
সিঙ্গিয়া রেল স্টেশনটি বহু পুরনো, বহু পুরনো বলতে বেশই পুরনো। আয়তনে খুব বড় না হলেও মাঝারি আকৃতির বলা যায়। একটাই প্ল্যাটফর্ম, প্ল্যাটফর্মের উপরে বড় একটি অফিস রুম, তার মধ্যে– একপাশে স্টেশন মাস্টারের ঘর এবং তার পাশে আর একটা ছোটো ঘর রয়েছে যেখানে সিগন্যাল ম্যান থাকেন। দুটো ঘরের সদর দরজা এই অফিস রুমের মধ্যেই। তবে সিগন্যাল ম্যানের ঘরের পেছন পাশে অর্থাৎ উত্তর দিকে যেদিকে ভৈরব নদী আর জঙ্গল আছে সেদিকে একটা দরজা আছে। এই অফিসের বাইরের শেডের নিচে, একদিকে যাত্রীদের বসার জন্য দুটি লম্বা বেঞ্চ পাতা আছে।
স্টেশনের পশ্চিম পাশে একটা দুই তলা ঘর, কিন্তু সবসময় তালা দিয়ে আটকানো থাকে। কাউকে কখনও খুলতে দেখিনি। গাছ-গাছড়ায় প্রায় ঢেকে যাওয়ার উপক্রম, এই ঝোপ ঝাড়ের জন্য একেবারেই এর পাশ ঘেঁষা অসম্ভব। এই দুইতলা ঘর আর বড় বাবুর ঘরের মধ্যবর্তী জায়াগায় রয়েছে বিশাল একটি বকুল গাছ, এই প্রকাণ্ড বকুল গাছের পুরো ছায়া এসে পড়ে স্টেশনের চালের উপর। গরমের সময় গাছটি দিনের বেলায় আরাম দিতে আর শীতের সময় রাতে সুগন্ধি ছড়াতে একটুও কার্পণ্য করে না। স্টেশনের পেছনের দিকটাতে রয়েছে একটা পুরনো পাকড় গাছ। এর উত্তর পাশে রয়েছে বুড়ি ভৈরব নদী। স্টেশন পেরুলে ঘন জঙ্গল, দিনের বেলায় সূর্যের আলো খুব ক্ষীণ হয়ে নিচে নেমে আসে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তা নেমে গেছে জঙ্গলবাধাল গ্রামের দিকে। আর আমাদের গ্রামটি হলো এর উল্টো দিকে। স্টেশন থেকে মিনিট খানেক হাঁটলেই নদীর দেখা পাওয়া যায় তবে স্টেশন থেকে নদীর যে অংশটুকু দেখা যায় তা যেন ভৈরবের বুড়িয়ে যাওয়া অংশ বিশেষ, জলের একেবারেই করুণ প্রবাহ পাড়ের গা ঘেঁষে নিচে নেমে গেছে। নদীর মাঝ বরাবর বাঁধ দিয়ে জঙ্গলবাধাল গ্রামবাসীরা সিঙ্গিয়া স্টেশনের সাথে যোগযোগের একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই স্টেশন দিয়েই বেনাপোল পোর্ট যাকে পেট্রোপোলও বলে থাকে, (অর্থাৎ এই স্থলবন্দরের মাধ্যমে) যার মাধ্যমে ইন্ডিয়ার সাথে স্থলবন্দরের সংযোগ স্থাপন করা হয়েছিল যা এখনও বর্তমান। ভারতের সাথে বর্তমান-বাংলাদেশের দক্ষিণ বঙ্গের সমস্ত যোগযোগ হতো এই সিঙ্গিয়া রেল স্টেশনের মাধ্যমে। এই স্টেশনে যে বড় বাবু ছিলেন তাঁর কাছে আমরা রোজ পড়তে যেতাম। আমরা বলতে আমি, শাহলম আর নুরুল। তবে আমরা ছিলাম দুই স্কুলের ছাত্র; আমি বসুন্দিয়া হাই স্কুলের আর ওরা দুজন ছিল জঙ্গলবাঁধাল হাই স্কুলের। তখন আমরা কোন ক্লাসে পড়তাম! ক্লাস নাইনে অথবা টেনে। রোজ ওদের মতলব কি করে আমাকে ওদের স্কুলে ট্রান্সফার করে নেওয়া যায়। আমাকে বিভিন্ন রকমের লোভ আর সুবিধা দেখিয়ে ওদের স্কুলে ভর্তি করার ফন্দি ভালোই চলে বেশ কিছুদিন। বলে নিতে হয় যে স্টেশনটি আমার বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আর ওদের স্কুল আমার বাড়ি থেকে আরও দূরে। সেই তুলনায় আমার স্কুলের দুরত্ব কম। স্কুলে বা স্টেশনে আমাকে হেঁটে অথবা সাইকেলে যাতায়াত করতে হয়।
স্টেশন মাস্টার মানে বড় বাবু, জলিদের বাড়িতে নতুন ভাড়াটিয়া হয়ে এসেছেন। জলিদের বাড়িতে ওঠার আগে আমাদের বাড়িতে থাকবেন বলে কথাবার্তা দিয়ে গেলেন কিন্তু কী কারণে তিনি মত পরিবর্তন করেছিলেন, ঠিক জানি না। জলির একটি বড় বোন ছিল নাম পলি, সুশ্রী, গায়ের রং ফর্সা, উচ্চতা মাঝারি। আমাদের বয়সেরই হবে; কিন্তু দৈহিক গঠনে সে বেশ ম্যাচিয়্যুর্ড। একবার ওর দিকে তাকালে ওর সুদর্শনা মুখ যে কাউকে উন্মাদ করে দিতে পারে। তার বাবা মা খুব চাপা স্বভাবের, কাউকে কিছু না জানিয়ে কম বয়সেই পলিকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেয়। বিয়ের পর পলিকে কোনো দিন ওদের বাড়িতে আসতে শুনিনি। একবার শুনেছিলাম ওর স্বামী নাকি কোনো এক রেল জংশনে চাকরি করে, স্বামীর সাথে সেখানেই থাকে। তার স্বামীকে আমি কখনও দেখিনি। একই ক্লাসে পড়ার কারণে আমাদের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব ছিল, কিন্তু হঠাৎ বিয়ে যাওয়ার পর আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।
সে যাই হোক কিন্তু স্টেশনের বড় বাবু যে ভালো অংক কষাণ সেটা আমার অন্তত জানা ছিল না। নুরুল আর শাহলমের সাথে আমার বন্ধুত্ব থাকায় আমি যখন জানতে পারলাম, তখন আমিও বড় বাবুর কাছে গিয়ে অংক করতে দলে ভিড়ে গেলাম। দলে আমরা তিন জনই, তবে জলি মাঝে মাঝে পড়তে চায় কিন্তু বড় বাবু স্টেশনের অফিসে বসে সন্ধ্যার পর আমাদের অংক করান, এর বাইরে তাঁর আর কোনো সময় নেই। তাছাড়া বড়বাবু বাড়িতে কাউকে পড়ান না। অগত্যা জলির বাবা মা সন্ধ্যে বেলায় মেয়েকে অত দূরে গিয়ে পড়তে দেবেন না বলে ও আর আমাদের দল ভারী করতে পারে না। তারপর থেকে তেমন যোগাযোগও নেই ওদের সাথে।
প্রায় বছর খানেক বড় বাবুর সাথে দেখা হয় না। এসএসসির রেজাল্ট নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে ভাবলাম বড় বাবুকে খবরটা দিয়ে বাড়ি ফিরি। রেজাল্ট নিয়ে ফিরতে ফিরতে বিকেল, সন্ধ্যা হতে আর বেশি দেরি নেই। অনেক সময় ধরে স্টেশনের অফিসের মধ্যে বসে আছি; বড় বাবু নাকি যশোর শহরে গেছেন, যশোর-রেল-ষ্টেশনের বড় বাবুর সাথে দেখা করতে। শিগগির চলে আসবেন। এই আসে এই আসে করতে করতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে প্রায় রাত পৌনে নয়টা। খুলনাগামী ট্রেনটা সব যাত্রী নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে প্রায় মিনিট দশেক হবে। যাত্রী আর কজনই বা হবে! তখনও বড় বাবুকে দেখতে পেলাম না।
ট্রেনটি ছেড়ে যাওয়ার পর অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে আসছে। তখন ডিসেম্বরের প্রথম দিক, ঠাণ্ডা ততটা জাঁকিয়ে বসেনি তখনও। তবে আজকে বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে। নুরুল আর শাহলমেরও আজকে আসার কথা থাকলেও কেন আসেনি জানি না। স্টেশন অফিসের মধ্যে আমি আর সিগন্যাল ম্যান। ঘড়ির কাটা যেন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। শেষ ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। ভাবছি বড় বাবু তো স্টেশন হয়েই বাড়িতে ফিরবেন, তবে ওনার সাথেই ফেরা যাবে। শেষ ট্রেনেরও দেখা নেই। বিধি বাম, কপালে বিপদ থাকলে তা আর কেইবা ঠেকাতে পারে! যদিও এই সিগন্যাল ম্যানকে আগে কখনো দেখিনি তবুও তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এতো রাতে এশা একা বাড়িতে যাবো কী করে, আজ আমি আমার সাইকেলটাও আনিনি, আমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসবেন? উনি কথার কোনো জবাব না দিয়ে হনহন করে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। অফিস রুমের মধ্য যে বাতিটা জ্বলছিল তার কেরোসিন মনে হয় শেষ হয়ে এলো। মেঘমুক্ত আকাশের ছিটকে পড়া টুকরো আলো, জানলার কাচের শরীর ভেদ করে কিছুটা ভেতরের অন্ধকারকে ম্লান করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিরুপায়ী আমি অস্বস্তি, ভয় আর বিতৃষ্ণা নিয়ে চেয়ারে বসে আছি।
রাত তখন সাড়ে এগারোটা বা প্রায় বারোটা, এমনই হবে। শেষ ট্রেন চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। সিগন্যাল ম্যান তার রুমের ভেতর ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিলেন। ভেজানো দরজার মাঝখানের ফাঁকা দিয়ে এক টুকরো আলো এসে পড়েছে আমার টেবিলের সামনে। বাইরে অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকার, নিজের শরীর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। আবছায়া অন্ধকারের মধ্যে দু’একজন যাত্রীকে যা নামতে দেখলাম তারা যেন নিমিষের মধ্যে হাওয়া গেল। কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না। জানলার দিকে তাকিয়ে মনে হলো কেউ বুঝি সিগেরেট পান করছে, জানলা দিয়ে ডাকলাম কিন্তু ভ্রুক্ষেপ করলো না। হয়তো ভাবছে কোথাকার কোন ছোড়া যদি সিগেরেটে ভাগ বসায়!
আমি জানলার কাছ থেকে ফিরে এসে চেয়ারে বসে ভাবছি, এতো রাতে একা বাড়ি ফিরবো কী করে! কিন্তু মা এতক্ষণে নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তা শুরু করে দিয়েছেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় দুটো। কিন্তু বাড়ি যে ফিরতে হবে আমাকে। এসব ভাবতে ভাবতে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম, ধীরে ধীরে সদর দরজার কাছে এগোচ্ছি এমন সময় পেছন থেকে শুনতে পেলাম ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম, কিছুটা চেনা আবার অচেনা। আমার শরীরের ভেতরটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, রক্তের মধ্যে হিমশীতল প্রবাহ অনুভব করলাম। নিজের সাথে যুদ্ধ করে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে পেছনে ফিরে তাকালাম কিন্তু আরও কোনো সাড়া পেলাম না।
ঘরটার চারিদিকে তাকালাম কোথাও কেউ নেই, না থাকারই কথা। আমি সেই সন্ধ্যে থেকে বসে আছি, কোনো নারীকে এই ঘরে ঢুকতে দেখিনি। পিছনে ফিরে তাকালে শুধু সিগন্যাল ম্যানের ঘরের ভেজানো দরজার ফাঁকা থেকে মৃদু আলোর রশ্মি ছাড়া আর সবকিছু নিস্তব্ধ নিথর। অফিস কামরাটি এতোটাই নিঃশব্দের মধ্যে ডুবে আছে যে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ আর হৃৎপিন্ডের ওঠা নামা স্পন্দনগুলো স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি। ভাবছি সিগন্যাল ম্যান, এইটুকু সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বে! যদি সে ঘুমিয়েও পড়ে তাহালে আমাকে ডাকবেই বা কে? হয়তো আমার শোনার ভুল ছিল যে ওটা মেয়েলি কণ্ঠ নয় ওটা পুরুষের কণ্ঠ, তাহলে…!
আমি সিগন্যাল ম্যানের ঘরের দরজা বরাবর এগোবার চেষ্টা করি কিন্তু কিছুতেই আমার পা এগোচ্ছে না, আমি শরীর এতোটা ভারী হয়ে পড়েছে যে আমার সাধ্য নেই তাকে টেনে সামনে নেয়ার। আমার গলা থেকে কোনো প্রকারের আওয়াজ বেরুচ্ছে না। গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ। ব্ল্যাড সার্কুলেশন বন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। মনে হচ্ছে মৃত দেহ টেনে নিয়ে সামনে এগোবার চেষ্টা করছি। স্টেশনের ভেতরকার এতো গাড় অন্ধকার আমি জীবনে দেখিনি। শুধুমাত্র একটি ক্ষীণ আলোক রশ্মি বেরিয়ে আসছে সিগন্যাল ম্যানের দরজার দুই পাল্লার মাঝ দিয়ে। ভাবলাম সিগন্যাল ম্যানকে একবার ডাকি, কিন্তু গলার ভেতরটা যেন সংকুচিত হয়ে অসাড় হয়ে পড়ে আছে।
নিজেকে কোনো রকম দরজার মুখোমুখি দাঁড় করালাম। দরজার আলোকে প্রতিহত করে দৃষ্টি বাড়ালাম ভেজানো দরজার ফাঁকা দিয়ে। চোখ পড়ল সিগন্যাল ম্যানের বিছানার উপর। এ কী! এ কী দেখছি আমি! সিগন্যাল ম্যান চিত হয়ে বিছানার উপর সটাং শুয়ে আছে তার উপর বসে আছে এক বিবস্ত্রা নারী! লম্বা চুল তার শিরদাঁড়া বেয়ে নিম্নদেশে এসে পৌছেছে, ফর্সা পিঠের উপর ছড়িয়ে থাকা অযত্নের ছড়াছড়ি, একেবারে তেলহীন উস্কশুস্ক। নারীর ডান হাত সিগন্যাল ম্যানের মুখে, আরেক হাত গলার নিচে। মনে হচ্ছে মুখ-মন্ডল খাবলে খেতে চায়। হাতের নিচের অমিমাংসিত ফাঁকা জায়গা দিয়ে স্ফীত মাংসপিন্ডের অস্পষ্ট অবয়ব চোখে পড়ছে।
আমি কী সত্যি ঠিক দেখছি! শারীরিক খেলার এই বীভৎস, অলৌকীক, মোহনীয়, কুৎসিত-কদাকার দৃশ্য যেন আচমকা আমার চোখের সামনে এক আকস্মিক ভয়ঙ্কর বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। এই উদোম দুঃসাহসিক শারীরিক খেলার কী নাম আমি জানি না, আমি সম্বিৎ হারিয়ে ফেললাম কিছুক্ষণের জন্য। যখন জেগে উঠলাম তখন তাকিয়ে দেখি আমার ডান হাত অসাড় হয়ে দরজার চৌকাঠের সাথে লেগে আছে। কোনো আলো নেই, দরজাও বন্ধ। আমি এবার প্রাণপণে চিৎকার করলাম, শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে আমি যেন একটা মৃত পশুর মতো মেঝেতে পড়ে আছি। আলো নিভে গেল সিগন্যাল ম্যানের রুম থেকে, দরজা পুরোপুরি বন্ধ। শুধু আমার চোখের দৃষ্টি কাজ করছে এই মুহূর্তে। বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিস্তেজ হয়ে আছে। তবে কি অবচেতন মনের সব কল্পনা আমার চোখের সামনে ছায়াছবির মতো ভেসে উঠছে। আমি তো সজ্ঞানে দেখেছি বিবস্ত্র সঙ্গমের সরবরে আন্দোলিত পদ্মফুল আর ভ্রমরের তান্ডব নৃত্য। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার চিৎকারে কেউ ছুটে এলো না, তারমানে আশেপাশে সত্যিই কেউ নেই!
তারপর কখন আবার জ্ঞান হারিয়ে সিগন্যাল ম্যানের দরজার সামনে পড়েছিলাম মনে নেই। হঠাৎ সদর দরজার শব্দ হতেই জ্ঞান ফিরলো আমার। তড়িঘড়ি করে কোনোরকম উঠে বসলাম। সকালে যখন অপরিচিত কাউকে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখলাম তখন আমি অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম- আপনি এখানে সিগন্যালের ম্যানের দায়িত্বে আছেন?
উনি আমার কাছে জানতে চাইলেন আমি কে? উত্তরে সব বললাম। শুধু বীভৎস কাণ্ডের কথা ছাড়া। তারপর বললেন হ্যাঁ, এইতো গত বছর বদলি হয়েছি এখানে। কিন্তু এই ঘরে আপনি থাকেন না? উত্তরে বলল- না, ওটা বন্ধই থাকে। আগে এই ঘরে যারা থাকতেন তারা খুলনা থেকে বদলি হয়ে এখানে এসেছিলেন। ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী নাকি ট্রেনে কাটা পড়েছিলেন। আত্মহত্যা বলে শুনেছি। আর কিছু শুনেছেন? শুনেছি স্ত্রীকে নাকি ভীষণ ভালোবাসতেন। তারপর? তারপর, স্ত্রীর শোক সামলে নিতে না পেরে নিজেও……।
এসব বলতে বলতে সিগন্যাল ম্যান তার কাজে ব্যস্ত হয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি আরও একবার সম্বিৎ হারাতে বসেছিলাম প্রায়; নিজেকে কোনোরকম সামলে নিয়ে বের হবো এমন সময় যশোরগামী ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে। চারিদিকে কুয়াশা, স্টেশনের ল্যাম্পপোস্টের সামান্য আলোর সে কুয়াশা ভেদ করে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব না, তবুও আবছা আলো পেরিয়ে ঘন কুয়াশার মধ্য দিয়ে আমি প্ল্যাটফর্ম বরাবর হাঁটছি। পেছন থেকে কে যেন আমাকে ডাক দিলো। ফিরে তাকিয়ে আমি সমস্ত শক্তি বিসজর্ন দিয়ে ধীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার স্তব্ধ চোখ, বুকের মধ্যে আটকে যাচ্ছে শ্বাস; এই শীতের সকালে কপাল গরম হয়ে উঠছে। গায়ে একটি চাদর জড়ানো, কপাল ভর্তি চুল কিন্তু কোথাও সিঁদুরের চিহ্ন নেই, নেই হাতে কোনো চুড়ি। সেই সুশ্রী কামনাময়ী মুখটি যেন অস্তগামী সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে যে ক্লান্তি রেখে যায় পশ্চিম আকাশে, ঠিক সেরকম।
এতো ভোরের ট্রেনে পলি একাকী কোত্থেকে এলো। আমি ল্যাম্পপোস্টের শক্ত খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার পায়ের নিচে মাটি যেন পাথরের মতো শক্ত হয়ে উঠেছে, আমি অনুভূতিহীন এই জগত সংসারের নির্জীব প্রাণীর মতো নির্বাক জড় পদার্থ। কিছুতেই এক পা সামনে এগোবার ক্ষমতা নেই আমার। আরও কাছে এসো বলল— চল বাড়ি যাবি না, এগিয়ে দিয়ে আসি?