কুশীলব
বড়কর্তা : মনীন্দ্র লাল চৌধুরী
ছোটকর্তা : রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী
চাকর : যোগেন ও মোহন
চাকরদ্বয়ের প্রেমিকা : অঞ্জলী ও বেনু
মা : নন্দিতা বালা
বড়কর্তার প্রেমিকা : ফাতেমা জান্নাত
অন্যান্য চরিত্র : ক্রিকেটার দল ও পূজা উদযাপন কমিটির সদস্যবৃন্দ।
প্রথম দৃশ্য
[পর্দায় রক্তিম সূর্যের প্রতিবিম্ব ভেসে উঠবে, অদূরেই শোনা যাবে প্রভাতপাখির কলস্বর। সূর্যের আলোকরশ্মি ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকবে; তক্ষুনি দেখা যাবে একটা ঠাকুরঘর। মূর্তির সামনে প্রার্থনার পোশাক পরে জোড়া-হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে একজন বৃদ্ধ লোক, নাম মনীন্দ্র লাল চৌধুরী। ‘আমি নয়নে বসন বাঁধিয়া, বসে আঁধারে মরি গো কাঁদিয়া, আমি দেখি নাই কিছু, বুঝি নাই কিছু, দাও হে দেখায়ে বোঝায়ে, তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’— গীতিকবি রজনী কান্ত সেনের ভক্তিসঙ্গীতের অন্তরাটুকু বেজে উঠবে। মূর্তির সামনে পাখির খাঁচায় সোনালি রঙের একটা পানির গ্লাস বন্দি অবস্থায় দেখা যাবে। খাঁচার ওপর গাঢ় আলোর প্রক্ষেপণ। পূজো-অর্চনা শেষ করে খাঁচাটি হাতে তুলে নেবে মনীন্দ্র লাল চৌধুরী। চতুর্পাশে সোনা-রুপোর পানি ছিটিয়ে জোড়া-হাতে এবং আনত মস্তকে ঠাকুরকে প্রণাম ঠুকবে। তারপর খাঁচাটি বুকে জড়িয়ে দীর্ঘকাল চোখ মুদে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখবে। কপালে ও বুকে পর্যায়ক্রমে বারকয়েক প্রবল ভক্তিতে উঠানামা করাবে খাঁচাটি। এ সময় শিকারি বকের মতো নিঃশব্দ পায়ে মনীন্দ্র লাল চৌধুরীর পেছনে এসে দাঁড়াবে চাকর মোহন।]
মোহন : কর্তাবাবু, বহুদিন ধরে একটা কথা মাথার মধ্যে খালি ঘুরপাক খায়। জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছি না।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : কী কথা রে মোহন। এত ভনিতার কী আছে, কথা জিনিস লুকিয়ে রাখতে নেই রে, বোকা। বলে ফেলা উচিত। যত তাড়াতাড়ি কথা মাটিতে ফেলা যায় তত তাড়াতাড়ি হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যায়। কথা লুকিয়ে রাখা যে আগুন লুকিয়ে রাখার মতো ভয়ঙ্কর জিনিস। কেবল পুড়িয়ে পুড়িয়ে মারে।
মোহন : জি বাবু, বলছিলাম যে [খানিকটা হেসে] প্রত্যেক বছর ভাদ্র মাসের ১ তারিখ এলে আপনি কেমন ঠাকুর ভক্ত হয়ে যান। গেলাশ-সমেত খাঁচাটি ঘর থেকে বের করে এনে ঠাকুরের পায়ের কাছে বসে ভক্তিতে একাকার হয়ে যান। এই গেলাশের আসল রহস্যটা কী একটু জানতে পারি বাবু?
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : [দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে] মোহন, জীবনে তো অনেক ধরনের প্রশ্ন করেছিস আমাকে, প্রশ্ন করার পর কখনও উত্তর পাসনি এমনটা কি একবারও ঘটেছে?
মোহন : আজ্ঞে, না বাবু। সবসময়ই আপনার কাছে প্রশ্ন করলে উত্তর পাই। উত্তর পাইনি এমনটা কখনো ঘটেনি।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : [প্রথমে খাঁচার দিকে তারপর মোহনের দিকে একবার তাকিয়ে] তাহলে এই একটা প্রশ্নের উত্তর না জানলে কি হয় না রে মোহন?
মোহন : জি, কর্তাবাবু। হয়। [মাথা চুলকাতে চুলকাতে] সমস্যা নাই। আপনার ইচ্ছে না থাকলে বলার দরকার নাই। আমি আসলে এমনিতেই প্রশ্নটা করলাম। চলেন বাবু, নাস্তার সময় যে হয়ে এল।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : জানার আগ্রহ যে চাইলেও দমানো যায় না রে, মোহন। তবুও কথাটা গোপন থাকাই শ্রেয়। তাই বললাম না। সে যাগগে, চল নাস্তা সেরে নিই।
মোহন : চলেন বাবু।
[বিনম্রচিত্তে একটু সরে জায়গা করে দিয়ে, সামনের দিকে হাত উঁচিয়ে দেবে। দুজনের প্রস্থান]
দ্বিতীয় দৃশ্য
[রাত কিছুটা গভীর। মঞ্চে আলো-আঁধারির খেলা। দুজন লোক প্রবেশ করবে। প্রথমে রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী, তারপর যোগেন। আলোর তীব্রতা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়বে ক্রমাগত দুজনের শরীরে। বিশেষত মুখের অগ্রভাগে। দুজনেই গম্ভীর ও চিন্তিত। কিছুকাল বসে থাকবে তারা। নীরবতা ভাঙবে রাজেন্দ্র।]
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : [বিক্ষুব্ধ চিত্তে দাঁড়িয়ে ওঠবে] না, না, না। যোগেন, এসব আর সহ্য করা যায় না। এত বছর মুখ বুজে অনেক সহ্য করেছি। আর না। জাদু-টোনা করে আমারই বড় ভাই আমার সংসারের সুখ-সমৃদ্ধি নষ্ট করবে, আর তরতর করে ধনসম্পদের মালিক হবে, আর আমি হবো গরিব-ফকির— এ আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না যোগেন। আমি এর যথার্থ প্রতিকার চাই।
যোগেন : [শ্লেষমাখা হাসি ছড়িয়ে] শুধুই কি আপনার সংসারের সুখ-সমৃদ্ধি নষ্ট করেছে বড়বাবু? আরও যা যা করেছে সেগুলোর কথা তো জানেন না ছোটবাবু। জানলে যে…।
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : [বিস্মিত হয়ে] আরও যা যা করেছে মানে? আর কী কী করেছে, বল যোগেন, বল আমাকে, আর কী কী করে আমার অনিষ্ট সাধনের চেষ্টায় মত্ত আছে ওই মনীন্দ্র লাল চৌধুরী?
যোগেন : [অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে] অনেক কিছু মশাই, অনেক কিছু। সব বলতে গেলে যে দিনটাই ফুরিয়ে যাবে, তবে একটুখানি শোনেন, আপনার ওই কঞ্জুস বড় ভাই, পাজির হাড্ডি মনীন্দ্র লাল চৌধুরী ওই জাদুর গেলাশের টাকায় ঢাকা সংসদ ভবনের পাশে বিশ কাঠা জমি কিনছে। সিলেটে কিনছে চা বাগান আর চট্টগ্রামে কিনছে তিন তিনখান পাহাড়! সব, সব ওই গেলাশের তেলসমাতি মশাই। দেখছেন? আপনাকে কেমন ঠকিয়ে যাচ্ছে মিস্টার চৌধুরী? লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের নামে সবকিছু করে নিচ্ছে। উপরে উপরে দেখায় মুনি ঋষির ভাব, যেন কিচ্ছুটি বোঝে না, অথচ বেটা তলে তলে আস্ত একটা খচ্চর কা বাচ্চা হ্যায়। ওই লোক আসলে একটা মিচকা শয়তান মশাই। আমি বিশ্বস্তসূত্রে এটাও জেনেছি, যে কোনো মুহূর্তে আপনার ভাই এই বসতভিটা, জায়গাজমি সব বিক্রি করে নিজের কেনা প্রাসাদে গিয়ে উঠবে। তখন আপনার কাঁচকলা ছাড়া আর কিছুই কপালে জুটবে না মশাই। হুম… ‘সময় গেলে সাধন হবে না।’
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : তুই এসব কী বলিস যোগেন! এটা কীভাবে সম্ভব! এত বড় ফাঁকিবাজি! আমার সঙ্গে প্রতারণা! আমি এর বিহিত করে ছাড়ব। আমি ছাড়ব না ওই চৌধুরীকে।
যোগেন : বিহিত করার টোপ অবশ্যি আমার কাছে আছে মশাই। হে হে হে। [খলখলিয়ে হেসে ওঠে] দারুণ সংবাদ আছে যে…।
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : কী টোপ, কী সংবাদ। দ্রুত বল যোগেন। আমার আর তর সইছে না। রক্তে আমার খুন চেপেছে। আমার সঙ্গে বাটপারি! আমার অনিষ্ট সাধন? ছাড়ব না, কিছুতেই আমি ছাড়ব না ওই চৌধুরীকে।
যোগেন : [একটু কাচুমাচু করে] হে হে, আপনি তো মশাই জানেন যে, সব সময় সব কথা আমার মুখ থেকে বেরোয় না। আমি চাইলেও মুখ বলতে চায় না। মুখে কিছু না গেলে…, পেটে কিছু না পড়লে যে আমার কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হয় মশাই… হে হে হে… ‘সাধন ছাড়া বাঁধন কাটে না’, হে হে…
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : তোকে নিয়ে আর পারা গেল না। [পকেট হাতড়ে কিছু টাকা যোগেনের হাতে গুঁজে দিতে দিতে] নে, এই নে। মুখে কী, দিবি দে। তারপরও গোপন কথা বের করে আমাকে উদ্ধার কর।
যোগেন : [তামাশার হাসি হেসে] যে গেলাশের এত তেলেসমাতি, যে গেলাশ দিয়া এত জাদুটোনা, এত অর্থবিত্ত গড়েছে আপনার বড় ভাই, সেই গেলাশখানা কিন্তু তার একার সম্পত্তি নয় মশাই! আমি খতিয়ে দেখেছি, ওই গেলাশ আপনার পারিবারিক গেল্লাস। আপনার বাবা-মাও ওই গেলাশ ব্যবহার করেছেন। ওটা যে আপনার বাবার টাকায় কেনা। অবৈধভাবে বেদখল করেছে আপনার দাদা। বাবার উত্তরাধিকারী হিসেবে গেলাশের মধ্যে অর্ধেক মালিকানা স্বত্ব কিন্তু আপনারও রহিয়াছে মশাই। অথচ দেখুন, আপনারই বেঈমান সহোদর কখনো বুঝতেই দেয়নি এসব। সবকিছু নিজের মতো ভোগ করছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, ওই গেলাশের মালিক তিনি একা নন, আপনিও এর মালিক বটে… বুঝলেন মশাই? হুঁ।
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : [বিস্মিত হয় এবং খলখলিয়ে হেসে ওঠে] বলিস কী রে! সত্যি! সাব্বাস যোগেন, তুই তো দেখছি গর্ত থেকে সাপ বের করে আনার যোগ্য ওঝা রে, চৌধুরীর অতীত বর্তমান এবং ভবিষতের সব খবরাখবর সুড়-সুড় করে বের করে নিয়ে আনলি তুই! বাহ! [আবারও হাসি এবং পকেট কচলে আরও কিছু টাকা গুঁজে দিলো যোগেনের হাতে। যোগেন প্রথমে টাকা না নেওয়ার ভান করে বলবে— আমি আবার ঘুষটুস খাই না মশাই, ওসব আমার একদম অপছন্দ কিন্তু মুখ বেচারা বড়ই নাদান, টাকা না পেলে যে কিছু বলতেই পারে না। কথাটা বলেই, টাকাটা ছিনিয়ে নেবে।] এবার তার চালাকির উচিত শিক্ষা দেব। আমাকে ফাঁকি দিয়ে এত কিছু! অপেক্ষা, অপেক্ষা কর, দু’একদিনের মধ্যেই আমি এর বিহিত করব। চল যোগেন আজকের মতো উঠি।
[দুজনের প্রস্থান]
তৃতীয় দৃশ্য
[‘জলেতে না যাইও তুমি কলঙ্কিনী রাধা, কদমগাছে উঠিয়াছে কানু হারামজাদা’ গুনগুন করে নদীর ধারে বসে গান গাইবে বেনু, একাকী। চুপিসারে পেছনে এসে চোখ চেপে ধরবে যোগেন। বেনু চমকে উঠবে। খিলখিল করে হেসে উঠবে যোগেন]
বেনু : মোহনদা!
যোগেন : [হাত সরিয়ে নিয়ে বিরক্ত হয়ে তার পাশে বসে] উফ, আরে না, আমি যোগেন! ওই খচ্চর মোহনের নাম মুখে তুললে কেন, বেনু?
বেনু : আমি কার নাম মুখে নিমু সেটা কী তোমারে জিগামু?
যোগেন : এত ক্ষেপিস কেনে রে? এই দেখ তোর জন্যে কী আনছি? [সোনার একটা চেইন বেনুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে] তোর জন্যে আনছি, দেখ দেখ কত সুন্দর!
[বেনু দারুণ খুশি হয় এবং মুরগি ছানা ছোঁ মেরে নিয়ে পালানো কাকের মতো দ্রুত সে যোগেনের হাত থেকে চেইনটা কেড়ে নেয় এবং গলার কাছে নিয়ে ধরে। খুব আনন্দিত হয়]
বেনু : ও-মা! কী সুন্দর গো! আমার জন্য আনছ যোগেনদা? সত্যিই আমার জন্য!
যোগেন : হুম, কী, খুশি তো…।
বেনু : আমি বেজায় খুশি যোগেনদা। (উচ্ছ্বসিত হয়, তারপর একটু চিন্তিতও হয়) কিন্তু এত টাকা তুমি কই পাইলা যোগেনদা?
যোগেন : কেন রে, অপারেশন, দারুণ একটা অপারেশন ছিল, সেখান থেকে পাইছি রে, বেনু। সামনেতে আরও বড় বড় জিনিস পামু, তুইও পাবি। তুই শুধু আমার কথা শুনবি, সব পাবি।
বেনু : অপারেশন! মানে! তুমি ডাক্তার হইলা কবে?
যোগেন : ধুর বোকা, এই অপারেশন সেই অপারেশন না, এটা হল বুদ্ধির অপারেশন।
বেনু : ও… তাই! কীভাবে করলা সেই অপারেশন, আমারে বলবা?
যোগেন : বলমু না মানে, সবকিছু খুইলা বলার তো এখনই সময়। বস, বস বুঝিয়ে বলি, আরেকটু কাছে আয় না… (বেনুর বাহুতে ধরে কাছে টেনে নেয় মোহন। তারপর তাকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে) তাহলে শোন…।
[সময় উপযোগী বাজনা বেজে উঠবে। ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ‘ও শ্যাম রে তোমার সনে, একেলা পাইয়াছি রে শ্যাম এই নিঠুর বনে, আজ পাশা খেলবো রে, শ্যাম।’ গানের মুখের অংশ-বিশেষ বেজে উঠবে। মঞ্চের আলো নিভে আসবে। দুজনের প্রস্থান]
চতুর্থ দৃশ্য
[সকালের রোদ বারান্দায় ঠিকরে পড়ছে। শোবার ঘর থেকে গ্লাসবন্দি খাঁচাটা বের করে এনে বারান্দায় বসে কাপড় দিয়ে ধোয়া-মোছার কাজে ব্যস্ত মনীন্দ্র লাল চৌধুরী। খাঁচার ভেতর থেকে গ্লাস বের করে টিস্যু দিয়ে সুন্দরভাবে পরিষ্কার করে নেয়, চুমু খায় এবং বুকের মধ্যে একটুখানি আগলে রেখে পাখির ছানার মতো আবার যথাস্থানে ঢুকিয়ে রাখে। পেছনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয় মোহন। তারপর বেডরুমে নিয়ে আগের মতো ঝুলিয়ে দেওয়ার সময় মোহনও পেছনে পেছনে যায় এবং কর্তাকে প্রশ্ন করে]
মোহন : কর্তাবাবু, একটা কথা বলি…।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : কথা জিনিস পেটে রাখতে নেই রে বোকা, যন্ত্রণা দেয়। যা বলার বলে ফেল।
মোহন : বলছিলাম যে, মানুষ খাঁচার মধ্যে পাখি পোষে, আর আপনি পোষেন গেলাশ! মাথামুণ্ডু কিছুই তো বুঝলাম না। এটা কি উড়াল দেব যে খাঁচায় ঢুকিয়ে রাখতে হয়?
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : [চমৎকার হাসি দিয়ে] এটাও যে একটা পাখি রে মোহন, পাখিদের চেয়েও বড় পাখি, সব পাখির সেরা পাখি, তাই পুষি। যেন উড়াল না দেয়…।
মোহন : কী সব আংরেজি-বাংরেজি বলেন মশাই, আমি এর আগা-গোড়া কিছুই পাই না।
[যোগেনসহ রাজেন্দ্রর প্রবেশ। বিধ্বস্ত মুখ। দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে মোহন, নমস্কার দিয়ে প্রস্থান করবে সে। খুব সকালে ছোট ভাইকে মনমরা দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে উঠে মনীন্দ্র]।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : কী রে রাজেন্দ্র, সাতসকালে হঠাৎ কী মনে করে? কোনো সমস্যা হল না তো? মন খারাপ কেন রে ভাই?
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : [রুক্ষস্বরে] হ্যাঁ দাদা, সমস্যায় পড়েই এলাম এবং সমাধানের জন্যেই এলাম।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : [কিঞ্চিৎ বিব্রত। কৃত্রিম হাসি হেসে] কী সমস্যা বল তো শুনি, সমাধান তো অবশ্যই আছে।
[চা নাস্তার ট্রে হাতে মোহনের প্রবেশ। টেবিলে চা রেখে মনীন্দ্র বাবুর পেছনে এসে দাঁড়ায় সে। মনীন্দ্র রাজেন্দ্রকে বসতে বলে, সে বসে না। চায়ের কাপেও হাত দেয় না। তার পেছনে দাঁড়ানো যোগেন, চেহারায় এক বিজ্ঞজনের ভাব]
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : [কোনো ভূমিকা ছাড়াই গ্লাসের দিকে ইঙ্গিত করে] দাদা, অনেক বছর ধরে তো তুমি ওই গেলাশটা ব্যবহার করে আসছ। এবার ওটা আমাকে দিয়ে দাও। আমাদের পারিবারিক গেলাশ হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে ওটার মালিক তো আমিও। তাই না? এত বছর তুমি ব্যবহার করেছ এখন করব আমি। আবার তোমার কখনো প্রয়োজন হলে বলো, আমি দিয়ে দেব। আপতত গেলাশটা আমার লাগবে।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : [বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার মতো চমকে ওঠে, স্তম্ভিত হয়] কী বলিস তুই এসব। না, না ভাই এই গেলাশ তুই চাইস নে। এটার মালিকানা স্বত্ব তোর আছে এ কথা বলতে আমার আপত্তি নেই। পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে এটা তোরও সম্পদ। কিন্তু তারপরও এই গেলাশ আমি তোকে দিতে পারব না ভাই। মরে গেলেও না। এই গেলাশ ছাড়া অন্য যা কিছু চাইবি আমি দিয়ে দেব। যত দামি বস্তুই হোক আমি দিয়ে দেব রে ভাই। শুধু এই গেলাশটা চাইস নে তুই। [কান্নায় ভেঙে পড়ে মনীন্দ্র লাল চৌধুরী।]
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : [কিংকর্তব্যবিমূঢ়, একটু ভেবে] তাহলে তোমার উত্তর পাশের বাগানবাড়িটা আমার নামে লিখে দাও। ওটা পেলে এই গেলাশের উপর আমার আর কোনো দাবি নাই।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : [অবাক এবং শান্ত-স্থির] ঠিক আছে, তুই কাগজপত্র রেডি কর। আমি এক্ষুনি বাগানবাড়ি লিখে দেব। তারপরও যদি এই গেলাশের দাবি ত্যাগ করিস আমার আর কষ্ট থাকবে না। ওই বাগানবাড়ির চেয়ে এই গেলাশ আমার কাছে অনেক বেশি দামি। যা, কাগজ নিয়ে আয়, আমি সই করে দেব।
[আনন্দচিত্তে রাজেন্দ্র ও যোগেন প্রস্থান। রাজেন্দ্রর আচরণ দেখে রাগ, ক্ষোভ এবং ঘৃণামিশ্রিত অবস্থায় প্রস্থান করবে মোহন। মনীন্দ্রের প্রচণ্ড মন খারাপ হবে, ভাইয়ের অবিশ্বাস ও লোভ দেখে। —মঞ্চবাতি নিভে আসবে এবং প্রস্থান]
পঞ্চম দৃশ্য
[দিনের আলোর মতো পুরো মঞ্চ ধবল আলোয় ফকফকা হয়ে উঠবে। সুন্দরী এক তরুণী প্রবেশ করবে। নাম অঞ্জলী। এমন সময় রবি ঠাকুরের ‘দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি’— গানের মুক এবং প্রথম অন্তরা বেজে ওঠবে। মেয়েটি নাচবে। পোশাক-আশাক সাদামাটা। নাচের মুদ্রা ততটা দক্ষ নয়। গান এবং নাচের মুহূর্তে দূর-মনা হয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে যাবে মোহন। মোহনকে দেখে নাচ থামাবে। একই সঙ্গে গানও থামবে।]
অঞ্জলী : [তামাশাসূচক অঙ্গভঙ্গিতে] এই যে মোহন চামচা। সারাদিন কেবল কর্তাকে নিয়ে পড়ে থাকলেই হবে? জগতে কি কেউ আর নাই? লুকিয়ে লুকিয়ে কই যাওয়া হচ্ছে? আমাকে দেখেও যেন দেখো নাই, আগে তো বেশ লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে, এখন দেখার সাধ মিটে গেল নাকি? আরেকজন মিলেছে বুঝি? নাকি যোগেন চামচার মতো বেনুর পিছনে তুমিও কিলবিল করো…।
মোহন : [বিষাদগ্রস্ত সুরে] আজ মনটা ভালো না রে অঞ্জু। খুব কষ্ট হচ্ছে। কান্না আসতেছে। এভাবে বলিস না রে। [মোহনের চোখ জলে চিকচিক করে উঠবে]
অঞ্জলী : [স্তব্ধ হয়ে যাবে। হাসিখুশি মোহনকে এতটা কষ্টকাতর দেখেনি সে কখনও] কী হয়েছে মোহনদা? হঠাৎ মন খারাপ কেন। শত বিপদেও তো তোমারে এতটা হতাশ হতে দেখি নাই কোনোদিন।
[প্রায় কেঁদে উঠবে মোহন ও মনীন্দ্রের সঙ্গে রাজেন্দ্র চৌধুরীর আচরণের হুবহু বর্ণনা দেবে। অঞ্জলী নির্বিকার হয়ে যাবে।]
মোহন : ওই বাগানবাড়ি দিয়ে দিলে কর্তামশাই নিঃস্ব হয়ে যাবে রে অঞ্জু। জীবনে শুধু একটা গেলাশ গেলাশ করে কম অপমান হয় নাই লোকটা। কান্নাকাটি ছাড়া কর্তাবাবু আর কিছুই পায় নাই রে জীবনে।
অঞ্জলী : এত বড় সম্পদ হারিয়েও যদি গেলাশ পেয়ে কর্তামশাই সন্তুষ্ট থাকেন তারপরও তো ভালো থাকবেন তিনি। তুমি এসব নিয়ে অযথা চিন্তা করো না তো মোহনদা। কর্তামশাই অনেক বড় মানুষ, বুদ্ধিশুদ্ধি কম নাই, না বুঝে কি আর কিছু করবেন?
মোহন : কর্তাকে সবাই সন্দেহ করে। সবাই বলে ওটা নাকি জাদুর গেলাশ। ওটা নাকি নাড়াচাড়া করলেই টাকা আর ধনরত্ন বেরিয়ে আসে। আসলে তা না রে অঞ্জু। আমি কাছে থাকি। সবই তো দেখি। ওটা সাধারণ একটা জলের গেলাশ ছাড়া আর কিছুই না। কর্তা শুধু এটাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। আর কিছু না।
[দুজনের নানাবিধ কথাবার্তার মাধ্যমে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। মোহন অঞ্জলীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনের কষ্ট কেটে যাবে।]
অঞ্জলী : আচ্ছা মোহনদা, ওটা যদি সাধারণ গেলাশই হয় তাহলে কর্তাবাবু এত ভক্তি-শ্রদ্ধা করে কেন? নিজের বিরাট সয়-সম্পত্তির বিনিময়েও সামান্য একটা গেলাশ হাতছাড়া করতে চায় না কেন? নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে। তুমি উনার সঙ্গে সারাক্ষণ থাকো, তুমি তো জানার কথা ওই গেলাশের গোপন রহস্যটা…।
মোহন : কর্তাকে বহুবার প্রশ্ন করেও রহস্য বার করতে পারিনি রে অঞ্জু। আমার মনে হয়, ওটা হচ্ছে কর্তাবাবু প্রেমিকার গেলাশ। ওটাতে করেই তো…।
অঞ্জলী : [কথা শেষ করতে না দিয়ে] প্রেমিকার গেলাশ! হো হো, তুমি হাসালে মোহনদা, কর্তাবাবু আবার প্রেমিকা পাবে কোথায়? চাপা মারার জায়গা পাও না, না? বলো যে আমি জানি না, শুধু শুধু মিথ্যা বলে আমাকে খুশি করিয়ে কী লাভ বলো তো? পৃথিবীর এত কিছু থাকতে প্রেমিকার গেলাশ নিয়ে এত মাতামাতি করে কেউ? বুড়া মানুষেরও কি প্রেমিকা থাকে, বোকা রাম? ওই লোক তো বিয়াই করতে পারে না জীবনে…।
মোহন : হাসবি না অঞ্জু। আমি তো বললাম কর্তাবাবু আমাকে কিছু বলেননি গেলাশ সম্পর্কে। কিন্তু ওই বাড়িতে এত বছর থেকে গোপনে গোপনে তদন্ত করে জেনেছি কর্তাবাবু যৌবনে এক মুসলমান মেয়ের সঙ্গে পিরিতি করতেন। মেয়েটির পরিবার তাকে অন্য ঘরে বিয়ে দিতে চাইলে সে আত্মহত্যা করে মারা যায়। আমার বোধহয় এই গেলাশে করেই মেয়েটি বিষ খাইছে রে…।
অঞ্জলী : সত্যি বলছ তো! আমারও বোধহয় এমন কিছু একটা হবে। নইলে সামান্য একটা গেলাশের জন্যে এত দিওয়ানা হবেন কেন।
মোহন : কর্তার অগোচরে আমি অনেক চেষ্টা করেছি গেলাশের রহস্য বের করতে কিন্তু পারিনি। একদিন কর্তার পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে কিছু চিঠিপত্র পেয়েছি। সেখানে তাদের হিন্দু-মুসলিমের প্রেমের সম্পর্ক যে সমাজ ভালোভাবে নেয়নি সেটা উল্লেখ আছে। মেয়েটি বারবার লিখেছে আমাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিলে আমি আত্মহত্যা করব। বিষ খাব।
অঞ্জলী : তাই?
মোহন : হুম।
অঞ্জলী : আচ্ছা মোহনদা, কর্তাকে তুমি অনেক ভালোবাসো, তাই না?
মোহন : হ্যাঁ রে অঞ্জু, জন্মের পর থেকেই এই মানুষটা ছাড়া আর কোনো আপনজন দেখি নাই চোখে। আমি কে, আমি নিজেও জানি নাই রে। কে আমার বাবা-মা, কোথায় আমার জন্ম এসব আজও আমি জানি না রে, অঞ্জু। কোনোদিন প্রশ্ন করার সাহসও হয় না কর্তাকে। যদি বাবু কষ্ট পায়…।
অঞ্জলী : [ভ্রু কুঁচকে] আচ্ছা মোহনদা, কর্তাবাবুকে কি তুমি আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসো?
মোহন : [একেবারেই ভড়কে যায় মোহন] ধুর, এসব কী আবোল-তাবোল প্রশ্ন করিস তুই। যাই রে, পরে কথা হবে।
[মোহনের প্রস্থান। পেছন থেকে অঞ্জলী তাকে ডেকে ডেকে হয়রান কিন্তু সে দৌড়ে পালাবে। অঞ্জলী হেসে উঠবে সজোরে। মঞ্চবাতি নিভে আসবে। বাজনা বেজে ওঠবে। প্রস্থান]
ষষ্ঠ দৃশ্য
[কয়েকটা স্ট্যাম্প প্রজাতির কাগজ চুমু খেতে খেতে হাসিমুখে মঞ্চে প্রবেশ করবে রাজেন্দ্র। পেছনে ঈর্ষাকাতর চেহারায় প্রবেশ করবে যোগেন। যোগেনের যেন হাঁটতে বড় কষ্ট হচ্ছে। এই মুহূর্তে তার হাতে বড় ধরনের একটা টাকার বান্ডিল গুঁজে দিলে সে ঈষৎ হাসবে। তারপর আরেকটা দিলে হাসির মাত্রাটা আরেকটু বাড়বে। এরপর আরও একটা দিলে সে যেন হাসতে হাসতে খুন হয়ে যাবে।]
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : দেখলি যোগেন, আমার খেলা? আমার সঙ্গে বাটপারি! তাই বলে ছেড়ে দেব নাকি? আহা! কী সুন্দর বাগানবাড়ি! আজ থেকে এখানকার সবকিছু আমার— বিশ্বাসই করতে পারছি না রে। অবশ্য তুই গোপন তথ্যটা না দিলে আমার এই সম্পদটুকুও যে হাতছাড়া হয়ে যেত রে। নে, নে এই যে আরও ক’টা টাকা রাখ পকেটে। বউ-বাচ্চারে কিনে দিস কিছু, ও… তুই তো আবার বিয়ে-টিয়ে করতে পারিস নাই এখনও। সমস্যা নাই, সেটাও হয়ে যাবে। তোর কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ হয়েই রইলাম। তোর বুদ্ধিশুদ্ধি আর গোয়েন্দাগিরির কাছে যে গোয়েবলসও হার মানবে হে যোগেন বাবু। হা হা হা।
যোগেন্দ্র : আজ্ঞে, ছোট কর্তা সবই আপনার দয়া। ওই কঞ্জুস মনীন্দ্র লাল চৌধুরী যে এত তাড়াতাড়ি নরম হয়ে যাবে সেটা দেখেই তো আমি অবাক। তারপরও বলতে হয় আপনার ঠগ হয়েছে বাবু।
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : ঠগ হয়েছে মানে? এত বড় বাগানবাড়ি পেলাম বিনে পয়সায়, আর তুই কিনা বলিস ঠগ হয়েছে!
যোগেন : ঠগ না তো কী ছাই, ওই গেলাশ কাছে থাকলে আপনি নিজেই তো প্রতি সেকেন্ডে এমন হাজারটা বাগানবাড়ি বানাতে পারতেন। আপনি কি মনে করেন আপনার কঞ্জুস ভাই কোনো লাভের হিস্যা না করেই এত তাড়াতাড়ি বাগানবাড়ি লিখে দিতে রাজি হয়ে গেল? এবার দেখুন না ওই গেলাশের জাদুতে আপনার ফলফলাদি হওয়া বন্ধ হয়ে যায় কিনা। ওই বেটা পারে না এমন কোনো কাজ নাই বাবু। আমি দিব্যি কেটে বলতে পারি লাভ ছাড়া বাগানের একটা কণাও আপনাকে দেবে না সে। আপনি মনে করছেন আপনার ভাই বোকা, কিন্তু মোটেও না। বরং আপনি অল্পতে তার চোখের পানির অভিনয় দেখে গলে গিয়ে বোকামি করছেন। তাছাড়া আপনি আরও কিছু চাইলে সমস্যা ছিল কোথায়, এ্যাঁ?
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : এটা তো ভেবে দেখি নাই রে যোগেন। তুই তো ঠিকই বলেছিস। আসলে অগ্রজের চোখের পানি দেখে কেমন যেন বিব্রত হয়ে গিয়েছিলাম। দাদাকে কখনো এভাবে কাঁদতে দেখিনি তো। শত হলেও তো বড়দা। তাই কিছু চাইতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ বাগানবাড়িটার কথা মনে পড়ে গেল। আর টুক করে চেয়ে বসলাম। পেয়েও গেলাম, হা হা হা।
যোগেন : পেয়েছেন বটে ঝুটা। আরে এত বড় সুযোগ কি কেউ মিস করে!
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : যাক যোগেন, তারপরও তো পেলাম। কিন্তু সমস্যা হল আমি বলেছি যে, গেলাশের ওপর আমার কোনো দাবি রাখব না আর এটা বোধহয় ঠিক হয় নাই। এখন কী করা যায় বল তো।
যোগেন : ওটা দ্রুত হাতিয়ে নেওয়ার বুদ্ধি বের করতে হবে। তার আগে ওই কঞ্জুস চৌধুরীর কিছু পয়সা না খসালে বেটার উচিত শিক্ষা হবে না। বেটা বড়ই বেড়ে গেছে। ঠগবাজিতে বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলেছে। বেটার শাস্তি হওয়া দরকার।
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : কীভাবে?
যোগেন : আমি থাকতে সে চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। এলাকার লোকজনকে দিয়ে দেখুন না কীভাবে তার পয়সা খসানোর ধান্ধা বের করে দিই। হা হা হা।
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : সে তুই যা করার কর ভাই। আমি ওই জাদুর গেলাশ হাতে পেলেই হল। [হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে] আমার জরুরি একটা কাজ আছে রে। আমি বরং সেদিকেই যাই।
[রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী প্রস্থান]
[রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী চলে যাবে; মঞ্চের আলো ক্ষীণ হয়ে যোগেনের উপর পড়বে। যোগেন চারদিকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে ভয়ঙ্কর একটা ভৎর্সনার হাসি দেবে। আর বিজয়ের আনন্দে বলে ওঠবে— চৌধুরী সাম্রাজ্যের অবসান তাহলে ঘনিয়ে এল, হে হে হে।]
সপ্তম দৃশ্য
[দুপুরের শেষভাগে। বারান্দায় বসে থাকবে মনীন্দ্র লাল চৌধুরী। পেছনে দাঁড়িয়ে তার মাথার উপর থেকে পাকা পাকা চুল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলবে মোহন। মোহনকে বারকয়েক সামনে এসে বসার জন্য বলা হলেও সে আমতা আমতা করবে। মোহন ওজর দেখিয়ে কর্তার সামনে বসার দুঃসাহস থেকে বিরত থাকবে।]
মোহন : কর্তাবাবু, আমি তো জানি আপনার নুন আনতে পান্তা ফুরায়, জমানো টাকাও প্রায় শেষের পথে। উত্তরের বাগানবাড়ি থেকে কিছু ফলফলাদির যে আয় আসত তাও এখন অন্যের দখলে। কোনো লভ্যাংশও পাবেন না আপনি। অথচ আপনার কনিষ্ঠ ভ্রাতা এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা এলাকায় ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে আপনি নাকি অনেক টাকার মালিক। ওই খাঁচাবন্দি গেলাশ নাকি আপনাকে রাতারাতি ধনি বানিয়ে দিয়েছে। ছি! ছি! মানুষ এতটা নীচে নামে কীভাবে।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : আমি সবই জানি রে মোহন, লোকে যা বলে বলুক। লোকে কেবল বলতেই পারে, উপকারে আসতে পারে না। ওসব নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কেউ আমাকে ধনী ভেবে যদি আনন্দ পায় তাহলে সমস্যা কোথায়। আর, ভগবান কী আমারে কম দিছে নাকি?
মোহন : এটা আনন্দের কথা নয় কর্তাবাবু, মিথ্যাচার। মিথ্যা জিনিস মানুষকে খুব সহজে বিপদে ফেলে দেয়।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : মিথ্যে মানুষকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়, তবে সে আনন্দের স্থায়িত্ব নেই। থাকুক মোহন, আমার কী আছে, কী নেই তা তো তুই আর আমিই ভালো জানি, লোকের কথায় কীইবা আসে যায়। মানুষের ঈর্ষার প্রভাবে কারো সম্পদ বাড়েও না, কমেও না; তবে ঈর্ষাকাতর মানুষের দুঃখ কিন্তু সর্বদাই বেড়েই চলে অন্যের উত্থানে— এটাও কিন্তু এক ধরনের শাস্তি, প্রাকৃতিক প্রতিদান। [দূর থেকে একটা বাজনার আওয়াজ ভেসে আসবে। দুজনের কথায় ছেদ পড়বে।] কীসের যেন একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে রে মোহন। কোনো হট্টগোল লাগল না তো? আজকালকার মানুষের মন থেকে তো ঈশ্বর পালাতে শুরু করেছে। দেখ তো ওদিকটায় কী হল হঠাৎ।
মোহন : [একটু এগোয় এবং হাত উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করে। তারপর ফেরত আসে] আওয়াজটা ঠিক ঠাহর করতে পারছি না বাবু। তবে ওরা বোধহয় এদিকেই আসছে।
[এলাকার কজন মান্যগণ্য লোক নিয়ে ধর্মীয় পোশাক পরে কজন পুরোহিত গোছের লোক প্রবেশ করবে। মা দুর্গার ভক্তি পাঠ করে মনীন্দ্র লাল চৌধুরীর সামনে এসে হাজির হবে। সবাইকে দেখে খুশি মনে নিজের ঘরে নিয়ে বসাবে এবং প্রাথমিক কুশলাদি পর্ব শেষ হবে]
দলপ্রধান : কী অবস্থা চৌধুরী সাহেব! দুর্গাপুজো যে ঘনিয়ে এল। তাই এলুম। মা দুর্গা তো এবার হস্তিতে চড়ে আসবেন। [কপালের কাছে দু’হাত উচিয়ে] দুগ্গা দুগ্গা দুগ্গা। আপনি তো প্রত্যেক বছরই কম-বেশি দেন। এবার কিন্তু বেশি কিছু চাইব না, শুধু মায়ের ঘরটা সাজিয়ে দিলেই হবে। ওতে হাজার তিরিশেক টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়। আর যদি বাড়িয়ে দিতে পারেন তাহলে তো ভালোই হয়। মা তো আর বার মাস আসবেন না। বছরে একবারই কেবল পায়ের ধুলো দিয়ে যান সন্তানদের কাছে, আপদ বিদেয় করে আবার কৈলাসমুখী হন। দুগ্গা দুগ্গা দুগ্গা।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : [চমকে ওঠে] তিরিশ হাজার টাকা! না না বাপু। আমি অত টাকা কোথায় পাব। আমি বরং আগে পরে যা দিয়েছি তাই দেব।
দলপ্রধান : কী যে বলেন কর্তাবাবু, ছে ছে ছে, এসব বলে আর লজ্জা দেবেন না যে, আমরা কিন্তু আপনার নাম খাতায় এন্ট্রি করে ফেলেছি। এখন শুধু জানাতে এলুম, এই যা। আপনি আর না করবে না বাবু, মা চোখ তুলে তাকালে তিরিশ হাজার কেন তিরিশ লক্ষ টাকা দেওয়ারও যে সাধ্যি আছে আপনার… হে হে হে।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : আমার সাধ্যে যা কুলায় দেব। আপাতত ধার্য করার দরকার নাই। সত্যি সত্যিই আমার অর্থনৈতিক অবস্থা আজকাল ভালো যাচ্ছে না। এবার আমি দিতে পারি কি না সেটাও তো জানি না।
[এরই মধ্যে ঝুলন্ত খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেবে দলের এক পুরোহিত গোছের ব্যক্তি। বসা থেকে উঠে গিয়ে ওটার কাছে দাঁড়াবে। দলপ্রধানের দিকে ইঙ্গিত দিলে সেও উঠে যাবে।]
দলপ্রধান : বাহ! বাহ! কী সুন্দর গেলাশ গো। যেন খাঁচায় একখান পাখখি! যাক বাবু টাকা যেহেতু দিতে পারবেন না তাহলে এই সুন্দর গেলাশ-খাঁচাটাই বরং মায়ের ঘর সাজাতে দিয়ে দিন। এতেই মায়ের ঘর যে আরও বেশি আলোকিত হয়ে উঠবে। এবার কিন্তু না করতে পারবেন না কর্তা মশাই। [কথাটা বলেই খাঁচাটা নামিয়ে নিতে উদ্যত হয়।]
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : [বিস্মিত ও বিচলিত হয়ে ছুটে যায়] না, না। ওটা কেউ ধরবেন না। ওটাই যে আমার একমাত্র সম্বল। ওটা ছাড়া আপনারা যে যা চাইবেন তাই দেব আমি। ওটা ধরবেন না প্লিজ…। ঠিক আছে আমি যেভাবে পারি তিরিশ হাজার টাকা জোগাড় করে দুদিনের মধ্যে পাঠিয়ে দেব। তারপরও ওটার দিকে কেউ হাত বাড়াবেন না, আমার কষ্ট লাগে।
[যথার্থ দাওয়াই কাজে লাগায় পূজা উদযাপন কমিটির সদস্যরা নমস্কার দিয়ে বিদায় নেবে। যাওয়ার সময় খাঁচাটির দিকে মুখ বাঁকিয়ে তাকালেও কর্তার প্রশংসা করতে তারা ভুলবে না। পূজা উদযাপন কমিটির প্রস্থান। মনীন্দ্র লাল চৌধুরী নিঃশব্দে গ্লাসটির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। প্রণতি জানিয়ে খাঁচাটি জড়িয়ে ধরবে। একটু চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কিছুকাল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকবে। ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে করুণ সুরে বেজে ‘ইয়ে বন্ধন তো পেয়ার কা বন্ধন হে, জম্ম কা সাঙ্গাম হে’ জনপ্রিয় হিন্দি গানের প্রথম অংশটুকু। নিঃশব্দে মোহন এসে তার পেছনে দাঁড়াবে।]
মোহন : কর্তাবাবু, পাড়ার কিছু তরুণ-যুবক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। কী কথা নাকি বলবে ওরা। অনুমতি দিলে ভেতরে আসতে বলি।
[চোখ মুছতে মুছতে মনীন্দ্র লাল চৌধুরী অনুমতি দেবে এবং মোহন এগিয়ে যাবে কিছু সময়ের মধ্যে কয়েকজন তরুণসহ প্রবেশ করবে]
তরুণদের দল : নমস্কার আঙ্কেল।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : নমস্কার।
[উভয় পক্ষের সামান্য কুশল বিনিময় হয়। মনীন্দ্র লাল চৌধুরী কথা বলতে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করবে]
তরুণ প্রতিনিধি : আঙ্কেল, আমরা এলাকার যুবসমাজ একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছি— ফ্রিজ কাপ। অনেক খরচপাতির বিষয় তো তাই আপনার কাছে ছুটে এলাম। সবাই বলে আপনার দুয়ারে এসে কেউ খালি হাতে ফেরত যায় না। বেশি না, আপনি শুধু ফ্রিজ কেনার টাকাটা দিলেই হবে। মাত্র পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হাজার টাকা দিলেই হয়ে যাবে। সমস্যা নাই, আমরা আপনাকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি রাখব।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : [হতবুদ্ধি, আগে-পরে কখনো এমন আব্দার তার কাছে আসেনি।] কী বলো তোমরা বাপু! আমি এত টাকা কোথায় পাব। তারচে ভালো তোমরা মেয়র সাহেবের কাছে যাও। উনি একটা না একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। অতিথি না করলেও আমার ক্ষমতা থাকলে তোমাদের দিতাম কিন্তু এই মুহূর্তে এক টাকা দেওয়ার ক্ষমতাও আমার যে নাই রে বাবারা।
তরুণ প্রতিনিধি : কী যে বলেন আঙ্কেল। আপনার কী সাধ্য আছে সেটা অত্র এলাকার সবাই ভালো করেই জানে। তাছাড়া মেয়র সাহেব নিজেই তো আপনার নাম প্রস্তাব করলেন। ঠিক আছে পাঁচ হাজার টাকা কম দিয়েন। সেটা আমরা অন্য কোথাও গিয়ে ম্যানেজ করে নেব। আপনি তিরিশ হাজার দিলেই হবে। আমরা কাগজে আপনার নাম টুকে রাখলাম।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : না না ওসব তোমাদের ভুল ধারণা। আমার অত টাকা দেওয়ার সাধ্য নেই। তোমরা আসতে পারো।
[টাকা বাগানোর পথ রুদ্ধ নিশ্চিত জেনে মোক্ষম চাল খেলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখল তরুণরা। কথার ফাঁকেই একজনের নজর যায় খাঁচাবন্দি গ্লাসের দিকে। সে দাঁতে দাঁত ঘষে এবং হাতে মৃদু তুড়ি মেরে বলবে— শালা, এবার তোর কিপ্টামির বারটা বাজাচ্ছি দেখ। সে খাঁচাটির দিকে এগিয়ে যাবে]
তরুণ ক্রিকেটার : ও-মা! ীসুন্দর খাঁচা রে বাবা! মানুষ নয়, পশুপাখি নয় আস্ত একটা গেলাশ কী সুন্দর করে পোষ মানিয়ে রাখা হয়েছে! আপনার ফ্রিজ-ট্রিজ কিংবা টাকাপয়সা কিছুই লাগবে না, আঙ্কেল। আপনি বরং এই বন্দি গেলাশের খাঁচাটাই আমাদের দিয়ে দিন। এতেই আমাদের চলবে। এটাই আমরা বিজয়ী দলকে ট্রফি হিসেবে দিয়ে দেব। [খাঁচাটা নামাতে ব্যস্ত হয়ে উঠবে তরুণ ক্রিকেটার]
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : [কেঁপে ওঠবে। বাজপাখির মতো ছুটে যাবে।] না, না। এটা ধরবে না। খবরদার, হাত দেবে না এখানে। এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু। এটা ছাড়া অন্য যা কিছু চাও পাবে তোমরা। আচ্ছা, ঠিক আছে তোমরা যা চাও আমি তাই দেব। ডাকাতি করে হলেও পুরো পঁয়ত্রিশ হাজার টাকাই তোমাদের দেব। তারপরও ওটার দিকে হাত দিও না কেউ। এক সপ্তাহের মধ্যে তোমরা টাকা পেয়ে যাবে। এবার আসতে পারো, যাও তোমরা; পরে এসে নিয়ে যেও টাকা।
[তরুণদল প্রস্থান করবে নমস্কার দিয়ে। যাওয়ার সময় প্রশংসাও করবে। মনীন্দ্র লাল চৌধুরী ওসব কানেও মাখবে না। বুকটা চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো ভাব নিয়ে বসে পড়বে। মোহন পেছন থেকে এসে সান্ত্বনা দেবে। সকরুণ সুরে বাদ্য বেজে ওঠবে। মঞ্চের বাতি ধীরে ধীরে নিভে আসবে। প্রস্থান]
অষ্টম দৃশ্য
[বৈকালিক চা-পানের আসরে দেখা যাবে রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী ও যোগেনকে। ভৃত্য হলেও ইদানীং তার কদর বেড়েছে। আজকাল সে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে শুরু করেছে। বুদ্ধির জোর থাকায় রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী তাকে বেশ লাই দিতেও শুরু করেছে। সুতরাং একই টেবিলে বসে দুজন চা-সিগ্রেট পানের বিষয়টি আজকাল স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ভৃত্য-মনিবের শব্দটির দূরত্ব বহু আগেই ঘুচে গেছে। যোগেনকে এখন চাকর ভাবতেও কিঞ্চিৎ ভ্রম হয় যেন।]
যোগেন : [কিছুটা সাহেবি ভাব নিয়ে, পায়ের ওপর পা উঠিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে] দেখলেন তো মশাই, কী খেলাটা দেখালুম। আপনার বজ্জাত ভাইকে কী চমৎকার শিক্ষা দিয়ে দিলুম? টাকা খসানোর কত চমৎকার পথ তৈরি করে দিলুম। হা হা হা। ওই কমজাতের বাচ্চা আপনাকে ঠগ দেবে, আর আমি কি ছেড়ে দেব ? এত বড় নেমকহারাম আমি নই বাবু…।
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : [চাকর যে আপন ভাইকে গালি দেয় বিষয়টা কানেই মাখে না। অর্থের ধান্ধায় অনেকটা অন্ধ সে।] সত্যি তোমার বুদ্ধির তুলনা হয় না, যোগেন। আমি তো অবাক, তুমি এত বুদ্ধি পেলে কোথায়?
যোগেন : [অহংকারে গ্রীবাদেশ ফুলিয়ে] সবই ঠাকুরের দান কর্তাবাবু, আপনার সেবায় স্বয়ং ঠাকুর আমাকে পাঠিয়েছেন যে…। তিনি চিন্তা করে দেখেছেন, আপনার মতো সৎ লোকের অধিকার আদায়ের জন্যে আমার মতো সৎ মানুষই দরকার। তাই তো পাঠিয়েছেন তিনি আমাকে। হে হে হে।
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : তুই থাকাতে বড্ড ভরসা পেলাম, যোগেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, মনীন্দ্র বাবুর টাকা খসিয়ে অন্যদের ধনী বানিয়ে কী লাভ আমাদের? আমরা তো কিছু পেলাম না তাতে। অন্যের পেট ভরিয়ে আমাদের কী লাভ? আমাদের পকেটের চিন্তা বের কর। সেটা বরং কাজে দেবে।
যোগেন : [একটু ভেবে হেসে ওঠে] পেয়েছি মশাই! যোগ্য দাওয়াই পেয়েছি। আপনার সুসময় আর বেশি দূরে নাই, অতীব নিকটে। আজই করতে হবে কাজটা। তবে সবকিছু করতে হবে গোপনে।
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : কী পেয়েছিস? সেটা বল আগে। তারপর না হয়…।
[যোগেন কিছু একটা ভনিতা করে। রাজেন্দ্র বুঝতে পারে। পকেট হাতড়ে বের করে দেয় কিছু টাকা]
যোগেন : তাহলে আসেন বিষয়টা নিয়ে কানে কানে আলাপ করা যায়। দেয়ালেরও যে কান আছে বাবু, আমি নিজেই তো আমারে বিশ্বাস করি না, তাই এসব আলাপে কোনো সাক্ষী রাখতে নেই গো বাবুজি।
[রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী তার কান পেতে দেয় যোগেন দিকে, চাকরের দেয়াল টপকিয়ে যোগেন বাল্যবন্ধুর মতো চুপিসারে তার কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বলতে থাকবে। বলা শেষ হলে দুজনেই সজোরে হেসে উঠবে এবং বন্ধুসুলভ আচরণে পরস্পর হাতে হাতে তুবড়ি মেরে সমবেত সুরে গেয়ে উঠবে— ‘তো চিজ বাড়ি হে মাস্তি মাস্তি তো চিজ বাড়ি হে মাস্তি।’ মঞ্চের বাতি নিভে আসবে। প্রস্থান]
নবম দৃশ্য
[অন্ধকারময় মঞ্চে রাতের একটা দৃশ্যপট তৈরি হবে। এক কোণে খাটে ঘুমিয়ে থাকবে মনীন্দ্র লাল চৌধুরী, রাতের গভীরতা ধীরে ধীরে দীর্ঘ হবে। অল্প সময়ের মধ্যে দীঘল দুটি ছায়া অত্যন্ত সর্ন্তপণে এসে আবার শূন্যে মিলিয়ে যাবে। রাতের গভীরতা বাড়লে সে স্বপ্ন দেখবে, সাদা শাড়ি পরা এক বিধবা নারী এসে তাকে ডাকছে— ‘বাবা মনীন্দ্র, তোর ঘরটা এত অন্ধকার কেন রে বাবা, তোর ঘরে কি আলো জ্বলবে না আর…।’ এতটুকু দেখার পর ঘুম ভেঙে যাবে। মা, মাগো— বলে চিৎকার দিয়ে ওঠবে। প্রায় তিরিশ বছর পর এই প্রথম তার মা স্বপ্ন যোগে এসেছে। ঘরের বাতি জ্বালিয়ে তাকিয়ে দেখে খাঁচাবন্দি গ্লাসটি নাই! মনীন্দ্র লাল চৌধুরী চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করবে এবং অবুঝ শিশুর মতো কান্নাকাটি জুড়ে বসবে। ঘুম জড়ানো চোখে পাশের ঘর থেকে ছুটে আসে মোহন।]
মোহন : বড় কর্তা কী হয়েছে! কী হয়েছে কর্তাবাবু?
[মনীন্দ্র লাল চৌধুরী পাগলের মতো ঘরময় এদিক ওদিক ছোটাছুটি করবে, হন্যে হয়ে কিছু একটা খুঁজে বেড়াবে। অবাক হবে মোহন।]
মোহন : কর্তা মশাই কী হয়েছে, কী হারিয়েছেন। আমাকে বলেন। আমিও খুঁজে দেখি।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : ওরে মোহন, আমার খাঁচা আর গেলাশ কোথায় গেল রে, কে যেন চুরি করে নিয়ে গেছে রে মোহন।
[অবোধ ছেলের মতো কেঁদে উঠবে। কর্তাকে ক্রন্দনরত দেখে ভেতরটা তার মুষড়ে যাবে]
মোহন : চিন্তা করবেন না কর্তা মশাই। আপনার খাঁচা-গেলাশ ঠিকঠিক পেয়ে যাবেন। যেভাবেই হোক আমি খুঁজে বের করব। জীবন দিয়ে হলেও খুঁজে আনবই আমি। আপনি কাঁদবেন না বাবু। আমার কষ্ট লাগে।
[পুরো বাড়িতে তুমুল একটা অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এ-ঘর ও-ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজাখুঁজি চলে। কোথাও মেলে না মনীন্দ্র বাবুর প্রিয়ধন খাঁচাবন্দি গ্লাস। পাগলের হয়ে যায় মনীন্দ্র বাবু, চিলচিৎকার শুরু করে]
মোহন : [কিছুটা চিন্তাকুল হয়ে] আপনি চিন্তা করবেন না কর্তাবাবু, আমি নিজে খুঁজে বের করে আনব আপনার গেলাশ। আপনি অপেক্ষা করেন…
[মোহনের প্রস্থান এবং করুণ একটা সুরের আবহ সৃষ্টি হবে, আলো নিভে আসবে। প্রস্থান]
দশম দৃশ্য
[ভোরের আলোকরশ্মি ভেসে ওঠবে। পর্দায় পড়বে রক্তিম সূর্যের আভা। পাখপাখালির হৈচৈ শোনা যাবে। আঙিনায় মনমরা অবস্থায়, বিধ্বস্ত মুখে হাত-পা গুটিয়ে মাথা কাত করে বসে থাকবে মনীন্দ্র লাল চৌধুরী। কান্নার ভারে একটু পরপর কেঁপে কেঁপে উঠবে সে। পরাজিত সৈনিকের মতো লজ্জামাখা মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে মঞ্চে ঢুকবে মোহন। বেদনায় আনত হয়ে যাবে সে। মোহনের উপস্থিতি টের পেয়ে মাথা উঁচিয়ে দেখবে মনীন্দ্র লাল চৌধুরী]
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : [দীর্ঘশ্বাস টেনে। কাতরকণ্ঠে] খুঁজে পেলি না, তাই না মোহন?
মোহন : [মাথা চুলকাবে এবং আমতা আমতা করে বোকার মতো হাসার চেষ্টা করবে] না, কোনো সমস্যা নাই কর্তাবাবু। আমি ঠিকঠিক খুঁজে বের করব। আপনি কোনো চিন্তা করবেন। অযথা কষ্ট পাবেন না মশাই। আজকের দিনের মধ্যে আমি আপনার খাঁচা আর গেলাশ খুঁজে আনবই আনব।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : তুই আর ওটা খুঁজিস না রে মোহন, তোরে মেরে ফেলবে ওরা। লোভ মানুষকে অন্ধ করে ফেলে। ফলে, খুন করারও স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়। আমি বুঝতে পেরেছি, এ কাজ কে করেছে। তুই ঘরে যা, খোঁজাখুঁজির দরকার নাই আর। [ফুঁপিয়ে ওঠবে।]
মোহন : [ছুটে গিয়ে মনীন্দ্র লাল চৌধুরীকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে মোহন] কর্তাবাবু, দোহাই লাগে আর কাঁদবেন না। আপনি কাঁদলে আমার বুক ফেটে যায়। জন্মের পর যে মানুষটার ছায়ায় বড় হয়েছি, তার চোখের জল দেখার আগে আমার মৃত্যু হল না কেন। চলেন, আপনার ঘরে চলেন। নাস্তার সময় হয়ে এল যে [কর্তার গায়ে হাত দিয়ে তাকে তুলতে গিয়ে সে চমকে উঠবে।] ইশ! আপনার সারা গায়ে যে ভীষণ জ্বর, হায় ভগবান, এখন কী যে করি… [বিচলিত হয়ে উঠবে মোহন]
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : [হাত ইশারা করে বিচলিত হতে বারণ করে ভাঙা ভাঙা স্বরে ডাক দেবে] মোহন?
মোহন : জি কর্তাবাবু।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : [কাতরস্বরে] শরীরটা ভালো লাগছে না রে, মোহন। আমাকে একটু জড়িয়ে ধর তো। খুব শীত লাগছে রে।
মোহন : [হন্তদন্ত হয়ে কর্তাকে জড়িয়ে ধরে] কিচ্ছু হবে না কর্তাবাবু, আমি তো আছি। সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি ঘরে চলেন।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : না রে… ও ঘরে আমি আর যাব না, শূন্য ঘরে গিয়ে কী করব বল। যেখানে আমার আত্মা নাই, সেখানে আমি কীভাবে যাই বল?
মোহন : কর্তাবাবু শান্ত হোন। সব ঠিক হয়ে যাবে।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : মোহন!
মোহন : জি কর্তাবাবু।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : তুই না একদিন জানতে চেয়েছিলি ওই গেলাশটা আমি এত আদর-যত্ন করে পাখির মতো কেন পুষি?
মোহন : জি বাবু, থাক, আর শুনতে চাই না। ওটা তো আপনার ব্যক্তিগত জিনিস।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : তোকে যে আজ শুনতেই হবে রে মোহন। শোনা বড় প্রয়োজন।
মোহন : সে আপনার ইচ্ছে বাবু।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : আচ্ছা মোহন, মানুষ আমার এই গেলাশ নিয়ে কী কী বলে রে…?
মোহন : সে অনেক কথা বাবু, আপনার ছোটভাই তো আরও বেশি বলে। চামচাটা তাকে বেশি পুশিং দেয়। বড়ই বজ্জাত।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : অনেক কথা! আমাকে বলবি না?
মোহন : থাক না বাবু, আপনি কষ্ট পাবেন। কী লাভ এসব শুনে।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : মানুষ বলে, এই গেলাশ দিয়ে আমি জাদুটোনা করি, লক্ষ লক্ষ টাকা কামাই-রোজগার করি, ইত্যাদি ইত্যাদি— এই তো বলে, তাই না?
মোহন : জি বাবু।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : আচ্ছা মোহন, তোর কাছে কী মনে হয়। আমি কি আসলেই এসব করি?
মোহন : না বাবু, আমার তো মনে হয় এই গেলাশ আপনাকে আরও নিঃস্ব করে দিয়েছে। আপনাকে পথে বসানোর জোগাড় করেছে এ গেলাশ। অযথা একটা গেলাশের মায়ায় আপনি দিনদুনিয়া ছেড়ে দিয়েছেন। জীবনে সংসারও পাতেননি। আপনি তো নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন বাবু।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : কেন গেলাশটা এত ভালোবাসি শুনবি?
[খকখক করে কাশি এবং শরীরে কাঁপুনি উঠবে]
মোহন : [কর্তাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে মোহন।] আপনি বললে শুনব, না বললে শুনব না বাবু।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : শোন তাহলে, কলেজ জীবনে মুসলিম এক তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক হয় আমার। বড্ড টান ছিল ওর দিকে— নাম ফাতেমা জান্নাত। কী সুন্দর ফুটফুটে চেহারা। পৃথিবীর সমস্ত মায়া যেন তার মুখে ঢেলে দিয়েছেন ঈশ্বর। [কাশি এবং কাতরস্বরে এক মনে বলে যাবে মনীন্দ্র লাল চৌধুরী] মেয়েটা সীমাহীন পাগল ছিল আমার জন্যে। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক কেউ মেনে নেয়নি। না তার পরিবার, না আমার পরিবার। মা ছিলেন ঘরের অভিভাবক। মাকে কিছুতেই মানাতে পারলাম না। আমি নাকি নরকে জ্বলার কাজ করেছি। সমাজে নাকি মুখ দেখাতে পারবেন না মুসলমান মেয়ে ঘরে আনলে। ফাতেমার পরিবার জোর করে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় অন্যখানে। বিয়ের রাতেই সে বিষ খায়! [ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠবে মনীন্দ্র লাল চৌধুরী। মোহন তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করবে] আমার ফাতেমা মরে গেল! মরে গেল আমার ফাতেমা জান্নাত! [আবারও বিলাপ করে ওঠে। মোহন সান্ত্বনা দেয়]।
মায়ের সাথে, সমাজের সাথে রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই আমি। আর যোগাযোগ রাখিনি। চাপাকষ্ট নিয়ে দূরে গিয়ে পড়ে থাকি, বাড়ি আসি না। মা খবরের পর খবর পাঠায়। এক নজর দেখতে চায় আমাকে। কানেও মাখি না। একদিন শুনি মা খুব অসুস্থ। আরেকদিন শুনি মায়ের অবস্থা খুব খারাপ, আমি আসি না। কিন্তু একরাতে স্বপ্নে দেখি, মা খুব অসুস্থ। আমার নাম ধরে কেবল ডাকেন আর কাঁদেন। আমার রাগ ভেঙে যায়। মায়ের কাছে ছুটে আসি। এসে দেখি মা বিছানায় মুমূর্ষ অবস্থায় পড়ে আছেন। কেউ নাই পাশে। আমাকে দেখে উঠে বসতে চাইলেন, পারলেন না। কাছে ছুটে গেলাম ‘মা, মা গো, আমি আসছি মা।’ বলে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বললেন— জল, বাবা জল, জল খাব বাবা…।
গেলাশ ভরে জল আনলাম। মা জল মুখে দিলেন আর চিরতরে ঘুমিয়ে পড়লেন। আর জাগলেন না। আমার হাতের এক গেলাশ জল খেয়েই মরে গেলেন মা আমার! নাই হয়ে গেলেন মা আমার! [আর্তনাদ করে উঠবে মনীন্দ্র]।
ওটা, ওটা সেই গেলাশ রে মোহন, যেই গেলাশে করে মৃত্যুকালে জল খেয়েছেন আমার মা। ওই গেলাশই এতদিন খাঁচায় বন্দি করে রেখেছি রে মোহন। [আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠবে]
সেদিন নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়েছিল, মনে হল আমি নিজেই মাকে হত্যা করেছি। আমার এই হাত দিয়েই মাকে খুন করেছি! শুধু আমার কারণে, শুধু আমার দেওয়া কষ্টে মা মরে গেলেন! মায়ের কাছে ক্ষমাটুকু চাওয়ার সুযোগও দিলো না ভগবান। ভেবেছিলাম, মায়ের হাতের শেষ স্পর্শ পাওয়া গেলাশের সেবাযত্ন করে নিজেকে শুদ্ধ করব। মায়ের হৃৎপিণ্ড মনে করে দিনরাত বুকে আগলে রাখব গেলাশটি। মায়ের কাছে ক্ষমা চাইব চুপিচুপি গেলাশের মাধ্যমে। ওরা, ওরা আমাকে সে সুযোগ দিল না রে মোহন। আমি নাকি জাদুকর, আমি নাকি গেলাশ দিয়ে ধোঁকাবাজি করি, আমি নাকি গেলাশ দিয়ে কোটি কোটি টাকা কামাই-রোজগার করি রে মোহন!
[সজোরে কেঁদে উঠবে মনীন্দ্র লাল চৌধুরী। বিমূঢ় হয়ে যায় মোহন। কর্তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাবে না। শুধু কর্তাকে জড়িয়ে ধরে হতভম্ভ হয়ে চেয়ে থাকবে।]
মোহন : কর্তাবাবু আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে। চলেন ঘরে চলেন।
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : না রে মোহন, যে ঘরে আমার মা নাই, সে ঘরে আর ঢুকব না আমি। বড্ড শীত শীত লাগে। আমাকে আরেকটু জোরে জড়িয়ে ধর তো মোহন। জীবনে তোকে কিছুই দিতে পারিনি রে, আমাকে ক্ষমা করিস।
মোহন : [কান্নাজড়িত কণ্ঠে] কর্তাবাবু আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে…
[মঞ্চে নৃত্যশিল্পীর সাজে একটি মেয়ের প্রবেশ। ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে বেজে উঠবে নজরুল গীতি— ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে নাচিছে ঘূর্ণি বায়, জলতরঙ্গে ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ তুলে সে যায়…।’ গানের তালে তালে তরুণী মঞ্চের এ পাশ থেকে ওপাশে নেচে নেচে পার হব। মনীন্দ্র বিস্ময়ে চমকে উঠবে]
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : ফাতেমা, আমার ফাতেমা, মোহন আমার ফাতেমা আসছে, ওই তো আমার ফাতেমা জান্নাত, ওই তো…, ফাতেমা বেঁচে আছে! ফাতেমা মরে নাই রে মোহন। আমাকে ছেড়ে দে মোহন, ফাতেমা আমাকে ডাকছে। ছেড়ে দে আমাকে।
মোহন : [চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পাবে না।] কী বলেন বাবু। কই, কাউকেই তো দেখছি না এখানে। আপনি অনেক অসুস্থ বাবু, আমি আপনাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাই চলেন।
[মঞ্চে একজন মাঝ বয়েসী নারীর প্রবেশ। বিধবা পোশাক পরা। মনীন্দ্র লাল চৌধুরীর দিকে হাত দুটো মেলে মঞ্চের এপাশে থেকে ওপাশ ধীরে ধীরে ক্রস করে যেতে যেতে বলবে— ‘বাবা মনীন্দ্র, আয় বাবা, আয়, খেতে আয়, কতদিন মুখে কিছু দিসনি বাবা, আয় খেতে আয়।’ মনীন্দ্র চিৎকার দিয়ে ওঠবে।]
মনীন্দ্র লাল চৌধুরী : মা, মা গো, মোহন, ওরে মোহন, আমার মা এসেছে, ওই তো মা আমারে ডাকছে। আমাকে ছেড়ে দে মোহন আমি মার কাছে যাব।
[কান্না শুরু করে দেবে। দাঁড়িয়ে উঠার চেষ্টা করবে। মোহন জড়িয়ে ধরে রাখবে। উঠে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা থাকবে না। খকখক কাশি শুরু করবে]
মোহন : [আবারও চারপাশে তাকায়। কাউকে দেখতে পায় না।] কর্তাবাবু কী যে বলেন, আপনার মা আসবে কোত্থকে। আপনি ভুল দেখছেন, কেউ নেই এখানে। চলেন আপনাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাই।
[মঞ্চে ক্রমান্বয়ে দুই পাশে দুজন নারীর প্রবেশ ঘটবে। প্রথমে নৃত্যশিল্পীর সাজে নেচে ওঠবে তরুণী। তার দিকে আলো নিক্ষিপ্ত হবে। ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে পুনরায় বেজে উঠবে নজরুল গীতি— ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে নাচিছে ঘূর্ণি বায়, জলতরঙ্গে ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ তুলে সে যায়…।’ মনীন্দ্র লাল চৌধুরী চিৎকার করে উঠবে— মোহন আমার ফাতেমা আসছে, ওই তো আমার ফাতেমা জান্নাত, ওই তো…, ফাতেমা বেঁচে আছে! ফাতেমা মরে নাই রে মোহন। কী সুন্দর করে নাচ করছে সে, দেখ, দেখ…।
দৃশ্যটা সমাপ্ত হতে না হতেই অপর প্রান্তের বিধবা নারীর দিকে আলো নিক্ষিপ্ত হবে। সে দাঁড়ানো অবস্থায় মনীন্দ্র লাল চৌধুরীকে হাত বাড়িয়ে ডাকবে— ‘বাবা মনীন্দ্র, আয় বাবা আয়, খেতে আয়, কতদিন কিছু মুখে দিসনি বাবা, আয় খেতে আয়।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে মনীন্দ্র লাল চৌধুরী বলে উঠবে— ‘দেখ, দেখ মোহন, ওই তো আমার মা আমাকে ডাকছে, আমাকে ছেড়ে দে মোহন। আমি মার কাছে যাব। আমি মার কাছে…’ আর্তনাদ করতে করতে হঠাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। তার দেহের স্পন্দন থেমে যাবে। মোহন ‘কর্তাবাবু’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠবে। মঞ্চের আলো নিভে আসা পর্যন্ত ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে সকরুণ সুরে বেজে উঠবে মিতালী মুখার্জীর গান— ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই, মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই, এই মানুষের ভিড়ে আমার সেই মানুষ নাই’]
একাদশ দৃশ্য
[মঞ্চে হাসতে হাসতে প্রবেশ করবে রাজেন্দ্র এবং যোগেন। তাদের হাতে খাঁচাবন্দি সোনালি রঙের গ্লাস। খুব উৎফুল্ল দেখাবে দুজনকে। আনন্দচিত্তে কৌতুকপ্রদ অঙ্গভঙ্গি করে লালন সঙ্গীতের প্যারোডি গাইবে তারা— ‘খাঁচার ভিতর অচিন গেলাশ, টাকা কেমনে আসে যায়।’
যোগেন : ছোটকর্তা, এবার আপনার নাগাল আর কে পায়? টাকা আর টাকা, টাকার সমুদ্দুরে ভেসে যাবেন আপনি। আহা কী শান্তি!
রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী : হে হে হে, সবই তোর বুদ্ধিরে যোগেন, তুই আমার বড্ড উপকার করলি। এই নে… [পকেট হাতড়ে কিছু টাকা বের করে যোগেনের দিকে বাড়িয়ে দিতে যাবে ঠিক এমন সময় মোহনের প্রবেশ। লম্বা একটি ধারাল কুড়াল হাতে। খিস্তি ঝেড়ে তাদের দিকে তেড়ে আসবে সে। কুড়াল দিয়ে আঘাত করার আগেই রাজেন্দ্র ও যোগেন দেখে ফেলবে এবং খাঁচা ও গ্লাস ফেলে দৌড়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাবে। মোহন খাঁচাটি পেয়ে এক লহমায় থেমে যাবে। ছোঁ মেরে মাটি থেকে তুলে নেবে এবং বুকে জড়িয়ে ‘বড় কর্তা’— বলে সজোরে কেঁদে উঠবে। স্বল্পসময়ের জন্যে বেজে উঠবে একটি করুণ সুর এবং মঞ্চের বাতি নিভে আসবে।]
দ্বাদশ দৃশ্য
[মঞ্চে মনীন্দ্র লাল চৌধুরীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন চলবে। তার মৃতদেহের ওপর দেখা যাবে তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় রত্নধন সেই খাঁচাবন্দি সোনালি রঙের গ্লাস। মোহন গিয়ে মুখাগ্নি করবে। মঞ্চে চিতার আগুন জ্বলে উঠবে। একপাশে বুকফাটা আর্তনাদে মূর্ছা যাবে মোহন। ব্যাকগ্রাউন্ডে থেকে বেজে উঠবে— ‘তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসবে।
রফিকুজ্জামান রণি : বর্তমান সময়ের সুপরিচিত কবি ও কথাসাহিত্যিক। খুব অল্প বয়সে দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখে লেখক হিসেবে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন। তার একাডেমিক নাম—মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। পিতা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান খোকা, মাতা লাভলী জামান। জন্ম ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ; চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায়, দোঘর গ্রামে। তিনি চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করে কুমিল্লা বঙ্গবন্ধু ল’ কলেজ থেকে আইনবিষয়ক ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। যুক্ত আছেন একাধিক ছোটকাগজ প্রকাশনার সঙ্গেও।
কবি, কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার রফিকুজ্জামান রণি স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন: জেমকন তরুণ কবিতা পুরস্কার, ২০১৯; চাঁদপুর জেলা প্রশাসক পুরস্কার, ২০১৮; ‘এবং মানুষ তরুণ লেখক পুরস্কার, ২০১৯; দেশ পাবলিকেশন্স পাণ্ডুলিপি পুরস্কার, ২০১৮; নাগরিক বার্তা লেখক সম্মাননা, ২০১৯; চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার, ২০১৪; স্বরচিত কবিতাপাঠে জেলা শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, ২০১৬; জাতীয় সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা, ২০১৪; দৈনিক চাঁদপুরকণ্ঠের বিশেষ সম্মাননা, ২০১৫; ছায়াবাণী লেখক সম্মাননা, ২০১৬; পাঠক সংবাদ লেখক সম্মাননা, ২০১৯, শপথ সম্মাননা, ২০১৯ এবং ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম পদক, ২০১৩-সহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা।
প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা চার : ‘দুই শহরের জানালা’ (ছোটগল্প), ধোঁয়াশার তামাটে রঙ’ (কবিতা), ‘চৈতি রাতের কাশফুল’ (গল্প) ও ‘মুঠো জীবনের কেরায়া’ (কবিতা)। গল্প-কবিতার পাশাপাশি লিখছেন নাটকও।