অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৩, ২০২৪
২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৩, ২০২৪
২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাঈদ কামরুল -
মেহবুবা

E:\Anupranon Antorjal\Anupranon Antorjal_5th Issue\Illustration_Antorjal 5\Part_1\Antorjal 5th Issue- Alonkoron, Part-1\Choto Golpo-22\choto golpo 14.jpg

হাফিজ শ্বশুরালয়ের দোতলার খোলা ব্যালকনিতে আবছা আলোয় মেহবুবার লেখা একখানা চিঠি হাতে গভীর রাতে দাঁড়িয়ে আছে আর ভাবছে। আমার জন্য এতদিন পরও কেউ আত্মহত্যা করতে পারে! তা আমার জানা ছিল না। কিন্তু এই আত্মহত্যার জন্য কোথায় সে দায়ী! কীভাবে সে দায়ী! কীভাবে সে অপরাধী! এর জন্য সে নিজেকে কোনোভাবেই অপরাধী মনে করতে পারছে না।

না, কোনোভাবেই না!

যাকে সে কোনোদিন ভালোইবাসেনি, ভালোবাসার কথা কখনো কোনোদিন জানতও না, তবে সে আমার জন্য মরতে যাবে কেন? সে মোটেও মেলাতে পারছে না, কিছুই মেলাতে পারছে না। মেহবুবার ডাইরির ভেতরে পাওয়া চিঠিটা পড়ে সে খুবই মর্মাহত হলো। আজ সেই কথাগুলো তার খুবই মনে পড়তে লাগল। কেউ যদি বাঁচতে চায় আমরা তাকে নানাভাবে বাঁচাতে পারি। কিন্তু কেউ যদি মরতে চায় আমরা তাকে কোনোভাবেই বাঁচাতে পারি না। একদিন না একদিন সে মরবেই, যে কোনোভাবে মরবেই। কথাগুলো ভেবে মনের অজান্তেই উদগত অশ্রু কপোল বেয়ে মেঝেতে পড়ে যেতেই সে সংবিত ফিরে পেল।

হাফিজুর রহমান গত দুই মাস হলো দ্বিতীয় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে সদ্য প্রয়াত মেহবুবার বড় বোন মাহফুজার সাথে। মাহফুজারও বছরখানেক আগে বিয়ে হয়েছিল। বনিবনা হয়নি বলে কয়েক মাস থাকার পর মেয়েপক্ষই আলাদা হয়ে গেছে।

হাফিজুর লেখাপড়া শেষ করে সরকারি চাকরিরত অবস্থায় বিয়ে করেছিল। পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে সে এক সন্তানের বাবা। তার স্ত্রী ও তিন বছরের শিশু সন্তানসহ সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে স্ত্রী মারা যায়। সৌভাগ্যক্রমে সন্তানটি বেঁচে যায়। তা প্রায় ছয় মাস আগের কথা। তারপর হাফিজ সহজে দ্বিতীয় বিয়ে করতে রাজি হয়নি। উভয় পরিবারের অনুরোধে এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে শেষপর্যন্ত রাজি হয়।

মাহফুজা একই গ্রামেরই মেয়ে। এখনো বেশ সুন্দরী, কলেজে পড়ে। পরিবারের অবস্থাও বেশ স্বচ্ছল। বাবা ইউরোপীয় কোনো এক দেশের নাগরিক। মোটা টাকা রোজগার করেন প্রতি মাসে।

মাহফুজা হাফিজের চোখে এখনো পবিত্র। সে তাকে মনে মনে পছন্দও করে। যাকে বলে গোপন পছন্দ, না বলা পছন্দ। পথিমধ্যে কখনো কখনো মুখোমখি হয়ে গেলে আত্মসম্মানের তাগিদে ত্বরিৎ মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। হাফিজ ছেলে হিসেবেও অযোগ্য নয়। প্রতিষ্ঠিত ও সুযোগ্য পাত্র। কিন্তু তার পেছনের ইতিহাসের দিকে তাকালে অনেকেই হয়তো সহজে তা মেনে নেবে না। কী আর করা, সবই নিয়তির ফল।

কিন্তু বিধ্বস্ত ও ভাঙা পাড়দ্বয় মিলে একদিন একটি সেতু রচনা হবে, পরিণয়ের সেতু; তা কেউই ভাবতে পারেনি। তারা দু’জনও নয়। জগতে কখনো কখনো পাশাপাশি দুটো ভাঙা দেয়ালের মিলনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সময়ের তাগিদে, প্রয়োজনের তাগিদে। শেষে তাদের পরস্পরের সংস্কারের সুচারুরূপিতার কাছে দুঃসাধ্য হয়ে যায় তাদের পুনঃচিহ্নিত করা। কোথায় সে সংযোগ! কোথায় সে আলাদা!

তাদের যুগল জীবনেও একদিন তাই ঘটল। পরিণয়ের সেতুতে উভয় পরিবারের যাতায়াত আরম্ভ হলো। বিধ্বস্ত ও ভাঙা পাড়দ্বয়ের ইতিহাস ক্রমশ একদিন সবাই ভুলেই গেল।

কিন্তু সেই পরিণয়ের সেতুতে যাতায়াতরত এক পথচারীর এভাবে অকাল প্রয়াণ হবে সেটাও কেউ ভাবতে পারেনি। হাফিজ ও মাহফুজার বিয়ের এক মাসের মাথায় একদিন সকাল বেলা মেহবুবার কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মুখে অস্বাভাবিক ফেনা জমেছিল। মেহবুবার মা সকালে প্রথমে এ দৃশ্য দেখে হাফিজ ও মাহফুজাকে ডাক দেয়। তারা মেহবুবাকে শ্বাস-প্রশ্বাসহীন অবস্থায় দেখতে পায়। শেষে আগরবাতির ধোঁয়া নাকের সামনে ধরে তাতেও নাসিকা বায়ু প্রবাহ লক্ষিত হয়নি। পরে পরিচিত এক চিকিৎসকের মাধ্যমে নিশ্চিত হলো, মেহবুবা আর নেই। ধারণা করা হলো, গরল পানে এ মৃত্যু হতে পারে। স্বজনহারা বেদনায় তারা সশব্দে কাঁদতে লাগল।

মেহবুবার গত হওয়া আজ একমাস অতিবাহিত হলো। গ্রামের সবাই কানাকানি করেছিল, কেন এ মৃত্যু হলো? কীভাবে এ মৃত্যু হলো? এর কারণ কী হতে পারে? তার পরিবারও মেহবুবার মৃত্যুর কারণের অতি ব্যাখ্যার প্রয়োজন মনে করেনি। বাবা প্রবাসে থাকায় আদরের কন্যার অনভিপ্রেত মৃত্যুতে সময় স্বল্পতার কারণে আসতে পারেননি।

মেহবুবার চিরবিদায়ের এতদিন পর সহসাই হাফিজ তার নিজের দ্বিতীয় বিয়ের দিনের স্মৃতি মনে করতে চেষ্টা করল। যেদিন সে প্রথম এ বাড়ির একজন হয়েছিল। সেদিনসহ সে বিগত তিরিশটি দিন আগের জীবিত মেহবুবার অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক আচরণগুলো মনে করার চেষ্টা করল। হ্যাঁ, সবই মিলে যাচ্ছে, ঠিক তাই। আজ মেহবুবা জীবিত থাকলে তার এসব অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক আচরণের সত্যতা পাওয়া যেত না। সে মরেই প্রমাণ করল, হাফিজের অনুসন্ধানী চোখে ধরা পড়া আচরণগুলোর সবকিছুই ছিল নিরেট সত্য। যা এতদিন তার কাছে অমূলক ভিত্তিহীন সন্দেহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সে অধোমুখে চিঠিখানা আবার পড়তে লাগল।

প্রিয়,

প্রিয়তে আর কিছুই লিখলাম না। কারণ আপনার মতো সম্পর্কের মানুষও শেষ পর্যন্ত প্রিয় থাকতে পারে আমার জানা ছিল না। আপনাকে আমি অনেক আগে থেকেই পছন্দ করি। অনেক আগে থেকেই। কিন্তু কখনো মুখ ফুটে বলতে পারিনি। মুখ ফুটে বলতে না পারলে ভালোলাগা ও ভালোবাসার দুঃসাহস যে কোত্থেকে আসে আমি জানতেও চেয়েছিলাম। খুঁজে হয়রান হয়েছি, কোনো শাস্ত্রেই পায়নি।

তারপর আপনার প্রথম বিবাহ হলো। সেদিন আপনাকে দেখতেও গিয়েছিলাম। যাতে আপনাকে দেখে মনে ঘৃণা জন্মাতে পারি। কিন্তু না, পারিনি। আপনার মায়াবী চোখ, পুরুষালি হাসি, সুঠাম শারীরিক গঠন আমার মনে আপনার প্রতি ঘৃণা জন্মাতে দেয়নি। আরও বেশি অনুরক্ত হয়ে লজ্জায় দ্রুত চলে এসেছিলাম। সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারিনি। হারানোর যন্ত্রণায় ছটফট করেছি। নিজের শরীরে উপর নির্যাতন করেছি।

এভাবে দু’টো বছর কেটে গেল। আপনি বাবা হলেন। কিন্তু আমি মা হতে পারিনি। সুযোগ বুঝে আপনার সন্তানকে আদর করেছি, সোহাগ করেছি। নিজের সন্তান ভেবে স্নেহ করেছি। কিন্তু আমি কখনই তার মা হতে পারিনি। তা হওয়া সম্ভবও ছিল না।

দীর্ঘ যন্ত্রণায় আরও তিনটি বছর কেটে গেল। আপনার সন্তানের মা মারা গেলেন। কিন্তু তখনো আমি বেঁচেই ছিলাম। আপনার স্ত্রীর প্রতি আমার কোনো অভিশাপও ছিল না। কিন্তু তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে আমার বুকের ভেতরে নিবু নিবু ভালোবাসার বাতিটা আবার শিখাসহ জ্বলে উঠেছিল। আপনার সন্তানের মা হবার প্রবল আকাঙ্ক্ষায়। সেই ছয় মাস আমি সবকিছু ভুলে আপনার সন্তানের আরও কাছে গিয়েছিলাম। খুব সহজেই তা আপনার নজর এড়িয়ে গেছে।

কিন্তু সেই ছয় মাসান্তে যা ঘটল, আমি মেনে নিতে পারিনি। আপনি আমার বড় বোনকে বিয়ে করলেন। আপনি আমার কত কাছে চলে এলেন! কিন্তু অন্যের ঘরে। যেদিন থেকে আপনি আমার আরও কাছে এলেন সেদিন থেকে আমার যন্ত্রণা আরও বেড়ে গেল। কাছে থেকেও না পাওয়ার যন্ত্রণা। কাছে পেয়েও হারানোর যন্ত্রণা। আমি আমার হিতাহিত জ্ঞান ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিলাম। বুদ্ধিবৃত্তি লোপ পাচ্ছিল। আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না। নিজেকে আর সামলাতে পারছিলাম না। দিন দিন আমি ভারসাম্য হারিয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছিলাম।

আপুর সাথে আপনার বিবাহের পর প্রতিটি রাত আপনাদের দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে নির্ঘুম কাটিয়েছি। শুধু আপনার মুখে আমার নামটি একটিবার শোনার জন্য। তাও পাইনি। তখন মনে হয়েছিল পৃথিবীতে আমি শুধু একাই বেঁচে আছি। কেউ কোত্থাও বেঁচে নেই। তো আমি একাই থেকে কী করব? আমি কী করছি, কী বলছি, কী খাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারতাম না। এ অসহনীয় কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ খুঁজতে থাকলাম। পেয়েও গেলাম।

মুহূর্তেই গোটা পৃথিবী আমার চোখের সামনে প্রদক্ষিণ করল। আমি দু’চোখ ভরে দেখলাম। কত সুন্দর পৃথিবী! কত রঙিন জীবন! মৃত্যুর আগে পৃথিবীকে অনেক সুন্দর দেখায়। শেষবারের মতো দেখলাম আপনার মায়াবী চোখ, পুরুষালি হাসি, সুঠাম শারীরিক গঠন। সবকিছুই আগের মতো আছে। শুধু আমিই নেই, আমার কিছুই নেই।

অসাড়ের মতো কিছুক্ষণ নিজের গলা নিজেই চেপে ধরলাম। অনুভব করলাম, ভালোই লাগছে। নিজেকে খুবই হালকা ও বেদনাবিহীন মনে হচ্ছে। আমি শেষ সুখের সন্ধানে চিৎকার করতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। তখন বুঝতে পারলাম, অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে।

ওদিকে আপনি, এদিকে আমি। মধ্যিখানে একটিমাত্র দেয়াল। যে দেয়াল আমি প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ভাঙতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি। ওটাই ভালোবাসার দেয়াল। ওটা পার হতে পারলে ভালোবাসা পাওয়া যায়। আমি ওটাই পার হতে পারিনি। এতটুকুর জন্যেই ভালোবাসা হারায়। অতি সামান্যের জন্যও আমরা হারিয়ে যাই। ভালোবাসার অবুঝ মেহবুবারা এভাবেই নিরবে হারিয়ে যায় অসীমের গহিনে…

নিভৃতচারী শেষ বিদায়ী

মেহবুবা

হাফিজ পেছন ফিরে বিছানায় ঘুমন্ত স্ত্রীর দিকে তাকাল। কোনোদিন সে যদি জানতে পারে, কী ভাববে আমাকে? কী ভাববে নিজেকে? সে কি আমাকে আগের মতো ভালোবাসতে পারবে? আমিও কি পারব? নাকি হারিয়ে যাওয়া মেহবুবার অনুক্ত ভালোবাসাই আমাদের পথ আগলে দাঁড়াবে আমাদের দাম্পত্য জীবনের বিশেষ মুহূর্তে? নাহ্, তা হতে পারে না। চিঠিখানা সে যথাসম্ভব ছোট করে ছিঁড়ে দলা করে অদূরে বহমান মহানন্দার তীরে সজোরে ছুড়ে মারল। নবযৌবনা নদীর এক ঢেউ এসে মুহূর্তেই তা তলিয়ে দিল। নিষ্ঠুর নদী মেহবুবার ভালোবাসার শেষ স্মৃতি চিহ্নটুকুও ভাসিয়ে নিয়ে বয়ে গেল অজানার গন্তব্যে।

 

Read Previous

ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি 

Read Next

লর্ড ডানসানি’র সাতটি উপকথা

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *