বাসে একদম পেছনের সিট পেলাম। সবাই দু’জন দু’জন করে বসে পড়েছে। আমার মতো বেজোড় আর কেউ নয়, মন্দ হয়নি। সিটটা আরামদায়ক। সেই সাথে জানালার পাশে বসতে পারছি, কেউ না থাকায় একটু হাত-পা ছড়াতে পারছি এও খারাপ কী।
কাচ সরিয়ে বাইরে রাতের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মানুষের শোরগোল, আলোছায়া। একটা বাদামওয়ালা তার শেষবেলার বাদাম কমদামে গছিয়ে দিতে চাইছে।
দূরে দোকানপাটের জ্বলজ্বলে বাতি। বাতাসে অগ্রহায়ণের ফিনফিনে কুয়াশা।
সহপাঠীরা শোরগোল করে গল্প করছে। সেই শোরগোলের কোথাও আমি নেই। একটু যে খারাপ লাগল না, তা নয়। বুকের ভেতর একটা জমাট মোমের বল যেন গড়াচ্ছে। একবার এদিক আরেকবার ওদিক। ওদের ভেতর সোমা আছে। মাঝে মাঝে তাকে দেখার চেষ্টা করছি। তবে তার চোখে না পড়ে গিয়ে। তার বা আর কারো।
বাস ছাড়ার সময় হয়ে এলো। সহকারী প্রক্টর আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। বাবুল স্যার। ছিপছিপে মানুষ। সবসময় সাদা শার্ট পরেন আর পুরোনো দিনের স্কুলশিক্ষকের মতো এখনও ওঁর বুকপকেটে একটা কলম দেখা যায়। নীল কালির কলম। বাবুল স্যার বোধহয় ক্যাম্পাসের একমাত্র শিক্ষক যিনি নীল কালিতে খাতা দেখেন।
‘তা তোমরা সবাই যার যার জায়গায় বসিছো আশা করি ঠিকঠাক, নয়?’
ওনার কথার বলার ভঙ্গি আমার ভালো লাগে। সবাই হৈ হৈ করে উত্তর করল।
বাস একটা গমগমে শব্দ করে চলতে শুরু করল। আমি সিটের ফাঁক গলে দেখলাম, কয়েক সিট আগে সোমা হেসে গল্প করছে। শাড়ি পরেছে। সবাই ঠাট্টা করছে।
‘অ্যাডভেঞ্চারে যেতে কেউ শাড়ি পরে পাগল?’
‘আমি পরি। কোনো সমস্যা?’
‘সবাইকে সমস্যায় ফেলবি।’
‘সবাই আমাকে ফেলে আগে হাঁটবি। মিটে গেল।’
এ কথার পর সবাই একটু চুপ হয়ে গেল। যেন একটা কোনো ব্যথা আছে ওর এই কথায়। কি ব্যথা?
ধীরে ধীরে পেছনের সিটের অশান্তি টের পেতে থাকলাম। ঝাঁকুনি তো আছেই। সেই সঙ্গে যখন মোড় ফিরছে, তখন বেশ রকম দোল খাচ্ছি। তবে অভিযোগের কিছু নেই।
আমি চোখ বুজে দুলুনি অনুভব করতে থাকলাম। তন্দ্রা মতন এলো। তন্দ্রার ঘোরে মনে হলো আমি যেন বনের ঘাস। আমি যেন বনের বাতাসে দোল খাওয়া লতা বা স্বয়ং বাতাস।
শরীর-মন ক্লান্ত ছিল বোধহয়। তন্দ্রা ঘুমে রূপ নিলো। অনেকটা সময় পর যখন ঘুম ভাঙল, বাস বাতাস কেটে ছুটছে। সামনে আমার সহপাঠীদের শোরগোল কমে এসেছে। আমি রাস্তা দেখতে থাকলাম। অন্ধকারে আলো ফেলে পথ করে ছুটেছি। যতটুকু আলো ততটুকুই পথ। তাই যত আলো তত পথ।
একটু পর আশুগঞ্জ সারকারখানার পেছনে একটা মাঝপথের রিসোর্টে বাস থামল। রিসোর্টের নাম ‘সকাল-সন্ধ্যা’। হৈ চৈ করে নামছে সবাই। আমিও নামব, তবে সবার পর। একসাথে গোল করে নামতে ভালো লাগে না।
রিসোর্টের বাথরুমে চোখে মুখে পানি দিয়ে আবার বাইরে এলাম। খিদে পায়নি। একটু চা খাওয়া যায়। তবে চায়ে অভ্যাস নেই। একটা সিগারেটও ধরানো যায়। ওরা অনেকেই ধরায়। ধোঁয়াটা মেঘের মতো উড়ে যায়, দেখতে ভালো লাগে। তবে গন্ধটা উৎকট আর শরীরের জন্যে সিগারেট খারাপ, বেশ খারাপ। এমন যদি হতো, সিগারেটের মেঘ পাওয়া যেত, কিন্তু ক্ষতিটা এড়িয়ে!
শীতের রাত। মনে হয় ঢাকার বাইরে শীত তার হৃদয় পেতে দিয়ে বলে, বসুন। রিসোর্টের দরজায় তাকালাম। সোমা একা দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ওর বন্ধুরা। ওর ওপর চাঁদের আলো এসে পড়েছে। চাঁদ দেখলে আমার খুব বিহ্বল লাগে। আর সেই চাঁদের আলোর নিচে সোমাকে দেখে আমি আরো বিহ্বল হয়ে পড়লাম। সোমা ধীরে ধীরে হেঁটে এসে বাসে উঠে পড়ল।
এক জায়গায় বাগানবিলাসের ঝাড় আছে। আমি তার নিচে দাঁড়িয়ে বড় রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। রাতের রাস্তা। থেকে থেকে একটা-দুটো গাড়ি যাচ্ছে। তাদের চাকার শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় নৈঃশব্দ্যের ভেতর। শুনতে ভালো লাগে। থেকে থেকে জমাট কুয়াশারা বেড়াচ্ছে এখানে ওখানে। একবার কিছুক্ষণের জন্য রিসোর্টের উঠানে জমাট কুয়াশা স্থির হয়ে থাকল।
জায়গাটা আরেকটু পরিচ্ছন্ন হতে পারত। তবে অভিযোগও নেই।
কিছুক্ষণ পর শোরগোল করে বেরিয়ে এলো আমার সহপাঠীরা। বাসে উঠে যার যার আসন নিলো। এবার আমার ওঠার পালা। ওদের পাশ কেটে আমার সিটের দিকে এগোতে থাকলাম। এর ভেতর আমার সঙ্গে কেউ কোনো কথা বলেনি। আমিও না। বলা দূরে থাক, কারো চোখের দিকে তাকিয়েছি বলেও তো মনে পড়ছে না। বুকের ভেতর মোমের বল গড়ালে কী হবে। দোষ কিন্তু আমারও কম না।
সিটের কাছে এসে চমকে উঠলাম। সোমা বসে আছে। কী কাণ্ড। আমার দিকে তাকিয়ে হাসার মতো ভঙ্গি করল। আমিও ভদ্রতা করলাম। আরো পেছনের সারিটা খালি। সেখানে গিয়ে বসলাম। অথচ খুব ইচ্ছে করছিল সোমার পাশে গিয়ে বসি। কিন্তু উল্টোটাই করলাম। এমন কেন হয়?
সোমা জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকল। সামনে থেকে ওর বন্ধু নীরব ডেকে উঠল,
‘কি রে সোমা!’
বাজখাঁই গলা। কে যে ওর নাম রেখেছে নীরব!
‘সোমা, কেন গেলি পেছনে তুই!’
অধরা বলল,
‘মেয়েদের কিছু ব্যাপার বুঝতে হয় নীরব। নয়তো আজীবন ষাঁড় রয়ে যাবি। মানুষ হতে পারবি না।’
মেয়েদের ব্যাপার- শব্দটা শক্তিশালী। নীরব মিইয়ে গেল।
বাস যেন আলোর বেগে যাচ্ছে। দু’পাশে সরে সরে যাচ্ছে ছায়াপথ নীহারিকা।
আবার ঘুম, আবার বনের পথ। মেঘের পথ। আমার ভেতর যেন একটা পাখি বাস করে। একটা সাদা পাখি। সারসের সাথে মেলে। কিন্তু ঠিক যেন সারস নয়।
তন্দ্রা। নিদ্রা। ঘুম ভেঙে দেখা রাজসড়ক, পাহাড়ের পথ। ঘোর। ঘোর ভাঙা। আবার ঘোর।
একটা সময় যখন হবিগঞ্জ রোডে বাস উঠে গেল, টের পেলাম বাতাসে কিছু বদলে গেছে। এখানে শ্বাস নিলেই আনন্দ।
শ্রীমঙ্গলে যখন বাস থেকে নামলাম তখন ভোরের আজান পড়ে গেছে। সবাই হৈ চৈ করে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ল। রেস্তোরার নাম ‘দেবালয়।’
ম্যানেজার পানি ছিটানো চোখ আর হাসি মুখ নিয়ে এসে হাত জোড় করে বলল,
‘একটু বসেন দয়া খরিয়া। একটু বসেন।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কোনো সমস্যা নেই, করেন আপনারা, করেন। তবে একটু তাড়াতাড়ি। পথ আরো বাকি আমাদের, নয়?’
‘কোথায় যাবেন?’
পরোটা আর ডিমের ঘ্রাণে বাতাস ম ম। সবজিটা করে উঠতে আরো সময় লাগবে, তাই নেওয়া হয়নি। খাওয়ার সময় গল্প একটু কমে এলো। একেকটা গোল টেবিলে যার যার পছন্দমতো দলে সবাই বসেছে। আমি সবার অগোচরে দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যখন সবাই পছন্দের চেয়ার পেল, ঢুকলাম ভিতরে। একপাশে চুপচাপ বসে পড়লাম। আমার পাশে রেস্তোরাঁর জানালা। আলোর একটা রিনরিনে সুর বাজছে বাইরে। আমি বাইরে এলাম। বাসটা দাঁড়িয়ে আছে কাছেই। লাল টুকটুক একটা বাস।
নাশতা করে সবাই একটু আলাদা আলাদা হয়ে চা-টা খেতে থাকল। কেউ কেউ সিগারেট ধরাল স্যারের চোখ এড়িয়ে।
আমি রাস্তাঘাট দেখতে থাকলাম। একেক দিকে চলে গেছে লম্বা সব পথ। মসৃণ, কালো। পথের দু’পাশে প্রাচীন বড় বড় গাছ। বাসের চালক তাড়া দিলো।
‘ওঠেক, ওঠেক!’
তাড়াটা সঙ্গত। হাওরে যেতে হয় খুব সকাল সকাল। যেতে হয় খুব সকাল সকাল।
আমাদের গন্তব্য বাইক্কা বিল। উদ্দেশ্য পাখি দেখা। তবে পাখি এখনো বেশি আসার কথা না। শীত আরেকটু জাঁকিয়ে পড়া দরকার।
বাস ছুটল। রাস্তাটা এদিকে আরো মসৃণ। মহাসড়কের চেয়েও। মিশকালো। দু’পাশে ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের ওপাশে কোথাও কোথাও উঁচু টিলার মতো। সেখানে ঘন হয়ে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে গাছপালা। একটা গাছ দেখা গেল ঘন গাছের ছোট-বড় গম্বুজের ভিড়ে মিনারের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এ গাছটাকে আমি মনে রাখলাম।
দেখতে দেখতে বড় রাস্তা ছেড়ে একটা পাড়ার পাকা রাস্তায় ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়ল বাস। এখান থেকে আরেকটু সামনে গেলে বারুণীর বাজার। বাবুল স্যার বললেন,
ওখান থেকে অটোরিকশায় উঠতে হবে।
এবার সোমা যেন আমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে থাকল সবার পরে নামার। পারল না শেষেমেশ।
ভেবেছিলাম সোমা নামলে ওকে জেঁকে ধরবে সবাই। তা ধরল না। জানি না কেন, হঠাৎ ওকে সবাই একটু ছাড় দিতে চাচ্ছে। একটু একা থাকতে দিচ্ছে।
বন্ধুরা একা থাকতে দিলেও মানুষের দৃষ্টি কিন্তু ওকে ঘিরেই থাকল। শাড়ি পরা একটা সুন্দর শহুরে মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। গাঁয়ের তরুণরা আগ্রহ নিয়ে দেখল।
আমি যে অটোয় উঠলাম, সেখানে চালকের পাশে ছাড়া জায়গা ছিল না। কেউ আমায় ডাকেনি। তবে কোনো অভিযোগ নেই। ভাড়া ঠিক করার সময় অটোচালক বলেছিল, আধা ঘণ্টার রাস্তা। দেখতে দেখতে আধা ঘণ্টা কেটে যাবে।
এক জায়গায় ধানক্ষেতে প্রচুর দুধসাদা বক। কোথাও কেউ একজন তালি বাজাতেই বকগুলো ডানা মেলে দিলো। একটা মেয়ে বড়সড় লেন্স লাগানো এক ক্যামেরা দিয়ে ওদের ছবি তুলতে থাকল। পেছন থেকে আবীর জিজ্ঞেস করল,
‘আর কতক্ষণ মামা?’
অটোচালক কোনো উত্তর দিলো না। আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে আর মিনিট দশেকের পথ।
অটোচালক নিরুত্তর থাকায় আবীর ক্ষুণ্ন। এমন হতেই হয় ওকে। প্রায়ই ছেলেমানুষী প্রশ্ন করে। যেমন- হয়তো বাবুল স্যার বললেন, ‘কাল ক্লাস টেস্ট।’ আবীর বলবে, ‘তাহলে কালকে আমরা কখন আসব?’
দুঃখ ভুলতে আবীর পাশে বসা নিশিথকে বলল,
‘প্রচুর পানকৌড়ি এখানে, নারে?’
মানুষ যাকে অপমানিত হতে দেখে, তার দর কমিয়ে দেয়। আবীরের উত্তরে নিশিথও কিছু বলল না। আমার খুব ইচ্ছা হলো বলি,
‘হ্যাঁ, আবীর প্রচুর পানকৌড়ি। কেমন ডানা মেলে স্থির হয়ে আছে কচুরিপানার ওপর। এমন স্থির হয়ে আছে কেন?’
পথে পথে মাছ পচে আছে। দু’পাশে মাছের ঘের। বোধহয় সেখান থেকে মাছ তোলার সময় দুয়েকটা পড়ে গিয়েছিল নিচে, কেউ তোলেনি।
অটোগুলো একে একে এসে থামল বাইক্কা বিলের প্রবেশ কাউন্টারের সামনে, নামলাম। একটু দূরেই বিশাল রুপালি চাদরের মতো হাইল হাওর। আমার বুকের ধুকপুক বেড়ে গেল। মনে হলো যেন বাড়িতে এসেছি। অথচ এখানে আগে কোনোদিন আসিনি আমি।
একে একে সবাই জড়ো হলো। অধরা সোমার হাত ধরে রেখেছে। সোমা যেন মনের ভুলে দুবার আমার দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলো। এমন করে কেন মেয়েটা?
বাবুল স্যার কাউন্টার থেকে সবার টিকিট কাটলেন। গলা উঁচিয়ে বললেন,
‘আশা করি যা যা বলিসি সবার মনে আছে, নয়?’
কখন কাকে কী বললেন স্যার? কাকেই বা জিজ্ঞেস করব। যাক, ক্রমান্বয়ে আপনাতেই জানা যাবে।
কাউন্টার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। এখানে একটা বারান্দা মতন আছে। নিচে বিল এলাকা শুরু। বুনো ঝোপঝাড় ক্রমশ ঘন হয়ে এসেছে। সামনের দিকে। দূরে রুপালি বিল বিছানার মতো পাতা। তার ধারঘেঁষে যেন পাশ ফিরে শুয়ে আছে বন, ঘন।
ছেলেমেয়েরা লাইন ধরে বাঁ পাশের সিঁড়ি ধরে নামতে থাকল। এগোতে থাকল বনটার দিকে।
কোনো কারণে সোমা পিছিয়ে পড়ল। কেউ আপত্তি করল না। ও কি কোনোভাবে আমার সঙ্গে হাঁটতে চাচ্ছে। আমার বুকে একটা বুনো হাঁস ডানা ঝাপটাল।
চারদিক থেকে ভেসে আসছে হাঁসের ডাক। কিন্তু কোথায় ওরা?
সোমা তখন কাছে চলে এসেছে। বললাম,
‘শব্দ শুনতে পাচ্ছেন? লাখ লাখ হাঁস ডাকছে।’
‘নাতো। হাঁস তো নামেইনি প্রায়।’
কথা সত্য। হাঁস বেশি নেই। এখনো নামেনি। উপরন্তু আমাদের আরো সকালে আসা প্রয়োজন ছিল। অনেকখানি আলো ফুটে গেছে। এ সময় পাখিরা ফিরে যায়। কিন্তু কী ঘটেছে আমি জানি না। আমি স্পষ্ট শুনছি লাখ লাখ হাঁসের ডাক। সোমাকে তা আর বললাম না।
সামনে হিজলের বন। মাটি থেকে ঢেউয়ের মতো এঁকেবেঁকে হিজল গাছেরা উঠেছে। তাদের কাণ্ড শাখা-প্রশাখা সবুজ পাতায় ছাওয়া। কী সতেজ রঙ।
দলের অন্যেরা অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদের কেন যে পিছিয়ে পড়তে দিলো। আমাকে বরাবরই এমনভাবে এড়িয়ে যায় যেন আমি নেই। এতে অভ্যস্ত বলে কিছু মনে করিনি। কিন্তু সোমাকেও কেন ওরা একইভাবে দেখেও দেখল না? ওরা বোধহয় এক নম্বর ওয়াচ টাওয়ারে চলে গেছে। ঢোকার মুখে কাউন্টারের লোকেরা যার কথা বলেছিল।
পায়ে নিচে পাতার মাদুরে ছাওয়া নরম মাটি। বনের কিনারে কিনারে পদ্মপাতারা শুকিয়ে কেমন গুটিয়ে আছে। এসব জায়গায় একসময় পানি ছিল।
‘কেমন লাগছে সোমা?’
সোমা হাসল। ‘কেমন নরম সবুজ চারপাশ, তাই না?’
নরম সবুজ। খুব সুন্দর শব্দ। ‘হ্যাঁ, নরম সবুজ। সঙ্গে একটু একটু ধূসর, একটু একটু কালো।’
‘হ্যাঁ।’ সোমা একমত।
একটু পিছিয়ে গেল। হয়তো একা থাকতে চায়। আমিও ওকে সুযোগ দিতে একটু এগিয়ে গেলাম। খুব ইচ্ছে করছিল একটা কিছু বলি। কিন্তু কিছু মাথায় আসছিল না।
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি সোমা?’ বললাম খানিক পর।
সোমা চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল। আমাকে দ্বিধা করতে দেখে বলল, ‘প্লিজ বলো।’
‘ওরা আমাকে এড়িয়ে চলে কেন?’
বিলের দিক থেকে সুন্দর বাতাস বয়ে এলো। আলোয় ছলছল করছে বিলের পানি। কোথায় অচেনা হাঁসের ঝাঁক ডেকেই চলেছে ডেকেই চলেছে? সোমাকে বিব্রত করলাম বোধহয়।
‘আপনি ওদের সাথে গেলেন না সোমা?’
‘না।’ তারপর সোমা যা বলল তার জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না একেবারে। ‘আমি তোমার সাথে থাকব বলেই আলাদা হয়েছি।’
আমার হৃদপিণ্ডে রক্তের উচ্ছ্বাস। মানুষের আবেগটা কী করে যেন শরীরের উপসর্গে ধরা পড়ে। ব্যাপারটা আমার কাছে বিচিত্র লাগে। মনকে তো মনে হয় শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয়। যদি তাই হয়, সোমা আমার সঙ্গে থাকবে বলে সবার কাছ থেকে আলাদা হয়েছে, এ আনন্দের খবর আমার শরীর কি করে পেল?
সোমা আমাকে এ সময় একটা প্রস্তাব দিয়ে বসল।
‘দুই নম্বর ওয়াচ টাওয়ারের কথাও বলে দিয়েছিল গেট থেকে। ওখানে যাবে?’
আমি একটু সন্দিহান। সোমার সঙ্গে দুই নম্বর ওয়াচ টাওয়ারে যাওয়া নিয়ে নয়। সোমা আমার সঙ্গে সত্যিই আলাদা কোনো ওয়াচ টাওয়ারে যেতে চাইছে, নাকি এ আমার কল্পনা, এ নিয়ে সন্দিহান। দ্বিধা নিয়ে বললাম, ‘বাহ। ঠিকাছে চলো যাই।’
ও তুমি করে বলছে তাই আমিও তুমিতে উঠলাম। আবারও শরীর পেয়ে গেল সেই খবর। বড় বিপদ।
সোমা বলল, ‘তোমার আগ্রহ না থাকলে থাক।’
‘না না, একশবার আগ্রহ আছে।’
সোমা হাসল। ওর হাসিটা কেমন নিষ্প্রাণ ঠেকল। সর্বশেষ বাসে এমন নিষ্প্রাণ হেসেছিল।
আমরা আরো সামনের দিকে হাঁটতে থাকলাম। বনের গাছে গাছে পাখিদের বাসা বাঁধার জন্যে আয়তকার বাক্স ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বাক্সে নম্বরও দেওয়া হয়েছে। এক, দুই, তিন করে গুনতে গুনতে আমরা ঊনিশে পৌঁছালাম।
সব গাছে যে বাসা ঝোলানো হয়েছে তা নয়। কিছু কিছু গাছ বাদ দিয়ে।
এতোটা পথ হাঁটতে হাঁটতে মনে কত কথা যে এলো। তার কমই বলা হলো সোমাকে। প্রকৃতিও আমাকে বিহ্বল করে তুলছিল। আর ওদিকে সোমা আমার সঙ্গে হাঁটছে এও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আগে মনে হতো আমার জীবন বুঝি এভাবেই কেটে যাবে, নির্বান্ধব এবং সোমাকে দূর থেকে কেবল দেখে দেখে। আজ যেন ভিন্ন কিছু মনে হচ্ছে। কল্পনা দেখলাম, আমি বন্ধুদের সঙ্গে খুব হাসছি। আমার বাহু জড়িয়ে ধরে আছে সোমা। আমি আমার চাদর দিয়ে ওর বাহু ঢেকে দিলাম।
‘সোমা!’
সোমা তাকাল। আমি ডাকলে সোমা তাকাবে, এতোটা সান্নিধ্য পাব কখনো ভাবিনি। এই হিজল বনের পথকে ধন্যবাদ। এই হাইল হাওরের আধভেজা মাটিকে ধন্যবাদ।
‘সোমা। তুমি আমার শিক্ষক।’
‘কেন?’
উত্তর দিতে পারলাম না। কেন যে জানতে চেয়েছি তা নিজেই জানি না। কী বলব কিছু না ভেবেই প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কোথায় জন্মেছ?’
‘ঢাকা।’
‘বেড়ে ওঠা ওখানেই?’
‘হ্যাঁ। আর তোমার?’
‘আমি-’
আমি কোথায় জন্মেছি? কী আশ্চর্য। কোথায় বড় হয়েছি আমি? কিছুই আমার মনে আসছে না কেন?
‘সোমা-’
‘বলতে না চাইলে থাক।’
‘না আমি তোমাকে বলব।’ নিশ্চিত করলাম আমি সোমাকে-। ‘একটু পরই বলছি।’ হাঁটতে হাঁটতে আমি চিন্তা করতে থাকলাম। কোনোভাবে মনে পড়ছে না। কোথায় বড় হয়েছি আমি? কোথায় জন্মেছি?
এর ভেতর বনের পথ আমার মন অনেকটা ব্যস্ত করে তুলল। যতই এগোচ্ছি, বনের পায়ে চলা পথ ততই হাঁটার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। মাটি নরম হয়ে উঠছে। আর বড় বড় ঘাস লতাগুল্মে ভরে উঠছে চলার পথ। মানুষ এদিকে আসে না বোধহয় তেমন একটা।
আমি পেছন ফিরে সোমাকে দেখলাম। ওর জন্যে আমার একটু একটু ভয় হচ্ছে। যদি কোনো বিপদ হয়। আমার বোধহয় ওর আরেকটু কাছে থাকা দরকার। ভাগ্যিস পাতার নিচে এখানে কোনো সাপ বিছা লুকিয়ে নেই। বর্ষাকাল হলে এর বিপদ বোধহয় এড়ানো যেত না।
পাতায় সর সর শব্দ তুলে বাতাস এলো বনে। আমরা পথ চলছি। এক পাতার শব্দ ছাড়া বনের আর কোনো শব্দ নেই। দূরের পাখির শব্দকে যদিও বন থেকে আলাদা করা উচিত নয়। তবু আমি বনের শব্দ হিসেবে ধরতাম যদি গাছে গাছে কোনো পাখি উড়ে আসত। কিন্তু কোনো কারণে কোনো পাখিই এসে বসছে না ডালে। শুধু দূরে দূরে ডাকছে।
অবশ্য দূরে দূরে ডাকছে তারাই, যাদের আমি দেখতে পারছি। আর যাদের পারছি না, তারা যেন ডাকছে আমার কুড়ি হাতের ভেতর। কিন্তু চারপাশে আমার কুড়ি হাতের ভেতর বন আর জল ছাড়া কিছু নেই।
এক পর্যায়ে আমরা পুরোপুরি আটকে গেলাম। বনের লতাপাতা, ঝোপঝাড় যেন সামনে দেয়াল তুলে দিয়েছে।
পেছন থেকে সোমা বলে উঠল, ‘দাঁড়াও!’
আমি তাকাতেই হাত তুলে বলল, ‘আর যেও না’
‘দ্বিতীয় টাওয়ারে যাবে না?’
‘না।’
‘কেন?’
আমি নিরস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সোমা নিরুত্তর। কী করি এখন?
অপ্রস্তুত হয়ে পিছিয়ে আসতে যাচ্ছি, সোমা বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘চলো।’
ও আবার যাওয়া মনস্থ করেছে। ভালোই হলো। শেষ দেখে ছাড়ি।
আমি আবারও এগোতে থাকলাম। মাটি ক্রমশ নরম হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে এখানে মাটির নিচে জোয়ারের পানি এসে ঘুমোয়।
একসময় থামতেই হলো। এরপর সোমার জন্য বেশি বিপজ্জনক হয়ে পড়বে পথ-। যতই সরাচ্ছি লতাপাতা আর কলমি জাতীয় এক অচেনা গুল্মের ডাল, ততই আরো স্তর সামনে আসছে। জায়গাটায় বন একটু পাতলা হয়ে এসেছে, তাই কেমন আলো আলো। আলোয় দেখা যাচ্ছে পাতার উল্টোপিঠের শিরা-উপশিরা। আমি পেছনে তাকালাম। সোমা স্থির দাঁড়িয়ে। ওর চোখে অশ্রু।
‘কী হয়েছে?’
‘কিছু না। তুমি এগোও।’
আলো আলো জায়গাটা পেরিয়ে এসে পেছন ফিরে ওকে ডাকতে গিয়ে দেখি ও নেই। কোথায় গেল?
সেই মুহূর্তে আমার শরীরকে চারপাশ থেকে যেন আলোর জোঁকেরা জেঁকে ধরল। আমার প্রতি অণু-পরমাণু ওরা শুষে নিতে চায়। স্মৃতিতে শেষ মুহূর্তের মতো খেলল সোমার মুখ ভেসে উঠল। যেন বলছে, ‘বিদায়। ক্ষমা করো। বিদায়। ক্ষমা। বিদায়।’
যেন আমি শেষবারের মতো সোমার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলাম। বোধহয় আমি মিলিয়ে যাচ্ছি। কী অদ্ভুত। সোমা, সোমা। জগত এতো অদ্ভুত আমার জানা ছিল না।
*
অগণিত হাঁসপাখির বিস্তৃত জগতে পা রাখলাম। গলার স্বরে বুঝলাম এতোক্ষণ এদের ডাকই শুনছিলাম আমি। লাখে লাখে পাখি। এরা ছিল কোথায়?
মনে হলো আমি হাইল হাওরের ওপর ভাসছি। আমি কি নিরাকার? কাছেই হিজল বন। ওই যে! বনের কিনারে শাপলা পাতার মতো সাদা শাড়ি পরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কে মেয়েটি?
বিলের জলে আলোড়ন। তাকিয়ে দেখি একটু ঘূর্ণি ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে। জলের ভাসমান প্রচুর পানা আর পদ্মপাতা সেই ঘূর্ণিতে বিলীন হলো। হাঁসেরা উড়ে যেতে থাকল, ভয় পেয়েছে। হঠাৎ মনে হলো ঘূর্ণিটা উপুড় হয়ে গেছে, অথবা আমি তলিয়ে গেলোম। আমার আকার চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। যখন আবার আকার পেলাম, দেখি আমার সামনে শুভ্র এক সারস, ছবির মতো স্থির দাঁড়িয়ে আছে।
‘কে?’
‘তুমি কে?’ বলল সারস।
‘আমি?’
থমকে গেলাম। আমি জানি না আমি কে। সারস বলল, ‘তুমি একটা সারস। আত্মপরিচয় হারানো এক সারস। আমাদের করুণার পাত্র।’
‘তুমি কে?’
‘তোমাকে করুণাকারী।’
‘তুমি আমাকে করুণা করেছ?’
‘তার চেয়ে বেশি কিছু। মেয়েটি তাকে সাহায্য করেছে।’
সারসটার ইঙ্গিত ধরতে পেরে আমি দূরে মেয়েটির দিকে তাকালাম। মেয়েটি তখনো তেমনই দাঁড়িয়ে আছে। বিমূঢ়। যেন ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনা ঘটেছে। সে ভুলতে পারছে না।
‘কে মেয়েটি?’
‘তুমি ওর প্রেমে পড়েছিলে।’
‘প্রেম?’
আমার স্মৃতিপথে কী এক স্মৃতি জেগে উঠতে চাইলো। যেন শাপলার পাপড়ির মতো সাদা শাড়ি পরে কেউ এসে বিলের ধারে দাঁড়িয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, যেন এক সারসী। আমি উড়ে গিয়ে গাছের ডালে বসেছিলাম। সারসী নয়। নারী। কী অপূর্ব এই নারী।
‘তুমি তাকে পেতে চেয়েছিলে।’
‘আমি?’
‘তারপর তুমি প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করলে। কিন্তু পথ অবলম্বন করলে।’
আমি তাকে পেতে চেয়েছিলাম। আমি প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করেছিলাম। কিন্তু পথ অবলম্বন করেছিলাম। বুঝতে পারছিলাম আমি যা করেছি, তা আমার বুদ্ধিমত্তার তুলনায় জটিল। আমি কীভাবে করেছি এতো কিছু?
‘তোমার ইচ্ছা প্রবল দেখে প্রকৃতি সদয় হয়ে তোমাকে অনুভূতি দিলো। কিন্তু অস্তিত্ব দিলো না। তুমি কেবল অনুভূতি হয়ে পথ অতিক্রম করলে। মেয়েটির কা গেলে।’
‘অস্তিত্ব কেন দিলো না?’
‘অস্তিত্ব নিয়ে যেতে পারতে না,’ বলল সারস। ‘অস্তিত্ব রেখে যেতে হয়। অনুভূতি নিয়ে যাওয়া যায়। তুমি তাই গেছ। কিন্তু ওখানে শুধু অনুভূতি হয়ে টিকে থাকাটা তোমার জন্যে ক্ষতিকর ছিল। মেয়েটির জন্য ক্ষতিকর ছিল।’
‘মেয়েটির জন্যেও?’
‘যেমন বলেছি।’
আমার স্মৃতিপথে ভেসে উঠল, শুধু মেয়েটি আমাকে দেখতে পাচ্ছে। আর কেউ পাচ্ছে না। শেষবার আমরা দুজন কোথায় যেন চলেছিলাম। আমি ওকে বিশ্বাস করেছিলাম। আমার খুব কষ্ট হতে থাকল।
‘কেউ আমাকে দেখতে পেত না। দেহ ছাড়া অনুভূতিকে কে দেখতে পায়। কিন্তু মেয়েটি আমাকে দেখতে পেত কেন?’
‘কী চেয়েছিলে তুমি। সেও তোমাকে না দেখতে পাক?’
আমি ভেবে পেলাম না কী বলব। ‘এখন আমাকে কী করতে বলো?’ ভেবেচিন্তে এ প্রশ্নটাই করলাম।
‘তোমার পাখি সঙ্গীদের সঙ্গে সময় কাটাও। যেমন কাটাতে।’
আমি দূরে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ধীরে ধীরে একটা সারসদেহ আমাকে ঘিরে জমাট বাঁধছে। ওদিকে মেয়েটি যেন ভীষণ এক যুদ্ধে লড়ছে। তার বন্ধ চোখে যন্ত্রণার ছাপ। সারা দেহ ব্যথায় শিথিল।
সারস বলল, ‘মেয়েটি তোমার পরিণতি দেখেছে। আশা করি তার অনুভূতি সে সামলাতে পারবে। তোমার মতো ভুল করবে না।’
সারসের কথা শেষ না হতেই মেয়েটি পায়ে পায়ে লতাগুল্মে ঢাকা ‘পথের’ দিকে এগোতে থাকল। সম্ভবত ওকে বাধা দেওয়া প্রয়োজন।