
শত চেষ্টা করেও সকাল নয়টা আগে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারি না। কিন্তু আজ ভোর পাঁচটার দিকে ঘুম থেকে উঠেছি। তবে মোবাইল ফোনে এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম বলে রক্ষে হয়েছে। নইলে এই ফেব্রুয়ারি মাসের কনকনে শীতের রাতে লেপ ছেড়ে আলসেমি কাটিয়ে সোজা সাপটে উঠা পড়া অনেক কষ্টকর ব্যাপার ছিল। সকল সাড়ে ছ’টায় ট্রেন ধরতে হবে, সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেসে রাজশাহী থেকে খুলনায় উদ্দেশ্যে একটা জরুরি কাজে। গ্রীষ্মের সময় হলে ভোর পাঁচটার দিকে সকাল হয়ে যায়। অথচ তখনও রাত হয়ে আছে, মাত্র ফজরের আজান দিয়েছে। তারপরও চারদিকে অসম্ভব কুয়াশার চাদরে ঘিরে আছে, একটু দূরে সামনে কিচ্ছু দেখার জো নেই। মহাসড়কে চলতে বিপদ জেনেও গাড়ির হেড লাইট জ্বালিয়ে আনেক ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সি এন জি চালক আমাদের স্টেশনে পৌছে দিল। রাস্তায় মনে মনে আল্লাহকে যে কতো ডাকাডাকি করেছি তার ইয়েত্তা নেই। কেননা, পথে চলতে গিয়ে এতো পরিমাণ দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে তা বলা মুশকিল। ঠুস করেই কখন যে কার প্রাণের বিনাশ হয় তা কেউ জানে না।
সময়মতো ট্রেনে উঠতে পেরে বেশ আনন্দ লাগছিল। প্রচণ্ড শীতে জুবুথুবু হয়ে বোরখা পরা মেয়েদের মতো শুধু দুচোখ বের করে রেখেছি। শরীরটাও খুব একটা ভালো না সামান্য জ্বর অনুভব করছি, যদিও প্যারাসিটামল খেয়ে নিয়েছি। তবু মনে হচ্ছে রাজ্যের একমাত্র শীত আমাকেই চোখে দেখেছে। পাশাপাশি দুটো সিট একটাতে আমি আরেকটিতে অন্য একজন বসেছে। জানালার পাশের সিটে বসার লোভ আমার সব সময়ের ছিল। কিন্তু পাশের জন মেয়ে বলে কিছু বলতে পারিনি। তাছাড়া যেভাবেই হোক জানালার পাশে আমার বসা চাই। মেয়েটার দিকে সরাসরি না তাকালেও হাল্কা লুকোচুরি ভাবে আড় চোখে দেখে নিয়েছি। যদিও সে আমার মতো করে শীতের থাবা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ততোটা সচেতন ছিল না। ও শুধু সালোয়ার-কামিজের উপরে লম্বা সোয়েটার আর মাথায় চোঙা টুপি ও মুখে অসম্ভব সুন্দর রকমের একটা মাস্ক পরে আছে। মাস্কটা যেন তার চেহারার লুকানো সৌন্দর্য আরও ফুটিয়ে তুলেছে, মনে হচ্ছে এটা একমাত্র ওর জন্যই তৈরি হয়েছে।
আমার অনেক ইচ্ছে থাকলেও নির্লজ্জতার ভয়ে সামনাসামনি তাকে দেখার সাহস করতে পারিনি। তবে যতোটুকু অবলোকন করার সৌভাগ্য হয়েছে তাতে করে নিঃসন্দেহে যথেষ্ট সুন্দরী মেয়ে বলা চলে। এমন একটা মেয়ের পাশে ঘেঁষাঘেষি করে বসে এই রেল ভ্রমণটাকে যেন স্বার্থক ও চমকপ্রদ মনে হচ্ছে। এইরকম রেল যাত্রাটা বহু দিনের পথ হলেও কোনরকম বিমূর্ত লাগতো না। পৃথিবীর সব প্রিয়জনকে ত্যাগ করে এই মেয়েটিকে নিয়ে সূদুর চাঁদের দেশে বসবাস করাও অমৃত সুখ। তাই মনে মনে অনেক ধন্যবাদ দিতে মন চাইলো টিকেট কাউন্টারের ভদ্রলোকটিকে এমন মিষ্টি মেয়েকে আমার পাশে বসার সুযোগ দানে। কেমন যেন শরীরের তাপমাত্রা বেশ খানিকটা বেড়ে গিয়েছে। এখন শীতকাল নাকি গ্রীষ্মকাল মনে করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না। কোথাও ভ্রমণে বের হলেই মনে মনে ভাবতাম আমার পাশে যদি একটা রোমান্টিক মেয়ে পড়তো তাহলে তার সাথে গল্প-গুজব করে কাটিয়ে দিতাম যাত্রা পথের সময়টা। অনেক নাটক – সিনেমাতে এরকম ঘটনা অহরহ দেখতে পাওয়া যায়। সত্যি কথা বলতে কি এমন সপ্নগুলোকে এই পোঁড়া কপালে সব সময় গুড়ে বালি পড়েছে। কোনো একদিন হয়তো কিছু ঘটেছে তবুও বয়স্ক মহিলা। অথচ সত্যিকার অর্থে অন্তত আজকে কখনো এমন কল্পনা করার ইচ্ছা জাগ্রত হয়নি কেন বলতে পারবো না। কিন্তু মেঘ না চাইতেই হঠাৎ ঝমঝম বৃষ্টির মতো হয়ে গেল।
সুঁচকো চোরের মতো আলগুছিয়ে আবারও খানিকটা দেখার চেষ্টা করতেই ওর নজর এড়াতে পারলামনা চোখাচোখি হয়ে গেল। সে যে বিষয়টি আগে থেকেই অনুসরণ করছে তা কিছুতেই বুঝতে পারিনি। যদিও ততোটা চিন্তার কারণ নেই যেহেতু আমাকে চেনার কোনো উপায় ছিল না। তবুও লজ্জায় খপ করে কচ্ছপের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। তবে মেয়েটি আমাকে কিছু বলতে চাই বলে মনে হলো। কিন্তু সে সুজোগ টুকু দেবার ফুরসত আমার হলো না। তাকে পাত্তা না দেয়ার ভান করে বরং বোকামি করা হলো এটা পরে বুঝলাম। আমি কখনোই নিজে থেকে কারো কাছে ছোটো হতে চাইনি। তাই সবসময় আশা করতাম ইচ্ছে করে কেউ এসে আমার সাথে সম্পর্ক করুক। কিন্তু এমন সৌভাগ্য আমি চাইলে আর হতে চাই না। তবে এমন ঘটনা যে একেবারে ঘটেনি তা নয়, তিন চারটি মেয়ে রীতিমতো আমার জন্য পাগল প্রায় ছিল। অথচ কেন যেন তাদের কোনোভাবেই ভালো লাগতো না।
আমি ওদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় একজন বিষপানে আত্মহত্যাও করার চেষ্টা করেছিল। ভাগ্যিস আল্লাহ এমন দুর্ঘটনা থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে আমাকে রক্ষা করেছে। কেউ কেউ আচ্ছামতো আমাকে অভিশাপ করেছে প্রেম প্রস্তাবে রাজি না থাকায়। কিন্তু আমি যাদের পছন্দ করি তাদের আবার নিজে থেকে কিছু বলবো তারও উপায় নেই, কেননা দূর থেকে অনেক কিছু বলবো ভাবলেও মেয়েদের কাছে গেলেই বোবা আর তোতলানো হয়ে যায়। সাজানো কথার ফুলঝুরি গুলো গ্রীষ্মের খরোতাপে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। ইচ্ছে থাকলেও কোনো কথা বলতে পারি না। নেশাখোরদের মতো একলা মনে মনে আবোল তাবোল বকি। ধু-ধু মরুভূমির বুকে বালুকাবেলায় হারিয়ে যাওয়া গুপ্তধন আলাউদ্দীনের চেরাগ খোঁজাই ব্যস্ত। যাত্রাপথে আমার একফোঁটাও ঘুম আসতে চায় না। জানালা দিয়ে প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য অবলোকন করতে ভালো লাগে। অথচ এটুকু সময়ের মধ্যেই মেয়েটি বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। একটু আকটু গল্প-গুজব করবো সে আশায় ছাই ঢেলে দিল। ইচ্ছে করে কিনা জানি না তবে বারবার আমার কাঁধে ভর দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চাইছে। আমিও তাকে স্বর্গীয় ঘুমের সুখ দিতে কাঠের পুতুলের মতো শক্ত হয়ে আছি। নড়াচড়া করছি না ওর ঘুম ভেঙে যাবার ভয়ে। আর আমিও চরম আনন্দে আবেগপ্রবণ হয়েছি নারীমাংসের ছোঁয়াতে।
যাই হোক, মুখ ভালো করে না দেখতে পেলেও যতটুকু দেখেছি এক কথায় আমি মুগ্ধ। এমন একটা মেয়ে সঙ্গে থাকলে পৃথিবীতে আর কিছু চাই না, বাকিটা সময় দিব্বি কাটিয়ে দেওয়া কঠিন কিছু নয়। মনের মতো সুন্দরী যদি বউ থাকে তাহলে জীবনে অপূর্ণ বলতে কিছু থাকে না। সত্যিই, কেন যেন মনে হয় আমি ওর প্রেমে পড়ে গেছি। হাজার বছরের পরিচিত অতি আপনজনের সক্ষ্যতা লক্ষ্য করছি। হৃদয়ের মধ্যেখানে অসম্ভব অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আচমকাই একশো কিলোমিটার বেগে তেড়ে আসা সুনামি ঝড়ে আমাকে তোলপাড় করে তুলেছে। হঠাৎ লুকানো অতীত লণ্ডভণ্ড করে দিল বুকের পাঁজর। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না কোনোভাবেই। এতো শীতের মধ্যে সারা শরীর ঘামে ভিজে জ্যাবজ্যাব করছে। জরুরি প্রয়োজন হয়ে উঠলো অক্সিজেনের সিলিন্ডার। কিন্তু কি করবো বুঝতে পারলাম না, মনে হলো মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় প্রহর গুনছি। কখন যে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় বলতে পারি না। ভেতরে ভেতরে এতোকিছু হয়ে গেলেও পাশের জনকে একটুও বুঝতে দেইনি আমার ব্যাপারটা। বাধ্য হয়ে শীতের পোশাক ও মুখমণ্ডল ঢাকা টুপি সব খুলে ফেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চাইলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
সংজ্ঞায় যখন ফিরলাম তখন বুঝলাম কোন ফাইভ স্টার হোটেলের নরম বিছানার কোল বালিশে আয়েশে লেপটে আছি। এসব হোটেলের বিল বেশি হবে না কেন? মনে হচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ে আছি, মুরগি যেমন তার বাচ্চাদের বুকের ভেতর আগলে রাখে তেমনি করে কেউ যেন জড়িয়ে রেখেছে মমতাময় পরশে। এমন কোমল তুলতুলে উষ্ণ জায়গা ছেড়ে কোনোভাবেই চোখ খুলে তাকাতে ইচ্ছে করলো না। যতক্ষণ মন চায় নিশ্চিতে ঘুমানোর অবকাশ হাতছাড়া করার সুজোগ অবহেলায় নষ্ট করবো না। বরং অনুভব করছি কোনো অকৃত্রিম প্রেয়সীর হৃদয় নিংড়ানো ভক্তিপূর্ণ ভালোবাসার বাহু বন্ধনে আবদ্ধ আছি। অনন্তকাল পর্যন্ত এভাবে থাকার সৌভাগ্য থেকে কেউ বিমুখ হবে না। জীবনে পাপ ও পূর্ণ কতটা করেছি বলতে পারবো না তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, স্বর্গরাজ্যের হুরপরীর সুগন্ধি অনুভূত আমাকে পেয়ে বসেছে। চরম অজানা উন্মাদনায় আমি যেন পুলকিত। তাই পরম আবেগে নেথিয়ে পড়া শরীরে বিদ্যুৎ সঞ্চারিত কেন্দ্রের ন্যায় উদ্যোমী। কিন্তু বুঝলাম না আমার মাথা যেই নরম জায়গায় সেঁধিয়ে রেখেছি সেখানে ক্রমাগত সংকোচন প্রসারণ হচ্ছে। মনে মনে কিছুটা আগন্তুক ভয় অনুভব করলাম। তবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবার সাহস হলো না, লিলিপুটেরা যেভাবে গ্যালিভারকে শক্তকরে বেঁধে রেখেছিল তেমনিভাবে আমিও আধমরা হয়ে পড়ে আছি।
হঠাৎ করেই ট্রেন স্টেশনে থামতে গিয়ে কষে ব্রেক করে। আচমকা ধাক্কায় নরমাংসের উপর আছড়ে পড়ে পুরোপুরি চেতনা ফিরে এলো। চোখ মেলে দেখলাম একটা মেয়ের বুকের মধ্যে লেপটে আছি। উঠতে চাইলাম কিন্তু সে আমাকে বাঁধা দিল। তবু লোকলজ্জার ভয়ে জোর করেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম।
-স্বর্না…, তুমি?
-হুম…,
-ছি, অন্যরা কী ভাববে বল তো?
-কেউ কিছু মনে করবে না। তুমি কিছু মনে করেছো? এরা সবাই জানে আমরা স্বামী-স্ত্রী।তোমার বিপদের সময় অনেকেই এগিয়ে এসেছে, মাথায় পানি দিয়ে কিছুটা সুস্থ করে আমাকে আগলে রাখতে বলেছে। প্রথমে আমি অনিহা প্রকাশ করলেও পরে তোমাকে চিনতে পেরে কাছে টেনে নিয়েছি।
-ইস! ভাগ্যিস তুমি ছিলে!
-আমি তো সবসময় তোমার বিপদ আপদে পাশে থাকতে চেয়েছিলাম।
-ভাগ্যে নাই।
-তুমিই চাওনি। কাপুরষ কোথাকার; আমি তোমার জন্য অন্ধকার রাতে বাড়ি ছেড়ে একাকী পালিয়ে আসলাম আর তুমি আসতে পারনি। সারারাত স্টেশনে বসে কাটিয়েছি। যাক সে সব কথা। বল, তুমি কোথায় যাচ্ছো?
-ইন্সুরেন্স এর কাজে খুলনা যাব, তুমি?
-আমিও। খুলনা হাসপাতালে চাকুরি করি।
-তোমার স্বামীও কি ডাক্তার?
-হুম! আমরা দুজনেই একি হাসপাতালে আছি। তুমি বিয়ে করোনি কেন?
-এমনি।
-চল, এখন নামতে হবে। শিহাব স্টেশনে এসে অপেক্ষা করছে।
-তোমার স্বামী?
-হুম! কদিন আছো? সময় পেলে বাসায় এসো।
-চেষ্টা করবো।
– তোমার চেষ্টা কখনো সফল হবে না। আমি চললাম।
– ঠিক আছে, সাবধানে যেও।
-আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না বরং তুমি নিজেকে নিয়ে ভাবো।
আজকে সুজোগ পেয়ে স্বর্না আমাকে অনেক উপদেশ দিয়ে গেল। আমার সামনে উঁচু গলায় কথা বলার সাহস কোনোদিন ছিল না। কিন্তু এমনভাবে কথাগুলো বললো যা শেলের মতো বিঁধলো আমার বুকে। কিছুই বলতে পারলাম না শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম তার পেখম মেলে পথ চলা। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে বোঝাতে অসামর্থ্য হলাম। শ্রাবণ মেঘের বর্ষার দিনের মতো অঝোর ধারায় চোখ ফেটে অনবরত লবণাক্ত অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়লো। দুচোখ ঝাপসা হয়ে গেল, সামনে ভালোমতো কিছুই দেখার অবকাশ থাকলো না। বাধ্য হয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে সামান্য হলেও গতিরোধ করলাম। জীবনে এই প্রথম এমন রেলযাত্রা কখনো কল্পনা করিনি।