অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৮, ২০২৪
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৮, ২০২৪
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কুমার অরবিন্দ -
মন খারাপের দিন

E:\Anupranon Antorjal\Anupranon Antorjal_5th Issue\Illustration_Antorjal 5\Part_2\Antorjal 5th Issue - Alonkoron, Part- 2\Antorjal 5th Issue - Alonkoron, Part- 2\Romyo Golpo-2\2.jpg

মোবাইল ফোনটা একটানা বেজেই চলছে। কিন্তু ধরতে ইচ্ছে করছে না সিন্থিয়ার। তার আজ ভীষণ মন খারাপ। এত বেশি মন খারাপের দিন তার জীবনে কখনো আসেনি। তার কোনো বয়ফ্রেন্ড মারা গেলেও সে এত দুঃখ পেত না, এত কষ্ট তার অনুভূত হতো না।

দেশের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি সলেমান বি ইসলামের একমাত্র কন্যা সিন্থিয়া। জন্মের পর থেকে মন খারাপের কোনো অনুষঙ্গ তার কাছে ঘেঁষতে পারেনি। মাঘের শীত বা জ্যৈষ্ঠের গরম কখনো তার চৌকাঠ মাড়াতে সাহস পায়নি। একটা সাধারণ মশার কামড় কতটুকু তীব্র হয় তা সে জানে না। ইলিশ মাছ পুকুরে নাকি নদীতে পাওয়া যায় এসব বিষয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি-নিম্নগতিতে তার মনের গতিপ্রকৃতির কোনো পরিবর্তন হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে বা শপিংয়ে যাওয়ার পথে ভিক্ষুকদের অসহায় আর্তি শুনে তার আদিখ্যেতা মনে হয়। সত্যি সত্যি মানুষের এত কষ্ট আছে নাকি, মানুষ এত গরিব হয় নাকি!

তবে সিন্থিয়ার একটা উদার হৃদয় আছে। তার সাবেক এবং বর্তমান প্রেমিকের সংখ্যা গুণে তার এই গুণের বিষয়ে খোঁজ পাওয়া যায়। তার বর্তমান প্রেমিকের সংখ্যা পাঁচজন। আরও একজন ওয়েটিং লিস্টে আছে। পাঁচজনের একজন বাতিল হলেই অপেক্ষমাণকে সে অন্তর্ভুক্ত করবে। এ প্রেমিকদের সঙ্গেও তার শুধু সুখের কথাই হয়, মধুর আলাপন হয়। আগামীকাল কোন কালারের থ্রিপিস পরবে, ঈদে শপিং করতে এবার কোন দেশে যাবে, চুলের ব্রাউন কালারটা আরও কিছুদিন রাখবে কিনা, চোখের মণিতে লেন্স লাগালে কেমন দেখায়, আইশ্যাডো কতটুকু শ্যাডো হলে তাকে আরও আকর্ষণীয় লাগে, ইত্যাদি।

এমন মহাগুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা সাক্ষাতে ও মোবাইল ফোনেও তার আলোচ্য বিষয়। প্রেমিকগণের সাথে সিন্থিয়ার মতের অমিল বা গরমিল যে হয় না তা কিন্তু নয়। তাদের সাথে এই অমিল-গরমিলে তার একটুও মন খারাপ হয় না। শুধু ওয়েটিং লিস্টের জনকে জানিয়ে দেয়, কাল তোমার সাথে বিকালে ঘুরতে যাব। তুমি কি ড্রাইভিং জানো?

বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডাতে সিন্থিয়াই মধ্যমণি। মেসির বিশ্বকাপের রান সংখ্যা নিয়ে বন্ধুদের সাথে আলোচনা হয়। তখন হয়তো বন্ধুদের কেউ একজন ধরিয়ে দেয়— ওটা রান নয়, গোল।

সিন্থিয়া মুখে একটু হাসি নিয়ে আত্মবিশ্বাসের স্বরে বলে, ক্রিকেটে যা গোল ফুটবলে তাই রান; একই কথা। বন্ধুরাও মুখ টিপে হেসে বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে সিন্থিয়াকে সমর্থন করে।

এবার কাতারে তার ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। টিকিটও কাটা হয়েছিল। কিন্তু মাঠে এসির ব্যবস্থা আছে কিনা সেই চিন্তা করে আর যাওয়া হয়নি। কাতারে অনেক গরম, এই মহান তথ্যটা সে তার এক সাবেক প্রেমিকের কাছ থেকে জেনেছিল। তার মাথায় কিছুতেই ঢোকে না মেসি-নেইমারদের মতো হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক কেন এত গরমে একটা ফুটবলের পেছনে হাফপ্যান্ট পরে দৌড়াদৌড়ি করবে? অন্য প্লেয়ারদের লাথিউষ্টা খেয়ে ঠ্যাং ভাঙবে! বড়লোকদের যতসব ছোটলোকি কাজকাম! ছি।

সিন্থিয়াকে কেউ কখনো গোমড়া মুখে থাকতে দেখেনি। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় এক ফুপাতো আপু বলেছিল, গোমড়ামুখী হয়ে থাকলে মুখে দ্রুত বলিরেখা পড়ে। মানুষ দ্রুত বুড়িয়ে যায়। বাইশ-তেইশ বছর বয়সে কত প্রেমিক গেল তবুও সে কখনো মন খারাপ করেনি, গোমড়ামুখে থাকেনি। এজন্য অবশ্য আপুর পাশাপাশি তার বাবারও ভূমিকা আছে। বাবা তাকে কখনো কান্না করার সুযোগ দেয়নি।

জন্মের পরও সে কাঁদতে চায়নি। মায়ের কাছ থেকে শুনেছে, ডাক্তার আংকেল নাকি পা উঁচু করে ধরে পশ্চাদ্দেশে থাপ্পড় মেরে সেদিন তাকে কাঁদিয়েছিলেন। জীবনে অই একবারই সে কেঁদেছিল। অথচ এই মেয়েটাই সারাদিন মুখ গোমড়া করে, চোখ ছলছল করে শুয়ে আছে।

আজ সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। এত মন খারাপ নিয়ে সে পরীক্ষা দিতে যেতে পারেনি। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, কিছুই ভালো লাগছে না। রাফানের সাথে সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার কথা ছিল। সে বারবার কল দিচ্ছে। আইফোনটা আরেকবার বাজতেই সেটা ছুড়ে মারে ওয়ালের দিকে।

সিন্থিয়া কিছুতেই বুঝতে পারছে না সম্রাট তার সাথে এমন কেন করল! যাকে সে এত আদর করে! নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দেয়! সারারাত বুকের ওমে আগলে রাখে! সে এমন বেঈমানি করতে পারল? এত আদর-যত্নের, ভালোবাসার প্রতিদান এই! সিন্থিয়ার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, তার কাছে কি এমন আছে যা আমার কাছে নাই?

মা মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে সিন্থিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলে— মাম্মা জানো, আমার হুলো সম্রাটটা বস্তির এক পুষিকে জুটিয়েছে! সকাল থেকেই তার পেছনে ঘুরঘুর করছে আর বেহায়ার মতো ম্যাও ম্যাও করে ডাকছে! রাত হয়ে যাচ্ছে তবুও তার আসার কোনো নামগন্ধ নেই!

 

+ posts

Read Previous

মুদ্রিত দুঃখের ধারাপাতে

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৫ম সংখ্যা (অক্টোবর-২০২৩)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *