অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

হাবিবুল্লাহ রাসেল -
পাতাবাহার

উত্তম আমার সহপাঠী ও সহকামরাবাসী। শিক্ষাজীবনের শেষ দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছে আমাদের। হঠাৎ একদিন উত্তমের কথায় অবাক হয়ে বললাম— তোর মাথা ঠিক আছে! এর ভবিষ্যৎ তুই বুঝতে পারছিস? উত্তম ওর কথায় অনড়— নাছরিনকে আমি ঠকাতে পারব না। উনুনের উত্তপ্ত বালিতে আমার কথার খই ফোটে। আর ও বারবার আমার কথার খইয়ে ঢেলে দেয় শীতল জল। ওর শেষ কথা— আমি ধর্ম দিয়ে নয়, ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে মূল্যায়ন করি।

আমি অবাক হলাম। যে উত্তম ধর্ম ছাড়া বোঝে না কিছু, তার কণ্ঠে মানবতার গান! এবার বুঝলাম আমরা শুধু গানই গেয়ে যাই— উত্তম বাস্তবে করে দেখায়। আমি উত্তমকে বুকে টেনে বললাম— সাবাস বন্ধু! সুখী হও।

২.

আইনজীবীর সামনে আমরা তিনজন। একবার তাকাই উত্তমের দিকে, একবার নাছরিনের দিকে। দু’জনের চোখেই শঙ্কা। নাছরিন বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসেছে, সে টাকায়ই বিয়ে হবে। উত্তম আইনজীবীর সাথে কাগজপত্র তৈরি করতে থাকে। আমি এই সুযোগে নাছরিনকে ডেকে বাইরে কিছুটা আড়ালে যাই। এটা ওটা কথা বলে কীভাবে উপস্থাপন করব বুঝতে না পারার ব্যর্থতা বুকের ভেতর যেন জজ সাহেবের হাতুড়ি পেটায়। বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে পানি খাই। ফের হাতুড়ি পেটানোর আগেই জিজ্ঞেস করি— যা করছ ভেবে করছ?

তীব্র গরমে নাছরিনের শরীর থেকে জল ঝরছিল। এবার ওর চোখ দিয়ে নেমে এল জল। বিব্রততা এবার আমায় পুরোপুরি ছেয়ে দিল। ও আমার বিব্রততা উপলব্ধি করে টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, আপনি আর বাধা দেবেন না ভাই। ওকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। আপনি অনেক কিছু জানেন না। আমাদের সম্পর্কটা চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে গেছে।

আমার চোখ কপালে উঠল। এই আগুনরোদ গরমে নাছরিনের চোখ দিয়ে আষাঢ় নামছে। উত্তমের ডাকে আমাদের উকিলের কাছে ফিরতে হলো।

অতঃপর আমরা আদালত প্রাঙ্গন থেকে যুদ্ধজয়ী সৈনিকের শঙ্কামাখা হাসি নিয়ে সোজা রাস্তায়। দুপুরের রোদ কৃষ্ণচূড়া ছুঁয়ে নাছরিনের শ্যামত্বকে বিবাহ-বিবাহ রঙ মেখে দেয়। আমি আমার আপত্তির কথা ভুলে যাই। ওরাও। মিষ্টান্ন খেতে খেতে দু’জনকে একসাথে বলি— জীবনে সুখী হও।

৩.

সাত বছর পর নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ডে উত্তমের সাথে দেখা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। দূর থেকেই চিনলাম ওকে। দ্রুত কাপ রেখে কাছে এগোই। হাত ধরে যে নারীকে বাসে তুলছে তার কপালে সিঁদুর। ভাবলাম— নাছরিন সিঁদুরও পরতে শিখেছে!

চোখ তুলে আর একবার তাকাই— এ তো নাছরিন নয়! আমার কণ্ঠ থেকে কেমন আছিস, কোথায় ছিলি, কোথায় আছিস, গন্তব্য কোথায় এর পরিবর্তে উচ্চারিত হলো— নাছরিন?

সঙ্গিনী কিছু বোঝার আগেই বাস থেকে নামল উত্তম। আমার হাত ধরে এক কর্নারে টেনে নিল, সব ফাঁস হয়ে যাবে এমন শঙ্কামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, আস্তে আস্তে— সব বলব তোকে। এখনই বাস ছেড়ে যাবে। এই নম্বরটি রাখ। কথা হবে।

ঝটপট একটি মোবাইল নম্বর লিখে দিল। আমার হাত ছেড়ে ও বাসে উঠল। আমি তাকিয়ে রইলাম। যদিও বাস ছাড়তে এখনো অনেক সময় বাকি।

৪.

বারবার ফোন করেও নম্বরটি খোলা পাইনি।

অতঃপর খুঁজে খুঁজে জানলাম— রাজধানীতে উঠে আবার বিয়ে করে উত্তম এখন ঘরজামাই। শশুর অঢেল অর্থের মালিক। নাছরিনের ঠিকানা শিকারপুর, এইটুকুই জানি। খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি— সন্ধান মেলেনি। হয়তো সন্ধান পাওয়ার মতো খোঁজও নেওয়া হয়নি। হয়তো সেও আবার বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। অতএব, এবার উত্তম-নাছরিনের গল্প মন থেকে মুছে ফেলি।

৫.

আরও এক বছর পর একদিন। বরিশাল হয়ে বাসে চড়ে ফরিদপুর যাচ্ছি। শিকারপুর যেতেই বাস থামল। কন্ডাক্টর জানাল টায়ার পাল্টাতে হবে। মিনিট দশের মধ্যে হয়ে যাবে। যাত্রীরা বিরক্তি নিয়ে একে একে বাস থেকে নামল। কেউ ছোট্ট দোকানের বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছে। কেউ চায়ের সাথে সিগারেট ফুঁকছে। কেউ কেউ নিষ্কাশনের তাড়নায় উপযুক্ত জায়গা খুঁজছে। নারী যাত্রীদের বিরক্তি চরমে। রোদ, গরম, বসার জায়গা না থাকা, বাচ্চাদের অস্থিরতা-কান্না-খাবার কেনার বায়না, সব মিলেমিশে তাদের দুর্ভোগ চূড়ায়।

আমি কিছুক্ষণ পায়চারি করে, বসার জায়গা না পেয়ে আর একটু সামনের দিকে এগোই। রাস্তার পাশে ধুলোর মাঠে চা খাওয়ার জন্য একটি টংঘর পেয়ে যাই। পত্রিকা দিয়ে ধুলো ঝেড়ে বেঞ্চের কর্নারে বসি। বসে বসে আরো দু’জন চা খাচ্ছে। বাসের যাত্রী কেউ নয়। দোকানির সাথে তাদের কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল স্থানীয়। এক একটি যানবাহন যায় আর বাতাসে নাচে ধুলো। পথের পাশের পাতাবাহারের পাতা আর সবুজ কিংবা লাল নেই, ধুলোর প্রচ্ছদ পরে হয়েছে মলিন। পাশের গ্যারেজ থেকে গান বাজছে— ‘ও আমার রসিয়া বন্ধু রে, তুমি কেন কোমরের বিছা হইলা না…’।

চায়ে চুমুক দিচ্ছি, দেখি ধুলোর মাঠ থেকে হেঁটে আসছে শরীরে জীর্ণপোশাক জড়ানো এক নারী। শরীর ও ছেঁড়া পোশাকে পড়েছে পাতাবাহারের মতো ধুলোর প্রচ্ছদ। বেঞ্চে বসা লোক দুটো ওকে তাড়াতে চাইল, লাঠিও হাঁকালো একবার, কিন্তু ও অনড়। হয়তো ভাবছে জীবনের দুর্বিপাকে, মাথায় বৃক্ষ ভেঙে পড়ার কাছে এই লাঠি নিতান্তই কঞ্চি ছাড়া কিছু নয়। আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। ধুলোর মধ্যে যে রোদ খেলে যায় তার কোনো আভা পড়ে না ওর চোখে। ও আমার দিকে নিষ্পলক তাকানো।

দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, কে ভাই?

বেঞ্চির একজন বলল, আমনেও মিয়া পাগল অইছেন, দেহেন না পাগলি?

আমি বিব্রতবোধ করলাম। তার চেয়েও কী যেন একটা কিছু আমার রক্তের মধ্যে বুদবুদ খেলতে লাগল। কী যেন একটা চেতনা আমায় অসাড় করে দিচ্ছে।

দোকানি চায়ের কাপে চামচ নাচাতে নাচাতে বলল, নাছরিন, নাছরিন পাগলি। ভালো আছিল, ওই আকাম ওকাম করলে যা অয়, একদিন বাচ্চা আইলো প্যাডে, গার্জিয়ানরা গোপন রাহার চেষ্টা করল। জোর কইর‌্যা প্যাট ফালাইল। পাপ কি আর গোপন থাহে। এখন পাগলি হইয়া পতে পতে ঘোরে।

নাছরিন আমার দিকেই তাকানো। আমি আবার ওর চোখের দিকে তাকালাম। আদালতপাড়ায় কৃষ্ণচূড়া ছুঁয়ে রোদ নেমে যে রঙ ছেয়েছিল চোখের পাতায়, এখন সেখানে কেবল ধোঁয়া আর ধুলো।

বাসটাও এতক্ষণে উত্তমের মতো টায়ার পাল্টে নিল। হর্ন বাজল ঘনঘন। যাত্রীরা উঠে পড়ল একে একে। ধোঁয়া ছেড়ে বাসটি আস্তে আস্তে চলতে লাগল। দু’একজন দৌড়ে এসে সিঁড়িতে উঠল। আমিও ইশারায় হাত নাড়ালাম। জোর পায়ে এগিয়ে সিঁড়িতে উঠলাম। ধুলো উড়ছে বাতাসে। পথের পাশে কী রঙের পাতাবাহার— সবুজ না লাল, একদম বোঝা যাচ্ছে না।

raselanuvab@gmail.com

 

+ posts

Read Previous

জলছবির প্রতিচ্ছবি

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৪র্থ সংখ্যা (এপ্রিল-২০২৩)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *