ঝরে পড়ল। দু’টি ঝরেপড়া আম চালা বেয়ে গড়িয়ে পড়তে দেখে খুব আনন্দ পেল এবং ভয় দূর হয়। ঘরের মধ্যে বা বারান্দায় খেলার সময় শব্দ হলে সঙ্গে সঙ্গে নাসিফ বলে ওঠে—‘ঐ দেখ আম পড়ল।’

শহরের এক চিলতে বারান্দায় বল গড়াগড়ি করে খেলে অভ্যস্ত। এখানে লম্বা বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করে বল খেলে মজায় পেয়ে বসেছে। ক্রমেই বারান্দা ছেড়ে উঠানে খেলা গড়াল। এত বড় পরিসরে বল খেলার সুযোগ সে পায়নি। ফলে যখন তখন খেলা আর খেলা। আমি যতক্ষণ বাসায় থাকি ততক্ষণ আমাকেই সঙ্গ দিতে হয়। কিন্তু আমি তার সাথে খেলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠি। খেলা বন্ধ করে বাইরে নিয়ে যাই। যেখানেই যাই না কেন সবসময়ে কথার ফুলঝুরি। কথায় কথায় ‘কেন’? রাস্তার ধারে একটু বসার ব্যবস্থা দেখে সেখানে বসলাম। আশপাশের কয়েকজন ছেলেমেয়ে নিজেদের মতো করে খেলা করছে। নাসিফ তাদের কাছে খেলা বা কথা বলার জন্য এগিয়ে যায়। সে শহরের ছেলে জুতা/ স্যান্ডেল ছাড়া বাইরে যায় না। কাপড়চোপড় ছাড়াও কথাবার্তায় পার্থক্য ধরা পড়ে সে শহরের ছেলে। সমবয়সী বা তার চেয়ে কিছুটা বড় ছেলেমেয়েদের সাথে কী ধরনের কথা বলতে হয় এখনো শেখেনি। তাদের খেলাধুলার সাথে পরিচিত নয়। ফলে নাসিফের কাছে অবাক লাগে তাদের খালি পা দেখে। কাছে গিয়ে বলে— ‘এই বেবি, খালি পায়ে কেন?’

সমবয়সীরা কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না। নাসিফের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। তাদের চুপচাপ থাকতে দেখে আবারো প্রশ্ন— ‘আমার সাথে কথা বলে না কেন?’

তারপরেও তারা চুপচাপ।

—‘আমি তোমাদের সাথে খেলা করব।’

স্বল্প পরিসরে তাদের ছোটাছুটি, এর পেছনে ওর পেছনে তাড়া করে হাসাহাসি বন্ধ হয়ে গেল। আমি কাছ থেকে তাদের গতিবিধি লক্ষ করছি। আমার কাছে ফিরে এসে বলে— ‘ওরা আমার সাথে খেলবে না কেন?’

আমি তাকে বলি— কাল থেকে খেলা করবে।

—আজকে খেলবে না কেন?

—তুমি তো বল আননি, কেমন করে খেলবে?

তারপর সে চুপ করে।

একদিন দুপুরবেলা নাসিফকে নিয়ে আম গাছের নিচে দাঁড়ালাম। শুকনো ঝরে পড়া মুকুলের ওপর পা রাখি। মুকুলগুলো মড়মড় করে শব্দ তুলে গুড়িয়ে গেল। এবারও নাসিফের প্রশ্ন— ‘তুমি খালি পায়ে কেন হাঁটছ?’

—আমার খুব মজা লাগছে, পায়ের নিচে সুড়সুড়ি লাগছে। তুমিও খালি পায়ে হাঁটো, সুড়সুড়ি লাগবে।

সে স্যান্ডেল খুলে হাঁটা শুরু করে এবং নরম কচি পায়ে সেটা অনুভব করে। বেশি করে সুড়সুড়ির আশায় ধুলার মধ্যে পা ঢুকিয়ে দেয়। সুড়সুড়ির পরিবর্তে ধুলা ওড়ানো শুরু করে বাড়তি আনন্দে মেতে ওঠে। এ খেলা থেকে তাকে বিরত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

চৈত্র মাস বিদায় নেওয়ার আগে পর পর দু’দিন সকালবেলায় প্রবল বৃষ্টি নামে। এ সময় নাসিফ ঘুমিয়ে ছিল। ঘুম থেকে উঠে দেখতে পায় উঠানের এক স্থানে পানি জমে রয়েছে। কিন্তু পানির রঙ ছিল ফিকে লাল। নানি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলে— ‘তুমি এখানে অনেক চা ফেলেছ কেন?’

তার কথা শুনে নানি হেসে অস্থির। টিনের চালায় জমে থাকা মুকুল বৃষ্টিতে ভিজে চায়ের মতো রঙ ধারণ করে নিচে পানি গড়িয়ে পড়েছে। কী উত্তর দেবেন ভেবে না পেয়ে সোজাসুজি বলেন— এগুলো বৃষ্টির পানি।

উত্তর মনের মতো না হলে নাসিফ অন্যকে যা বলে নানিকেও একই কথা— ‘তুমি উল্টো কথা বলছ।’

উঠানে জমে থাকা পানি সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য নানি জায়গা বুঝে মাটি আলগা করে দিতে ব্যস্ত। অন্যদিকে জমে থাকা পানিতে দাপাদাপি করার জন্য নাসিফ চিৎকার শুরু করে। ঠাণ্ডা পানিতে দাপাদাপি করতে গিয়ে সকালে পুরো শরীর ভিজিয়ে ফেলবে। ঠাণ্ডা লেগে যাওয়ার ভয় রয়েছে। সে জন্য তাকে নিচে নামতে দেওয়া হয় না। জমে থাকা পানি সরিয়ে দেবার জন্য তার নানি একটু মাটি আলগা করে দেয়। বারান্দা থেকে সে বুঝতে পারে পানি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। দেখে বলে— নানি, তুমি নদী বানালে?

—হ্যাঁ ভাই, নদী বানালাম!

—নদী যে অনেক বড় হয়। বাবার সাথে গিয়ে নদী দেখেছি।

—এটা ছোট নদী, কম পানি।

তেঁতুলিয়ার পরিবেশ সবসময় শ্যামলিমাময়। সবুজে শ্যামলে ভরপুর। লোকবসতি কম। তবে গাছপালার সংখ্যা অনেক। বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ। থোকায় থোকায় আম-কাঁঠাল ঝুলে রয়েছে। লিচু ও জাম দানা বেঁধেছে। কামরাঙা, জামরুল, গোলাপজাম ও অন্যান্য গাছে মুকুলে সয়লাব। ফলমূলের গাছ থাকলে পাখির আনাগোনা বেশি হয়। মধু মাস অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাস শুরু না হতেই বিভিন্ন পাখির কলকাকলিতে এখনই মুখর। পাখির কলতান সকাল থেকে রাত অবধি শোনা যায়। ফলে নাসিফের পাখি দেখা ও কিছু পাখি চেনার সুযোগ হয়। ঘরের ওপরের একটি বড় গাছে বেশ জোরে একটা পাখি ডেকে চলেছে। এ পাখির সাথে পরিচিত করার জন্য বলি, —তুমি কি ‘টু-টু’ ডাক শুনতে পাও? এটা কোকিলের ডাক। ইচ্ছা করলে তুমিও ‘টু-টু’ করে ডাকতে পারো।

চারিদিকে শান্ত পরিবেশ। কোকিল মশাই নাসিফের প্রতিউত্তর শুনতে পেয়ে আরও জোরে ‘টু-টু’ করে মাত করে ছাড়ে— ‘দেখ বাবা, কোকিল আমার ডাক শুনতে পেয়েছে।’ এই বলে আনন্দে নেচে ওঠে এবং নানি, মামি সকলকে সেটা বলা শুরু করে। তারপর থেকে কোকিলের ডাক তার মনে গেঁথে বসে। কেননা যখন তখন কোকিল ডেকে ওঠে। একদিন খুব সকালে নাসিফের ঘুম ভেঙে যায় এবং ‘টু-টু’ ডাক শুনতে পেয়ে। বলে— ‘দেখ আম্মু, কোকিল ডাকে।’

শুধু কোকিল কেন? কত ধরনের ছোট বড় পাখি গাছে গাছে মনের আনন্দে ডানা মেলে উড়ছে আর এ ডাল সে ডালে বসে কিচিরমিচির শব্দ তুলছে। কাছ থেকে নাসিফের এত পাখি দেখার সুযোগ হয়নি। সে শুধু কাক ও ‘কা-কা’ ডাকের সাথে পরিচিত। কেননা ঢাকার অলিগলিতে বা ছাদে কাক বেশি করে দেখতে পায়। কিন্তু গ্রামের এই নির্জন রাস্তায় ঘুঘু পাখি চরে বেড়াচ্ছে, কীটপতঙ্গ ও অন্যান্য খাবারের সন্ধান করছে। আমি তাকে ঘুঘু পাখির সাথে পরিচিত করে বলি, এ পাখি ‘ঘুঘুটি-ঘুঘুটি’ বলে ডাক দেয়। তুমিও এ ডাক শুনেছ। খুব ঘনঘন ঘুঘুটি ডাকটি শোনা যায়। আরও একটি ডাক খুব করে যখন তখন কানে দোলা দেয় ‘বউ কথা কও’। এ ডাকও তেঁতুলিয়ার আকাশ-বাতাসকে মুখরিত করে রাখে। রাতেও ‘বউ কথা কও’, এমনকি সকাল হওয়ার আগেই এ ডাক শোনা যায়। তবে ঘুঘু দেখার পর কোকিল ও অন্যান্য পাখি দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

এ রকম খোলামেলা পরিবেশ পেয়ে নাসিফ ঘরে থাকতে চায় না। জানালা দিয়ে তার বয়সী ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা করতে বা অলসভাবে বসে থাকা দেখতে পায়। বাইরে যাওয়ার জন্য ছটফট করে। বেশির ভাগ সময় আমাকেই সঙ্গ দিতে হয়। ঘর থেকে বাহির হয়েই গরু, ভেড়া, ছাগল, হাঁস, মুরগি চরে বেড়াতে দেখতে পায়। এ সবের সাথে তার পরিচয় রঙিন ছবির বইয়ের মাধ্যমে। ছাগল বা ছাগলছানার কাছে দৌড়ে যায় তাদের গায়ে হাত বোলাবার জন্য। কিন্তু পারে না, পালিয়ে যায়। তাদের পেছন পেছন নাসিফ ছুটতে ছুটতে বলে, ‘পালাও কেন? পালায় না, পালায় না।’ কিন্তু কোনো কাজ হয় না। আমার কাছে অভিযোগ দেয়, ‘তারা কেন পালিয়ে গেল।’

এ অবস্থা দেখে আমি তার হাতে গাছের পাতা ধরিয়ে বলি, দাঁড়িয়ে থাকো, তোমার কাছে আসবে। এতে কাজ হলো। ছাগলছানা নিকটে এসে পাতায় মুখ দিয়ে টান দিল, অমনি হাত থেকে ডালসহ পাতা ফসকে পড়ে গেল।

—‘বাবা, টান দিয়ে ডাল ফেলে দিল।’ ডালটি পুনরায় তার হাতে তুলে দিয়ে শক্ত করে ধরে থাকতে বলি। ছানা দু‘টি আবারো পাতায় কামড় দিয়ে জোরে টান দিলো এবং নাসিফ পড়ে গেল। কিন্তু ছানাগুলো তার পাশ ঘেঁষে ঘুরঘুর করছে ও পাতা চিবাচ্ছে। সে তখন ছানা দু’টোর গায়ে হাত বোলায়।

একদিন ভিন্ন রাস্তায় নদীর ধারে হাঁটাহাঁটি করার সময় এক দল রাজহাঁসের সঙ্গে দেখা পাওয়া গেল। রাজহাঁসের দলটি কচি কচি দুর্বা মুখে পুরছিল এবং একই সঙ্গে লম্বা গলা উঁচিয়ে একের পর এক ডাক দিতে থাকে। নাসিফ বইয়ে হাঁসের ছবি দেখেছে। ফলে সহজেই চিনতে পারে এগুলো হাঁস। সে পেছন থেকে হাঁসের দিকে দৌড়ে যায়। হাঁসগুলো গলা ছেড়ে সকলে ডাক দিয়ে পালাতে থাকে। দলের পেছনে দৌড়ায় আর বলে— ‘দাঁড়াও, পালায় না।’ হাঁসের সঙ্গে দৌড়ে পেরে ওঠে না। আমার কাছে ফিরে এসে বলে— ‘পালাল কেন?’ আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি— ‘একটু পরে আবার আসবে, তখন কাছে যাবে।’ সে আর কথা বাড়াল না।

সবুজ ঘাস মাড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম। একটু সামনে যেতেই ‘বাক বাকুম কুম’ শব্দ শোনা গেল।

—‘বাক বাকুম কুম’ শব্দ শুনতে পাও?

—এটা কীসের ডাক?

নাসিফ জানতে চায়। আমরা তাদের কাছাকাছি চলে এসেছি। এক ঝাঁক কবুতর কিছু মাটির ওপর এবং কিছু ঘরের চালায় মনের আনন্দে দাপাদাপি করতে ব্যস্ত। কোনো কোনোটি একটানা ডেকেও চলেছে। একবার অল্প দূরত্বে উড়ে এসে পুনরায় চালে বসে ‘বাক বাকুম কুম’ শব্দে মুখরিত করে তুলছে। কবুতর কোনোটা সাদা, কোনোটা ধূসর, কোনোটা খয়েরি রঙের। নাসিফের প্রথম কবুতর দেখা এবং একই সাথে কাছ থেকে ‘বাক বাকুম কুম’ ডাক শোনা। ‘কী সুন্দর, কী সুন্দর’ বলে সেও আনন্দে নেচে ওঠে। ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে যায়— কবুতর একটু উড়ে গিয়ে আবার বসে। সেখানে কিছু খাবার পড়ে ছিল। লুটোপুটি করে খাচ্ছে আর ডানা ঝাপটে মাতামাতি ও ডাকাডাকি করছে। আমি তাকে তাদের মতো করে ডাকতে বলি। প্রথম প্রথম বলতে জড়তা লাগে, পরে জড়তা কাটিয়ে বলতে থাকে— ‘বাক বাকুম কুম’।

প্রতি দিন বিকেলে নাসিফকে সাথে নিয়ে নিকটে বহমান মহানন্দা নদীর ধারে ঘুরতে যাই। নদীর পাড় থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায়। সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে লাল আভা আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। লাল আভার ওপর মেঘ ভেসে বেড়ায়। পাখিরা দল বেঁধে আপন আপন নীড়ে ফেরে। দিনের শেষ কাজ সেরে নদীতে গৃহবধূরা গোসল করে, কাপড় কাচে। লোকজন গোসল করে, হাত-মুখ ধয়, মেয়েরা গোসল শেষে কলসভর্তি পানি নিয়ে ঘরে ফেরে। এ সময় এটি মরা নদী, কোমর সমান ক্ষীণধারা প্রবাহিত, কিন্তু জায়গা বিশেষে কিছুটা বেশি পানি। একদিন পড়ন্ত বিকেলে এক ঝাঁক পানকৌড়ি উড়ে এসে কিছু স্বচ্ছ পানিতে এবং কিছু বালির ওপর বসে। কয়েকটা পানকৌড়ি পানির ওপর পাখা মেলে দাপাদাপি ও পানিতে ঢেউ তুলতে থাকে। অন্যরা পানিতে একের পর এক ডুব দিতে থাকে। নাসিফের দৃষ্টি সেদিকে— বাবা এগুলো কী পাখি?

—এগুলো পানকৌড়ি, পানিতে থাকতে ভালোবাসে। নদীর আশপাশে থাকে। নাসিফ দেখতে পায় কয়েকটা পানকৌড়ির ব্যস্ততা, কেউ ডুবসাঁতার দিয়ে অল্প দূরে আবারও ভেসে ওঠছে। টলটলে পানিতে তাদের ডুবসাঁতার পরিষ্কার দেখা যায়। পানিতে ভেসে বেড়ানো চোখে পড়ে। হঠাৎ করে পানকৌড়ির দল গা ঝাড়া দিয়ে উড়তে থাকে, ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরতে থাকে।

—ঐ দেখ বাবা, সবাই উড়ে গেল, আকাশে উড়ছে। আকাশে কিছুক্ষণ চক্কর দিয়ে পুনরায় ঝুপ করে পানিতে গা ভাসিয়ে দেয়।

—‘বাবা, আমি পানির কাছে যাব, পাখি দেখব, পানিতে দৌড়াব। আমাকে নিয়ে চল।’

নদীর ঢাল বেয়ে ঢেউখেলানো বালির ওপর দিয়ে হাঁটুসমান প্রবহমান পানির নিকট গেলাম। সে পানিতে নেমে দৌড়াদৌড়ি করতে চায়। পানিতে নামতে না দেওয়ার জন্য বলি— ঐ দেখ পানির মধ্যে পানকৌড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আমার কথায় কাজ হয়।

—পানিতে মুখ ঢুকিয়ে ওরা কী করছে? নাসিফ জানতে চায়।

—ওরা খাবার খুঁজছে।

—কী খাবার?

—ছোট বা বড় মাছের খোঁজ করছে।

—ওরা মাছ খায়? রান্না করবে না?

—ওরা রান্না-ছাড়া মাছ খায়। পানিতে ডুব দিয়ে মাছ খুঁজে বেড়ায় এবং পাওয়া মাত্র খেয়ে ফেলে।

মাঝে-মধ্যে কথা বা প্রশ্ন করলেও একদৃষ্টে পাখির দিকে চেয়ে থাকে। কাছ থেকে দেখা নদীর হাঁটু পানিতে কালো কালো পানকৌড়ির লুকোচুরি ও ঘনঘন ডুব দেওয়া নাসিফকে আকর্ষণ করে। সূর্য অনেক আগে বিদায় নিয়েছে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। পানকৌড়িরাও দল বেঁধে উড়ে গেল।

নাসিফ বলে— ‘চল, আমরাও ফিরে যাই।’

 

Read Previous

মুদ্রিত দুঃখের ধারাপাতে

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৫ম সংখ্যা (অক্টোবর-২০২৩)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *