অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৪, ২০২৪
১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৪, ২০২৪
১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দীলতাজ রহমান -
মানবতা ও পাখবতার রজ্জু

E:\Anupranan Antorjal 3nd Issue- To Shafik For editing- 3rd Oct 2022\Antorjal 3rd Issue_22.10.2022\11.Antorjal 3rd issue- Choto Golpo-13\diltaj.jpg

অস্ট্রেলিয়া থাকাকালীন একদিন দেখলাম আবীর একটা তেলচিটে প্লেটে কোয়েলের তিনটে ডিমের ছবি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে। ডিম দেখার আগেই দেখলাম, আমার দীর্ঘ চেনা সে প্লেটের চল্টাওঠা দাগ, আমার বাড়ির জানালা, দরজা, বারান্দার গ্রিল। আর গ্রিলের জন্য ছবিতে আকাশ-টুকরোকেও মনে হচ্ছিল আমার বড় চেনা এক পরিসর! আমি কমেন্ট বক্সে লিখলাম, এমনিতে বাড়ি কাজের লোক নেই, তার ওপর আবার এই আপদ কে জোটাল? উত্তরে আবীর লিখল, ‘আমি কিনেছি, আমিই পুষব!’

আবীরের উত্তরটা মুখ ফসকে যে কাউকে যা তা বলা স্বভাবের রূঢ় আমাকে কিছুটা নমনীয় করল। ভাবলাম, কোনো কিছু পুষলে মানুষের অন্তর তৃপ্ত হয়। অনেকরকম বোধের উন্মেষ ঘটে। পোষা-পুষি সেই অর্থে ঠিক আছে। আবীর আমার ছোটো বোন শারমিন সুলতানা রীনার পুত্র। সে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ে। আবীরদের বাসায় আবীরের বড়বোন বাঁধনের বিড়াল পোষার অস্বাভাবিক নেশা। নিজের টাকায় খাবার কিনে দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তার কুকুরদের খাইয়ে আসে। ভাগ্যিস বাসাটা দোতলায়। তাই বাসায় কোনো কুকুর এনে সে তুলতে পারেনি। তবে বিড়ালে তাদের বাসা ঠাসা বলে আমি নিজেই ও বাসার পথ মাড়াই না। আর আবীরও আমাদের বাসায় এসে থাকে বিড়ালের উৎপাত ছাড়া নির্বিঘ্নে বসবাস করতে। সেই নির্বিঘ্নে অবস্থা-কামীর দ্বারা যদি আমার নির্বিঘ্নে অবস্থায় বিঘ্ন ঘটে, বাড়ির অভিভাবক হিসেবে যত দূরেই থাকি না কেন, একটু শঙ্কা তো মনে বাজেই! যথাসময়ে দেশে ফিরে, ঘরে ঢুকেই যে শব্দ শুনি, তা কোনোভাবেই কূজন নয়, রীতিমতো একলার চেঁচামেচি! বললাম, চেঁচানোর শব্দ আসে কোত্থেকে? বাসার কর্ত্রী চাকরিজীবী আমার ছোটো কন্যা ফারজানা রহমান। তিনি বললেন, ‘আবীরের কেনা দুটি কোয়েল থেকে কদিন আগে একটা মরে গেছে। ওটা মরার আগে কোনো চেঁচামেচি ছিল না। একটা মরার পর আরেকটা এইভাবে চেঁচাচ্ছে!’

কন্যার উত্তর শুনে মনে মনে ভাবলাম, এমন অবস্থায় মানুষ চেঁচালে যারা দোষ দেয়, তাদের সব বাড়ি একবার করে এই পাখিকে পাঠানো উচিত। কারণ প্রকৃতির শিক্ষাই হলো আসল শিক্ষা। এর বাইরের শিক্ষা আরোপিত এবং অসম্পূর্ণ শিক্ষা! কুকুরের লেজ টেনে ধরে রেখে তাকে স্বাভাবিক সোজা প্রমাণ করার শিক্ষা। একবার ফেনীর নতুন বাড়িতে ক’টা দেশি মোরগ-মুরগির সমাগম ঘটাতে চাইলাম। এ-বাড়ি ও-বাড়ি খবর দিয়ে কটা সুস্থ মুরগি জোগাড় করতে পারলাম বটে। কিন্তু তাদের বিস্তার লাভের জন্য একটিও বীর্যবান মোরগ আর পাই না। বাজার থেকে কিনে আনলে সে যদি পালে মড়ক লাগায়, শেষে যাদের পালে ফোটা কয়েকটা মোরগ আছে, চেনা এমন একজনকে খবর পাঠিয়ে এনে, সুগন্ধি জর্দায় ডবল খিলি পান খাইয়ে, বাকি জর্দা কৌটাসমেত হাতে দিয়ে, আরেক হাতে তিনগুণ দাম ধরিয়ে বললাম, তোমাদের বাড়িতে মোরগ আছে জানি। একটি মোরগ পাঠিয়ে দিও।

মোরগ বিক্রি করলে ধারে-কাছের পড়শির উপকার হবে, তাই হৃদয়ের ওপর এত বড় ফাঁড়া নিয়ে সে মোরগ বিক্রিতে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু হাতে তিনগুণ দাম কড়কড়ে নোটটা ফেরতও বুঝি দিতে ইচ্ছে করল না। এমন দশার ভেতর মোরগ একটা এনে দিল বটে। কিন্তু সে মোরগ আমার নানান বয়সী একপাল মুরগি দ্বারা পরিবেষ্টিত থেকেও, তবু পাশের বাড়ির কোনো মুরগির কুনকুন একটু ডাক শুনতে পেলে, ককক্ক ককক্ক ক করতে করতে দৌড়ে চলে যায়। যেতে যেতে গ্রীবার পেখমে যে ভাবখানা তার ফোটে, যেন ভীষণ মহৎ উদ্দেশ্য রক্তে টগবগ ফুটিয়ে যাত্রা করছেন তিনি! মনেপ্রাণে তখন তার তীব্রপণ, যেন আমি আসছি তোমাদের সব যাতনা বধে। এদিকে বাড়ির মুরগিগুলো যেমন দানা খুঁটে খাচ্ছিল, তারা তেমনি খেতে থাকে! কোনোটাই তাদের সে সবেধন একমাত্র নীলমণি মোরগের পথ আটকে বলে না, এই যে আমরা এতজন আছি তো! পেছনে পেছনে কম বয়সী দুই-একটাও বোহেমিয়ান সে পতির সাথে বিহারে যায় না! অথচ মনুষ্য-আচারের বৈপরীত্য, মোরগের এসব অনাচার চোখে পড়ে অধিকার বোধের মতো প্রবল মর্মজ্বালাটি আমার একলার প্রাণে ভীষণ তড়পাতে থাকে। আমি আমার চৌকশ সহকারি মমতাজকে ডেকে বলি, বিধাতা পুরুষ তাহলে নারীর ভেতর কেন এতো ঈর্ষা দিয়েছেন রে? স্বামী বা প্রেমিক-পুরুষের মনোযোগ, ভালোবাসা, যৌনক্ষমতা এবং তার সহায়-সম্পত্তি, স-ব, সব তার স্ত্রী বা প্রেমিকা নিজের সুরক্ষায় কেন রাখতে চায়!

কালে কালে নারী-পুরুষ উভয়েরই সম্পর্ক এবং জীবন বেদম ভারাক্রান্ত এই এমন একটি বিষয়ের অধিকারের চর্চা নিয়ে, যা শতবার দলিল করিয়ে নিয়েও নিশ্চিত থাকার উপায় নেই! তবু শুধু একে একটা ঘেরাটোপে বাঁধতে এ নিয়ে কত হাদিস-কালাম, ধর্ম ও আইনের শক্ত শক্ত শর্ত প্রয়োগ! প্রাণিজগতের এইসব কাণ্ড দেখে-শুনে আমার তো ইচ্ছে করছে, জোর গলায় বলি, এই মোরগের প্রবণতা দিয়েই তো বিধাতা পুরুষমানুষ গড়েছেন। তাহলে আইনকানুন সেই ধাতে ফেলে, শর্তগুলো সেরকম আরও খোলাসা হতে পারত। আর নারীগুলোকে বিধাতা কেন শুধুই মুরগির মেজাজেই বানাতে পারলেন না! যাদের শেয়াল-বেজি, কাক-চিলের মতো ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষের সাথে লড়াইয়ের তাগদ থাকলেও ঘরের পুরুষকে আটকানোর কোনো প্রবণতা, কোনো আগ্রহ-ভালোবাসা থাকবে না!

পুরুষকুলকে কেবল তাদের ইচ্ছেমাফিক তারা সন্তানের বীজদাতা করে রাখা ছাড়াও হেলায়-ফেলায় মাঠের ফসল তোলার চাষিগিরি, চাক ভেঙে মধু আনার মৌয়ালগিরির মতো আরও এমনি সব কাজের জন্য যদি পোষ্য মানে বশ করে রাখত, সেটাই বেশ হতো। তাহলে নারীই হতে পারত জগৎ-সংসারের একমাত্র অধিকর্ত্রী। নারী তখন বনের অন্যান্য বন্য পশু- ঘোড়া, গাধা, হাতি, জিরাফ, হরিণ ছাড়াও বাঘের দিকেও নজর দিত ঘরে এনে পুষতে। কারণ রাখালসম পুরুষগুলোর ভরণ-পোষণের মূল্য উসুলের চিন্তা তখন নারীর মাথায় বড় হেডেক হয়ে থাকত! নিশ্চয় তখন রেওয়াজটাও অন্যরকম হতো, যার দখলে যত বেশি পুরুষ থাকত, সে নারী ততো বেশি সম্মানিত, ক্ষমতাধারী, প্রতিপত্তিশালী! এমন প্রথা-ই চালু থাকলে, ঘরের বাইরে থেকে টানাপাখা টানতে টানতে পুরুষ তখন বুঝত স্ত্রীর ওই দাবড়ে ধরে ভালোবাসার চাষবাস, যত্ন-আত্মি তার জন্য কী রক্ষাকবচ! এমনকি তার ওই আত্মঘাতী অধিকারবোধ আরোপ তখন কী মধুর!

আসলে সৃষ্টি এবং রক্ষার প্রধান কাজটি যে নারীই করে, তা বাঘের দিকে তাকিয়ে নারীর পক্ষেই রায় দিন বিজ্ঞ বিচারকমণ্ডলী! কেন যে ঈশ্বর স্বামীর ওই ঠুনকো, পতনজাত বীর্য রক্ষায় জীবন বিপন্ন করা অমন শাঁখের করাতের মতো করে দামি ঈর্ষাটুকু গুঁজে দিলেন সুজলা-সুফলা নারীর কোমল প্রাণের ভেতর, যাতে করে পৃথিবীর রূপই পাল্টে গেলো এবং যার মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগে সমাজও তাকে, মানে নারীকে কখনো খল ঠাওরায়। শুরু থেকে নারীকে মানবতাবোধের চেয়ে পাখবতা বোধটা বেশি শেখাতে পারলে, পুরুষের সাথে নারীর সম্পর্কের আঁটোসাঁটো ভাবটা কমে আসবে। তাতে রক্ষা পাবে অনেক সংসার। কোনো শিশুকে আর চোখের সামনে পোহাতে হবে না, মা-বাবার সম্পর্ক ভাঙার মর্মান্তিক যাতনা!

ঘরে বিপত্নীক কোয়েলটি নিয়ে এইসব ভাবনার ভেতরে একদিন আজিজ সুপার মার্কেট যাওয়ার দরকার হলো। ড্রাইভার বাংলামোটরের জ্যাম এড়াতে কাঁটাবন হয়ে ঘুরে গেল। এতে করে রাস্তার পাশে অপ্রত্যাশিতভাবে পাখির দোকান দেখে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললাম। কয়েক দোকানে খুঁজেও কোয়েল পেলাম না। শেষে এক দোকানে আধাখাস্তা তিনটে পেলাম। আমার দরকার একটি নারী কোয়েলের। ও, আমারইবা দরকার কোথায়? দরকার তো ওই মাথা গরম পুরুষ কোয়েলটার, যে আস্ত পৃথিবীর প্রতি মারমুখী হয়ে আছে! দোকানি নারী কোয়েল বলে যেটা দিতে চাইল, আমার সন্দেহ যাচ্ছিল না কোয়েল-নারীর আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য না জানা থাকায়। তাই দুটো একসাথে নিলাম।

সদ্যকেনা কোয়েল দুটোই মুমূর্ষু ছিল। তবু অনন্যোপায় হয়ে কেনা যেহেতু! দুপুর পেরিয়ে বাসায় এনে কোয়েল দুটোকে খাঁচার ভেতরে ঢোকাতেই পুরনো কোয়েলটা মুহুর্মুহু একটা ছেড়ে আরেকটা যেভাবে ধরছে, তাতে আমি তো আমি, যে কারওরই তাজ্জব না বনে উপায় ছিল না! আবারও ভাবতে লাগলাম, তাহলে সেই তো মানুষেরই আর দোষ কী! প্রায় বিশ বছর আগে আমারই এক প্রকৌশলী বান্ধবী ফেলে আসা দিনের কথা বলতে বলতে কখন তার স্মৃতির পুরো ঝাঁপি খুলে গেছে, সে তা টেরই পায়নি! না হলে এমন করে আর কজন বলতে পারে, ‘মা মারা গেলে ক’দিন না যেতে বাবা আবার বিয়ে করতে চাইলেন। আমাদের চার ভাইবোনেরই তখন বিয়ে হয়ে গেছে। তাই আমরা ভাইবোনেরা সবাই মিলে মানা করলাম। কেউ কেউ বললামও, আপনি মারা গেলে আমাদের মা কি এরকম কথা বলতে পারতেন? ভাইয়ের বৌয়েরাও বাবাকে বলল, আব্বা আপনার কোনো অযত্ন হবে না…।

কিন্তু আব্বা তবু বিয়ে তো করলেনই, তাও কোনখান থেকে এক কমবয়সী মেয়েকে বিয়ে করে আনলেন। তারপর আব্বার সকালে গোসল করার পানি আমরাই কল থেকে চেপে বাথরুমে পৌঁছে দিতাম। কিন্তু আব্বা সে বেটির গোসলের পানি চাপতে চাপতে বুকে ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আব্বা অসুস্থ হলে আমরা সবাই হাসপাতালে আব্বাকে নিয়ে ব্যস্ত। আর খালি বাড়ি ফেলে বেটি ভেগে গেছে। ভয়ে। ভেবেছিল, আমরা হয়ত তাকে দোষারোপ করব, মারব! আব্বা হাসপাতাল থেকে আর ফিরতে পারেননি। তারপর আব্বার কুলখানির আগেই ভাইয়েরা সে বেটিকে খুঁজে কাবিনের টাকা শোধ করে আসছে, আব্বাকে দায়মুক্ত করতে!’

পাখির কাণ্ডকারখানা দেখে কদিন ধরে এই গল্পও আমার মন থেকে মাথায় উঠে কাকের মতো ঠোকরাচ্ছে। এখন ভাবছি, এই কাহিনির সবই ঠিক ছিল, খালি যার গোসলের পানি তাকে চেপে নিতে বললেই হতো! আর বাপের কাবিনের টাকাছেলে-মেয়েদের হাতে শোধ হওয়াটাও একটু কেমন যেন ঠেকে। তাই মানুষ বোধহয় এইখানেই এসে ঠেকে গেছে! পাখি হতে তার এখানেই বড় বাধা! শেষ বয়সে আরেকটি বিয়ে করলে, পিতার স্নেহ-মমতা ভাগ হওয়ার সাথে, জন্ম নেওয়া নতুন খুদে শরিকের পাতে চলে যায় সম্পত্তির সমান ভাগও। শেষে এই মানবিক আর পাখবিক দুইরকমের দুইটি বিষয় রজ্জুর মতো আমার সমস্ত চৈতন্য এক করে একটানা পাকাতে লাগল। সেদিন নতুন পাখি খাঁচায় ঢোকানোর পর, বাকি সেটুকু বেলা আর চেঁচামেচি শোনা গেল না।

কিন্তু রাত একপ্রস্থ পার হতেই আবার একটার প্রাণঘাতী চিৎকার! চিৎকারের কারণ জানতে চাইলে, মাত্র একদিন আগে কিশোরগঞ্জের কোনো এক গ্রাম থেকে কাজের জন্য আসা ষাটোর্ধ্ব মহিলা, যাকে ইতোমধ্যে খালা বলে ডাকতে শুরু করেছি, সে-ই বলল, ‘এইহানো ব্যাডা দুইডা, আর মাইয়া একটা! এক মাইয়ারে লইয়া, দুই ব্যাডার খুনাখুনি…!’ আমি সে মৃত্তিকা-ঘনিষ্ঠ জীবনের অধিকারি খালাকে সাক্ষী মেনে বললাম, কিন্তু তুমিও তো দেখলে, আনার সাথে সাথে পুরান কোয়েল যা আচরণ করল, তাতে তো মনে হলো, নতুন দুটোই মেয়ে!

খালা বলল, ‘তহন কি আর ব্যাডা চোউখ দিয়া দ্যাকছে? এহন যহন মাথার আগুন কমছে, এহন দিশা বাইরাইছে!’

আমি বললাম, তাহলে ঠ্যাকায় পড়লে পাখিও সমকামী হয় বলছ? সমকামী শব্দটি আগে না শুনলেও খালা ফেরে পড়ে বুঝে গেছে। শেষে আমার দিকে তাকিয়ে সরু-চোখে বলল, ‘দ্যাকলা তো নিজের চোউখ্খে!’

এরপর আর সময় ক্ষেপণ চলে না। আমি খাঁচার কাছে গিয়ে দেখলাম, নতুন দুটোর একটার মাথা বেয়ে রক্ত পড়ছে এবং যন্ত্রণায় সে মাথা তার ঘাড়ের ভেতর সেঁধিয়ে আছে। বুঝলাম ঘায়েল হওয়াটা নতুন পুরুষ! যদিও এই কতল হওয়া মাথা নিয়ে নারীঘটিত বিষয়ে এর পুরনোটার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাওয়ার সাহস-ক্ষমতা কোনোটাই আর হবে না, তবু ড্রাইভার জহীরকে ডেকে বললাম, এটাকে জবাই করে আনো। জহীর সেটা জবাই করে চামড়া ছিলে, একটুকরো কাগজে মুড়ে ঢিল ছোড়ার মতো করে ডিপফ্রিজে ছুঁড়ে মারল। আর খালা ছুটে এসে তু তু করে বলল, ‘জবাই না কইরা ছাইড়া দিলে কি অইল অইলে?’

আমি বললাম, মায়া লাগতেছে?

খালা উত্তর দিল, ‘অয়ও!’

বললাম, মুরগি খাও না? গরু? হরিণ? মোষ? তখন মায়া লাগে না? এটাও তো টাকা দিয়া কিনছি! তাই একসময় ভেজে খেয়ে ফেলব নে!

খালার চোখ ভিজে উঠলেও এতটা ভয় পেতাম না! কিন্তু দাবানল শেষের বন আমি দেখেছি। পুড়ে কয়লা হওয়া গাছ থেকেও ডাল জন্মে। ভয়ঙ্কর সে দৃশ্য! তাই আপাতত খালার সামনে থেকে সরে গিয়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঠেকালাম। এরপর এক খাঁচায় সুখে-শান্তিতে বাকি কোয়েলদ্বয় বসবাস করলেও আবীরের তাতে আর আগের মতো আগ্রহ টের পেলাম না। জীব-জন্তু, পশু-পাখি পুষতে আমারও ভালো লাগে। কিন্তু তা মনে মনে। কারণ অত বাহুল্য সময় আমার জীবনে কোনোকালে ছিল না, যে, নিরালায় বসে পাখির অধিক নিজের সাথেও দুটো অনিবার্য কথা বলি! এই কদিন আগে আবীরকে বললাম, একমাস না যেতেই খালা তো তার নাতিপুতির টানে চলে গেছে। তুমি যেহেতু কিনেছ, এখন পাখিকে ঠিকভাবে খাবার দেওয়া, মাঝে মাঝে তোমার সাথে বাথরুমে নিয়ে তাদের গোসল করানো এবং সাধারণভাবে পরিষ্কার করার দায়-দায়িত্ব তোমার। না হলে কিন্তু গোনাহ হবে। পশু-পাখি পুষলে তা দরদ দিয়ে পুষতে হয়। আর গোসল মানে তো, তুমি নিজের গোসলের সময় খাঁচাসহ ওদেরকে তোমার পায়ের কাছে রেখে দিলে শাওয়ারের ছিঁটে আসা পানিতেই ওদের গোসল হয়ে যায়…।

আবীর গলা ঝাড়া দিয়ে বলল, ‘এবার তো আপনি কিনছেন! আমি আগেরবার কিনছিলাম!’

আমি বললাম, ‘ওম্মা, তাই নাকি? তোমার কেনা পাখি একটা মারা যাওয়াতে আরেকটার চিৎকারে টিকতে না পেরে বিরহী সে পাখির প্রতি মায়া, আর তোমাকে সম্মান করেই না এত হ্যাপা করে আমি কিনলাম,আর তাতেই আমার দোষ?’

আবীর বলল, ‘তয় কি? আমি কি আবার কিনতে গেছিলাম নাকি?’ বুঝলাম, তার মোহটুটগিয়া! তবু খাবার ফুরিয়েছে দেখে, সে দুদিন আগে পান্থপথ বাসা থেকে হেঁটে যাওয়া-আসা করে কাঁটাবন থেকে পাখিদের খাবার এনেছে। কিন্তু খাবারই তো শেষ কথা নয়! পাখি বেচারিদের পুরোপুরি যত্ন হচ্ছে না দেখে আমার মনটা খুব কাতরাচ্ছিল। কী করি, কাকে দিই! যাকে তাকে তো পোষা পাখি দিলে হবে না। দিতে হবে যে এগুলোকে ভালোবাসবে। আবার যাকে দেব তাকে হতে হবে আমাদের ভালোবাসার মানুষ!

চ্যানেল আইয়ের নামকরা সাংবাদিক আদিত্য শাহীন ও ‘পারি’ পত্রিকার সম্পাদক লাইলা খালেদার বৃক্ষপ্রেম দেখে, আদিত্যর স্ত্রী লাইলাকেই বললাম, ‘আমার একজোড়া কোয়েল আছে। তোমাকে দিতে চাই।’

লাইলা বলল, ‘দেন আপা, খাবার কিনে নিচে কেয়ারটেকারদের কাছে রাখব…।’ লাইলার কথায় মনটাতে একটু মোচড় দিয়ে উঠল। মনে মনে ভাবলাম, এত কম যে ভালোবাসবে, অথবা বাসবেই না, তাকে এতদিনের পোষা পাখি সমর্পণ করা যাবে না! লাইলাকে দিলে নতুন পাখি কিনে দেওয়া যায়।

পথের ভেতর আবীরের মা’র কথা মনে হলো। তিনি আবার ইদানীং ছড়া লিখে বেশ খ্যাতি পেয়েছেন। সেই সুবাদে ফোনও ব্যস্ত থাকে। মানে বন্ধু-বান্ধব বেড়ে গেছে। তবু তাকে ফোন দিয়ে সাথে সাথে পেয়ে গেলাম এবং বললাম, আবীরের পাখি জোড়া তোমরা রাখো। ছড়া-সাহিত্যিক বললেন, ‘আমাদের ঘরভরা বিড়াল। সমবেত হয়ে তারা খাঁচার শিক ভেঙে এক লহমায় ও দুটোকে কাড়াকাড়ি করে খেয়ে ফেলবে!’

সব শেষে মন এক ভিন্নমুখ খুঁজে পেল, কোয়েল গ্রহীতা হিসেবে যে হবে সেরা উপযুক্ত। কবি অঞ্জনা সাহার তিন বছরের পৌত্রীর মুখ মনে পড়ল। সাথে সাথে দ্বিতীয়, তৃতীয় মনও, মানে একটা মানুষের যে ক’টা মন থাকে তার সবই এসে এইমুখের পক্ষে সায় দিল।

আবীরকে ডেকে বোঝালাম, পাখি পোষা দোষের নয়, যদি তুমি তাকে ভালোবাসো। পাখির কাছ থেকে আকাশ ছিন্ন করে খাঁচায় ভরেছ, ঠিক আছে। কিন্তু তাকে ভালোবাসা দিয়ে তো তা পুষিয়ে দিতে হবে! বন্দিত্বেও যে কেউ কিছুটা সার্থকতা খুঁজে পেতে পারে, যদি তার মনে হয়, শুধু ভালোবাসতেই কেউ আমাকে বন্দি করেছে। কিন্তু ভালো না বেসে অবারিত স্বাধীনতা থেকে যে কাউকে বন্দি রাখলে নিজেরও একটি যাতনা সৃষ্টি হয়। নাকি?

আবীর বলল, ‘ঠিক!’

আমি আবীরের অনুমতি পেয়ে কবি অঞ্জনা সাহাকে বললাম, আমি যে কোনো সময়ে তোমার বাসায় একটি জিনিস দিতে আসব। এই প্রতিশ্রুতির পর সময়ের অভাবে কবিকে দুদিন অপেক্ষায় রাখতে হলো। তারপর যখন গেলাম, পৌত্রী অদ্বিতীয়া রাই দরজার কাছেই ছিল। আগে খাঁচাটা নজরে পড়তেই ওইটুকু রাই, সেও বুঝতে পারল ভেতরে পাখি আছে!

তারপর তার বাড়ানো দুহাতে গ্রহণের ভেতর দিয়ে আমার পাখি সমর্পণের কাজটি মধুরভাবে সম্পন্ন হলো। বুঝিয়ে দেওয়া হলো পাখির বাকি খাবারও। যা সে এ বাড়িতে থাকলে আরও কদিন খেত।

এদিকে চাকরিজীবী মেয়ে-জামাই দুজন দুদিন রান্নাঘরের বারান্দায় গিয়ে কোয়েলদ্বয়কে দেখতে না পেয়ে, আলাদাভাবে একই কায়দায় অবাক চোখে জানতে চাইল, ‘পাখি গেল কই?’ আমি দুজনকে একইরকম করে উত্তর দিলাম, কবি অঞ্জনা সাহার পৌত্রীকে গছিয়েছি!

দুজনেই সেই একইভাবে অনিবার্য আরেকটি প্রশ্ন করল, ‘আবীর কিছু বলেনি?’

আমি সেই একইরকম করে দ্বিতীয়বার আরেকটি যে উত্তর দিলাম, বললাম, আবীরকে বুঝিয়েছি, ভালোবাসার বিনিময়ে কাউকে বন্দি রাখা যায়। কিন্তু অবহেলা করে তো বন্দি রাখার দরকার নেই! কোয়েল দুটিকে তাকেই দিই, যে ওদের ভালোবাসবে…!

কথা শেষ না হতেই দুজনেই তাদের শেষের প্রশ্নটি ঝেড়ে দিয়েছে, ‘আবীর কী বলল?’ তিন নম্বরপ্রশ্নটিও সেই আমার একইরকম। বলি, ও তো এমনভাবে ‘দ্যান’ বলল, যে দিতে পেরে বাঁচল বলে মনে হল।

আর যেটুকু শোনার জন্য কেউ-ই অপেক্ষা করে না, তা হল, যে কাউকে প্রতিদানহীন একটানা ভালোবেসে যাওয়া সোজা কথা নয়। সে পাখিই হোক, গাছ কিংবা মানুষ!

কোয়েল অবশ্য কদিন বাদ দিয়ে আবার একটানা ক’দিন একটি করে ডিম্ব দিত। কিন্তু নর্থ সাউথে লাস্ট ইয়ারে পড়া একজন ছাত্রের প্রতিদিন অনেকখানি করে অভিনিবেশ পেতে মাঝে মাঝের সে ডিম্ব আর প্রতিদান হিসেবে কতটুকু!

গল্পটি এখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আবীর আজ মেসেজ-বক্সে লিখে রেখেছে, ‘একটা জবাই করা কোয়েল দেখলাম ফ্রিজে! আপনি কি কোয়েল দুটো আসলে কাউকে দিয়েছেন, নাকি, না দিয়েই দেওয়ার মিথ্যে গল্প লিখেছেন?’

গল্পটি লিখে খাবার একদিন টেবিলে সবার সাথে তা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আবীর তা ভোলেনি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ওর ওই ক্ষুদেবার্তা দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গেল আমার। আমি তার খালা, মানে মায়ের বড় বোন! তাও তার মায়ের পিঠাপিঠি বড় বোন নয়, মাঝখানে আরও দুজন আছে! তাই ভাবছি, সম্পর্কের এই বিশাল ভার আর বয়সের দুস্তর ব্যবধান অমান্য করে সে আমাকে এমন কথা লিখতে পারল কী করে?

তড়বড় করে গালাগাল না করে চোখে খেজুরের কাঁটার খোঁচার মতো শুধু সত্যটা মনে করিয়ে দিলাম। বললাম, ওই যে মনে নেই, পুরনো কোয়েল নতুন একটাকে জখম করার পর জহীর সেটা নিচে নিয়ে গিয়ে জবাই করে আনল?

আমার ওই খোঁচার কাঁটা লেখার পর আবীর পলকা একটু ঝরা পালকের মতো, তাও পাখির নয়, ফড়িংয়ের পালকের মতো শুধু লিখল, ‘ও!’

তারপর আমাকে অবিশ্বাসী ঠাওরানোর জন্য মনে মনে চেঁচিয়ে ওকে দিনভর গালাগালি দিলাম। বললাম, মানুষের বাচ্চা…, তোরা নিজেরাও শান্তিতে থাকবি না, আর অন্যরা কেউ নিজের মতো করে একটু শান্তি বুনে পুলওভারের মতো তাতে মুড়ে থাকবে, তার কোনা ধরেও হেঁচকা টান দিবি!

আদতে তোদের অই বুড়োর মতো অন্যের গোসলের পানি চাপার দায় পূরণ করতে করতে মরণ হোক! পাখি-পশুর মতো অত উঁচু মার্গের স্বাধীনতা ভোগের কৌশল তোরা কখনই আয়ত্ত করতে পারবি না! অথচ দেখ, বাজপাখির দীর্ঘজীবী হওয়ার কৌশল দেখ! মানুষ এখন বাজপাখির জীবন যাপনের ধরন লিখে গলায় ঝুলিয়ে রাখছে, তাতেও যদি সে তার থেকে কিছু বর পায়! অথচ মানুষের থেকে পশু-পাখির শেখার এবং পাওয়ার কিচ্ছুটি নেই। অথচ পশু-পাখির থেকে মানুষের শেখার বিস্তর বিষয় আছে!

তাই ‘মানুষের বাচ্চা’র থেকে নিচু গালাগাল তখন আর আমার মাথায় একটিও আসেনি!

 

+ posts

Read Previous

হাফিজ রহমান-এর গুচ্ছকবিতা

Read Next

কলঙ্কিনী রাধা – দ্বিতীয় পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *