প্রায় পাঁচ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে শারমিনকে স্কুলে যেতে হতো। পথে যেতে যেতে সবুজের সাথে তার প্রায়ই দেখা হতো। চোখাচোখি হতো। কথা তেমন হতো না। সবুজ ধামুড়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। শারমিন এবার নাইনে উঠল। একদিন সবুজ শারমিনের পথ আগলে ধরে বলে, শারমিন! তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। ভয়ে নদীর ঢেউয়ের মতো কাঁপতে ছিল শারমিন। কে দেখে, কে কী বলে ফেলে— শেষে এসব তার বাবার কানে গেলে সর্বনাশের আর শেষ থাকবে না।
না, আশপাশে কেউ নেই। কেউ দেখছে না তাদের। শুধু আকাশে কয়েকটা কাক-পক্ষি উড়ছে। খালের ধারে, ঝোপের ভেতর দৌড়ে গেল দুটো বেজি। সবুজ বলল, কই কিছু বলবে না? কেঁপে উঠছে শারমিনের জেরিন ঠোঁট। কিছু বলতে পারছে না সে। এ অবস্থায় সবুজ বলল, আমি তোমাকে একটা গোলাপ দিতে চাই। নিবে? অনেকটা চিলের মতো ছোঁ মেরে গোলাপটা হাতে নিয়ে শারমিন দ্রুত হাঁটা ধরল সামনের দিকে। সবুজ পেছন থেকে ডেকে বলল, কিছু না বলেই চলে গেলে? শারমিন পেছন ফিরে কিছু না বলে একটু হাসল। বাতাসে উড়ছিল শারমিনের চুল ও ওড়না। চলে গেল শারমিন।
২.
এরপর শারমিনের আর সবুজের সাথে দেখা হয়নি। কথা হয়নি। শারমিনের বিয়ে হয়ে যায় বিদেশ ফেরত দুই বিয়ে করা মধ্যবয়সী এক ছন্নছাড়া মানুষের সাথে। যেখানে শারমিন বারো বছর ছিল। কিন্তু এই তার কোনো সন্তান না হওয়ায় তাকে ফিরে আসতে হয় বাপের ভিটায়। যদিও তখন তার মা ও বাবা কেউই আর বেঁচে ছিলেন না। শারমিনকে উঠতে হয় তার ভাইয়ের সংসারে। ভাগ্য ভালো ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা ফুফু বলতে অজ্ঞান ছিল। তাই তাদের মা শারমিনকে খুব বেশি জ্বালাতন করতে পারেনি। সুখেই কাটছিল তার দিন। কিন্তু বিধিবাম, শারমিনের বয়স যখন চল্লিশ পার হয়ে গেল, তখন একদিন তার বড় ভাইয়ে করুণ মৃত্যু হয়। ভিটেবাড়িতে এজমালি গাছ কাটা হচ্ছে। সবাই সেখানে নিরাপদ থাকলেও কাটা গাছ এসে পড়ে শারমিনের ভাই রহিম মিয়ার গায়ে এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তাকে আর হাসপাতালে নিতে হয়নি।
৩.
আরো অনেক পরে, প্রায় দেড় যুগ পরে শারমিনের জায়গা হয় শিকারপুরের রজব আলি বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানেই শারমিন তার চশমা পড়া চোখ দিয়ে একদিন সবুজকে আবিষ্কার করেন। আছরের নামাজের জন্য অজু করে সবুজ বের হয়ে আসছে গোছলখানা থেকে। তার হাতে একটি লাল রঙের গামছা— মুখ মুছতে মুছতে সবুজ অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শারমিনের দিকে। তার মনে হলো একে তো আমি চিনি। কোথায় যেনো দেখেছি…
নামাজ শেষে সবুজ কেয়ারটেকারের কাছে কিছুক্ষণ আগের দেখা মানুষটির কথা জানতে চাইল। বলল, তার চোখে চশমা আছে। কেয়াটেকার মিষ্টি হেসে বলল, আপনি বোধহয় শারমিন বুর কথা বলছেন। উনি থাকেন ১২ নাম্বার রুমে।
সবুজ সোজা চলে গেল ১২ নাম্বার রুমে। আলতো করে দরোজায় টোকা দিল। বলল, কে আছেন ভেতরে? একটু বাইরে আসবেন। শারমিনই দরোজা খুলে দিল। বলল না কিছুইÑ শুধু অপলক চেয়ে রইল সবুজের দিকে। বাইরে ঝড় বাইছে।
আপনাকে কোথায় যেনো দেখেছি। কিছুটা ভয় কাজ করছিল সবুজের ভেতর। কোনো ভুল করছি না তো!
আমারো তাই মনে হচ্ছে, কোথায় যেনো দেখেছি আপনাকে। ম্লান কণ্ঠ শারমিনের।
আপনার সমস্য না থাকলে, বাইরে বৃষ্টি— আমি আপনার ঘরে বসতে চাই বলল সবুজ।
আমরা আরেকদিন কথা বলি? বলল শারমিন।
না। কাঁপা কণ্ঠে বলল সবুজ— আমি আজই কথা বলতে চাই আপনার সাথে।
আসুন।
চিন্তার বলিরেখা ঢেউ খেলে গেল সবুজের দেহমনে এবং ঘামতে থাকল সবুজ। অনেকক্ষণ কথাই বলতে পারল না সে।
৪.
পরিচয় পর্বের পর হাউমাউ করে কাঁদতে থাকল শারমিন। কাঁদছে সবুজও এবং তাদের কান্নার আওয়াজে সেখানে জমা হলো বৃদ্ধাশ্রমের অনেকেই। সবার চোখ ভিজে গেল পানিতে। এ কী করে সম্ভব? একজন বলল, আল্লাহ! তুমি আর কতো খেলবে? অথৈই সাগরের মতো তোমার খেলার যে কোনো কূল-কিনারা নেই। আরেকজন বললেন, সাগরের খেলা হয়তো একদিন শেষ হবে। আল্লাহর খেলার কোনো শেষ নেই। এ অসীম। এ চলবে…
রাতে বৃদ্ধাশ্রমে ভালো খানাপিনা হলো। অনেক রাত পর্যন্ত আনন্দ-ফুর্তি হলো, বুড়োদের কেউ কেউ নাচ-গান করতে থাকল। দমাদম মাস্ত কালান্দার, আলি দা পয়লা কদম। অথবা কেউ কেউ গাইল— আয়ে হো মেরি জিন্দেগি মে তুম বাহান বনকে…
৫.
ঠিক এর এক বছর পর, প্রবল এক বর্ষার দিনে বিয়ে হলো সবুজ-শারমিনের। হাওয়া বদলের জন্য সবাই তাদের পাঠিয়ে দিল কুয়াকাটায়। বিয়ের খবর শুনে আমেরিকা থেকে সবুজের ছেলে বেশ কিছু টাকাও পাঠিয়েছিল বাবার জন্য। যদিও সবুজ টাকাটা রাখেনি। আমেরিকার টাকা আবার চলে গেছে আমেরিকায়…