অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আনোয়ার হোসেন বাদল -
পাথুরে মাটির কিষাণ

নোট : পাথুরে মাটির কিষাণের মোট ৪৫টি পর্ব রয়েছে। পর্ব-০১ থেকে পর্ব-৫ ধারাবাহিকের পূর্ববর্তী কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল। দ্বিতীয় কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে— পর্ব-৬ থেকে পর্ব-১০ পর্যন্ত)।

পাথুরে মাটির কিষাণ। পর্ব-০৬

জহিরুদ্দিন মাস্টার হঠাৎ করেই মারা যান। তার অকাল মৃত্যুতে বিনয়কাঠি আর রাজগঞ্জের মানুষের মধ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া। তিনি ছিলেন ভাঙনকবলিত নদীজনদের কাছে দেবতুল্য মানুষ। নদীর ভাঙনে মানুষগুলো যতটা কষ্ট পেয়েছে জহির মাস্টারের মৃত্যুতে তার চেয়ে কম কষ্ট পায়নি।

সবচেয়ে অসহায় বোধ করছে ভিক্ষুক বানেছা বুড়ি। বুড়ির যৌবনেই নদীতে চলে গেছে তার স্বামীর বসতবাড়ি যা ছিল রাজগঞ্জের পশ্চিমপাড়ায়। একাত্তরে একমাত্র ছেলে গয়জদ্দিন চলে গেল ঝালকাঠি, তার শ্বশুরবাড়িতে। পরে উড়ো খবরে জানা গেল সে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে মরে গেছে। বুড়ি দশবাড়ি ভিক্ষে করে তবু জহির মাস্টারের বাড়ি এসে থাকত। সেই জহির মাস্টারের মৃত্যু বুড়িকে অকূল সায়রে ভাসিয়ে দিয়ে গেল।

বানেছা বুড়ি তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে আর মাস্টারের দাওয়ায় বসে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। রাক্ষুসে নদী একেবারে জহিরুদ্দিন মাস্টারের দাওয়ায় এসে হাজির। এসময়ে জমিরুদ্দিন এসে বলে—

ও দাদি বুড়ি, বইয়া বইয়া কী দেহ?
দেহি মোর কপাল। ফের বলেন— চোর ডাহাইতে নেলে কিছু থাহে গাঙ্গের ভাঙ্গনে পড়লে কিছু থাহে না রে ভাই।
বাপজান কইছে তোমাগো বোলে তাঁত আছেলে? তোমরা বোলে কাপড় বোনতা? তয় হেই তাঁতগুলা কী হরছ?
বুড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নদীর দিকে বলেন— সব গেছে গাঙ্গে।
জমিরুদ্দিন বলে, গাঙ্গে তো বাড়ি গেছে, তাঁতগুলো কী করছ?
বুড়ি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে— যদি পায় নাঙ্গে আর যদি পায় গাঙ্গে তয় হেগো কিছু থাহে না রে ভাই। মোরতাও সব গাঙ্গে গেছে। মাইনসে কাপড় কেনে হাটে বাজারে যাইয়া, তাঁত আর চলে না। পেটের জ্বালায় সব বেইচ্চা দিছি।

বাপের মৃত্যু আর নদীর করালগ্রাসে বালক জমিরুদ্দিনও একেবারে অসহায় হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া। তার মা চোখে অন্ধকার দেখতে থাকেন। একদিন জমিরুদ্দিনকে বলেন— বাজান রে, তোরে আল্লায় মাতাটাতা ভালোই দেল্লে, এই বয়সেই এতিম অইয়া গেলি! তুই কোনহানে যাইয়া লজিং টজিং থাইক্কা দ্যাখ পড়াডা চালাইয়া যাইতে পারোনি। পেটে-ভাতে কাজ কাম কইর‌্যা পারলেও যাহ। তোর বুইনডারে লইয়া মুই যেমনে পারি চলি। আর যদি কাম-কাইজ কইর‌্যা কিছু পারি তয় দুই চাইর টাহা মুইও পাডামুনে।

জমিরুদ্দিন মায়ের কথামতো বাড়ি থেকে বহুদূরে কল্যান্দি হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে এক বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছে। থেকেছে লজিং তবে লজিংয়ের নামে মূলত সে বাড়ির কৃষি কাজের কামলা দিয়ে পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছে। ঐ ছোট্ট বয়সে পরের বাড়িতে থেকে খাওয়া-পড়া, কাম-কাইজ করে জীবিকা নির্বাহ করা সে কি সহজ কথা? সাত কুয়োর জল পেটে পড়লে বোঝা যায় কত ধানে কত চাল! তার হয়েছে সেই দশা। জমিরুদ্দিন খুব কাছে থেকেই জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছে। বাপের শাসনে আর মায়ের আদরে যে বয়সে মুক্ত বলাকার মতো উড়ে চলার কথা সে বয়সে এক কিশোরের পরের মর্জিতে চলার মতো বিড়ম্বনা আর কী হতে পারে? সুতরাং এই অল্প বয়সেই মানুষ চিনতে পাকা জহুরির মতো হয়ে উঠেছে জমিরুদ্দিনের চোখ।

আসলে জমিরুদ্দিনের বাবা জহিরুদ্দিন মাস্টার ছিলেন খুবই জ্ঞানী মানুষ। তিনি লেখাপড়া জানতেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধেও গিয়েছিলেন। নদী ভাঙনের আগে জহিরুদ্দিন মাস্টারের প্রচুর ভূ-সম্পত্তিও ছিল। গ্রামের মাথা ছিলেন জমিরুদ্দিনের বাপ।
তিনি বলতেন— মানুষের চেয়ে বড় পুস্তক পৃথিবীতে আর নেই। মানুষকে যে পাঠ করতে জানে সে পৃথিবীর সবকিছু জয় করতে জানে।

জমিরুদ্দিনের বাবার স্মৃতি তাকে খুবই তাড়া করে। বাবার মতো মানুষ সে কোথাও দেখেনি। যেমন দেখতে সুপুরুষ তেমনি তার কথাবার্তার ধরনও ছিল আলাদা। দশ গ্রামের মানুষ তাকে মান্য করত। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তার কাছে আবছা হয়ে গেছে। পাঁচ-সাত বছরের শিশু তখন জমিরুদ্দিন কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা বাপের কাছে যুদ্ধের বহু গল্প শুনেছে সে।

হেকিম সাহেবের মধ্যে জমিরুদ্দিন তার বাবার প্রতিচ্ছবি খোঁজে। নাহ তেমন কোনো মিল পায় না। তবে লোকটি যখন কথা বলে তখন কোথায় যেন বাবার একটা সুর তার কানে বেজে ওঠে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হেকিম সাহেবের মজমার সকল কলাকৌশল রপ্ত করে ফেলে জমিরুদ্দিন। হেকিম সাহেবের বুঝতে বাকি থাকে না, জমিরুদ্দিন ছেলেটি আসলেই একটি রত্ন। সে যেমন মেধাবী তেমনি সৃজনশীলও। ওষুধ বানানো থেকে শুরু করে তা বোতল বা প্যাকেটজাত করা। মাইক, ব্যাটারি অপারেটিং সকল বিষয়ে সে এক বিস্ময়কর প্রতিভাবান ছেলে।

জমিরুদ্দিন তার বাপের কাছে শিখেছিল পানপাতার বাঁশি বাজানোর কৌশল। পানপাতা দিয়ে যেকোনো গান সে নিমেষেই তুলে ফেলতে পারে। পান পাতার বাঁশী বাজিয়ে তার বিনয়কাঠি হাই স্কুলের স্পোর্টসে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। আর কল্যান্দি হাইস্কুলের হেড সার তার স্কুলের যাবতীয় খরচ ফ্রি করে দিয়েছিলেন। সেই পানপাতা এখন হেকিম আব্দুল হাইয়ের মজমার একটি প্রধান অনুষঙ্গ।

আজ শুক্রবার, খালিশপুরের সতেরটি জুট মিলে সরকারি ছুটি। চিত্রালী হলের সামনে লোকে লোকারণ্য। মিলের সব শ্রমিক সপ্তাহের এ দিন একটু আনন্দ ফুর্তি করেই কাটায়।

তারা দল বেঁধে মজমায় এসে ভিড় করে দাঁড়ায়, সালসা কেনে। ধ্বজভঙ্গ, মেহ-প্রমেহ, শ্বেতপ্রদর, ক্ষয়রোগের, বাতের ওষুধ কেনে। বয়স্করা যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধ কেনে। জমিরুদ্দিন এখন রীতিমতো ক্যানভাসার, সে খাবার নিয়ম বলে দেয়, প্যাকেট করে দেয়।

মজমায় জমিরুদ্দিনের ডিউটি কম নয়। প্রথমে সে পানের বাঁশীতে সুর তোলে—

‘আমায় ভাসাইলি রে
আমায় ডুবাইলি রে
অকুল দরিয়ার বুঝি
কুল নাইরে…’

সুরের মূর্ছনায় মুহূর্তে আশানুরূপ দর্শক জমা হয়। গোল দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলে শুরু হয় যাদু দেখানো। তিনটি মুরগির ডিম কাপড় দিয়ে ঢেকে তিনটি বাচ্চা বের করে। একটি তাস দেখিয়ে পাঁচটি করে দেখায়। একটি বাচ্চাকে পানি খাইয়ে তার হাত ধরে টিউবওয়েলের মতো চাপে আর কান দিয়ে বদনীর নালে পানি পড়ে।

সবশেষে আসেন হেকিম সাহেব। শুরু হয় তার হৃদয়গ্রাহী কথার যাদু।
শ্রেণমতো সবাইকে সালাম জানিয়ে হেকিম সাহেব বলেন—

আমার মজমা থেকে এ যাবত যারা ওষুধ কিনে খেয়েছেন অথচ উপকার পাননি এমন কেউ কি আছেন? থাকলে সামনে আসুন। হেকিম আবদুল হাই কারও টাকা অন্যায়ভাবে মেরে খায় না। উপকার না পেয়ে থাকলে এখনি টাকা ফেরত নিয়ে যান।

উপকার পায়নি এমন কাউকে পাওয়া যায় না। হেকিম সাহেব ফের কথা শুরু করলে দু’একজন এগিয়ে এসে বলেন—
হেকিম সাব, মায়ের জন্যে বাতের ওষুধ নিছিলাম, উপকার পাইছি। আরেক ফাইল দেন।
এরকম যারা বলেন জমিরুদ্দিন ইতোমধ্যে তাদের চিনে ফেলেছে। এরা হচ্ছেন হেকিম সাহেবের ফিট করা লোক। মজমার আগে পরে এদের সাথে হেকিম সাহেবকে কথা বলতে দেখেছে জমিরুদ্দিন। হেকিম সাহেব খুব সহজ সরল মানুষ। তার কাছে কোন লুকোচুরি নেই, জমিরুদ্দিনকে কৌতূহলী দেখে বলেন—
বুঝলে বাবা, এইডা অইল ব্যবসার কৌশল। এতে দোষের কিছু নাই, এরা যহন দু’এক ফাইল ওষুধ নিজে থেকে চাইবে তহন দেখবা কী টপাটপ বিক্রি বাইড়া যায়!
জমিরুদ্দিন দেখেছে এমন কেউ যখন এসে ওষুধ চায় তখন ঠিকই বিক্রি বেড়ে যায়। আর তখন হেকিম সাবেরও কথার তুবড়ি ছোটে—

তিনি বলেন— ভাই ছাহেবান—
মনে করবেন না যে, মা ঘরে বসে বানিয়েছেন আর ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিক্রি করছে এটা সে ওষুধ।
দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর গবেষণা করে বাংলার বন জঙ্গল থেকে ওষুধি গাছ, ফুল, ফল কুড়িয়ে এনে হেকিম আবদুল হাই তৈরী করেছেন এই মহৌষধ।
আসুন, নিয়ে পরীক্ষা করুন
নিয়ে যান, বিফলে মূল্য ফেরত।
আছেন কোনো এমবিবিএস, কোনো এফসিপিএস?
একবার পরীক্ষা করে দেখুন…
ব্যস, দর্শকদের মধ্যে ওষুধ কিনে নেওয়ার হিড়িক পড়ে যায় আর জমিরুদ্দিন তখন ওষুধ দিয়ে দম ফেলার ফুরসত পায় না।

পাথুরে মাটির কিষাণ। পর্ব-০৭

সিনেমার নাম ময়নামতি। খালিশপুর চিত্রালী হলের সামনে চিত্রশিল্পীকে দিয়ে রাজ্জাক-কবরীর বিশাল ছবি আঁকিয়ে সিনেমার বিজ্ঞাপন ব্যানার টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। মিষ্টি মেয়ে কবরী আর নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত ছবি, হলে একেবারে উপচেপড়া ভিড়। ম্যাটিনি শো’তে যারা টিকেট পায়নি তারা হয়তো ছয়টার ফার্স্ট শো দেখবে, সে অপেক্ষায় চিত্রালী মার্কেটের আশপাশে ঘুরঘুর করছে। অল্প দূরেই লিবার্টি সিনেমা হল। খালিশপুরের এ হল দু’টোতে সব সময়েই দর্শকের উপচেপড়া ভিড়। ছবি যেমনই হোক দর্শকের চাপে প্রায় প্রতিদিন কাউন্টারে লেখা থাকে হাউসফুল। লিবার্টিতে চলছে রাজ্জাক শাবানা অভিনীত “অবুজ মন”। যুবকদের মধ্যে কেউ কেউ এক হলেরটা দেখে অন্য হলে ঢুকবে। তখনকার দিনে আবহমান বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্য যাত্রাপালাসহ অন্যান্য বিনোদনগুলো প্রায় যায় যায় দশা। নগর জীবনে বিনোদনের এই সহজ মাধ্যমটিই তখন সবচেয়ে জনপ্রিয়। সিনেমা দেখে বন্ধুদের মাঝে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করার এক নেশা যুবকদের মাঝে তখন নিত্যকার ঘটনা।

সে সময়ে নায়ক-নায়িকাদের জীবনচিত্র নিয়ে আলাদা পত্রিকা বের হত। পত্রিকার নাম সিনে ম্যাগাজিন, চিত্রালী, সচিত্র, সিনেকথা ইত্যাদি। জাতীয় পত্রিকাগুলো ছিল সাদা-কালো কিন্তু সিনেমার সংবাদ নিয়ে সপ্তাহে একদিন রঙিন কাগজে বের হত পত্রিকার ক্রোড়পত্র। তখন কবরী, শাবানা, ববিতা, শবনমদের যুগ। পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকত নায়ক-নায়িকাদের খুঁটিনাটি বৃত্তান্ত। কোনো নায়িকার নামে স্ক্যান্ডাল বের করতে পারলে পত্রিকার কাটতির আর শেষ থাকত না।

চিত্রালী আর লিবার্টি থেকে একটু দূরত্বে মীনাক্ষ্মী হল। মীনাক্ষ্মী পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ, দৌলতপুরে। যারা চিত্রালী, লিবার্টিতে টিকেট পেতে ব্যর্থ হত তারা ছুটে যেত মীনাক্ষ্মীতে। তবে মীনাক্ষ্মীর দর্শক বেশিরভাগই সরকারি ব্রজলাল কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে সরকারি দলের ক্যাডাররা খুব বেপরোয়া টাইপের। আগে এমন ছিল না, বর্তমানে তারা সরকারের রাজনৈতিক হাতিয়ার। তাদের ভয়ে জুটমিলের দর্শকরা সাধারণত মীনাক্ষ্মীতে বেশি একটা যায় না। একবার ছাত্রদের সাথে পিপলস জুটমিলের শ্রমিকদের মারপিট লেগে যায়। সে ঘটনা বহুদূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল।

চিত্রালী আর লিবার্টিতে ছাত্ররা বেশি একটা আসে না, এ হল দু’টোতে শ্রমিকদের আধিপত্য চলে। পাটকল শ্রমিকরা সাধারণত বাম সংগঠনের হয়ে থাকে। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে জুটমিলগুলোতে কম্যুনিস্ট প্রভাব ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে সকল সরকারই শ্রমিক শক্তিকে হীন স্বার্থে ব্যবহার করেছে। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যা আরও ত্বরান্বিত হয়েছে।

দেশ স্বাধীনের পরও বাম রাজনীতি করা কেরামত সরদার এখন প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাতিয়ার। এখন তিনি সরকারি দলের শ্রমিক নেতা। তার সাথে সরকারের বড় বড় মন্ত্রীদের সাথেও খাতির। সরকারি শ্রমিক সংগঠনের খুলনা তো বটেই গোটা দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়ার পথে কেরামত সরদার। রাস্তাঘাটে তার দলের শ্রমিকদের ক্ষমতাও তাই বেপরোয়া

চিত্রালী মার্কেটের সামনে খোলা চত্বরে বসে ভাসমান দোকান-পাট। বিকেলবেলা এখানে লোকজনের ভিড় বেড়ে যায়। কেউ কেনাকাটা করতে আসে, কেউ আসে ঘুরতে ফিরতে। বৈশাখের প্রচণ্ড গরমে তখন রিকশা-ভ্যানে সাজিয়ে শরবত বিক্রি করে কেউ কেউ। এসব ভাসমান দোকানী কেরামত সরদারের নামে খুব সম্মান দেখায়। তার দলের লোকজনকে সমীহ করে। বিনে পয়সায় বরফ আর লেবুযোগে শরবত খায় আলমগীর আর জমিরুদ্দিন। তারাও কেরামত সরদারের লোক। তারপর যায় বাঁদর নাচের খেলা দেখতে।

হলের ঠিক সামনেই মাটিতে পাটি বিছিয়ে নানান পদের পত্রিকা, সস্তা দামের বই-পত্রও থাকে। বইয়ের নাম নূরানী নামাজ শিক্ষা, মোকছুদুল মোমেনীন, চিতা বহ্নিমান, টেডি বিয়ে, রিকশাওয়ালার প্রেম, নরনারীর গোপন কথা ইত্যাদি। দর্শকদের দু’চারজন পত্রিকা হাতে নিয়ে হেডলাইন দেখে। রাজনীতির আলোচনা করে। শ্রমিকদের খবর থাকলে শব্দ করে পড়ে কেউ কেউ। আলমগীর মোকছুদুল মোমেনীন উল্টেপাল্টে দেখে, একখানা নূরানী নামাজ শিক্ষার বই কিনে।

জমিরুদ্দিন আর আলমগীর এসব ঘুরে-ফিরে দেখে সময় কাটায়। তারা ছয়টার শোতে সিনেমা দেখবে। জমিরুদ্দিন তার জীবনে কোনোদিন সিনেমা দেখেনি। শহরেই যায়নি তো সিনেমা দেখবে কী করে। হলে বসে জীবনে এই প্রথম সিনেমা দেখবে, সে খুব এক্সাইটেড। রাজ্জাক কবরীর সিনেমার গল্প সে শুনেছে। তার চাচা রইজুদ্দিন বরিশাল থাকেন। একবার সন্ধ্যেবেলায় বাড়িতে বৈঠক ডেকে কী একটা সিনেমার গল্প বলেছিলেন। সবাই খুব মন দিয়ে শুনেছিল সে গল্প। আরেকবার তার মামা জেলা সদরের লাইট হাউস সিনেমা হলে দেখে এসেছিলেন রাজ্জাকের মতি মহল। সে গল্পও শুনেছে জমিরুদ্দিন। আজ সে সরাসরি চিত্রালী হলের বড় পর্দায় দেখবে ময়নামতি। মনে মনে ভাবে বাড়ি ফিরে আর কাউকে না হোক শিকদার বাড়ির জামিলা আর গোমস্তা বাড়ির রেবতিকে এ গল্প শোনাবেই। জামিলাকে খুব মনে পড়ে, বাড়ি থেকে আসার দিন অনেকদূর এগিয়ে দিয়ে গেছে। গোপাল গোমস্তার মেয়ে রেবতিও জমিরুদ্দিনের খুব নেওটা। রেবতির বিয়ের কথা চলছে, হয়ত হয়েও গেছে।

আলমগীর বয়সে জমিরুদ্দিনের চেয়ে বছর তিনেকের বড়। চাকরির বয়স পাঁচ বছর, সদ্য বিয়ে করেছে। জমিরুদ্দিন যা দেখছে তাই তার কাছে নতুন। তাতেই সে মুগ্ধ। বইয়ের প্রতি তার খুব ঝোঁক, ঘুরে-ফিরে এসব বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে বিচিত্র সব বই দেখছে সে। অল্প বয়েসী ক্রেতা দেখে দোকানদার তার গোপন সংগ্রহ থেকে রসময় গুপ্তের একখানা চটি বের করে দেন। বলেন— গোপনে নিয়া যান, বাসায় গিয়া পড়বেন। বইয়ের উপরে সুন্দরী এক নারীর নগ্ন ছবি। ভেতরের পৃষ্ঠাগুলো স্টাপলার পিন দিয়ে আটকানো। পকেটে পয়সা নেই, জমিরুদ্দিন কিনতে পারে না কিন্তু মনের মধ্যে গেঁথে থাকে বইয়ের প্রচ্ছদ।

খালিশপুরের এইসব জুট মিল শ্রমিকদের অধিকাংশ এসেছে ফরিদপুর আর বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চল থেকে। জমিরুদ্দিনের দূরসম্পর্কের ভাই কেরামত সরদার এরই একটি জুট মিলের শ্রমিক নেতা। খুবই প্রভাবশালী লোক। রাস্তায় নামলে শত শত শ্রমিক তার পেছনে শ্লোগান দেয়। নির্বাচনে দু’বার ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সেক্রেটারি হয়েছেন। সপরিবারে থাকেন শ্রমিক কলোনিতে। কেরামত সাহেব তার কোয়ার্টারের পেছনে টিন আর বাঁশ দিয়ে একটি অস্থায়ী ঘর বানিয়ে নিয়েছেন। সে ঘরে কেরামত আলীর সংগঠনের দু’জন শ্রমিক বসবাস করেন। তাদেরই একজন আলমগীর, অন্যজন বাড়ি গেছে।

কোনো এক অজানা কারণে আলমগীরের সাথে জমিরুদ্দিনের সখ্যতা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। সারাদিন একত্রে ঘোরাফেরা করে, মাঝে মাঝে আলমগীরের সাথে মিলের ভেতরেও ঢোকে। আলমগীর প্রোডাকশন সেকশনের কর্মী। জমিরুদ্দিন মিলের মেশিনপত্র নেড়েচেড়ে দেখে। মনে মনে নিজেকে কর্মী হিসেবে ভাবে। দু’জনকে দেখে সবাই বলে— হরিহর আত্মা। জমিরুদ্দিনের চালচলনে আলমগীর খুব খুশি, সে বলে— বেয়াই তুমি বাড়ি যাইও না, কয়ডা দিন থাহ। দেহি দুলাভাইর ধারে কইয়া টইয়া তোমারে বদলিঅলা পোস্টে একটা চাকরি দেতারি কি না।

বদলিঅলা মানে কোনো শ্রমিক অনুপস্থিত থাকলে তদস্থলে কাজ করা। অথবা কাজের চাপ বেড়ে গেলে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া।

আশান্বিত হয় জমিরুদ্দিন। তাকে আলমগীর সাথে সাথে রাখে। শহর ঘুরিয়ে দেখানো, নদীর পারে নিয়ে যাওয়া, সিনেমা দেখানো সব খরচই আলমগীরের। জমিরুদ্দিন নিষেধ করলেও আলমগীর একেবারে দিল দরিয়া। সে বলে— আরে রাখো তো বেয়াই, টাহাপয়সা কামাই করি তো খরচের পান্নেই। তোমারে আমার খুব পছন্দ অইছে, তোমার মতো একটা বেয়াই আগে পাইলাম না ক্যা? তারপর বলে— লও যাই সিনেমা দেইক্কা আহি।

জমিরুদ্দিনের খুব ভালো লাগে। চাকরি না পাওয়ার কষ্ট তাকে আর স্পর্শ করে না। আলমগীরের সাথে সে সারাদিন লেগে থাকে। হাসি আনন্দে সময় কেটে যায়। আলমগীর কেরামত সরদারের সাক্ষাৎ কুটুম, সে চেষ্টা করলে জমিরুদ্দিনের চাকরি হবেই। সে আলমগীরকে জিজ্ঞেস করে—
বেয়াই, আপনার বাড়িতে কেডা কেডা আছে?

মা-বাবা, ভাই-বোন আছে, সবাই আছে। বউও আছে। ছয়মাস আগে বিয়া করছি। আলমগীর তার বউয়ের ছবি বের করে দেখায়। সুন্দর নায়িকা টাইপের একটি মেয়ে। মুখটা এক্কেবারে কবরীর মতো। একমাস আগে বাড়ি থেকে এসেছে। তার বউয়ের গল্প করতে করতে বিচিত্র সব কথা বলে আলমগীর। বড়রা যা বলে মানে প্রাপ্তবয়স্ক গল্প। জমিরুদ্দিন জীবনে কখনও এসব কথা শোনেনি। নর-নারীর গোপন জীবনের নিষিদ্ধ ইঙ্গিতময় কথাবার্তায় জমিরুদ্দিনের কান ঝাঁঝাঁ করে ওঠে। এমন অদ্ভুত অথচ নেশা লাগানো কথা সে জীবনে শোনেনি।

পাথুরে মাটির কিষাণ। পর্ব-০৮

আলমগীর বলতে থাকে তার নতুন বিবাহিত জীবনের গল্প। সদ্য বিবাহিত দু’টি নর-নারী বাসর রাতে কেমন করে একে অন্যকে আবিষ্কার করে, কেমন করে দু’জনে মানব জীবনের আদিমতম দৈহিক সম্পর্কে মেতে ওঠে সে গল্প আনাড়ি জমিরুদ্দিনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। পৃথিবীর সবকিছু ভুলে গিয়ে আবিষ্ট হয়ে মনোযোগী শ্রোতার মতো জমিরুদ্দিন শুনতে থাকে বন্ধুর কথা।

আলমগীর বলে— হোনো বেয়াই, মোর বুইন আর দুলাভাইরে দেইক্কা মনে অয় না যে খুব শান্তিতে আছে? ক’দিন থাহ দেকপানে, কত্ত শান্তি। দিন রাইত ঝগড়া কেমন লাইগ্গা থাহে। পাঁচ বছর ধইর‌্যা দেখতে দেখতে ঘেন্না ধইর‌্যা গেছে। একবার ভাবছিলাম জীবনে বিয়াই করমুনা। পারলাম না ক্যা জানো? মায়ের জন্যে। কিন্তু এহন মনে অইতেছে ঠিকই করছি। মানুডার জন্যে পরানডা যে কী করে! তোমারে কেম্মে বুঝামু?
জমিরুদ্দিন কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ শুনতে থাকে।
আলমগীর বলে— আইচ্চা বেয়াই, তোমার কারও লগে কী ঐসব কাম কাইজ অইছে?
বুঝতে পারে না জমিরুদ্দিন। সে বলে— কী সব কাম কাইজ, কী অইবে?

আলমগীরের চোখে দুষ্টুমি খেলে যায়। সে দৃষ্টিতে এক ধরনের রহস্যময় ইঙ্গিত করে। বলে— ইস বুঝতাছ না? আরে ঐয়া, ঐ যে মাইনষে প্রেম ট্রেম করে আর হেই প্রেমের মাইনষেরে যেমনে আদর-টাদর করে…? তারপর বলে, তোমার বেইনের লগে বাসর রাইতে মোর যা যা অইছে হেই সব কাম? তুমি কোনোদিন কি কোনো মাইয়া মাইনষের লগে ঐসব করছ?

জমিরুদ্দিন রাগ করার ভান করে। বলে— ক্যান, আমি কি বিয়া করছি নি? আমনে বাসর রাইতে কী কী হরছেন হেইডা কয়ন।
আলমগীর হাসে। বলে— কী কী হরছি, কেমনে কেমনে হরছি সব হোনবা?
সম্মতি দেয় জমিরুদ্দিন, একটু লজ্জাও পায়। বলে— বাসর কী? ফুলাইজ্জা?
আলমগীর বলে— হয়, ফুলাইজ্জা। তয় ওডারে ভদ্রলোকেরা কয় ফুলশয্যা।
ফুলশয্যায় কী কী অয় হ্যা বেবাকই জানি। বলে হাসে জমিরুদ্দিন। আলমগীর চোখ সরু করে তাকায়, বলে— কেমনে জানলা বেয়াই? তুমি বোলে কেউল্লগে হরো নাই?
জানমু না ক্যা? জানতে কী ঐসব করা লাগে? তয় হোনেন, জমিরুদ্দিন তার গ্রামের ভিক্ষুক ফরমান আলী, আবুল আর পরীবানুর গল্প করে। বলে— আমাগো বিনয়কাডি গ্রামে একজন খয়রাতি আছিলে নাম ফরমান আলী। সাত আষ্ট বছর আগে লোকটা মইর‌্যা গেছে। মুই তহন কেলাশ ফোরে পড়ি। বাবায় তহনও আছে, মোগো জমিজমা তহনও বেবাক ভাঙ্গে নাই। মোগো বাড়ির উত্তর পাশের একটা ভাঙ্গা ঘরের মধ্যে বানেছা বুড়ি নামে একজন খয়রাতি থাকতে। ফরমান চাচায় মাঝে মধ্যে বানেছা দাদির লগে গল্প টল্প করতে আইতে।
আলমগীর কান খাড়া করে গল্প শোনে। বলে— ফরমান বানেছা বুড়ির লগে ঐসব করছে?
আরে না, বানেছা দাদি তো তহন ষাট বচ্ছইরা বুড়ি। হেরে ফরমান চাচায়ও চাচি কইয়া ডাহে।
তাইলে ফরমান আলী তার বউল্লগে রাইতে কী কী হরছে বেড়ার ফাঁক দিয়া হেইসব তোমরা দেখছ?
আরে না না, আগে হোনোই না।
আচ্চা কও হুনি।

জমিরুদ্দিন বলে— ফরমান আলী খয়রাত করতে করতে দশ গ্রাম দূর পর্যন্ত চইল্লা যাইত। যে গ্রামে রাইত অইত সেই গ্রামের কোনো বাড়িতে যাইয়া থাকত। ফরমান আলীর পেরথম বউ আছে। এ্যার মধ্যে মোরা একদিন হুনি কি ফরমান আলী কোম্মে গোনে যেন এউক্কা জুয়ান মাইয়া বিয়া কইর‌্যা আনছে। গ্রামের হগলে ফরমানের বাড়ি যায়। আহারে কী সুন্দর এউক্কা মাইয়া, এক্কালে পরীর নাহান। নামও পরীবানু। পরীবানু দেখতে তো সুন্দর তয় কতা কবার সময় নাকে বাজে আর বুদ্ধিও নাই, সবাই কয় গোঙ্গা।
জমিরুদ্দিনের গল্পে আলমগীর বেশ মজা পায়। বলে— প্রতিবন্ধী?

হয়, মানে কিছু কইলে যেমন বোঝে না আবার নিজেও গুছাইয়া গাছাইয়া কিছু কইতারে না। গ্রামের সব পুরুষ মানু বউডার পিছে পিছে ঘোরে, ঠাট্টা মশকরা করে। বউর নাকে বাজানো কতায় বেশ মজা লয় সবাই। সব কতাই চন্দ্রবিন্দু দিয়ে। মোরাও জিগাই এক কতা হে জবাব দেয় আরেক কতা। ফুর্তি লাগে— আনন্দ লাগে, সবাই হাসাহাসি করে। এ্যার মধ্যে ফরমান আলী একদিন মইর‌্যা যায়। মাতারি খয়রাত করতে করতে কল্যান্দি যাইয়া আবুইল্লার লগে বিয়া বয়।

আবুলের আরও দুইডা না তিনডা বউ আছে, হেরাও ভিক্ষা করে। আবুইল্লার দুইডা হাতের একটাও নাই, জন্ম থেকেই নাই। নতুন বউ পাইয়া হের লগেই ঘুমায়। আবুলের ঘরে পরীর একটি পোলা অয়। পরীর ভাগ্যে সেই পোলাডাও আবুলের মতো পঙ্গু অয়। পরীবানু তাতেই অনেক খুশি, পঙ্গু মাইনষের খয়রাত পাইতে সুবিধা।
আলমগীর বুঁদ হয়ে জমিরুদ্দিনের গল্প শোনে। বলে— তারপর? খুব মজার গল্প তো! কও বেয়াই পরীর গল্পডাই আগে হুনি।

আবুল আবার অন্য বউগো লগে থাহা শুরু করে। পরীরেও রাকতে চায়, হে থাকপে না। আবুল আগে হাট বাজারে, গাও গেরামে খয়রাত করতে। তাতে পোষায় না, এহন সবতেরে লইয়া দল বাইন্দা লঞ্চে লঞ্চে গান গাইয়া খয়রাত করে। প্রথম জনের হাতে ভিক্ষা নেয়ার জন্যে এনামেলের থালা, অন্য দু’জন তার পিছনে আবুলকে হাঁটতে সাহায্য করতে করতে এগোয়।

আবুল সুরে সুরে কয়—

‘ঐযেন আল্লায় মোরে দেয় নাই
দুইডা হাতও
কেম্মে নেলা ধরিরে…’

তখন তিন বউ মিল্লা কয়—

‘ও হক্ক লাইলাহা ইল্লাল্লা… ইল্লাল্লা আল্লাহু।’
লঞ্চ যায় বরিশাল, লঞ্চ যায় খেপুপাড়া
লোকে জিগায়— ও মেয়া লগের মাতাইর‌্যা কেডা কী লাগে?

আবুল হাসে— বলে লম্বাজন মোর গিরাস্ত, খাডোজন শালী আর ওনার বাড়ি কালাইয়া।
যারা চেনে তারা কিছু বলতে গেলে সবাই মিলে ঝগড়া শুরু করে। মান ইজ্জতের ভয়ে লোকে চুপ হয়ে যায়। পরী নাকি সুরে তাদের সাথে সুর দিতে পারে না। সে গ্রামে গ্রামে হাঁটে। মানে জিগায়— ও পরী তোর পোলার বাপ কী আবুইল্লা না কী ফরমাইন্না ক দিহি? এ কথায় পরী শরম পায়। নাকি গলায় চন্দ্রবিন্দু দিয়া বলে— ক্যা আবুইল্লা? দেহেন্না পোলারও আত নাই?
সবাই বলে আবুইল্লার লগে কেম্মে কী হরো? হের তো আত নাই তোরে কেম্মে ধরে?
একথায় পরী লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে যায়। বলে— শরম লাগে, কইতারমু না।
মোরা কই— চাউল দুগ্গা বাড়াইয়া দিমুনে, কও।

পরী নাকি গলায় চন্দ্রবিন্দুযোগে কয়— হের আত নাই, তয় হের তো তোয়াজ আছে। হের অনেক শক্তি… তারপর বলে— আমনেরা বোঝেন না? আগেরজন তো বুড়া মানু, বুড়া মানের কী তোয়াজ থাহে?

গল্প শুনে হাসতে হাসতে আলমগীরের পেটে খিল লাগার দশা হয়। সে বলে— বেয়াই গল্প তো এইডাই চ্যাতা। এর কাছে মোর গল্প তো ফেল। মোরতা আর হুইন্না লাভ নাই। বলে বিড়ি ধরায় আলমগীর। বলে— তার চাইতে লও, চিত্রালী মার্কেটে ক্যানভাসাররা মজমা দেছেনি দেইক্কা আয়ি। আলমগীর বাসর রাতের গল্প আর বলা হয় না।

জমিরুদ্দিন বলে— মজমা দেহনের সময় পামুনে। আগে বাসর রাইতের কতাগুলা কয়ন, শুইন্না মনডা জুড়াই। আলমগীর একটা বিড়ি এগিয়ে দেয়, জমিরুদ্দিন বলে— না না, মায় নিষেধ কইরা দেছে। বিড়ি আর খামু না। আলমগীর বলে— ঠিকাছে, তাইলে আর গল্পও হোনোন লাগবে না।

জমিরুদ্দিন দোটানায় পড়ে যায়। বাসর রাতের অজানা কথা শোনার জন্যে তার কিশোর মন উদ্বেলিত হয়। হাঁসফাঁস করে। সে হাত বাড়িয়ে বিড়িটা নিয়ে ঠোঁটে রাখে। মনে মনে বলে, বিড়ি তো সাত-আট বছর বয়সেই ধরেছে সে। শুধু গোপনে খায়, এহন তো মায় ধারে কাছেও নাই, দেখবে কেম্মে? মার কাছে গেলে তহন না খাইলেই অইল!

পাথুরে মাটির কিষাণ। পর্ব-০৯

চিত্রালী সিনেমা হলের সামনে থেকে আলমগীর আর জমিরুদ্দিন রিকশা নিয়ে নদীর ঘাটে চলে যায়। নদীর নাম ভৈরব, এ নদী খালিশপুর শহরের অলংকার। এ নদীর পারেই গড়ে উঠেছে খুলনা মহানগরীর বিখ্যাত সব ইন্ডাস্ট্রি, জুটমিল, পেপারমিল ইত্যাদি। নদীপাড়ের এখানটায় ঘন গাছপালা আর লতাগুল্মে একেবারে পাহাড়ি জঙ্গলের মতো মনে হয়, চারিদিকে সুনসান নীরবতা। দূরে পিপলস আর স্টার জুটমিলের ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসছে তবে নগরীর যানবাহনের কোলাহল এখানে তেমন একটা নেই। একপাশে বিশাল এলাকাজুড়ে সরকারি কয়েকটি নৌযানসহ নৌযানের নানান যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। অন্যপাশে বাউন্ডারি করা একটি বিশাল মাঠ। বাউন্ডারির তিন দিকে দেয়াল তবে নদীর দিকটা খোলা। মাঠের মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পতিত জমি। ছন আর বুনো ঝোপঝাড়ে ভর্তি হয়ে আছে জায়গাটি।
ভৈরব তীরবর্তী এ এলাকা আলমগীরের বেশ চেনাজানা কিন্তু জমিরুদ্দিনের কাছে একেবারেই নতুন। তবু ভীষণ ভালো লাগে তার। সে নদীপাড়ের মানুষ, সে নদীপুত্র। তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা দখিনের পায়রা নদীর কোলে। পায়রা নদী তার পৈত্রিক ভিটেবাড়ি খেয়ে নিয়েছে, তবু সে নদীকেই জমিরুদ্দিন মাতৃজ্ঞান করে। নদীতে সাঁতার কেটে, তার বুকে মাছ ধরে কেটে গেছে তার শৈশব, কৈশোর। ভৈরব নদীর কাছে এসে তাই জমিরুদ্দিনের প্রাণ আনন্দে নেচে ওঠে। সে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়।
নদীতে কত রঙ-বেরঙের নৌকা চলে! ছোট ছোট লঞ্চ, বড় বড় জাহাজ! কম প্রশস্ত হলেও এতটা দৃষ্টিনন্দন নদী জমিরুদ্দিন খুব কমই দেখেছে। সে ছুটে যায় নদীর ঘাটে হাতমুখে জলের ছিটা দেয়। এখন চৈত্রমাস, তবু নদীর দক্ষিণমুখী তীব্র স্রোত দেখে জমিরুদ্দিন জিজ্ঞেস করে— নদীটি কোথা থেকে আইল আর কোথায় যায়, আপনি কী জানেন?
আলমগীর হাসে। বলে— নদী দিয়া কী করমু? নদী দেকলে আমার কেবলই গাবখান চ্যানেলের কতা মনে হয়। জমিরুদ্দিন বুঝতে পারে না, নদী দেখলে গাবখান চ্যানেলের কতা মনে হবে কেন? সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আলমগীর বলে— রকেডে আইতে যাইতে গুণ্ডারা গাবখান চ্যানেলে মালামাল লইয়া লাফাইয়া পড়ে। মোর বাড়ির ধারে কোনো নদী নাই। গাবখান ছাড়া কোনো নদী চিনিও না। আচ্ছা বাদ দেও হের চাইতে লও ঘাসের উপ্রে বইয়া দু’হান গল্প করি।
জমিরুদ্দিন উদাস মনে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। মনের গহীনে উঁকি মেরে যায় তার শৈশব, কৈশোর। আহা রে নদী! এসব ভাবতে ভাবতে তার মনের জানালায় দেখা দিয়ে যায় মায়ের মুখখানা। অরেছ শিকদারের মেয়ে জামিলা একবার পায়রার পাড়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল— জমিরুদ্দিন ভাই, হাতর দিয়া নদীডা পাড়ি দিতে পারেন?
জমিরুদ্দিন দুষ্টমি করে বলেছিল— সোনাই রে, তুই কইলে আগুন নদীও সাঁতারাইয়া যাইতে পারি।
জামিলা বড় বড় চোখ দু’টো দিয়ে স্থির তাকিয়েছিল জমিরুদ্দিনের মুখের দিকে। দু’জনের বুকের ভেতর উথাল পাতাল ঢেউ। জামিলা বলেছিল— মোর কতায় কী আয় যায়?
তুই জানো না?
নাহ!
তুই অইছো মোর পরাণ। তুই যদি মোর পান্নে খাড়াইয়া থাকতারো মোর সাঁতরাইতে কোনো ভয় নাই।
জামিলা বলেছিল— জমিরুদ্দিন ভাই, এই কতা মোর বাপে হোনলে কৈলম মোরে কাইট্টালাইবে..
বাপের কতা বাদ দে সোনাই, নিজের কতা ক। তুই মোরে চাও না?
জামিলা চোখ নামিয়ে বলেছিল— চাই। বলেই দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল।
অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ডুবে থাকে জমিরুদ্দিন। হঠাৎ আলমগীর হ্যাঁচকা টানে সম্বিৎ ফিরে পায়। আলমগীর বলে— গাঙের দিকে চাইয়া থাকতে আইছ? লও যাই দুইডা মনের কথা কই। একটি ঝোপের আড়ালে বসে ওরা। বলে— জায়গাডা কেমন লাগতাছে বেয়াইসাব? বলেই ফের বিড়ি ধরায় আলমগীর।
বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে, অতঃপর ঘাসের উপরে আয়েশ করে বসে তার বাসর রাতের গল্প শুরু করে—
সরকারি জুটমিলগুলো ঈদ-কোরবানিতে সাত দিন কইর‌্যা ছুটি থাহে। আমার মায় আগেই মাইয়া ঠিক কইর‌্যা রাকছিল, দেকতে যাইয়াই কলমা কাবিন হইয়া গেল। মোর তো বাপ নাই, মা চাইছে বিয়া করাইয়া পোলারে বাইন্ধা হালাইবে। মা আর মামুরাই এহন অভিভাবক আর আছে দুলাভাই। ছুটির তিনদিনের মাথায় কলমা অইয়া গেল। পরের দিনই বউ আনতে হউর বাড়ি গেলাম। হেরহম কোনো বড় আয়োজন না, কোনো অনুষ্ঠানও না। এক্কালে ছোড, ঘরোয়া কায়দায়, মোগো দেশে কয় পয়নামা। বউর জন্যে কাপুর চুপুর, হাজুনী গুজুনী কিনছি। সব লইয়া পনেরজনের একটা দল। বুড়োরা বা মামু-চাচারা কেউ না, বুইন ভগ্নিপতি, মামাতো-চাচাতো ভাই আর বন্ধু-বান্ধব। হউর বাড়ি তিন গ্রাম দূরে সন্ধ্যা নদী পার অইয়া যাওন লাগে। যাইতে যাইতে রাইত অইয়া যায়। মেহমানগো খাওয়াদাওয়া শেষ করতে করতে রাইত দশটা ছাড়াইয়া গেল। দুলাভাই কানে কানে কইলো— রাইত দুহারের দিকে ঘরের মাচায় বউর লগে তোমার বাসর। এপর্যন্ত বলে একটু থামে আলমগীর, আরেকটা বিড়ি জ্বালায়। বিড়ি টানতে টানতে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলেছে।
জমিরুদ্দিনের হাতেও আপনমনে পুড়ে যাচ্ছে বিড়ি, সে হা করে শুনছে আলমগীরের কথা।
মোর হালী আর হুম্মুন্ধির বউরা মিল্যা মোর বউরে মাচায় উডাইয়া দিয়া চইল্লা যায়। ঘোমডা পইর‌্যা বউ বইসা আছে। আগে মাত্র একবার দেকছেলাম, তহনতো কোনো কতা-বার্তা অয় নাই। হেই মানুষ নির্জনে একলা মোর লাইগ্গা বইয়া রইছে। মুই কী কমু কেম্নে কমু চিন্তা কইর্রা কুলাইতে পারতেছি না। এ পর্যন্ত বলে ঘনঘন বিড়ি টানতে থাকে আলমগীর।
জমিরুদ্দিন তাড়া দেয়, বলে তারপর? তারপর কী করলেন বেয়াই?
সিঁড়ি দিয়া মাচায় উইট্টা দেহি ঘোমডা দিয়া মানুডা বইয়া রইছে। কাছে যাইয়া বইলাম। দেহি ঘোমডা আরও টানে। কী করি? কী করি? হঠাৎ মোর ছোড দুলাভাইর একটা কতা মোনে পড়ল। হে কইছে বাসর রাইতে বিলই মারার কতা। কইছে পয়লা রাইতে যদি বিলই মারতে না পারো তয় কৈলম কপালে দশা আছে। হারা জীবন কৈলম পস্তান লাগবে। এ পর্যন্ত বলে আবার থামে আলমগীর।
জমিরুদ্দিন অবাক হয়। সে বলে— বিলই মারা লাগবে কীর পান্নে? আর ঐ অত রাইতে বিলই পাইবেনইবা কোম্মে?
হাসে আলমগীর। বলে তুমি তো বেয়াই সত্যিই একটা রাম বলদ। বিলই মারা কীরে কয় হেডাও বোঝ নাই? হোনো, বিয়া তো একদিনের কারবার না, বাসর রাইতে বউরে কাবু করতে না পারলে বউ সারা জীবনে আর তোমারে পাত্তা দেবে না।
হেরে কাবু করার কী আছে? হে তো কাবু অইয়াই আছে। না অইলে ঘোমডা দিয়া একলা বইয়া থাকবে ক্যা?
বলদে কয় কী? কাবু মানে বউরে বুঝাইয়া দেতে অইবে যে এই দুন্নইতে স্বামীই অইলো সব। হেরে সোনমান করতে অইবে, হেরে ভয় করতে অইবে। স্বামীরে দেকলে বউ যেন ডরে কম্পমান অয়।
জমিরুদ্দিন অনুসন্ধিৎসু হয়, বোঝার চেষ্টা করে বউকে কীভাবে ভীত, অনুগত করতে হবে। সে প্রশ্ন করে হের লইগ্যা তয় কী করতে অইবে?
আলমগীর একটু ইতস্তত করে, সহজে বোঝাতে পারেনা। সে কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছে, বিব্রতবোধ করছে। জমিরুদ্দিন তাড়া দেয়, বলে কয়ন না দিহি?
আলমগীর বলে— আরে হালার ভাই হালা, বউর লগে মিলন করতে অইবে না? পেরথম রাইত অইলো পেরতেক পুরুষ মাইনসের পরীক্ষার রাইত। ওই রাইতের পরীক্ষায় নিজের পুরুষত্বের পেরমাণ দিতে অয়। বউর মা-চাচিরা, দাদি-নানিরা আর শালা-সুমুন্ধির বউরা বেইন্নালে বউরদে জিগাইয়া, আকার ইঙ্গিতে বুইজ্জা লইবে যে, জামাই পছন্দ অইছে কি অয় নাই। দেখবে দু’জনে ফরজ গোসল করলে কি না।
তারপর?
যদি দেহে বউ যদি খুব খুশি, যদি দু’জনে গোসল কইর‌্যা কাপড়চোপড় শুকাইতে দেয় তাইলেই ধরবা পরীক্ষায় পাশ।
জমিরুদ্দিন যেন কিছুটা বুঝতে পারে। সে বলে— তয় আমনে পেরমাণডা কেম্মে দিলেন? বেইনে খুশি অইলে কী পাইয়া?
গল্পের এখানটায় আলমগীর বিপাকেই পড়ে। এ অধ্যায় নর-নারীর জীবনের এক গভীর গোপন পর্ব। অথচ এ পর্বই পৃথিবী বিবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। লক্ষ বছর ধরে মানবসভ্যতার প্রবাহ এবং এর বিকাশ এ পর্বের ধারাবাহিকতায় নিহিত এ এক চিরন্তন সত্য। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা চিকিৎসার অধিকারের মতোই মানব ইতিহাসে নর-নারীর মিলন পর্ব এবং তার মাধ্যমে বংশ বিস্তার এক শাশ্বত প্রবাহ। একে অস্বীকার করার ক্ষমতা কারও নেই। অথচ জনসম্মুখে তা ব্যক্ত করা লজ্জার, অপমানের, সংকোচের। আলমগীরের এতসব বুঝবার ক্ষমতা নেই, প্রয়োজনও নেই। তবু গল্পের এ অংশটুকু সে প্রকাশ্যে বলতে পারে না।
জমিরুদ্দিন তাড়া দেয়। বলে— কী অইলে বেয়াই? হেরপর কী হইলে, কয়ন না ক্যা? বেয়াইনে কী পাইয়া খুশিতে এক্কালে আত্মহারা অইলো?
আলমগীর বলে— নাহ, এহন আর কইতে পারমু না। রাইতে কমুআনে, ঘুমাবার কালে।

পাথুরে মাটির কিষাণ। পর্ব-১০
মানুষের কাছে গোটা পৃথিবীই এক রহস্যের ভাণ্ডার। জন্ম থেকে মৃত্যু অব্ধি রহস্য উন্মোচনে তাকে কেবলই জানতে হয়, শিখতে হয়। অথচ মানুষ স্বভাবে তার উল্টোটাই দেখিয়ে থাকে। প্রায় সবক্ষেত্রেই দেখা যায় মানুষ তার অজ্ঞতাকে আড়ালে রেখে আচার আচরণে বুঝাতে চায় যে, পৃথিবীর সবকিছুই তার জানা। সে অতীব জ্ঞানী আর পণ্ডিত ব্যক্তি। তাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রহস্য হচ্ছে মানুষ নিজে। মানুষের গতি-প্রকৃতি, জীবনচক্র, তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠার নানান পর্যায়ে স্তরে স্তরে রয়েছে অপার বিস্ময়। মনীষীরা বলেন স্বর্গ-নরক, সুর-অসুর সবই এই মানুষের মধ্যে বিরাজিত।
মানুষ কখনও একা থাকতে পারে না। বন্ধুহীন হয়ে বাঁচতে পারে না, তাই সে সৃষ্টি করেছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। আবার বয়স, কাল, স্থানভেদে সেই বন্ধুত্বেরও আছে নানান পর্যায়। শিশুর বন্ধুত্ব আর প্রাপ্ত বয়স্কের বন্ধুত্ব এক নয়। শিশু নিষ্পাপ। ফুল, পাখির মতো প্রকৃতির যা কিছু মানুষের চিরন্তন ভালোলাগার, শিশুও তাই। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সমাজ সংসারের জটিলতা-কুটিলতা, ঘাত-প্রতিঘাতে বেঁচে থাকতে মানুষ নিজেকে করে তোলে অধিক কৌশলী। আবার কিছু কিছু মানুষ প্রকৃতির মতোই সরল, নিষ্পাপ হয়ে বেড়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত তেমনই থেকে যায়।
মানুষের কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে পরস্পরের যে বন্ধুত্ব তা হয় বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো। কোনো কিছুতে সে জোয়ার থামানো যায় না। আলমগীর আর জমিরুদ্দিনের এখন সেই বয়স ও সময়। তাদের বন্ধুত্বের মধ্যেও সেরকম বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, উপচেপড়া আনন্দ আর রঙ্গে-রসে টইটুম্বুর। তাদের আলাপচারিতার বিষয়বস্তু যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ তেমনি লাগামহীন। একজন সবে মাধ্যমিক শেষ করেছে, অন্যজন প্রাথমিকের বিদ্যা নিয়ে কৈশোরেই ঢুকে পড়েছে জীবনযুদ্ধে। পারিবারিক, বৈষয়িক, সামাজিক বা আত্মিক কোনো জ্ঞানেই তারা পরিপক্ব হয়ে ওঠেনি। তবু বক্তার প্রবল ইচ্ছে এবং শ্রোতার শ্রবণের অসীম আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও আলমগীরের বাসর রাতের সে রসাল গল্প আর এগুতে পারে না। অনেকক্ষণ বসে থেকে নানান কথাবার্তা বলে ঠিক সন্ধ্যেবেলা তারা চিত্রালী হলে সিনেমা দেখতে ঢুকে পড়ে।
গল্পটা বলতে পারলে আলমগীরের হয়তো ভালো লাগত, মন হালকা হত। সে আন্দাজ করে জমিরুদ্দিনও মনে হয় খুব আহত হয়েছে। তবে জমিরুদ্দিন তেমন কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করে না। সে নিবিষ্ট চিত্তে সিনেমা দেখতে থাকে। সে দেখতে থাকে গ্রামের এক কৃপণ বাবার শিক্ষিত ছেলে বহুদিন শহরে ছিল। সেখান থেকে লেখাপড়া শিখে এসে কীভাবে নিজ গ্রামের প্রতিবেশী হতদরিদ্র এক বালিকার প্রেমে হাবুডুবু খায়। আর সেই কৃপণ বাবা তার ছেলের বিয়ের জন্য কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার কাছে যৌতুক চেয়ে তাকে কীভাবে হেনস্থা করেন।
নিজের জীবনের সাথে সিনেমার কাহিনীর মিল খোঁজে জমিরুদ্দিন। সে শহরে এসেছে জামিলা গ্রামের বাড়িতে— এ পর্যন্ত ঠিক আছে। তারপরই সব এলোমেলো। সে হতদরিদ্র, ভূমিহীন আর জামিলা ধনীর দুলালী। নায়ক রাজ্জাকের অনুপস্থিতিতে সিনেমার ময়নাকে যেমন এক জমিদার বিয়ে করে নিয়ে যায় তার অনুপস্থিতিতে তার জামিলাকেও কোনো ধনীর দুলাল নিয়ে যাবে? জমিরুদ্দিন হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে। সে আলমগীরকে জিজ্ঞেস করে— ময়না কি মতির লগে আর আইতে পারবে না?
আলমগীর বলে— কেম্মে আইবে? ঐ দিহি পালকিতে চইর‌্যা যাইতে আছে, দেহ না? এরপর আর আইবে কেম্মে?
জমিরুদ্দিন আর কিছু বলে না। ময়নার পালকি নিয়ে বেহারা চলে, লোকজন গ্রামের রাস্তা দিয়ে লাইন ধরে হাঁটে আর সমান্তরাল দূরত্বে মতি আকাশ বাতাস মথিত করে বিরহের গান গায়—
‘অনেক সাধের ময়না আমার
বাঁধন কেটে যায়
মিছে তারে শেকল দিলাম
রাঙা দু’টি পায়…’
হঠাৎ আলমগীর খেয়াল করে যে জমিরুদ্দিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে প্রশ্ন করে— কী বেয়াই, সিনেমা মনে কয় তোমার মনে ধরছে। ময়নার নাহান তোমারেও কেউ ছাইর‌্যা গেছে নাহি?
জমিরুদ্দিন লজ্জা পেয়ে চোখ মোছে। তার জীবনে প্রথম সিনেমা দেখা। আনন্দে, উত্তেজনায়, নায়ক নায়িকার বিচ্ছেদ দৃশ্যে তার আর কোনোদিকে খেয়াল থাকে না। আলমগীর পাশে বসে ফিসফিসিয়ে বলে— এইডা কিন্তু কবরী আর ঐ যে নায়কটা দেহ ওডা কেডা জানো? উনার নাম রাজ্জাক।

জমিরুদ্দিনের সংক্ষিপ্ত জবাব— জানি, কওন লাগবে না।
আলমগীরের মনে ঘুরে-ফিরে তার বাসর রাত দেখা দিয়ে যায়। আহা অমন সুন্দর কচি মাইয়াডা বুইড়া জমিদার নিয়া কীসব করবেনে? সে ভাবে জমিরুদ্দিন তার বাসর রাতের গল্প শুনতে না পেরে তার উপর বোধহয় অসন্তুষ্ট হয়ে আছে, তাই কথা বলতে চাচ্ছে না। আসলে আলমগীর তার স্ত্রীর সাথে বাসর ঘরে কী কী করেছে, কীভাবে স্ত্রীকে বশ করেছে এবং কীভাবে স্বামী-স্ত্রীর গোপন মিলনে বীরত্ব দেখিয়েছে তা বলতেই ভৈরব পাড়ের নির্জন জায়গাটিতে গিয়েছিল, বলতে শুরুও করেছিল কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক সংস্কারবশত বলতে পারেনি।
গল্পটা বলতে গিয়ে হঠাৎ আলমগীর বুঝতে পারে যে, বিয়ে শুধু নরনারীর যৌন আকাঙ্ক্ষা মেটানোর উপায় মাত্র নয়। দু’টি প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষের মধ্যে এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক বন্ধন। আবহমান কাল ধরে এই বন্ধনের মধ্য দিয়ে তামাম মানবজাতির মধ্যে গড়ে উঠেছে পরিবার প্রথা, মজবুত সামাজিক কাঠামো যা চিরন্তন ও শাশ্বত।

বিয়ে নামক এই বন্ধনের মাধ্যমে সে নিজেও তার মা-বাবার সংসারে জন্ম নিয়েছে, বড় হয়েছে। এর মাধ্যমেই অনতিবিলম্বে তারও একটি সংসার হবে, ছেলে-মেয়ে ইত্যাদি একটি সুন্দর পরিবার হবে। তার প্রবল ইচ্ছে ছিল জীবনে প্রথম কোনো নারীর সাথে যৌন সংসর্গের সেই রসঘন বর্ণনা তার বন্ধুর কাছে সে করবে কিন্তু সঙ্গত কারণেই তা পারেনি।
এই না পারার কারণে তার মন অস্থির হয়ে আছে, ভাবছে বন্ধু জমিরুদ্দিন তার প্রতি হয়ত রুষ্ট হয়ে আছে তাই বারবার তাকে খোঁচা দিয়ে, বাদাম ভাজা দিয়ে, পপকর্ন ইত্যাদি কিনে দিয়ে নানান কৌশলে তাকে সহজ করতে চাচ্ছে। কিন্তু জমিরুদ্দিন?
সে এতক্ষণ নিবিষ্ট চিত্তে মগ্ন হয়ে দেখছিল ছবির ঘটনাপ্রবাহ, উপভোগ করতে থাকে নায়ক-নায়িকার নানান খুনসুটি। তার অবচেতন মনে চলছিল আরেকটি সিনেমা। তখন মানসপটে জ্যান্ত হয়ে ভাসছিল তারই গ্রামের শিকদার বাড়ির মেয়ে জামিলার মুখচ্ছবি। জমিলাও কবরীর মতো অমন করে বেণি দুলিয়ে তাদের বাড়ির দক্ষিণের পাড়ায় আম কুড়াতে আসত। জমিরুদ্দিনকে দেখে বলত— দু’টো আম পেড়ে দাও না জমিরুদ্দিন ভাই।

ডাগর ডাগর দু’টি চোখ, লম্বা লম্বা হাত-পা, মুখে কথার ফুলঝুরি।
জমিরুদ্দিন একবার আম পেড়ে মেরেছিল জামিলার পিঠে, জামিলা কঁকিয়ে উঠে ভেঙচি কেটে বলেছিল— ভালো হবে না কিন্তু…।

 

+ posts

Read Previous

একজন মন্ত্রীর একদিন

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন- ৩য় সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *