অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ৩০, ২০২৪
১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ৩০, ২০২৪
১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আশরাফ উদ্দীন আহ্‌মদ -
বিজলীর আকাশ

বিজলীকে অনেকটা সময় ধরে দেখে অন্যমনস্ক হয়ে যায় নোমান। ওর চোখ দুটো চমৎকার। আকাশের সব নীল যেন ছড়ানো। কালো দীঘল কেশ আর একহারা চেহারাখানা আর্কষণ করে বড় বেশি। তার চেয়ে বড় কথা বিজলী যেন সত্যিই একটা অদ্ভুত কিছু। যা হয়তো বলে বোঝানো যাবে না। আজ দুদিন হলো এই পাহাড় টিলার শহরে আসা। এখনো পরিপূর্ণ চেনাই হলো না। নোমান সময়-অসময়ে তাকিয়ে থাকে নির্বাক হয়ে। যেন এরচেয়ে আর কিছু দেখার নেই ওর। বিজলী যেন অকস্মাৎ ঝড়ে-পড়া বাজ। সত্যিই কি সে ওমন একটা কিছু।

বিজলীকে নিয়ে এভাবে পালিয়ে আসাটা উচিত-অনুচিত সে চিন্তা না করলেও হয়তো এভাবে না এলেও হতো। ওর বাবা গোঁড়া-গোবিন্দ মানুষ। কনজারভেটিভ পরিবারের মানুষগুলো হয়তো এমনই হয়। সবাইকে তৎক্ষণাৎ আপন করতে পারে না। একটা দ্বিধা কাজ করে হয়তো। নোমানকে পছন্দ করে কিনা তাও জানা হয়নি। প্রথম দেখাতে ওভাবে অনুমান করাও কঠিন। আর মা তো প্যারালাইসিস রোগী। সাত বছর যাবত শয্যাশায়ী। কথা বলতে পারে তবে স্পষ্ট নয়। বেশ কয়েকটা ভাই-বোন আছে, যে যার মতো জীবনযাপন করছে। এক ভাই সদ্য চাকরির খাতায় নাম লিখিয়েছে, বিজলী তো আজ ছয় বছর যাবত চাকরির ঘানি টেনে যাচ্ছে। নোমানের পাশের কামরায় ওর আসন।

মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানির এই কর্পোরেট বেঞ্চে দীর্ঘ সময় ধরে নোমান আছে। ওর হাতে অনেক ক্ষমতা আজ। নিজেকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছে সে। বিজলীকে ভালোবেসেছে বললে ভুল হবে, বিজলীই ভালোবাসার হিরণ্ময় পথ চিনিয়েছে ওকে। চৈত্রসংক্রান্তি বা শারদীয়া উৎসবে নোমান গিয়েছিল নিমন্ত্রণ পেয়ে বিজলীদের বাড়ি। বাড়ি গিয়ে মুগ্ধ না হয়ে পারেনি। সাজানো-গোছানো পরিবার। পরিপাটি করে রেখেছে সেকালের বাড়িঘর। বুনিয়াদির সাক্ষর রয়েছে বাড়ির আনাচেকানাচে। লোহার মোড়ানো সিঁড়ি দিয়ে বিশাল বারান্দায় উঠেই মনটা কেমন ভালো হয়ে যায়। প্রথমদিন কেবলই বিজলীকেই দেখছিল, গোলাপি একটা শাড়ি পরেছিল। মেয়েদের শাড়ি পরলে কেমন যেন পালটে যায় অবয়ব। বড় মোহনীয় লাগে। একসময় যখন ওর বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্ব হয়, মনটা একটু ভেঙে গেলেও নিজেকে সামলে নেয় নোমান। ভদ্রলোক নেহায়েতই গোবেচারা ধরনের, ধোপদুরস্ত একজন মানুষই বটে। সেকেলে মানুষেরা সচরাচর সবাইকে আপন করতে না পারলেও মনটা কিন্তু নারকেলের মতো। ওপরে যতই শক্ত থাকুক না কেনো ভেতরটা নরোম তুলতুলে। চিনতে ভুল হতেও পারে, তাই সব ভুল তো ভুল নাও হতে পারে।

—বাবা, ইনি আমার বস নোমান আসাদুল্লাহ খান।

—ওহো, বেশ বেশ…।

নোমান দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করতে চাইলে, ভদ্রলোক অকস্মাৎ বলে ওঠে, ঠিক আছে। অত বিচলিত হওয়ার দরকার নেই।

—বাবা ইনি আমার অফিস বস…।

—হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো শুনলাম। তা তুই যে বললি কে যেন স্বজাতের কে আসবে… যার সাথে তোর…

—বাবা ইনি নোমান আসাদুল্লাহ খান। ওর কথাই তোমাকে বলেছিলাম।

ভদ্রলোকের পায়ে যেন সাপ পরেছে এমন ভাব করে দূরে সরে দাঁড়ালেন। নোমান ঘটনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে স্থির হয়ে যায়। পরবর্তী নাটক কীভাবে মঞ্চস্থ হবে সে ভাবনায় সময় গোনে।

—তাহলে তুই আমাকে এর কথাই…

—হ্যাঁ বাবা…

—তোর সাহস নাকি দুঃসাহস বুঝতে পারছি না। আসলে কী বলতে চাইছিস আমাকে?

নোমান তারপর আর দাঁড়িয়ে থাকেনি। ঘরের ভেতরের মুখগুলো চারদিক থেকে তাকিয়ে থাকে। কারও মুখে কোনো রা নেই। বোবা পাথরের মতো দণ্ডায়মান যেন। সবাই হতভম্ব, কিন্তু কারও কিছু করার নেই এখন। বিজলীর কোনো কথা বা প্রতিবাদের মূল্য নেই। বুক ঠেলে একরাশ ঘৃণা বের হলেও কিছুই বলার নেই। সেদিন কিন্তু বিজলী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে এর জন্য বড় একটা ধাক্কা সামলাতে হবে পরিবারকে। নিজেকে অনেক কষ্টে বেঁধে রাখে। আজ তার সেদিনের কথা মনে হতেই একরকম জেদ চেপে বসে। নোমানকে জাপটে ধরে রাখতে তার ভারী ইচ্ছে হয়। এমন একটা মানুষকে পরিবার মেনে নেবে না। শুধু সংস্কার আর ধর্ম নিয়ে খেউখেউরের কারণে আজ মানুষ নিজেদের চোখে বার্ধক্যের চশমা পরে রয়েছে, ভালোমন্দ বিচার করবার বোধবুদ্ধি পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছে বেনোজলে।

বিজলী অনেক কিছু ভেবে আজ বড় ক্লান্ত যেন। তার রোজগারের টাকা সবার প্রয়োজন, সংসারের বাড়তি রোজগারের দিকে তাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে কিন্তু তার মতামতের কোনো মূল্য নেই। যেন সে সারাজীবন কলুর বলদের মতো খেটে যাবে। ভালো-মন্দের কোনো মূল্যায়ন হবে না। কারণ তুমি সংসারের বাড়তি একটা রোজগেরে একজন, তোমার কোনো মতামত থাকতে নেই। নারী জীবন নিয়ে এসেছ, এভাবেই থাকবে চিরটাকাল। ভালো লাগে না এসব আর। বিজলী নিজেকে একটু বাইরের হাওয়ায় খুলে-মেলে ধরতে চায়। বাইরের পৃথিবীটা ঝকঝকে চকচকে, সেখানে কোনো কালিমা নেই। শুধু মনের ভেতরে চাপ চাপ অন্ধকার। এত এত অন্ধকার আর কালিমা নিয়ে মানুষ বাঁচে কিভাবে বিজলী ভেবে পায় না।

—তুমি কি বাইরে থাকবে দাঁড়িয়ে…।

—বেশ লাগছে কিন্তু।

—তাহলে আমিও বাইরে থাকি।

—কী দরকার…।

—দরকার মানে? তুমি বাইরে থাকবে আর আমি রুমে বসে থাকব। এ কেমন কথা!

—না, থাক না।

—থাকবে কেন?

—আসলে তোমার কী হয়েছে বলো তো!

—কী হবে আবার।

—না মানে…।

—আমাকে লুকিয়ো না প্লিজ।

—তোমাকে লুকোনোর কী আছে আর!

তারপর অনেকটা সময় দুজনে নিশ্চুপ। মিষ্টি বাতাসে মন যেন দূরে কোথায় হারিয়ে যায়। বুকভরে শ্বাস নেয়। চোখের সামনে যে সমস্ত দৃশ্য সব যেন পটে আঁকা ছবি মনে হয়। কেন মন হারিয়ে যায়, আন্দাজ করা সহজ হয় এখানে আসলে। মনের কষ্ট বুকের জমাকৃত বেদনা সব নিমেষে কোথায় তলিয়ে যায়। মন একেবারে সতেজ তরতাজা হয়ে যায়।

—সেদিনের কথা খুউব মনে পড়ে…।

—কোনদিনের!

—আরে সেই দিনের, তোমাকে অপমান করে তাড়িয়ে…।

—ওভাবে তো ভাবেনি কখনো।

—তুমি মহৎ বলেই হয়তো।

—সমস্ত পরিবারের গুরুজনেরাই ব্যাপারটাকে ওভাবেই ট্যাঁকেল দেয়।

—তুমি এতোটা সহজ করে নিলে…।

—জীবনটাকে সহজ-সরল করে নিতে হয়।

—কিন্তু কঠিন পাথর কি গ’লে কখনো!

—হয়তো গ’লে না, তবুও মনকে শান্ত রাখতে হয়।

রাতটা চরচর করে বাড়ছে। আকাশে চাঁদের জ্যোৎস্নাময় আলোয় মন যেন হারিয়ে যেতে চায়। গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে করলেও কেমন একটা দ্বিধা লাগে। সামাজিকভাবে তাদের কোনোদিন বিয়ে হতো না। যদি না এভাবে পালিয়ে আসত, হয়তো কোনোকালেই তাদের পরিবার বিয়েটাকে মানতে পারত না। বিশেষ করে বিজলীর বাবা এখনো জীবিত। মেয়ের রোজগার সংসারে বড় রকমের ফ্যাক্টর। তার পেনশন-ছেলের চাকরি বা বাড়িভাড়া বাবদ যে টাকা আসে তাতে পরিবারটা এই আক্কারার বাজারে চলে যায়। বিজলীর প্রেম ভালোবাসা ইচ্ছের দামটা হয়তো কোনোদিন তাদের কাছে মূল্য পাবে না।

নোমান অনেকটা সময় নিশ্চুপ থেকে অকস্মাৎ বলে ওঠে, তোমার বাবা অনেক কষ্ট পেলেন।

—তো আমি কী করতে পারি?

—না মানে তিনি তো রক্ষণশীল একজন…।

—তো আমার অপরাধ…?

—হয়তো এভাবে আসাটা।

—আহা তোমার হলো কী বলো তো!

—আমি ঠিকই আছি।

—না মানে তুমি কবি নাকি দার্শনিক হয়ে যাচ্ছো বোঝা যাচ্ছে…।

—তাই নাকি!

সেদিনের পর থেকে নোমানের মধ্যে অন্যরকম প্রতিক্রিয়া হলেও তা সে কাউকেই বুঝতে দেয়নি। নিজের মনের মধ্যে ঢেকে রেখেছিল কিন্তু বিজলীর কথা শুনে একটা ধাক্কা লাগে। পুরোনো ক্ষতে কে যেন আঁচড় বসিয়ে দিল।

পরিবারের একজন রোজগেরে মানুষ যদি নিজের পছন্দের কারও সাথে চলে যায়, সেখানে পরিবারটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে বৈকি! কিন্তু একটা কতটা আর পরের বোঝা নিজের কাঁধে চেপে চলতে পারে! ভারবাহী গাধাও হয়তো একটা সময় হাঁপিয়ে ওঠে, সেখানে একজন বিজলী কতটা আর ধকল নিতে পারবে। তার ভেতরের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো মূল্য যেখানে নেই, সেখানে কেন পড়ে থাকবে সংসারের গুটিকয়েক মানুষের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। বিজলী সত্যিই সে চক্রাকারের ঘানি ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে, সংসারের কাছে অবশ্য সে এক অন্যরকম মেয়েতে পরিণত হয়েছে, কিন্তু তার ভালোবাসাকে অপমানিত হতে দেখে প্রতিবাদী হয়েছে, নীরব থেকেও মোক্ষম আঘাত দিয়েছে। নোমান বোঝে তার জন্যই মেয়েটির এমন স্বরূপ।

মানুষ তখনই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, যখন সে বোঝে তার পাশে ভালোবাসার কিছু মানুষ আছে। নোমানকে সেই কাছের এবং ভালোবাসার মানুষ ভাবতেই পারে। আজ যার হাত ধরে জীবনের একটা বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে, এখানে কতটা ভুল বা লাভ তা তো বিচার করা যায় না। মানুষ যে প্রতিনিয়ত একটা গোলকধাঁধার মধ্যে ঘূর্ণায়মান তা অনেকটা আন্দাজ করা যায়। মানুষ পাহাড়-নদী বা সমতল ভালোবাসে, এই ভালোবাসার মধ্যেই তার জীবনের মূল বীজ রোপিত থাকে, হয়তো সে জানে অথবা কিছুই সে জানে না। চিরটাকাল তার অজানাই রয়ে যায় জীবনের মানেটা। বিজলী দেখলে বর্ষার মেঘের মতো মনে হয়, তার মধ্যে একটা অন্ধকার-অন্ধকার ভাব থাকলেও থাকতে পারে, সবাই সেটা দেখতে নাও পারে, কিন্তু নোমান সেটা বেশ অনুমান করতে পারে। কট্টর রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হলেও ওর মধ্যে উদারতা স্পষ্ট। জীবনটাকে বাঁধা-ধরা ছকের মধ্যে রেখে কষ্ট পেতে চায় না, হয়তো অনেক বেশি কষ্ট পেতে পেতে আজ একটু প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে।

নোমান যতটুকু চিনেছে বিজলীকে, তা যথেষ্ট। এর বেশি আর কী চিনবে! নোমান ভালোবাসে এবং ওর পরিবার মেনে নিয়েছে, এটা কি বিজলীর জন্য যথেষ্ট নয়! তারপরও বিজলী ভেবে ব্যাকুল হয়, কী চমৎকার করে নোমানের পরিবার সমস্ত কিছু মানিয়ে নিল। এতটুকু ফাঁক রাখেনি। অথচ তার পরিবার কি কখনো মানতে পারবে? একটা কিন্তু মনের ভেতর রয়ে গেল। হয়তো কোনোকালেই ওভাবে আর ফিরে যাওয়া হবে না, আপন লোকগুলোর কাছে। ওরা কি আর আগের মতো ওর টাকার ওপর নির্ভর করে থাকবে! অনেক না বলা কথা মনের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসে, তারপর আবার ওপর নির্ভর করে থাকবে! অনেক না বলা কথা মনের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসে, তারপর আবার কোথায় মিলিয়ে যায়। বিজলী ভেবে পায় না, কোথা থেকে ভাবনাগুলো আসে আবার কোথায় হাওয়া হয়ে যায়।

টিলা-পাহাড় নীল আকাশ সব সবই সুন্দর, কিন্তু নীলকষ্ট কি সুন্দর হয়! মানুষের জীবনে কত কত কষ্ট থাকে, কত কত স্বপ্ন ভালোবাসা থাকে, তার ভেতর থাকে চাপ চাপ দুঃখ। অনেক না বলা কথাগুলো একটা সময় নীল কষ্ট হয়ে আকাশে উড়ে বেড়ায়। ঘুরে বেড়ায়। তখন পৃথিবীর কোনো সুখ ভালো লাগে না। ভালো লাগা মরে যায়। মন যখন মরে যায়, ভালোলাগা কীভাবে বেঁচে থাকে? ভালোলাগা ভালোবাসা কখনো একই জায়গায় থাকে না।

অনেক রাতে রুমে ফিরে দেখে নোমান না ঘুমিয়ে একটা ইংরেজি ম্যাগাজিন পড়ছে। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বিজলী নিজেকে হারিয়ে ফেলে। চমৎকার একটা মানুষ। কতো বড় মন ওর। নীল আকাশের মতো বিশাল মনের চৌহদ্দিজুড়ে ভালোবাসার রৌদ্দ ঝলমল করছে, সেখানে দাঁড়িয়ে দূরের প্রজাপতির দুষ্টু-মিষ্টি খেলা দেখতে বেশ লাগে। বিজলী এখন আকাশের খুবই কাছাকাছি। যেন সে দু’ হাতে আকাশটাকে ছুঁয়ে আছে। বরফের কুচির মতো আকাশের জ্যোৎস্না নিয়ে খেলতে বড় সাধ হয়। তখনো নোমান দূরদ্বীপ। দারুচিনি দ্বীপের কোনো ক্লান্ত পথিক। নাকি অতিথি পাখি এসে বসত গড়েছে কাঠঠোকরার কোঠরে।

 

Read Previous

মুদ্রিত দুঃখের ধারাপাতে

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৫ম সংখ্যা (অক্টোবর-২০২৩)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *