অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

শামীম আহমেদ -
মকারি

‘শালার তো বিড়ালের জান।’

ভিসেরা রিপোর্ট হালহকিকত যা বলেছে, তাতে কোনো ধাক্কা নেই। বিষক্রিয়া বা অন্য কোনো আঘাতজনিত কারণ দায়ী না হলেও, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছে এবং এই রক্তক্ষরণ ইন্টার্নাল। ফিজিক্যালি কিছু গভীর-অগভীর আঁচড় ও দংশন দাগের আলামত পাওয়া গেছে। ভিক্টিমের পোশাকে সিমেনের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে ফরেনসিক টেস্টে। রিপোর্ট জমা পড়ায় কর্তারা নড়েছেন। অর্ধগলিত মুর্দাকে আবারও গোর থেকে ওঠানো হবে কিনা, কেসটা থানা থেকে সিআইডি না হোমিসাইডে যাবে তা উপর মহলের সিদ্ধান্তের বিষয়। আইন তো বসে থাকতে পারে না। ক্রাইমসিন এলাকার আওতাধীন থানার কার্যক্রমে গরমাগরমি ব্যস্ততা ও ধরপাকড় ধারাবাহিক চলমান। কিছু ত্যাড়াব্যাঁকা প্রশ্ন ও কোণঠাসা মানুষ নিয়ে রিহার্সেল চলছে।

এমন পলকা-হ্যাংলাদেহী লোকটা যে এত মার হজম করতে পারে, তা কেউ বিশ্বাস করবে না। পুলিশকর্তার চোখাচোখা গালাগাল ও মন্তব্যে বাদশার কীইবা বলার বা ভাবার আছে! নাম বাদশা হলেও সে এখন নামের খোলসে পরাজিত সৈনিকের ভূমিকায়। সে শুধু ঘোলাটে চোখ মেলে ইতিউতি তাকায়। বউটা তো দিনের পর দিন অকথা কুকথার সাথে শারীরিক অসোহাগ নির্যাতনে নার্ভগুলো খুঁটির মতো শক্তপোক্ত করে দিয়ে গেছে।

‘না, স্যার, এই শালা বোধহয় বিলাইয়ের গোস্ত খাইছে কোনোদিন। তা না হলে এতো মার সহ্য করে ক্যামনে।’

বয়েসী হাবিলদার আরও একটু মরিচগোলা জল ক্ষতে ঢেলে দেয়। বাদশা মেঝের ওপরে থুবু হয়ে বসে হাঁপরের মতো হাঁপায়। তার মাথায় তাবত দুনিয়া এ মুহূর্তে জটলা করে আসে। তবদালাগা কানটা ভোঁ ভোঁ করে। সে ঘটনা পরম্পরা মেলাতে টাল খায়। কোনোদিন থানার চৌহদ্দি না মাড়ানো বাদশা খুন আর ধর্ষণের সন্দেহে মার খাচ্ছে। এরা কি তার ইতিহাস জানে? নাকি তাদের জানানো উচিত? বাদশার ভোঁ ভোঁ করা মাথা বুঝতে পারে না।

‘এ ব্যাটা এখনো স্বীকার কর। তাইলে তোর শাস্তি কম হবে।’

ঘাড়ে-গর্দানে আবলুস কাঠের মতো রঙের পোঁচমারা সাব-ইন্সপেক্টর যথেষ্ট শুদ্ধ ও দরদমাখা সমাধান দেখিয়ে দেয়। সন্দেহজনক আটক ব্যক্তিকে নিশ্চয়ই ‘তুই’ করে বলা যায়। আর যদি নিম্ন পেশাজীবী হয় তাহলে তো কথাই নেই। বয়স এখানে দেয়াল তোলে না।

‘এমন পটকা শরীরে অমন তাগড়া মেয়েটাকে ক্যামনে ধর্ষণ করলি?’ গলার আওয়াজ উচিত গম্ভীর করে কর্তা জিজ্ঞাসা করতেই হাবিলদার শুধরে দেয়। অফিসার যে বেখেয়ালে অনুচিত শব্দ ব্যবহার করছেন তা খেয়াল করে হাবিলদার গলা খাঁকরে ওঠে।

‘স্যার, এইটা তো গ্যাং রেপ।’

উচ্চস্তরের গাম্ভীর্য বিকরণ শেষে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। এই রেপ সম্পর্কিত কেসগুলোতে সে বরাবরই কোণঠাসা অবস্থায় থাকে। প্রায়শই অনেক কুকুর ও কেউটেদের সাথে বেমক্কা ফোনালাপ হয়ে যায়। মিনমিনিয়ে জি, আচ্ছা, ঠিক আছে— ছাড়া আর বিড়ালের মতো মিঁউ মিঁউ ছাড়া কিছুই বলার থাকে না। বাইরে কুয়াশানামা নভেম্বর, জানালা দিয়ে ফিকে জোছনার সাথে হিম ধাক্কা আসে। বাদশার শুঁটকো শরীরে কাঁপন নামে। মারের প্রকোপে না ঠাণ্ডায় বোঝা যায় না। অসহায় বাদশা তেড়ে কেঁদে ওঠে, ‘আমি খুন করিনি, স্যার।’ বলেই সে পরবর্তী মার গায়ে প্রতিবাদহীন গ্রহণ করার প্রস্তুতি নেয়। জোর করে কাঁপুনি থামিয়ে গা শক্ত করে ফেলে। অবশ্যম্ভাবী মার ফিরে না আসায় সে স্নায়ুর বাঁধন ঢিলা করে। কোন ফাঁকতালে বড় সাইজের একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় তা টের পায় না।

‘তা হলে কে করছে, তার নাম ক? ধর্ষণ তো করছিস? বাড়ির কে কে তোরা জড়িত?’

‘আমি কিছুই জানি না, আমি কিছুই করিনি স্যার।’

কর্তা এবার ক্ষেপে যাওয়ার বদলে পিঠখাড়া করে বসে। মনে হয় হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি প্রকাশ পায় এতে। লদলদে ভুঁড়িটা টানটান হয়ে সামনে ঝুলে আসে। হয়তো দারোয়ানজীবীর শুদ্ধ ভাষার কথনে কিঞ্চিত ভিমরি খায়। তার স্থুল দেহের পীড়নে কাঠের চেয়ারটা খেঁকিয়ে ওঠে। তাল সামলে এর সাথে পাল্লা দিয়ে বেমক্কা খেঁকিয়ে ওঠে অফিসার, ‘এই… এরে উল্টা ঝোলা।’

এবার বাদশার মুখ কালো করে ঝপ করে ভয় নেমে আসে, চোখে হাভাতে একটা ছবি ভেসে ওঠে। ঘাড়ে-গর্দানে সাব-অফিসার এগিয়ে এলে বাদশা ভেউ ভেউ কান্না জুড়ে দেয়। কাঁপা কাঁপা হাত দুইখান তুলে হাহাকারের সুরে বলে, ‘আমার দ্বারা ধর্ষণ করা সম্ভব না স্যার।’

মানুষের চোখে কান্না দেখার পরও আবেগী না হওয়ার বা কথা বলার অভ্যস্ততার কৌশল আইনের লোকের নিজের অজ্ঞাতেই হয়ে যায়। সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করতে গিয়ে মাঝপথে থামে অফিসার। তিরিক্কি মেজাজটা ভাষায় রূপান্তর করে আবার খেঁকায়।

‘কী? শালা তুই কি সাধু-সন্ন্যাসী নাকি?’

বাদশা মিইয়ে আসে, সাব-অফিসার থেমে যায়। অফিসারের চোখে রাগ এনার্জি লাইটের প্রতিফলিত আলোয় ধকধক করে জ্বলে। বাদশার মনে হয় এবার তাকে গোমোর খোলসা করতেই হবে। দীর্ঘদিন আগলানো জ্বালাময় গোমোর। আহা রে!

এই সময় জানালায় বাইরে ফিকে কুয়াশা উঁকি দেয়। তিনজন পুলিশের সামনে কুকুর মার খাওয়া, ঘা খাওয়া বাদশা তাদের খানিক স্থবির করে দিয়ে তিক্ত স্মৃতিতে ফেরত যায়। মাঝখানে অনেক দিনের শূন্যতা। তার সেই স্মৃতিতে শুধু কাঁটার বহর। অথচ সে দীর্ঘদিনের চেষ্টায় ভুলে থাকার কৌশল রপ্ত করেছিল, ভুলে ছিল। সে কতকাল আগেকার কথা যা শুনতে আর বলতে বাদশার এখন আর দুঃখ হয় না। তবে আজকের মতো হীনতার তীব্রতা সে জীবনে অনেকদিন পর পেল। অজীর্ণের বমির মতো সে উগড়ে দেওয়ার আগে ছাড়া ছাড়া ভাবে ভেবে নেয়।

‘হামার গাওত হাত না দেন, তোমা মোর ধম্মের বাপ।’

বিয়ে করা বউ যখন প্রথম রাতেই সাপের মতো পা পেঁচিয়ে হাউমাউ বলে উঠেছিল তখনো বাদশা মাথার টোপরটা খুলতে পারেনি। সে ভিমরি খেয়ে যায়। শুনেছিল হবু বউয়ের আগে লাইন ছিল, কিন্তু মাথা খারাপ ছিল বা আছে তা তো জানা হয়নি। বেড়ার ফাঁকে ইয়ার-দোস্তরা কান লাগিয়ে আছে, অনুরোধ করেছে যাতে আজ রাতে বিছানা বাপ-দাদার আমলের দাঁত নড়বড়ে চকির উপরেই থাকে। হাসাহাসির শব্দ আসছে, তার মানে এরা কথাটা শুনেছে। নতুন বউয়ের কথাটা যতটা না চিন্তায় ফেলে, দোস্তদের হাসির ফোয়ারা ততোধিক চিন্তায় ফেলে। শালারা বড় বজ্জাত, তাকে বেকায়দায় পেয়েছে। অজ গাঁ, পরের দিন সকালে ইচ্ছে করে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে। সবাই মনে করুক সারারাত বেচারার ঘুম হয়নি। কিন্তু মানুষের কানাঘুষা তার উপস্থিতিতে থেমে যায় দেখে তার সন্দেহ বাড়ে। এবং বিকেল গড়াতে না গড়াতেই নতুন বউ উপাধি পেয়ে যায়। বড়দের মুখ আটকে থাকলেও বাচ্চা মুখ ফসকে বের হয়ে আসে ‘বাপভাতারি’। ঘটনা খোলাসা হতে সময় লাগেনি। বাদশার কালো মুখ দেখে অভিভাবকেরা এক হয়। ঘরোয়া আলাপে শ্বশুর নত মাথায় ক্ষমার সাথে সময় চেয়ে নেয়। বাপ মায়ের সাথে শ্বশুর গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করে চলে যাওয়ার পর দিন কয়েক বাদে আবার হানা দেয়। বশীকরণ টোটকা বাদশাও মেনে নেয়। কারণ বউ সুন্দরী আর যৌতুকের। বশীকরণ কাজ করে। সপ্তাহ পেরোনোর আগেই বউ বশ মানে। যদিও ইয়ার-দোস্তরা সহজে ক্ষান্ত হয়নি, বশ মানেনি।

‘কিন্তু…।’ বাদশা থেমে সবার উৎসুক মুখের দিকে তাকায়। এমন নয় যে, সে প্রতিক্রিয়া দেখতে চাচ্ছে। আপাতত মারটা আটকাতে পারলেই সে খুশি। অফিসার একটু নড়ে বসে। তাতেই বাদশার বুক কেঁপে যায়।

‘কিন্তু কী?’

‘স্যার, পানি খাব…।’

‘পানি দেও।’ হাবিলদারের দিকে চোখ মেলে বাক্যটা বলে ফের চোখটা বাদশার দিকে ফেরায় কর্তা, ‘তারপর কী! তোর কাহিনী শোনার সময় আছে?’ ফলে থরহরিকম্প বাদশা দ্বিতীয়বার ওগলানো শুরু করে।

বাবার চালের মিলে নব্য বিবাহিত বড়ছেলের তদারকি শুরু হয়। এসময় গ্রামে পল্লী বিদ্যুতের লাইন আসে। পুরাতন শ্যালো মেশিনের জায়গায় বিদ্যুতের মোটর লাগে। বেদম ঘোরে। ঘটরঘটর শব্দ থিতানো মটরের শব্দে প্রতিস্থাপন হয়। শ্যালো প্যাডেলের কষ্ট নাই, সুইচ মারলেই কাম। বউটা মুখ বুজে সঙ্গ দেয়। টোটকা প্রতিক্রিয়ায় বউয়ের বোবা আদল দেখে সে আর কখনো ভাবেনি কারও মনের থই পাওয়া আসলে প্রেম আরাধনার বিষয়। ভাবতেও চায়নি।

‘একদিন কারেন্টের তার ছিঁড়া…।’

‘কী হলো?’ এই আগ্রহী প্রশ্নটা বাদশা আশা করলেও কারো মুখ দিয়ে বের হলো না দেখে সে কাহিনী টেনে নিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে হাবিলদার মুখ খোলে।

‘বউয়ের গায়ে পড়ল, আর তোর বউ মরল?’ লোকগুলো সিরিয়াসলি ঘটনার লাইন বানিয়ে বেহুদা মজা করে।

‘না স্যার, আমি আগানু ধরার জন্যে।’

‘আর তোকও কারেন্ট ধরল।’

এই সময়ে বাদশার মুখে যে কষ্ট নেমে আসে, তা যেন ত্রিমাত্রিক আকার পায়। চোখে বিষণ্নতা ঝিলিক দেয়। সে নিজেও বোঝে না আজকে বলতে গিয়ে এত কষ্ট পাচ্ছে কেন? অফিসারের ঝানু চোখ বুঝে ফেলে এই লোক সত্য বলছে এবং জীবনের বড় কোনো কষ্টের স্মৃতি এই মুহূর্তে তাকে ফালি ফালি করছে। কিন্তু ইমোশনাল হয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায় না। দোষী শনাক্ত করা যায় না।

‘মেশিন চালু আছিল, বেল্টের সাথে লুঙ্গি আটকে গেল। একটা চিল্লান মারলাম। আর কিছু মনে নাই। এই দেখেন স্যার, পেটের ম্যালখানি চামড়া নাই। তলপেট আর উরুর চামড়া একই রকম।’ বাদশা পড়নের চটা গ্যাবার্ডিনটা নাভির নিচে হালকা নামিয়ে এবং শার্টের প্রান্ত পুরোটা উজিয়ে দেখায়। আলোছায়ায় তবুও কোঁচকানো চামড়ার ভাঁজগুলো সবার নজরে পড়ে।

‘নে হইছে, গল্প কইরা স্যারকে ইমোশনাল করিস না। আগুনে পুড়ছে না কারেন্টে আমরা কি দেখবার গেছি? ব্যাটা এইটার সাথে তুই ধর্ষণ করিসনি তার সম্পর্ক কী? গল্প বাদ দে। আরও তিনজন আছে।’

কর্তা এবারে নীরব থাকেন। তার সিগারেটের আগুন আঙ্গুল ছুঁই ছুঁই। মনে হয় কিছু ভাবেন, না হলে ক্লান্তিতে ঝিমান। তার সাড়া না পেয়ে বাদশা তৃতীয়বার উগড়ে দেয়।

‘বাড়ি ফিরতে তিন মাস সময় লাগল। আব্বা রাইস মিলটা বেইচা দিল। আমি স্যার লেখাপড়া জানি। সুস্থ হয়ে স্টকের ব্যবসায় নামব আব্বা ঠিক কইরা রাখল। বাড়ি ফেরার গোনা গুনতি নয়দিন পর বউ জানাল, ‘তোর সংসার আর করিম না’। আমি আর আপত্তি করিনি। এইটার জন্যে মনের প্রস্তুতি আপনাআপনিই হইছিল, অবাক হইনি। বাড়ির লোকজনেরও আপত্তির কিছু আছিল না। এরপর আমিও গ্রাম ছাড়ি। ঠিকানা ছাড়া, এক কাপড়ে। মানুষের কথার বাণ গায়ে লাগার আগেই। ঐ জীবনটা আমার এই জীবন থাইকা ল্যাপামোছা।’

‘ব্যাটা, লাইনে আয়।’

অফিসার কথা চিবায়, তবু ব্যাটা এবার সহজে লাইনে আসতে চায় না। দোনামোনা করে। কিছু সময়ের জন্য সবাই নীরব হয়ে পরে। বাদশা জানে এই নীরবতার প্রতিটি সেকেন্ডের দৈর্ঘ্য তার কাছে পরিমাপহীন। সে আর সময় নেয় না। দুখী চেহারা করে সবাইকে একবার দেখে নিয়ে, অনেকদিন যে কথা সে মুখে আনেনি, সে কথা নিজ মুখে তাকে বাধ্য বালকের ন্যায় বলতে হয়।

‘স্যার…, আমার… অণ্ডকোষ থেঁতলে গেছিল। আমার পুরুষত্ব নাই।’

এবং সবাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই অথবা অবাক হওয়ার সুযোগ না দিয়ে বাদশা অনিচ্ছায় দৃশ্যটি একটু বেশি নাটকীয় বানিয়ে হুট করে প্যান্টটা খুলে ছেড়ে দেয়।

বাদশা অন্ধকারে শরীর মিশিয়ে কুঁকড়ে বসে আছে। তার মনে এসময় হয়তো দেয়ালে মিশে যাওয়ার খেয়াল জাগছে। পাশের রুম থেকে চ্যাংড়া ড্রাইভারের হাউমাউ শোনা যায়। তার মধ্যে ভয়ঙ্কর উদাসীনতা চেপে বসে। দীর্ঘদিন পাহারাদারি করা বাড়িটার কথা মনে হলে ভয় করে। বাড়ির মালিকের মাঝরাতে গেট খুলে রাখার নির্দেশের কথা মনে হয়। হঠাৎ সেই রাতেই তাকে ছুটি ও অগ্রিম বেতন দিয়ে দীর্ঘদিন পর বাড়িতে যেতে বলার কথা মনে হয়। এরা কি কেউ সেটা জানে না? সে কি বোকা? উঁহু, এতটা না। তার ভাবনায় ছেদরেখা টেনে কেউ অন্ধকারের বিপরীতে এসে দাঁড়ায়।

‘তাহলে তুই পালায় যাসনি? মালিক তো কইছে তুই পালাইছিস।’

‘না তো! ছুটি দিছিল।’

‘তাইলে যাসনি ক্যান?’

‘মালিকের সাথে তার শালীর সম্পর্ক ওই বাড়ির সবাই জানে। মালিকের সাথে ম্যাডামের প্রায়ই ঝগড়া কথা শোনা যাইত।’ বাদশা হঠাৎ আলাপের মোড় ঘুড়িয়ে ফেলে।

‘চুপ থাক। তুই চলে যা, স্যার তোক ছাইড়া দিছে।’

এত তাড়াতাড়ি মুক্তি হলেও তাকে দাম দিতে হলো চড়া। এটা সে ছাড়া আর কেউ হয়তো এখানকার অনুধাবন করবে না।

‘তাইলে আমার সাথে এইডা কী হলো?’

বাদশার গলায় কড়া উষ্মা বের হয়। হাবিলদার উত্তর হাতড়ায়। লোকটাকে এত মারার পর এবং তার তিতকুটে জীবনী জানার পর এ-বেলা তার মনে হয় দরদ বের হয়ে আসে। কাচুমাচু করে হাতড়ে পাওয়া শব্দগুলো উচ্চারণ করে, ‘মনে কর এইডা একটা মকারি বাবা, মস্করা।’

বাদশা ঘোলাটে মাথা নিয়ে, উঠে দাঁড়ায়। তার মুখ যেন একটা প্রশ্নচিহ্ন। হাবিলদার সেলের দরজা মেলে ধরে। তার মানুষী দীর্ঘশ্বাসটা বাদশা খেয়াল করে। ফলে একটু থমকায়। তার চোখে নতুন প্রশ্নচিহ্ন খেয়াল করলেও হাবিলদার মাথা ঘুরিয়ে নেয়। তবুও বাদশা জিজ্ঞাসা করে।

‘সত্যটা কি মানুষে জানবি চাচা? আমারটার মতো খোলাসা হবি? দেন একটা সিগারেট দেন খাই।’

উত্তরের আশা না করে, পুলিশের কাছ থেকে সিগারেট চাওয়ার সাহস প্রদর্শন করে এবং অনেকদিন পর লুপ্ত পৌরুষের অহং অথবা সুড়সুড়ি অনুভব করে বাদশা হাবিলদারের দিকে হাত পেতে সবজান্তার মতো অবজ্ঞার হাসি হাসে।

শামীম আহমেদ : ঊর্ধ্বতন শিল্পনির্দেশক, বাংলাদেশ টেলিভিশন

 

+ posts

Read Previous

জলছবির প্রতিচ্ছবি

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৪র্থ সংখ্যা (এপ্রিল-২০২৩)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *