অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া -
সংযোগ

টারসিয়ারি লেভেলের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো বাঙালি মায়েদের মতো। নিজের দেহে সয় এমন সীমার চেয়েও অতিরিক্ত ভার বহন করে বেঁচে থাকে আশ্চর্যজনকভাবে। এক হাজার শয্যার হাসপাতালে পাঁচ হাজার রোগীর অ্যাডমিশন। মেঝেতে, বারান্দায় বেড নেই, তবু বেডশিট বিছিয়ে রোগীদের বিছানা দেয়া হয়। সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয় ক্যাজুয়ালটি বিভাগে। রাস্তাঘাটে বা পত্রিকা অফিস কিংবা থানায় যাওয়ার দরকার নেই। প্রতিদিন সারাদেশে কী পরিমাণ মারামারি হয় এবং সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে তার নমুনা দেখতে হলে সরকারি টারসিয়ারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর ক্যাজুয়ালটি বিভাগে একরাত কাটানোই যথেষ্ট। হাইওয়ের অনতিদূরে যে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি আছে তার ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে বেডসংখ্যা আশিটি হলেও রোগীর সংখ্যা তার তিনগুণ। ইমার্জেন্সি থেকে প্রায় রোগীই এই ওয়ার্ডে স্থান পায়। রোগীর তুলনায় জনবল ঘাটতি প্রায় প্রতিটি সরকারি হাসপাতালেই দৃশ্যমান। বিশেষত ডাক্তার আর নার্সের ঘাটতি চোখে পড়ার মতো। ইন্টার্নিরা ডিউটিতে আসে বলেই কিছুটা রক্ষা। নইলে দুইজন সিএ, একজন অনারারি মেডিকেল অফিসার আর একজন ইনডোর মেডিকেল অফিসার দিয়ে এতো বড় একটা ওয়ার্ড চালানো চাট্টিখানি কথা নয়। ইউনিটের হেড একজন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর আর একজন আছেন অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর। এই দু’জন মিলে সপ্তাহের ছয়দিন সকালে ভাগ করে রাউন্ড দিয়ে ডিসিশন দেন। সপ্তাহে দুদিন ওটি। একদিন মঙ্গলবার আর একদিন রবিবার। মঙ্গলবারে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের ওটি আর রবিবারে অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসরের। সপ্তাহের প্রতিদিনই এখানে অ্যাডমিশন ডে।

সকাল আটটা থেকে ধীরলয়ে যে রোগী আসতে শুরু হয়, তা স্রোতের মতো বেগ পায় মধ্যরাতে। শেষরাতে এসে রোগীর স্রোতে কিছুটা ভাটা পড়ে। মনে হয় রাতদুপুরেই মানুষকে শয়তানে পায় বেশি। ক্যাজুয়ালটিতে এমন কোনো রাত নেই কেউ বলতে পারবে শান্তির। এমনিতেই ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীগুলো ব্যথায় কাতরায়, তার ওপর নতুন রোগীদের আনাগোনা ওয়ার্ডটিকে কুরুক্ষেত্রের ময়দান বানিয়ে রাখে সারাদিন। দু’জন সিএ’র মধ্যে একজন পুরুষ আর একজন নারী। এরা দু’জনে পালাক্রমে নাইট ডিউটিতে থাকে। শনি-সোম-বুধ পুরুষ সিএ’র ডিউটি আর রবি-মঙ্গল-বৃহস্পতি নারী সিএ’র। তাদের ওয়ার্ডে এ মুহূর্তে পাঁচজন ইন্টার্ন চিকিৎসক আছে। সবাই দলবেঁধে একযোগে মর্নিং-ইভনিং শেষ করে। দু’জন করে ইন্টার্ন প্রতিদিন নাইট ডিউটিতে সিএ’র সাথে ওয়ার্ডে থাকে। রাত দশটায় নাইট শুরু হয় আর সকাল আটটায় তা শেষ হয়। নাইট ডিউটিকালীন সিএরা তাদের রুমে বসে এফসিপিএসের পড়াশোনা করে আর মাঝে মাঝে ওয়ার্ডে রাউন্ড দিয়ে ইন্টার্নদের কর্মকাণ্ড দেখে যায়। কখনো কখনো জটিল রোগী এসে পড়লে ইন্টার্নরা সিএকে ডেকে আনে।

ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে যারা অভিজ্ঞ ওয়ার্ডবয় থাকে, তারা অনেক ডাক্তারের চেয়েও হাতেকলমে দক্ষ। এরকম অ্যাডমিশনের নাইটগুলোতে তারাই হাতেকলমে ইন্টার্নদের ইনজুরি স্টিচ্ করতে শেখায়, সার্জিক্যাল ক্লিনিং অ্যান্ড টয়লেটিং দেখিয়ে দেয়। ঘিলু বের হওয়া মাথার ইনজুরিতে শেভ করে দিতে তাদের এতটুকু হাত কাঁপে না।

সেদিন রাতে ডিউটি ছিল নারী সিএ’র। তার নাম ধ্রুবকণা। এমবিবিএস পাস করেছে বছর সাতেক আগে। বিসিএসে চাকরি হওয়ার আগে এক বছর সার্জারিতে অনারারি ডিউটি করে হাত পাকিয়েছে। এরপর সরকারি নিয়োগ পেয়ে দু’বছর গ্রামে যেতে হয়েছিল, ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে। ইউনিয়ন সাব-সেন্টারে থাকার মতো নিরাপত্তা ছিল না। তবু বাধ্য হয়ে থাকতে হতো। ঊর্ধ্বতনকে ম্যানেজ করে চলতে শেখেনি তখনো। ফলে সপ্তাহে ছয়দিনই থাকতে হতো। তার কর্মস্থল একেবারেই অজপাড়াগাঁ। সন্ধ্যা সাতটা না হতেই ঝুম রাত নামে। চারদিকে শেয়ালেরা ডেকে ওঠে। ঝিঁঝির ডাকে কানে তালা লাগিয়ে দেয়। তার যে আয়া তিনি রাতে থাকতেন তার সাথে। ধ্রুবকণা বৃহস্পতিবার বিকেলে বাসায় আসতো বাবা-মায়ের কাছে। শুক্রবারে থেকে শনিবার কাকডাকা ভোরে রওনা দিতো কর্মস্থলের উদ্দেশে। সপ্তাহের পাঁচদিন কর্মস্থলটাকে সে লাইব্রেরির মতো বানিয়ে ফেলে এফসিপিএসের প্রস্তুতি নিতে। এভাবেই একসময় পেশাজীবী হিসেবে তার দু’বছরের গ্রামজীবন শেষ হয়।

ধ্রুবকণার জীবনে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আসলে দুর্ঘটনা ছিল না। ঘটনাই ছিল। ক্লাস টেনে থাকতেই তার প্রেম হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ছেলের সাথে। শহুরে জীবনে বেড়ে ওঠা ধ্রুবকণা আলট্রামডার্ন নয়, তবে আধুনিকা। মুখের শ্রী হতে শুরু করে দেহকাঠামো সবটাই তরুণীর লাবণ্যে ভরা। ফলে যে কোনো ছেলের চোখে সে পড়বেই। গণিতে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির চূড়ান্ত বর্ষে পড়া ছেলেটিও তার ব্যতিক্রম নয়। ছেলেটি মেধাবী। তার ক্লাসে সে শীর্ষস্থানীয় ছাত্র। গণিত নিয়ে তার ভাবনা-চিন্তা অধিক। গণিত ছাপিয়ে হৃদয় যে তাকে কীভাবে হাতছানি দিলো তা ভাবা মুশকিল। ছেলের পিতৃপক্ষে বড়লোক হওয়ায় অপরিণত বয়স হলেও এইচএসসির প্রথম বর্ষে পড়াকালীন পারিবারিক আগ্রহে তাদের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের প্রথম ছয়মাস ধ্রুবকণার জীবন কাটে প্রজাপতির মতো। তারপরেই দেখা দেয় গণ্ডগোল। নিজের ক্লাসে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া ছেলেটি, যার নাম মহাকাশ মন্ডল, তার আচার-আচরণে পাগলামো দেখা দিল। গণিত নিয়ে অতিরিক্ত ভাবতে ভাবতে তার বাস্তব বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে গেল। খাঁটি বাংলায় বললে, ছেলেটা পাগল হয়ে গেল। ভাতের থালায় অঙ্ক করে, ঘুমের বিছানায় অঙ্ক করে। টয়লেটে গেলেও ঘণ্টর পর ঘণ্ট বসে থেকে অঙ্ক ভাবে। দিনকে দিন এই সমস্যা বাড়তে থাকলো। গায়ে কাপড়-চোপর রাখতে চাইতো না। হাওয়ায় আঙুল ঘুরিয়ে খালি লেখে। কী জানি লেখে। শহরের, এমনকি দেশের সব মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো হলো। কিন্তু কারো কাছেই কোনো সমাধান পাওয়া গেল না। তারা এ রোগটাকে নাম দিল সিজোফ্রেনিয়া। স্বামীর ব্রেইন আউট হয়ে যাওয়ায় ধ্রুবকণার দাম্পত্যজীবন বলে কিছু রইল না। ফলে বাঙালি মেয়েদের বিয়ে হলেই অল্প বয়সে মা হয়ে যাওয়ার ব্যাধি তাকে ছোঁয়নি।

মা-বাবা দেখেশুনে খারাপ পাত্রের সাথে বিয়ে দিলেও সেটা পৃথিবীর সেরা পাত্র। আর প্রেম করে পৃথিবীর সেরা পাত্রকে বিয়ে করলেও মা-বাবার কাছে তা হয়ে যায় সবচেয়ে নিকৃষ্ট। ধ্রুবকণার ক্ষেত্রে তা না হলেও তার মা-বাবা একটা সুযোগ পেয়ে গেল। পাগল জামাইয়ের ঘর করাবে না বলে তারা মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসলো। মায়ের বাড়িতে এসে প্রথম দুয়েক মাস তার মহাকাশের জন্যে খারাপ লাগলেও সময় তা ভুলিয়ে দেয়। এরপর এইচএসসির ফাইনাল পরীক্ষা এসে তাকে আরও ব্যস্ত করে রাখল। জামাইয়ের বাড়ির পক্ষ থেকেও আর কোনো যোগাযোগ না রাখায় সবাই প্রায় ভুলেই গেল, ধ্রুবকণার একটা প্রেম করে বিয়ে হয়েছিল। হোঁচট খাওয়া জীবনকে সাজাতে ধ্রুবকণা মেধার যুদ্ধে শামিল হয়। ডাক্তারি পড়ার জন্যে সে সুযোগ পায় মধ্যম মানের এক সরকারি মেডিকেল কলেজে। মেডিকেল কলেজ মানেই এক আজব কারখানা। সাদা কোট পরিহিত ছাত্র-ছাত্রী আর শিক্ষক মিলে কলেজ প্রাঙ্গণকে করে তোলে শান্তির কপোতের মতো পবিত্র। মাঝে মাঝে নষ্ট রাজনীতির ছোবলে তা যে রক্তাক্ত হয় না তা নয়। পাঁচ বছরের পাঠ কাটিয়ে এক বছরের হাতেকলমে শিখে ধ্রুবকণা হয়ে ওঠে পুরোদস্তুর একজন ডাক্তার।

সেই ধ্রুবকণা সিএ’র দায়িত্ব নিয়ে ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে নাইট ডিউটিতে ব্যস্ত। ডিসেম্বরের কড়া শীতের রাতে সেদিন তেমন কোনো রোগী ভর্তি হয়নি। দু’চারজন হালকা আঘাতের রোগী আসলেও তাদের কোনো বেশি সেবা লাগেনি। ইন্টার্ন আর ওয়ার্ডবয় মিলে সে রোগীদের ব্যবস্থা দিয়ে দিয়েছে। কেবল রাত তিনটার দিকে যখন ধ্রুবকণার চোখ লেগে এসেছে তখন ইন্টার্ন একজন এসে ডাক দিয়ে নিয়ে গেছে ওয়ার্ডে। একজন পুরুষ রোগী, বয়স আটত্রিশ-ঊনচল্লিশ হবে, খুব মারাত্মকভাবে রোড অ্যাক্সিডেন্টে আঘাত পেয়ে ভর্তি হয়েছে ওয়ার্ডে। সাথে কোনো অ্যাটেনডেন্ট নেই। ভদ্রলোকের মাথার বাম দিকের প্যারাইটাল বোন ফ্র্যাকচার হয়েছে ভয়ানকভাবে। মুখে ও মাথার চামড়ায় গভীরভাবে কেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রচুর। মুখটা বিছানায় উপুড় করা। ফলে বোঝা যায় না লোকটার চেহারা কেমন। তবে লোকটার জ্ঞান আছে, কিন্তু সাড়া কম। ধ্রুবকণা ওয়ার্ডবয়কে নির্দেশ দিলো ট্রলিটাসহ রোগীটাকে মিনি ওটিতে নিতে। ইন্টার্নদের একজন খুব দ্রুত রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সক্ষম হলো। নার্স একজন আইভি ল্যাকটোরাইড স্যালাইন দিয়ে ব্লাড ভল্যুম বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, যাতে ব্লাড প্রেশার পড়ে না যায়। ধ্রুবকণা এখনো মারাত্মকভাবে দুর্ঘটনা কবলিত রোগীটাকে দেখেনি।

মিনি ওটিতে নেয়ার পর কাটা মুখ সেলাই করতে গিয়েই তার হাতে কাঁপন ধরে যায়। এ যে মহাকাশ মন্ডল! তার বিচ্ছেদ হওয়া স্বামী যার সাথে ধ্রুবকণার প্রেম ছিল বছর দুয়েক। ধ্রুবকণা অবাক হয় রোগীর কোনো অ্যাটেনডেন্ট নেই দেখে। সিজোফ্রেনিক রোগীকে একা ছাড়লো কেন তার পরিবারের লোকজন- এই ভেবে ধ্রুবকণা কোনো তল খু্ঁজে পায় না। অজান্তে তার দু’চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। নিজেকে সামলে নিয়ে ইন্টার্নদের সামনে গাম্ভীর্য ধরে রেখে ধ্রুবকণা সেলাই দিতে শুরু করে। ব্যথার ইঞ্জেকশন দেয়ার পরেও সেলাই দিতে গেলে অন্য রোগীরা ব্যথায় চিৎকার দিয়ে ওঠে। কিন্তু এক্ষেত্রে ধ্রুবকণা সেলাই করতে গেলে মহাকাশ মন্ডল কোনো চিৎকার করে না। তার নিঃশ্বাস সজীব এবং প্রাণের সাড়া আছে। অবাক হয় ধ্রুবকণা। বিবাহিত জীবনে একবার পেরেকের আঁচড় খেয়ে সে কি চিৎকার দিয়েছিল মহাকাশ! কিন্তু আজ এতো বড় সুঁইয়ের ব্যথাতেও তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ট্রিটমেন্ট টিকেটে অর্ডার লেখে নীরবে। তারপর কড়া করে ওয়ার্ডবয় ও নার্সকে নির্দেশ দেয়, যাতে ঠিকমতো খেয়াল রাখে। নিজহাতে কটন দিয়ে মুখমণ্ডলের ব্লাডের ধারার দাগ মুছে দেয়, মাথায় অজান্তে হাত বুলিয়ে দেয়। ইন্টার্নদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে ধ্রুবকণা এসে বসে নিজের কক্ষে।

ধীরে ধীরে পুরোনো দিনগুলো ধ্রুবকণার চোখে সাদা-কালো সিনেমার মতো ভেসে ওঠে। প্রথম যেদিন মহাকাশ মন্ডল ধ্রুবকণাকে চিঠি দেয়, সেদিন ধ্রুবকণার বুক ধড়ফড় করে উঠেছিল খুব। এ চিঠি সে কোথায় লুকোবে। নগরীর উপকণ্ঠে পাহাড়ের পাদদেশে তাদের প্রথম ডেট। তারপর রিকশায় ঘুরে ঘুরে দিন কাটে ঘোরের মধ্যে। মহাকাশ সাদাসিধে। জীবনে সাহসের কাজ সে একটাই করেছে। একটা প্রেমপত্র লিখেছে ধ্রুবকণাকে নিজের ভালোবাসায় সাড়া দেয়ার আবেদন জানিয়ে। তারপর সবকিছুতে ধ্রুবকণাই এগিয়ে। প্রথম চুমু- সে-ও ধ্রুবকণাই দিয়েছে। ভার্সিটিতে পড়লেও মহাকাশ কখনো ধ্রুবকণার প্রেমে কামনার ফায়দা খোঁজেনি। বরং অদম্য সময়কে সে জয় করেছে ধ্রুবকণার সাথে প্রিয় উপন্যাসের প্রিয় চরিত্রের কথা আলোচনা করে।

পুরোনো দিনের স্মৃতিকথা ভাবতে ভাবতে কখন চলে গেছে একঘন্টা তা তার খেয়াল নেই। ভেতরে উথাল-পাতাল করে ওঠা তাগিদে সে উঠে আসে রুমের বাইরে। হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় মহাকাশ মন্ডলের বেডের পাশে। চোখ বুলিয়ে নেয় তার শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে। ঘুমুচ্ছে সে। স্যালাইন চলছে মিনিটে ত্রিশ ফোঁটা করে শিরায়। হাতের শিরা দেখে ধ্রুবকণা। মোটামুটি নরমাল। তবে হেড ইনজুরি প্রবল। কাল সকালে সিটি স্ক্যান করিয়ে দেখতে হবে। যে কোনো সময় আইসিইউতে নিতে হতে পারে। উচ্চক্ষমতা-সম্পন্ন আইভি অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়েছে শিরাপথে। অক্সিজেনও চলছে মিনিটে তিন লিটার করে। ক্যাথেটার করা হয়েছে। ইউরিন আউটপুটও ভালো। এর মধ্যে প্রায় আটশ মিলি জমেছে। কপালে হাত দিয়ে দেখে ধ্রুবকণা। বরফের মতো ঠান্ডা। মনে হয় কোনো শবদেহে সে হাত রেখেছে। নার্সকে ডেকে দ্রুত একটা রক্সাডেক্স ইঞ্জেকশন দিতে বলল। চিন্তায় তার মাথা কাজ করছে না। কাল সকালে রাউন্ডে প্রথমেই এটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ধ্রুবকণা ধীরে ধীরে চেয়ারে গিয়ে গা এলিয়ে দেয়। ভোরের আজানের শব্দ শোনা যায়। ধ্রুবকণা ক্লান্তিতে তদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

সকাল হয়। সরব হয়ে ওঠে হাসপাতাল চত্বর। মর্নিং শিফটের আয়ারা এসে মেঝেতে সোয়াব করা শুরু করেছে। ইন্টার্ন দু’জন যাওয়ার সময় হয়েছে। আজ তাদের মর্নিং অফ। তারা গিয়ে ধ্রুবকণাকে জাগায়। আপা আমরা আসি তাহলে…বলে ওঠে তাদের একজন। ঠিক আছে যাও। নতুন পেশেন্ট কি আর এসেছে? ধ্রুবকণা শুধায়। জ্বি না আপা। উত্তর দেয় ওরা। আচ্ছা, ওই সিভিয়ার হেড ইনজুরির পেশেন্টটার কী খবর? ইন্টার্নরা বলে- আপা, তখন দেখেছিলাম ঘুমে। তবে রেসপিরেশন রেট স্বাভাবিক আছে। আচ্ছা তোমরা এসো। এই বলে ধ্রুবকণা উঠে নাকে-মুখে পানি ছিটায়। নিজেকে ফ্রেশ করে তোলে। এককাপ চা খেতে ক্যাফেটেরিয়ায় যায়। টেবিলে স্থানীয় পত্রিকা আসে। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে দ্রুত চোখ বুলায় পত্রিকায়। রাতের নিদ্রাস্বল্পতাকে নিমেষেই গরম চায়ে উড়িয়ে দিয়ে ধ্রুবকণা স্বাভাবিক হয়ে আসল। পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে বিরক্ত হয়ে গেল। কেবল সড়ক দুর্ঘটনা আর ধর্ষণের খবর। এছাড়া আর কিছু নেই। বিরক্ত হয়ে পত্রিকাটা রাখতে গিয়েই তার চোখ পড়ে শেষ পাতার অষ্টম কলামের সংবাদের ওপর। তাড়াতাড়ি পত্রিকাটা মেলে ধরে ধ্রুবকণা। আরে, বলে কী! হাইওয়ে সংবাদদাতার বরাতে লিখেছে, গতকাল রাত আটটায় ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে চারজনের মৃত্যু। এর মধ্যে একজন মো. ইব্রাহিম, একজন নিরুপম সেন, একজন রবার্ট বাড়ৈ আর একজন…। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বাকিটা সে পড়তে পারে না। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত আর একজন মহাকাশ মন্ডল, পিতার নাম গগন মন্ডল। মায়ের নাম ধরিত্রী মন্ডল। মৃতদেহগুলো মেডিকেল কলেজের মর্গে নেয়া হয়েছে রাতেই এবং এ বিষয়ে নিকটস্থ থানায় পুলিশ বাদী হয়ে অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছে।

খবরের এতটুকু পড়েই ধ্রুবকণা দৌড় দেয় ওয়ার্ডের দিকে। ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডের পুরুষ অংশের বেড নম্বর ছেষট্টির কাছে এসেই সে হতবাক হয়ে যায়। আশ্চর্য! কোনো রোগীই নেই! নার্সকে জিজ্ঞেস করে ধ্রুবকণা। নার্স বলে, হ্যান্ডওভার নেওয়ার পর থেকে তারা এই বেডের পেশেন্টকে দেখেনি। আশপাশের রোগীদের জিজ্ঞেস করে ধ্রুবকণা। কেউই বলতে পারে না, এই রোগী কোথায়। ঝকঝকে সাদা বেডশিট যেন ধ্রুবকণাকে উপহাস করছে। বিভাগীয় প্রধানের রুমে তখনো স্যার আসেননি। পিয়ন রুম খুলে সবকিছু সাজিয়ে রেখে গেছে। ধ্রুবকণা বিভাগীয় প্রধানের রুমে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে। ভোর চারটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত ফুটেজে কলাপসিবল গেট পার হয়ে এমন কাউকে বের হয়ে যেতে দেখেনি, যাকে মহাকাশের মতো মনে হয়। ধ্রুবকণা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসে স্যারের রুম হতে।

ধ্রুবকণা চায়নি বিবাহবিচ্ছেদ। কিন্তু বাবা-মায়ের চাপাচাপিতে তার কোনো কথা খাটেনি। তাছাড়া মহাকাশের সিজোফ্রেনিয়া ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। দিনকে দিন তার আচরণ ম্যানিয়াক আর ইলেটেড হয়ে যাচ্ছিল। আচরণে অ্যাগ্রেশনও বেড়ে যাচ্ছিল। একদিন ধ্রুবকণাকে সে ফল কাটার ছুরি নিয়েও তাড়া করেছিল। তখন না বুঝলেও ডাক্তার হওয়ার পর এখন ধ্রুবকণা বুঝতে পারে, এটা আসলে তার আচরণ ছিল না, এটা ছিল রোগের প্রকোপ। তাই তখন মহাকাশের ওপর তার রাগ থাকলেও একসময় সাইকিয়ার্ট্রি পড়াকালীন সে রাগ মমতায় পরিণত হয়। যদিও ততদিনে আর তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। এমনকি আগের মোবাইল সিমও পাল্টে দিয়েছে ধ্রবকণার বাবা-মা। ফলে অতীত অধ্যায় অতীত হতে বেশি সময় নেয়নি।

ধ্রুবকণা পা চালিয়ে কলেজের মর্গে চলে আসে। মর্গে যে পিয়ন কাজ করে তার নাম দুলাল। নিজে যখন ছাত্রী ছিল, তখন তার অটোপসি ক্লাস করতে মর্গে যেতে হতো। তাই মর্গ নিয়ে ধ্রুবকণার কোনো ভীতি নেই। পিয়ন দুলাল তাকে চেনে। মাঝে মাঝে তাদের ওয়ার্ড থেকে বেওয়ারিশ লাশ আনতে দুলালকে যেতে হয় ক্যাজুয়ালিটিতে। ধ্রুবকণাকে মর্গের বারান্দায় দেখে এগিয়ে আসে দুলাল। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে- ম্যাডাম, আফনে এহানে? ধ্রুবকণা সালামের জবাব দিয়ে সরাসরি বলে- দুলাল দাদু, কালরাতে এখানে কি চারটা রোড অ্যাক্সিডেন্টের লাশ এসেছে? দুলাল বলে- জ্বি আফা, গতরাত তিনটায় হাইওয়েতে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে এমুন চাইট্যা লাশ আসছে। চাইরটাই এস্পট ডেড। ধ্রুবকণা বলে, আমি একটু দেখতে পারি? দুলাল বলে ওঠে দ্রুত, কেউ আপনার আত্মীয় নাকি? ধ্রুবকণা বলে, হুঁ। দুলাল মর্গের হিমাগার থেকে লাশ দেখায়। চারটা লাশ পাশাপাশি রাখা। একে একে চারটা লাশেরই মুখ দেখায় দুলাল। তিনটা লাশ দেখার পর চতুর্থটার দিকে চোখ যেতেই ধ্রুবকণা গোঁ গোঁ করতে করতে সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে গেল মর্গের বারান্দায়। অসহায় দুলাল কিছুই বুঝতে পারে না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সে তাকিয়ে থাকে ফ্যাল ফ্যাল করে মূর্ছিত ধ্রুবকণার মুখের দিকে চেয়ে। মৃত্যুর পর শেষ যোগাযোগের তৃপ্তিতে যেন মৃদু হাসি ফুটে ওঠে মহাকাশের রক্তাক্ত মুখে।

পরিচিতি
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
চাঁদপুর
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : কল্পকুসুম, মুক্তিবীর, ভূতুড়ে পাখা, লুইপা’র কলম।

+ posts

Read Previous

ম্যাজিস্ট্রেটের বাপ

Read Next

একান্তে গরলে ডোবা সন্ধ‍্যা নামে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *