অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ১৯, ২০২৪
৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ১৯, ২০২৪
৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিশির আজম -
কবিতা কেন অসতী

আমি আদৌ নিশ্চিত নই, আমি যা লিখি তা কবিতা কি না। কেন না কবিতা বলতে ঠিক কি বোঝায় তা-ই আমি জানি না। অবশ্য আমার লেখা কবিতা হল কি না এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র দুর্ভাবনা আমার নেই।

‘কীভাবে কবিতা লেখা শুরু করলে?’— এই প্রশ্ন যখন কেউ আমাকে করেন আমি উত্তর দিতে পারিনে। সত্যিকার অর্থে, এ-বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই নেই। সৃজনশীল পড়াশোনা, চিন্তাচেতনা আমি যে পরিবেশ বড় হয়েছি সেখানে কখনো ছিল না। কীভাবে যেন ঊষাকৈশোরেই নজরুল ও সুকান্তের একাধিক কবিতার বই আমার হাতে এসেছিল। তখন থেকে আমার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল যা লিখব তা যেন নজরুলের মতো, সুকান্তের মতো হয়। জীবনানন্দ দাশ হাতে না আসা পর্যন্ত অনেক দিন ধরে এমন চলছিল।

সচেতনভাবে চেয়েছিলাম ছবি আঁকা শিখব। এ বাসনা থেকে কখনো বিচ্যুত হইনি। আমার কবিতা আসলে ছবিই, যতই আনাড়ি হাতে আঁকা হোক। রাজনীতি আমাকে এত বেশি টানে যে আমার কবিতাকে কবিতা না বলাই ভালো। আমার সমালোচকদের সঙ্গে আমি একমত। আমার কবিতা আসলে রাজনীতিই। বয়স যখন পনের পার হয়নি এরকম সময়ে অজানা এক মেয়ে আমার ভেতরে গেঁড়ে বসেছিল। তারপর দিনের পর দিন সে ছড়িয়ে পড়েছে আমার চারপাশের পরিবেশে, আমার পঠনপাঠনে, চেতনায়, আমার অনাবিষ্কৃত আকাশে। এসবই আমার কবিতা।

তবে রাষ্ট্র বা সমাজ যতটা মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নেয় কবি বা শিল্পী হয়তবা ততটাই পরিস্ফুট হন। এ কারণে দেখা যায় বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ে রুশরা যত প্রতিভাবান কবি বা লেখক পেয়েছেন বিপ্লব পরবর্তী সময়ে তার সংখ্যাটা যেন কম। আমাকে যে কবি বলা হয় এর অন্তর্নিহিত রহস্যটা বোধহয় এখানেই। যে সমাজ মধ্যযুগীয় চেতনা দ্বারা আষ্টেপৃষ্টে জড়িত, যে রাষ্ট্র জেনারেলদের অপরিসীম লোভের শিকার, যে রাষ্ট্র রাজনীতিবিদদের বেহায়াপনা আর ব্যবসায়ীদের নির্লজ্জ মুনাফাচক্রে নিষ্পেষিত, সে সমাজে বা রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষকেই কল্পনায় হয়ে উঠতে হয় ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ বা সামরিক আমলা যার সামগ্রিক রূপ হল ‘কবি’। (পাঠক এখানে ‘কবি’ না পড়ে ‘বিজ্ঞানী’ও পড়তে পারেন, অথবা ‘চলচ্চিত্রশিল্পী’ অথবা ‘ভাস্কর’ অথবা…)।

প্রতিকূল পরিবেশ আর ব্যক্তির অপরাধ আত্মহত্যায় যথাযোগ্য সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। এ হিসেবে বলা যায় আমার কবিতা আমার আত্মহত্যার সমকল্প প্রস্তাবনা। জীবনের বিভিন্ন পর্বে সচেতন অথবা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কত যে মারাত্মক অন্যায় করেছি, এ কি কেউ জানে? কেউ জানে না। কিন্তু নিজের কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়? উপায় কবিতা। উপায় গান। উপায় রাজনীতি। উপায় গণমানুষের ক্ষোভ আর আর্তনাদে নিজের সত্তা ডুবিয়ে দেওয়া।

মানব প্রজাতির অংশ হিসেবে হয় তো আমি সন্তুষ্ট। কিন্তু নৈতিকতায়, মননশীলতায়, বিজ্ঞান-চেতনায় নিজেকে পরিশীলিত করতে না পেরে আমি লজ্জিত। অন্যের শঠতার, যুক্তিহীনতার কথা আমি লিখি। বস্তুত তা আমারই কথা। নিজের অপরাধ স্বীকার করার মতো সাহস ও সততা কোনোটাই আমি পুরোপুরি অর্জন করতে পারিনি।

এই অস্বীকারই আমার কবিতা।

দার্শনিকের বিভ্রান্তি

শব্দ হল তরঙ্গ

মানুষ হল শব্দ

নক্ষত্র হল মানুষ

আগুন হল নক্ষত্র

আমরা কেউ কাউকে দেখিনি

কিন্তু কাউকে না কাউকে

দোষারোপ করতেই হয়

দার্শনিক কে? আমি? সমগ্র মানবজাতি? নিজের ভণ্ডামি অন্যদের উপর চালিয়ে দিতে বেশ কায়দা করেই আমি কথাগুলো সাজিয়েছি। একে যদি কেউ কবিতা বলেন তো আমি আপত্তি করব না। ইতিহাসে যে কেবল আমার মতো অপ্রস্তুত কেউ প্রথম এই কাজ করেছে তা নয়। রঁদা বালজাকের যে অশরীর মূর্তিটাকে অমন বেঢপ করে গড়ে তুলেছিলেন তা কি প্যারীর বোদ্ধাদের উপহাস করবার জন্য? নাকি এ কর্ম তার নিজেরই অনমনীয় শিল্প ব্যক্তিত্বকে এক হাত দেখে নেওয়া?

ক্ষুদে পৃথিবীর গান

মাঠের এক দিকে চায়ের ধোঁয়া অন্যদিকে প্রাচীন গুহাগাত্র

যা হোক দৃশ্যাবলি হতে যৌক্তিক উপস্থাপনার সমাহার

এবং কাব্যিক

বাঁশি ও মাদলে অস্বস্তির সুযোগ নেই

সংস্কারে এবং বড় কিছুর অর্জনে স্থিতিশীলতা অপরিহার্য

মঞ্চের স্থাপত্যসমূহ

প্রস্তুতি নেয় আত্মহত্যার

এটি হচ্ছে দেশে দেশে ছদ্ম-গণতন্ত্রধারীদের নিজেদের ধোয়া তুলসীপাতা প্রমাণ করর চিরকালীন কৌশল। বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র নিজের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে নৃতাত্ত্বিক চিহ্নগুলো ধ্বংস করে, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে করে কলুষিত। এর ধারাবাহিকতা আমরা দেখেছি। কিন্তু কবির নিজের ভেতরের ছোট ছোট প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানসমূহ?

দুই.

আমি কবি। প্রতিটা মানুষই কবি। কবিত্ব আছে বলেই মানুষ। কবিত্বই সত্তা। সত্তা না থাকার অর্থ মানুষ মৃত। দৈনন্দিন জীবনযাপনের ফাঁকফোকরে লুকিয়ে থাকা কবিত্বই মৃত্যু থেকে আমাদের আগলিয়ে রাখে। একারণে কবিতাকে কোনোভাবেই ঐশ্বরিক বলা যাবে না। কবিতা নিতান্তই মানবিক। একজন সাধারণ ব্যক্তি যদি তার অনুভূতিকে গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারেন তবে তা বিশেষ একটি কাজ বলে গণ্য হয়। আর যদি তা অন্যের অনুভূতিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় তা-ই হয়ে ওঠে কবিতা অর্থাৎ শিল্প। আমি চেষ্টা করছি আমার অনুভূতিকে গুছিয়ে উপস্থাপন করতে। দেখুন, হয়বতা কবিতাই!

ঝিঁঝিপোকা

ভোরের আলো ফুটবার আগমুহূর্ত পর্যন্ত ঝিঁঝিপোকা ডাক থামায়নি।

প্রবন্ধ লেখার আগে এটুকু অনুভব কর, ঐ সাধারণ পোকার কান্নার

উৎসমুখ কী। ডানা না হৃৎপিণ্ড।

এখানে ঝিঁঝিপোকা কি কোনো প্রতীক? অথবা প্রতিটি মানুষ কি হাজার হাজার ইঁদুরের মতো হ্যামিলনের বাঁশিওলার পেছনে ছুটে চলেছে? আমি যাকে ঝিঁঝিপোকা বলছি সে কি ঐ বাঁশিওয়ালা? অথবা এও তো হতে পারে যে জীবনযন্ত্রের নিচে চাপা পড়ে প্রতি মুহূর্তে মানুষ ঝিঁঝিপোকা নামক সত্তাকেই নির্মাণ করছে।

এটুকু ঠিক আছে। একজন সাধারণ মানুষ এভাবে চিন্তা করতে সক্ষম। কিন্তু ঐ ঝিঁঝিপোকার কান্নার উৎসমুখ থেকেই হয়তবা কবিতার সৃষ্টি।

শব্দ কি চিরন্তন কিছু? সাধারণ মানুষের মাথায় এই প্রশ্ন আসে না। আসে কবির মাথায়। আর স্বভাবতই এর বিপক্ষে অবস্থান নেন তিনি। সময় ও অবস্থানভেদে পরিবর্তিত হয় শব্দের অর্থ। এমনকি উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখীও হয়ে উঠতে পারে। সামাজিক জীবনে আমরা যে শব্দসমূহ ব্যবহার করি তা-ই কবি তুলে আনেন তার লেখায়। তবে একটু অন্যভাবে। এই অন্যভাবে যে কতরকমভাবে হতে পারে তা আমাদের ধারণার বাইরে। এমনকি একেবারে নতুন কোনো ধাঁচেও কবি তার বক্তব্যকে লেখায় হাজির করতে পারেন। যা পাঠককে ভাবতে বাধ্য করতে পারে। পাঠকের অনুভূতিতে প্রবল অনুরণন তুলতে পারে। পাঠকের মননের স্থায়ী চূড়াকে ধসিয়ে দিতে পারে।

রঙের বিচিত্র প্রকৃতি

সাদা কিছুটা কালো

কালো কিছুটা সবুজ

সবুজ কিছুটা নীল

নীল কিছুটা কমলা

তবে লালের ভিতর লালই সবচে লাল

এই কবিতায় কয়েকটি রঙের উল্লেখ রয়েছে যা আমাদের অতিপরিচিত। তবে প্রতিটি রঙের বিপরীত চরিত্রের কথাও কবি আমাদের জানিয়ে দেন। যা পাঠকের ভাবনায় এর পূর্বে আসেনি। একে তুলনার করা যায় নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে। দুপুরে একে মনে হবে ইলিশের পিঠ। সন্ধ্যায় ঘুঘুপাখির চোখের মতো। রাতে এটি এগিয়ে চলে কেউটে সাপের মতো এঁকেবেঁকে।

তবে লেখাটির শেষ লাইনে কবি শব্দগুলোকে এমনভাবে সাজান যা পাঠকের চোখে অভিনব বলে প্রতিভাত হতে পারে। অথচ শব্দগুলো খুবই পরিচিত। লাইনটিকে তুলনা করা যায় জলস্রোতের সঙ্গে। যা পাঠকের চিন্তা-চেতনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

একজন সাধারণ ব্যক্তির চোখে সাদা সাদা, কালো কালো। কিন্তু কবি এক রঙের ভেতর অন্য এক বা একাধিক রঙ দেখতে পান।

আবার একটি নির্দিষ্ট রং যে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যমূলক সত্তাই বহন করে তা নাও হতে পারে। কবিতাটির শেষ লাইনে তিনটি ‘লাল’ লাল রংটিকে পাঠকের চেতনার বিচিত্র স্তরে জারিত করে দিয়েছে। ফলে পাঠকের চিন্তাকাঠামো যে আর পূর্বের জায়গায় থাকবে না তা বলাই বাহুল্য।

বুদ্ধদের দাশগুপ্ত বিভিন্ন রং বা একই রং বিভিন্নভাবে সেলুলয়েডে যেভাবে সাজান, আবার একটি মাত্র রং কালো জয়নুল আবেদিন সাদার উপরে যেভাবে আঁচড়ে দেন, সেভাবেই কবি সাদা কাগজে শব্দ সাজান।

যা পাঠকের ভাবনার স্তরে কথনো মৃদৃ গুঞ্জন তোলে, কখনো সৃষ্টি করে প্রচণ্ড অভিঘাত। কবির চূড়ান্ত উদ্দেশ্যও তাই।

নিজের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে মাঝে মাঝে আমি সুভাষ মুখোপাধ্যায় পড়ি। প্রশ্ন জাগে, প্রবল জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও অধ্যাপকদের কাছে কেন এখনও তিনি গ্রহণীয় হলেন না। পাঠক হিসেবে আমি নিজেই বিচার করে দেখেছি যেসব বাঙালি কবি আমাদের উপর প্রবল অভিঘাত সৃষ্টি করেছেন, আমাদের চিন্তার কল্পবিধুর কেন্দ্রটিকে নাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের ভেতর সুভাষ একেবারে প্রথম দিকে থাকবেন। তাহলে? আসলে এটা সেই পুরনো শ্রেণিবিভক্তির গল্প। অধ্যাপক রাজনীতি পছন্দ করেন না। (রাজনীতির অসম সুবিধার প্রথম শ্রেণির অংশীদার সে।) সুভাষ রাজনীতিকে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে ফ্যালেন। তার ‘মেজাজ’ কবিতায় আমরা দেখি আটপৌরে পারিবারিক জীবনের ফোঁড় কীভাবে রাজনৈতিক চেতনায় জারিত হয়ে যায়।

এভাবে সাধারণ সব শব্দ কবির হাতে অসাধারণ হয়ে উঠে, শব্দের যথার্থ গাঁথুনির কারণে। তা সেই শব্দসমূহ ব্যক্তিক বা রাজনৈতিক যে অর্থই বহন করুক।

ইবলিশ

স্বর্গের

খুব কাছে

পৃথিবী

ইবলিশ জানতেন

ঈশ্বর

কী

ইবলিশ ছাড়া

আর কার পরিষ্কার ধারণা ছিল

মানুষ

ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি

পৃথিবী

মানুষের জগৎ

ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র

ইবলিশ

পৃথিবীতে এলেন

মানুষের কি

দাসত্ব মানায়

সাধারণের আটপৌরে ভাষা আর সাধারণ চেতনা কীভাবে অসাধারণ বা অন্যরকম হয়ে উঠতে পারে তা বুঝতে আমি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে বারবার ফিরি। পর্ব ভাগের ভিন্নতাও শব্দের গুরুত্বের হেরফের ঘটায়। পাঠক আমার উপরোক্ত কবিতায় বিষয়টি দেখতে পাবেন।

এখানে প্রচলিত ছন্দ খুঁজতে গেলে নন্দনতাত্ত্বিকরা নিশ্চিত হতাশ হবেন। প্রতিটি লাইন এখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়েছে। এই কবিতায় ১৭টি লাইন আছে। এর ভিতর ৭টি লাইন আছে যাদের প্রত্যেকের শব্দসংখ্যা মাত্র ১টি। ৮টি লাইন আছে যাদের প্রত্যেকের শব্দসংখ্যা মাত্র ২টি করে। অর্থাৎ কবি পাঠকের নিশ্বাস নেওয়ার জন্য যথেষ্ট জায়গা ছেড়ে দেন। চিত্রশিল্পী যেমন কখনো কখনো ছবিতে অনেকটা জায়গা ফাঁকা রাখেন, রং যেন নিজের মতো করে বিস্তৃতির সুযোগ পায়। অন্যভাবে বললে, শিল্পী দর্শককে সুযোগ করে দেন রং নিয়ে খেলা করার। ছবিটি তখন হয়ে ওঠে শিল্পী ও দর্শকের যৌথ শিল্পকর্ম। দর্শক নিজেকে সৃজনশীল দেখতে পান। চেতনার স্তর গাঁথুনি অনুযায়ী ঐ শিল্পকর্মটি তার কাছে ভিন্ন অর্থ ও মাত্রা নিয়ে হাজির হয়।

এই কবিতায় কোনো কোনো লাইন একটি মাত্র শব্দকে জায়গা দিয়েছে। অর্থাৎ ঐ এক শব্দের লাইন পাঠকের চেতনায় নিশ্চিত ভিন্নতর দ্যোতনার সৃষ্টি করবে। পাঠক এবং কবির অভিজ্ঞতা এক। উপস্থাপনার ক্ষেত্রেই কেবল কবি সাধারণ পাঠক থেকে স্বাতন্ত্র্যের দাবি করতে পারেন।

তবে পাঠকের গ্রহণ ক্ষমতাকে ভিন্ন দৃষ্টিতেও বিচার করা যায়। যেমন ঘটেছে তসলিমা নাসরিনের বেলায়। তসলিমা নিশ্চিত বাংলা ভাষায় সর্বাধিক প্রভাব সৃষ্টিকারী কবিদের একজন। তবে তার দুর্ভাগ্য হল আমাদের গড়পরতা চেতনার স্তর তার আইডিয়া গ্রহণের পক্ষে প্রতিকূল। আর আমাদের সৌভাগ্য হল সার্বিক চেতনার নিম্নমানকে দ্রুত সাবালক করতে তিনি আমাদের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

তাসলিমা যা বলেছেন তা যে একেবারেই নতুন তা না। বেগম রোকেয়াসহ অনেককেই আমরা এসব বিষয়ে প্রশ্ন করতে দেখেছি। তবে তসলিমার বলার ভঙ্গিটা নিঃসন্দেহে অন্যদের থেকে আলাদা। এর প্রতিক্রিয়াও হয়েছে মারাত্মক। আমরা ভুল বুঝেছি। প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও শাসক সম্প্রদায় এর সুযোগ নিয়েছে।

সংসদে সন্ত্রাসবিরোধী বিল পাস

রাত মিশ্র এক পদার্থ

সবাই জানে

চাঁদের চারপাশে ঘোরাফেরা করে ষাঁড়গুলো

বাতাসে উসকে ওঠে অন্ধকার থিয়েটার

আমার স্বপ্ন তোমার মেয়ের প্রজাপতি

তোমার ছাই তার সিঁড়ি

মোড়ে বাইক দাঁড় করানো হল

দেখাও আইডি কার্ড

ড্রাইভিং লাইসেন্স

কাবিননামা

: এরা যে নবদম্পতি

এর প্রমাণ কী

তোমার ভবিষ্যৎ ব্যাঙের বর্তমান

প্রকৃতির উৎসবে

তারা দেখছে তাদের সদানৈতিক মগজ

ঝাঁকবাঁধা ক্ষিপ্ত পিঁপড়ে

সবুজের ব্যাকুল উদ্ভিদ

গাইগরু রাতেই পেট ভরে খায়

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে

ইউনিফর্মের শুকনো রক্তের কোলাহল

বলা হয়ে যাওয়া শব্দ

বন্দি শব্দ

এগুলো যে বুকে ধারণ করে

তার নাম কাক

সে সন্ত্রাসী

আমার লেখা এই কবিতায় ‘রাত’ এবং ‘কাক’ শব্দটি, বোঝা যাচ্ছে, পাঠকের মনোযোগ অনেক বেশি পাবে। উপযুক্ত জায়গায় বসবার কারণেই, সঠিক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে। রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণির কাছে রাত নিছক কালের একটি নির্দিষ্ট অংশ। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত নিষ্পেষিত শ্রেণি? রাত তাদের কাছে উত্তরণ আর প্রতিরোধের বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে হাজির। এখানে বিপন্ন হয়েছে অধুনিকতা-জ্বরগ্রস্ত শব্দের একরৈখিকতা।

শাসকের চোখে কাক যে প্রতীকরূপে অঙ্কিত এরা তাই।

প্রবাদ আছে : ‘ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খাইনি’। কবিতাটির দ্বিতীয় লাইনে প্রশ্ন আছে। কাকে? বাংলায় ছড়ায়, গাঁথায়, প্রবাদ-প্রবচনে, গানে, গল্পে, নৃত্যে আমরা কি ক্রমাগত প্রশ্ন করে চলিনে? এ এক পদ্ধতি।

আমাদের আত্ম-আবিষ্কার।

তিন.

আমার বিরুদ্ধে সমালোচকদের অভিযোগ আর আমার ব্যাপারে শুভাকাঙ্ক্ষীদের খেদ একই: ছেলেটার কাব্যবোধ আছে, কিন্তু ওর কবিতায় বড্ড রাজনীতি।

কবিতার যারা সাধারণ পাঠক, কাব্যবোধের জায়গায় কখনো কখনো তারা পিছিয়ে থাকতে পারেন বা নন্দনতত্ত্বের ঘোরপ্যাঁচ হয়তবা তারা বুঝবেন না। কিন্তু সমালোচক বা অধ্যাপক?

সাধারণ পাঠক তখনই কবিতার কাছে যায় যখন কবিতা তাদের টানে। কবিতা কখন টানে? যখন তাদের জীবনের ক্লেদ, পরাজয়, ভালোবাসা, ক্ষোভ কবিতা নিজের ভিতরে টেনে নেয়। একেই আমি বলি রাজনীতি। কখনো কখনো অধ্যাপকগণ এটা ধরে ফ্যালেন। আর চ্যাঁচান। আমার কবিতার যারা মূল্যবান পাঠক তারা কি কবিতার কাছে কিছুই প্রত্যাশা করেন না?

শিল্পে রাজনীতিকরণে যারা ঘোর বিরোধী তাদের কাছে বিনীত প্রশ্ন, নেরুদাকে কি আপনি কবি বলবেন না? এ্যালেন গিন্সবার্গকে? পিকাসোকে কীভাবে দেখবেন? এমনকি হেনরি মুরের মেক্সিকান ধাঁচের অর্ধশায়িত মানবমূর্তিগুলো যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন লন্ডনে প্রদর্শিত হয়েছিল, সেগুলো? আবদুল গাফফার চৌধুরীর রাজনৈতিক কলাম আর জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের চিত্রাবলির মধ্যে পার্থক্যটা তাহলে কীভাবে আমরা ধরতে পারি?

ধোঁকাবাজি

এক মুহূর্ত থেমে

এবার ভাবো

আমার কবিতা

আর তোমার বক্ষবন্ধনী

জগৎকে

কীভাবে ধোঁকা দিয়েছে।

এই কবিতায় ‘কবিতা’ ও ‘বক্ষবন্ধনী’ শব্দদুটোকে কী বলব— রাজনৈতিক শব্দ? প্রেমিক-প্রেমিকা তো এই জগতেরই বাসিন্দা। ব্যাপারটা অনস্বীকার্য যে পুঁজি নরনারীর একান্ত নির্জনতাকেও অরক্ষিত করে তুলেছে। শব্দের নির্ধারিত কোনো জাতপাত থাকছে না। করপোরেট সভ্যতার ফাঁদে শব্দ নিতান্তই পণ্য।

কোন শুদ্ধতা দিয়ে কবিতাকে ঢাকব?

এখানে একটা দ্বিধার কথা বলি। কবিতাকে আমি গণমানুষের কাছাকাছি যেমন নিয়ে যেতে চাই, তেমনি চাই গতানুগতিক বাংলা কবিতার কলাকৌশল ভেঙেচুরে সব রকম সতীপনা হতে কবিতাকে মুক্ত করতে। উপরোক্ত ছোট্ট কবিতাটি ধারণ করেছে আমার নির্মোহ সরলতা। পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে যা উৎসারিত। পাঠকই শেষ বিচারক। তাৎক্ষণিকভাবে পাঠক আমাকে সমর্থন নাও করতে পারেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত, নিজের সত্তা আবিষ্কারে পাঠক ভুল করবেন না। পাঠকই কবিকে সৃষ্টি করেন।

এখনও, এই সময়ের ডামাডোলের ভেতর বসে কোনো কোনো অধ্যাপক আমাদের জানিয়ে দেন, কবিতাকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে। যেন কবিতা রাজনীতি বিচ্ছিন্ন কোনো জিনিস। কবিতা যেন শ্লোগান না হয়ে যায়। কেন? তাতে ভয় কীসের? কবিতার কোনো লাইন যদি গণমানুষের চেতনার সঙ্গে একাত্ম হয় বা মিছিলে এক সুরে ধ্বনি তোলে তাহলে কবিতার চরিত্র নাশ হওয়ার আশঙ্কা কেন? নাকি ভেতরের রাজ্যপাটে আঘাত আসার আশঙ্কা থেকেই এই ফতোয়া। না হলে শিল্প তো কোনো আইন মানে না। আর যদিও বা মানে তা ভাঙার উদ্দেশ্য নিয়েই। ‘বিখ্যাত একজনের মৃত্যু পরবর্তী অভিজ্ঞতা’ শিরোনামের কবিতাটি তুলে দিচ্ছি।

গত সোমবার তিনি মারা গেছেন।

আজ শহরের সবচেয়ে অভিজাত রেস্টুরেন্টে ঢুকে

তিনি দেখলেন;

মাঝখানের টেবিলে

এক যুবক কর্নেল ও একজন সরকারি আমলা

অসৎ রাজনীতির মুণ্ডুপাত করছেন।

প্লেটে

প্রায় শেষ হয়েছে

তারই সুস্বাদু মগজ।

এখানে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ যা অরাজনৈতিক শক্তির দ্বারা শাসিত হয় শোষিত হয় তার চিত্র রয়েছে। এটি সামরিক শাসক ও তার সুবিধাভোগীদের ছলনা। তারা যদি সবকিছুর জন্য রাজনীতিবিদদের দায়ী করতে না পারেন, রাজনীতিবিদগণ কত খারাপ এটা যদি জনগণকে বোঝাতে না পারেন তাহলে দেশ দখল করে লুটপাট করে খাওয়ার পথ সুগম হবে কেন?

অধ্যাপক হয়ত একে কবিতা বলবেন না। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করতে পারি, কোন বিষয় নিয়ে লিখলে, কীভাবে লিখলে তা কবিতা হবে তা কি অধ্যাপক মশাই আমাদের জানাবেন? বিভিন্ন বই ঘেঁটে বিভিন্ন ছক নিশ্চয় অধ্যাপক সাহেব প্রস্তুত করে রেখেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তার থেকে কয়েকটি তিনি আমাদের জানিয়ে দিতে পরেন। কিন্তু কোন্ কবি কোন কালে অধ্যাপকের সূত্র মেনে কবিতা লিখেছে? বরঞ্চ কোনো কোনো কবি কবিতায় ব্যর্থ হয়ে কালে অধ্যাপক বনে গেছেন। ফলে সূত্র আবিষ্কারে তাদের এতো আগ্রহ। পড়া যাক আমার ‘শয়তান’ কবিতাটি।

স্বর্গ হতে বিতাড়িত

কেন রে মরতে এলি দুনিয়ায়

তোকে বলা হবে

দেশদ্রোহী

বিচ্ছিন্নতাবাদী

সন্ত্রাসী

চরমপন্থী

এটি নির্যাতিত সাধারণ মানুষের আকুতি। কবির হাত ধরে এভাবে কাগজে উপস্থাপিত হয়েছে। একে কবিতা বলা যায়। অধ্যাপক বলবেন রাজনৈতিক কবিতা। বিষয়টা এমন যে এটি কবিতা পদবাচ্য নয়। তা হোক। কিন্তু সমস্যা আরও গভীরে। মানুষের অসহায়ত্বের কথা বললে নির্যাতনের কথা বললে, জেগে ওঠার কথা বললে কেন তা কবিতা হবে না? নাকি সমাজের সুবিধাভোগী অংশের হয়ে সুবিধা হারানোর ভয়ে এই কারসাজি? হতে পারে মিডিয়া নামক হাতিয়ার দ্বারা মগজ ধোলাইয়ের প্রতিক্রিয়া।

এদের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর সাক্ষী জেনারেল ফ্রাংকো। এর প্রমাণ শামসুর রাহমানের প্রতি আততায়ীদের দৃশ্য ও অদৃশ্য আঘাত, মৃত্যুর পরেও।

নিপীড়িত সম্মিলিত শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই।

এবার কবি হিসেবে আমার কথা বলি। কবিতায় পাঁচ লাইনের শেষ স্তবককে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত বাগাড়ম্বর বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু তা একে হতে দেয়নি প্রথম দুটি লাইন, আর প্রতি লাইনে একটি করে প্যারা। সবচে বড় কথা, জমকালো চিত্রকল্প আর কাব্যিক মুখরতা থেকে কবিতাটি মুক্ত।

প্রথম লাইনের পর এবং দ্বিতীয় লাইনের পর দুটি প্যারা পাঠককে চিন্তার সুযোগ করে দেয়। ফলে শেষ পাঁচটি লাইন তার কাছে প্রচলিত অর্থের বাইরে আরও বেশি কিছু হয়ে ওঠে।

তার কাছে এটি না রাজনীতি

না কবিতা।

জীবন।

চার.

এতক্ষণ বলেছি, কেন কবিতা। এখন বলব, কেন কবিতা নয়। আধুনিকতা বলতে আমরা ইউরোপ থেকে আসা আইডিয়াকে বুঝি। আধুনিক কবিতা বলতে ইউরোপীয়রা যেমন কবিতা লেখে তেমন কবিতা। দেখে দেখে আমরাও তাই শিখেছি। যে যত বেশি পশ্চিমকে অনুকরণ করতে পারছি সে তত আধুনিক। মজার ব্যাপার হল, লেখার চর্চাটা প্রথম শুরু করেছে আমাদের চীনা ভাইরা। পশ্চিম নয়। আর কবিতাচর্চায় পশ্চিমের চেয়ে আমাদের দক্ষিণ এশীয়দের ঐতিহ্য অনেক পুরনো।

তাহলে আমরা তোতাপাখির মতো পশ্চিমকে আওড়াই কেন? একটা সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে হাতেগোনা কয়েকটা জাতির মতো আমরাও বলা যায় অর্থসম্পদে, নৈতিকতায়, চিকিৎসায়, বিজ্ঞানে, ব্যবসায়, রাজনীতিতে বেশ স্বচ্ছল ছিলাম। ইউরোপের শিল্পবিপ্লব এই পরিস্থিতিকে অনেকটা বদলে দেয়। হাতে নতুন নতুন প্রযুক্তি আসে। নতুন পণ্য উৎপাদিত হয়। কাঁচামালের অভাব দেখা দেয়। আবার পণ্য বিক্রির জন্য পর্যাপ্ত বাজারও দরকার।

ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায় ধেয়ে আসে আমাদের ভূখণ্ডে। আমাদের নিজস্ব পণ্য ছিল খুবই উন্নত। যেমন মসলিন বা জামদানি। যদিও তা প্রযুক্তিনির্ভর ছিল না। ছলে বলে কৌশলে ইউরোপীয়রা আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ধ্বংস করে। স্থানীয় বাজার শূন্য না হলে তাদের পণ্য ঢোকার জায়গা কোথায়? বুদ্ধিতে কৌশলে তারা আমাদের শিল্পে সাহিত্যে জীবনাচরণে কালি লাগিয়ে দেয়। যাতে আমরা নিজেদের হীন মনে করি। এতে তাদের বেনিয়া স্বার্থ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য উভয়ই সফল করতে সহজ। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে তারা বাইবেল বুকে করে গ্রামে-গঞ্জে ছুটে বেড়িয়েছে।

যা হোক, এই ছকে আমরা পা দিয়েছি। শিখেছি শেক্সপিয়ার কবি, লালন শাহ ভাবুক। আমরা আদর করে ডাকি বাউল। হাসন রাজা বাউল, পাগলা কানাই বাউল। কবি নন। যেন ভাবুক হলে কবি হওয়া যায় না। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় কেতায় কবিতা লিখেছেন! না হলে তার কবিতার যে ভাব তাতে তাকে আমরা বাউল বলেই চালিয়ে দিতাম। বাউল শব্দটা আমাদের খুব প্রিয়। কিন্তু বাউলরা কবি নন কেন? ইউরোপীয়দের মতো করে বলেন না বলে?

জাপানের ‘নো’ নাটক কি ব্রেখটের নাটকের মতো? তেমন হলে কী বিশ্রী ব্যাপার হত!

কোথায় যেন আমাদের কুণ্ঠা রয়েছে। জাপানিদের নেই। লালনকে কেন শেক্সপিয়ারের মতো করে লিখতে হবে? শেক্সপিয়ার কি লালনের চেয়ে উঁচু চেতনাসম্পন্ন! বেশি মানবিক?

আসলে আমাদের মননে এই সংস্কার গেঁড়ে বসেছে যে আধুনিক কবিতা তেমনই যেমন ইউরোপীয়রা লেখে। এটা ঐ দীর্ঘদিন পরাধীনতার ফল। কলোনিওলাদের ফেলে যাওয়া বাটখারাগুলো আমরা কুড়িয়ে নিয়েছি। মাপজোকের কাজবাজ সব এখনো ওতেই চলছে। আবার বলা যায় এ সেই গোয়েবলসীয় তত্ত্বের মহত্ব। কোনো মিথ্যে একশ’ বার বল, তাই সত্যে পরিণত হবে। অন্যান্য হাতিয়ারের মতো প্রচারযন্ত্রও পশ্চিমা পুঁজিবাদের হাতে। আমাদের নিজস্ব মিডিয়া নেই। এখানে আমরা মানে রণজিৎ-ভাবা-গায়ত্রী কথিত নিম্নবর্গ। ফলে আমরা যা দেখছি, যা শুনছি সব পশ্চিম থেকে পাওয়া। পশ্চিম একশ’ বার যা বলছে তা-ই আমরা সত্য বলে মেনে নিয়েছি।

অন্য দিকও আছে। এটা অধ্যাপকদের কাজ। তারা কবিতা তৈরির বিভিন্ন নন্দনতাত্ত্বিক উপাদান যেমন উপমা, প্রতীক, চিত্রকল্প, ছন্দ, মাত্রা, উৎপ্রেক্ষা, পর্বভাগ, স্তবকবিন্যাস— এছাড়া কাব্যতত্ত্বের আরও আরও কত ডালপালা-পাতা-পতঙ্গ বিষয়ে কবিদের শিক্ষিত করতে চান। কিন্তু অধ্যাপকদের দুর্ভাগ্য হল তারা কোনোদিন কবিদের মাস্টার হতে পারলেন না। কবিরা চিরদিনই অবাধ্য, অসামাজিক!

রঁদার ভাস্কর্য যেমন দীর্ঘদিন ফরাসিদের সরকারি সঁলোতে ঠাঁয় পায়নি তেমনি কবিদের অনেক কবিতাই সমকালে কবিতা বলে স্বীকৃতি পায় না। হয় তাকে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, না হয় অশ্লীলতার দোষে অভিযুক্ত করা হয়। যেমন মলয় রায় চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যতিক ছুতার’। এই কবিতা জন্য মলয়কে গারদ খাটতে হয়েছে।

লেজ

যা-ই হোক,

এ না হলে কেউ বলতে পারত—

কেন?

কেউ জানত—

কখন?

কারো বোঝার সাধ্য ছিল—

জন্তুটার লেজ

শুরু হয়েছে

ওর পশ্চাদ্দেশ থেকে নয়

ওর ভেতর থেকে

বা ভেতরের ভেতর থেকে?

জানি, অধ্যাপকগণ আমার এই অনাড়ম্বর লেখাকে কবিতা বলে মানবেন না। কিন্তু এতে আমি খুশিই হব। কেন না আমি সাধারণ মানুষের জন্য কবিতা লিখি। অধ্যাপকদের জন্য না। অধ্যাপকগণ যতই কবিতা ‘হয়নি হয়নি’ বলে চ্যাঁচাবেন আমি বুঝব আমি সফল। তা একে কবিতা বলা হোক বা না হোক।

বরং আমি চাই, আমার কবিতা কোনোভাবেই যেন কবিতা না হয়ে ওঠে। কবিতা হোক যৌনতা, কবিতা হোক রাজনীতি। যে যৌনতা বা রাজনীতি আপসের জন্য না, বিক্রি হওয়ার জন্য না। এ যৌনতা বা রাজনীতি আক্রমণের জন্য, ভাঙার জন্য।

অন্তর্বাস

অন্তর্বাস ব্যবহারেই সব মিটে যায় না—

এই সহজ কথাটা

বোঝাবার জন্য

আমি

বকবকম করে যাচ্ছি।

শাসক বা সুবিধাভোগী শ্রেণি যেমন রাজনীতি পছন্দ করে না, তেমনি যৌনতাও তাদের শত্রু। অবশ্য বিশেষ অপকৌশলে এ-দুটো থেকে সর্বোচ্চ ফায়দা তারাই তুলে নেয়। কবির হাতে যৌনতা যৌনতার চেয়ে বেশি কিছু হয়ে ওঠে। যা শোষক শ্রেণির জন্য হয়ে উঠতে পারে ক্ষতিকর। অন্তত আশঙ্কা তো থাকেই। এই আশঙ্কা বা ভীতি থেকেই মকবুল ফিদা হুসেনের ছবি পুড়িয়ে ফেলা হয়। শাসক নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় যৌনগন্ধী যে কোনো শিল্প অচ্ছুৎ ঘোষিত হয়। দেশে দেশে যৌনতা পারমাণবিক বোমার চেয়ে মারাত্মক বিবেচিত হয়। অবশ্য নিয়মের ভেতর সবই চলে। প্রতিটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেই আইনসম্মত পতিতালয় রয়েছে। তারা সরকারকে ট্যাক্স দেয়। যৌনতা বিক্রির টাকা রাষ্ট্রের মুদ্রা তহবিলকে আরও বড় করে।

সমস্যা হল, শিল্পের যৌনতা রাষ্ট্রের নিয়ম মানে না। রাষ্ট্রকে ট্যাক্স দেয় না। সর্বোপরি তার চরিত্র হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রদ্রোহী।

এ কারণে রাষ্ট্র বা সমাজ শিল্পের যৌনতাকে সহ্য করে না।

আমি চেয়েছি আমার পাঁচ লাইনের ‘অন্তর্বাস’ কবিতাটি যেন কবিতা না হয়ে ওঠে। তাহলে আমার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। কবিতায় নাকি উদ্দেশ্য থাকতে নেই। কেন নেই? কার ক্ষতি? বুঝে নিন ব্যাপারটা।

একটা শ্রেণি আছে যাদের অবশিষ্ট কিছুই আর নেই। আরেকটি শ্রেণি আছে যাদের সব আছে এবং চাহিবা মাত্র পাইবার উপযুক্ত হাতিয়ার এদের করায়ত্ত। মাঝামাঝি একটা শ্রেণি আছে যাদের কিছু আছে কিছু নেই। যা নেই তা পাওয়ার জন্য এই শ্রেণি কুকুরের লালা চাটতেও প্রয়োজনে পিছপা হবে না। (দুঃখিত কুকুর সম্প্রদায়ের কাছে। কুকুরদের আমি আদৌ অনৈতিক বা নিম্নস্তরের জীব বলে মনে করিনে। মানুষ প্রজাতির বোধগম্যতার সুবিধার্থে কুকুর শব্দটা নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে হল।)

উপরোক্ত কবিতার শেষ চারটি লাইনে বিশেষত্ব নেই। কিন্তু কবিতার প্রথম লাইন শেষ চার লাইনকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চেয়েছে।

‘অন্তর্বাস’ কবিতায় অন্তর্বাস শব্দটি নিঃসন্দেহ নিউক্লিয়াস। এই একটি মাত্র শব্দ মধ্যবিত্ত চরিত্রের কদর্যতা আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরেছে। শেষ চার লাইন নিজেদের যথাসম্ভব আড়াল করে প্রথম লাইনকে হাতিয়ার করে মধ্যবিত্তের পাছায় মেরেছে লাথি।

আমিই এর সাক্ষী। আমার শ্রেণিও তো আলাদা না!

পাঁচ.

‘ধর্মে’র ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা রয়েছে। সেদিকে আমরা যাব না। কিন্তু এ যে মধ্যযুগীয় প্রতিক্রিয়াশীল চেতনাকে লালন করে, সমাজকে পেছনে টেনে নিয়ে যেতে চায় তা তো আমরা দেখেছি, দেখছি। অজানার প্রতি এক ধরনের ভীতি থেকেই মানুষ বিভিন্ন দেবদেবী বা ঈশ্বর সৃষ্টি করেছে। সভ্যতার এক পর্যায়ে উৎপাদনের উপকরণসমূহ যখন মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে চলে গেল তারা হয়ে উঠল প্রভু। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে বিভিন্ন কৌশল তারা বের করল। এর একটা হল অজানা-ভীতিকে কাজে লাগিয়ে তাদের ক্ষমতাকে ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে প্রচার করা। এতে ধর্মভীরু মানুষ প্রতারণা-প্রবঞ্চনাকে নিয়তি নির্ভর বলে মেনে নেবে। যা এখনও চলছে। ধরন পাল্টেছে। কিন্তু সবই চলে আধিপত্যকামীদের স্বার্থ সংরক্ষণের খাতিরে।

কবি, শিল্পী বা বিজ্ঞানী যিনি হবেন তিনি অবশ্যই মুক্ত মানুষ হবেন। কারণ বন্ধ্যাত্ব থেকে কোনো কিছু সৃষ্টি হয় না। কিন্তু সরলভাবে দেখলে বাস্তবতা অন্যরকম। মধ্যযুগে ইউরোপে চার্চ অসীম ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছিল, সাধারণ মানুষের রক্ত শুষে। আধুনিককালে উপমহাদেশ এই ব্যাধি থেকে মুক্তি ছিল না, নেই। প্রমাণ, এক দেশ ভেঙে তিন দেশ হয়ে যাওয়া। (বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবে ধর্মের প্রত্যক্ষ প্রভাব নেই। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান যদি ভারত থেকে আলাদা না হতো তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত কি না সন্দেহ। অথবা হলেও তার কাল এবং আকার নিশ্চয় ভিন্ন হত।) ধর্মের ফণা কী ভয়ঙ্কর!

এ থেকে আমরা এখনও মুক্ত হইনি। কিন্তু যারা সৃজনশীল মানুষ, যারা মানবতাবাদী বলে পরিচিত, তারা?

কবি নির্মলেন্দু গুণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন ‘রাজনীতির কবি’। আমরা শামসুর রাহমানকে বলি ‘কবিতার রাজনীতিক’। ডেরেক ওয়ালকট বলেছিলেন, ‘গোটা দেশের বুদ্ধিমত্তা আর উত্তাপ ছাড়া একজন মানুষ বেশি কিছু নয়।’ শামসুর রাহমান তা-ই। গোটা একটা জাতির আত্মাকে তিনি ধারণ করেছিলেন। তিনি দাঁড়িয়েছিলেন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে। নিজের স্বার্থে পুঁজিবাদ যাকে লালন করে সেই ধর্মকেও তিনি প্রশ্রয় দেননি। এ কারণে প্রতিক্রিয়াশীলরা তাকে বারবার আঘাত করেছে। এ আঘাত বাঙালি-সত্তায়। বাঙালি তার সত্তাকে পরিপূর্ণরূপে ধারণ করতে শামসুর রাহমানের মতো দ্বিতীয় কাউকে পায়নি।

দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাস

আমি এক দ্বীপপুঞ্জ। মৃতদের সহজ কথাগুলো প্রবালপ্রাচীরে

আরও সবুজ হয়ে উঠেছে। জলের অসীম ঘূর্ণি সৃষ্টি করেছে কক্ষপথ;

নামহীন ছায়ারাশি আর মৃত হাড়গোড় সেই নিঝুম ডানায় পেয়ে যাবে

নতুন ছায়া। ধানের বিন্দুতে একই কোলাহল, মা-ফড়িঙের উদ্ধত গ্রীবা—

আদমের ভুল আর ঈভের অদম্য তৃষ্ণাই আমাদের চালিত করে। রুপালি নুড়ির

হিংস্রতায় উজ্জ্বল ঐ দ্বীপপুঞ্জের চূড়া।

সমুদ্রছোঁয়া যে ভূখণ্ডে আমার নিশ্বাস মিশে আছে এটা তার গল্প। যে মাটি, সমুদ্রের যে ফ্যানা আমাকে সৃষ্টি করেছে আমি তাকে খুঁজে বোড়াচ্ছি। শামসুর রাহমান এই ঘূর্ণিতে আমাকে ফেলে দিয়েছেন। আমার উপরোক্ত কবিতা তারই তৃষ্ণা, তারই কাতরতা।

শামসুর রাহমানের কবিতাকে এজন্য কেবল কবিতা বলা যায় না। আরও কিছু। এই আরও কিছুর জন্যই তিনি বিপজ্জনক। তার আঁচ আমি মেখে নিচ্ছি।

পরপর দুটি কবিতা তুলে দিচ্ছি। প্রতিটি চার লাইনের।

চিরকুট

আমি তোমাকে ভালোবাসি

পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগগুলোর চোখে ঘুম নেই

তবু আমি তোমাকে চাই

সে তুমি দক্ষিণ এশিয়া বা আফ্রিকা— যেখানেই থাক

মোদ্দা কথা

সমালোচকদের থোড়াই কেয়ার করি

কবিতা আমাদের মতোই হবে

কী লিখব, কীভাবে লিখব

তা কি আমাদের চেয়ে বেশি কেউ জানে

এ দুটো লেখাকে কোনোভাবেই কবিতা বলা যায় না। আমি চাই কবিতা দুটোকে যেন কোনোভাবেই কবিতা বলে স্বীকৃতি দেওয়া না হয়। এখানে রয়েছে বুর্জোয়া সভ্যতার মাতলামির খবর, আর গণমানুষের ঘুরে দাঁড়াবার মোড়। এ আদৌ কবিতা না। আমি কবিতা লিখিনি। নেরুদা কবিতা লেখেননি। লোরকা কবিতা লেখেননি। নাজিম হিকমত না। নিকোলাস গ্যিয়েনও না।

কবিতা না লেখার শিক্ষা আমি পেয়েছি শামসুর রাহমানের কাছ থেকে। ওঁর ‘বন্দী শিবির থেকে’ বা ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ যদি কেবল কাব্যগ্রন্থই হত তাহলে আজ ওঁদের নিয়ে আমরা আলাদাভাবে কথা বলতাম না, আমাদের ভাবনার স্তরে ওঁদের আঘাত আমরা অনুভব করতাম না।

আমাদের জাঁদরেল অধ্যাপকগণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে এবং তারা যে বিপ্লবের সমর্থক এটা বোঝাতে প্রায়ই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী চে গুয়েভারাকে উদ্ধৃত করেন। এখন কবিতাপ্রেমীদের মনে করিয়ে দিই, চে-র সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল, এমনকি বলিভিয়ার গেরিলা-জীবনেও, নেরুদার ‘কান্তো জেনারেল’।

ছয়.

ষড়যন্ত্র

আমরা রয়েছি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে

অথবা বলা যায় একই জায়গায়

একটা ষড়যন্ত্রে সবাই কাছাকাছি

সেই মুহূর্তটি আসার আগ পর্যন্ত

এক হবে না দু’চোখের পাতা

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের একটা দল

যে কোনো দিন যে কোনো মুহূর্তে এসে দাঁড়াবে

আমার উঠোনে

জিপে উঠিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে নির্জন কোথাও

তারপর ঠুস্ করে একটা শব্দ হবে

অবশ্য খবরের কাগজে ও টিভিতে

বরাবরের মতো

রিপোর্টটা আসবে একটু অন্যভাবে

‘পলায়নের সময় র‌্যাবের হাতে চরমচন্থী নিহত’

অথবা

‘ক্রসফায়ারে নিহত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী অমুক’

অথবা…

আসল ব্যাপারটা সবাই জানে

আর

একটা গুলিতে একটা ষড়যন্ত্র শেষ হয়ে যায় না

এই কবিতা আসলে আমি লিখিনি। পাঠক এখানে কবির নাম শিশির আজম না পড়ে অন্য যে কোনো নামই পড়তে পারেন। ধরে নিন এটি আপনি নিজেই লিখেছেন। রাষ্ট্র যদি ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে তাহলে এমন কবিতা যে কেউ লিখবে। তা আপনি ভয়ে স্বীকার করেন বা না করেন।

তবে সবচে ভালো হয় যদি একে কবিতা হিসেবে বিবেচনা না করি। মনে করুন এটি আপনার বন্ধুর তৈরি করা খবরের কাগজের একটি রিপোর্ট। অথবা হতে পারে এটি উপসম্পাদকীয়। আমি যা লিখি তা-ও কোনো না কোনো বর্তমান ঘটনার নির্যাস। হয় তো তা কখনো অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিক্রিয়ায় লিপ্ত হয়ে জারিত হয়, হয়ত তা ভবিষ্যৎ অনুভবে অনুষঙ্গ হয়ে উঠতে চায়।

কবিতা তো এক ধরনের আত্মজীবনীই। আর চলমান সময়কে বাদ দিয়ে আত্মজীবনীর পূর্ণতা কতটুকু?

মধ্যযুগীয় চেতনা দ্বারা রাষ্ট্রকে যারা পেছনে টানছে রাষ্ট্র তাদের লালন করছে। আর এখনও পর্যন্ত যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শন পৃথিবীর সংখ্যাগুরু মানুষের জন্য কল্যাণকর বিবেচিত হয়েছে সেই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ রাষ্ট্রের শত্রু। রাষ্ট্র হল পুঁজিবাদের হাতিয়ার। পুঁজিবাদ এবং মৌলবাদ উভয়ই কম্যুনিজমকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে। এদের প্রতিহত করতে রাষ্ট্র প্রলোভন এবং বুলেট, উভয়ই ব্যবহার করে। সেকারণে আমরা দেখি, এককালের ডাকসাইটে বিপ্লবী বর্তমানে জাতীয় বিনিয়োগ বোর্ডের প্রধান। আর বিপ্লবী দল ‘লাল পতাকা’র প্রধান উপমহাদেশের অন্যতম শীর্ষ তাত্ত্বিক নেতা মিজানুর রহমান টুটুলকে গুলি করে মেরে ফেলা হল।

‘ষড়যন্ত্র’ নামের এই কবিতাটি আমি লিখি টুটুলের মৃত্যুর আট মাস পূর্বে। যদিও প্রতিদিনই বিপ্লবী চিন্তার ধারক বা বিপ্লবী চিন্তায় আকৃষ্ট মানুষদের খুন বা গায়েব করে ফেলা হচ্ছে, তবে টুটুলের মৃত্যুই আমাকে যেন খাদের কিনারে দাঁড় করিয়ে দেয়। এখন আমি নিশ্চিত, উক্ত লেখাটি মানবিক পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষায় নিবেদিত টুটুলের আত্মজীবনী।

কবিতা বিষয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। এর অনেকগুলোই মিটে যায় যদি আমরা ধরে নিই যে কবিতা লেখা একটা কাজ। স্মরণ করুন, বাহদুর শাহ জাফরের কাব্যপ্রতিভার চূড়ান্ত স্ফুরণ ঘটেছে কখন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে যখন তিনি ইংরেজদের হাতে ভারতের পুতুল সম্রাট; অথবা নিজেকেই প্রশ্ন করুন, মাদ্রিদ অবরোধের সময়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কেন একই সঙ্গে প্রতিবাদে মুখর হল লোরকা ও নেহেরুর কণ্ঠস্বর।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো ওঠে তা কবিতার বিরুদ্ধেও তোলা যায়। কবিতা কখনো পাস, কখনো ফেল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত, এটা কবিতার বিজয়। এর ভেতরে কবিতার দায়বদ্ধতারও প্রমাণ রয়েছে। আবার নজরুলের কবিতাকে যে প্রতিক্রিয়াশীলরা ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারছে, এতে কি কবিতার সত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি?

সাত.

আমি এখন যেরকম কবিতা লিখি, এই ‘যেরকম’টা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে পাওয়া। সুভাষ কোথা থেকে পেয়েছিলেন? সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কাছ থেকে। তা ওখান থেকে আমি কেন পাইনি? হ্যাঁ, পেয়েছি। কিন্তু আমি কি জানতাম গণমানুষের কণ্ঠস্বর, জীবনাচার কবিতার ভাষার সঙ্গে এভাবে মিশে যেতে পারে? সুভাষ সাধারণত কথাবার্তা বলেন ভেঙে ভেঙে, ছোট ছোট লাইনে। সাধারণ মানুষকে জীবনের অন্ধকারকে, আধিপত্যবাদীদের ফাঁকফোকরকে এভাবেই হয়ত ভালোভাবে সমগ্রতাসহ দেখতে পাওয়া সম্ভব।

একটা ব্যাপারে সুভাষ-সমালোচকদের সঙ্গে আমি একমত: আদর্শগত উদ্দেশ্যকে সফল করতে গণমানুষের কাছে পৌঁছাবার জন্য সুভাষের কবিতা কখনো কখনো শিল্পকৌলিন্য (!) থেকে বিচ্যুত হয়েছে। কিন্তু সমালোচকদের উদ্দেশ্য আর সুভাষের উদ্দেশ্যর মধ্যে ফারাক আছে। যা আমার আর সুভাষের মধ্যে নেই।

তবে সুভাষ যেমন কম্যুনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী ছিলেন আমি তো তা না। অভিজ্ঞতার বিস্তর পার্থক্যই উদ্দেশ্যকে সফল করতে আমাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবধান এনে দিয়েছে।

মা হাওয়া

১.

সবার উপর

সম্মান

স্বাধীনতা

২.

তুই

কখনো চাসনি

সন্তান

বড় হোক দাসত্বে

কোনো বক্তব্যকে তুলে আনতে সুভাষের পদ্ধতি হল সামগ্রিক পরিবেশকে শাখাপ্রশাখার মতো খণ্ড খণ্ড রূপে পাঠকের সামনে উপস্থিত করা। শেষে চমক থাকে। বস্তুর খণ্ড খণ্ড অংশ সমন্বিতরূপে পাঠকের চেতনায় একাত্ম হয় যেন তা পাঠকেরই কল্পনার স্বরূপ।

অন্যদিকে আমি প্রথমেই বস্তু বা পরিবেশের সমন্বিত রূপ পাঠকের সামনে উপস্থিত করি। যাতে চমক থাকে না। অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি পাঠকের চেতনা-সমুদ্রে ছুটতে থাকে নিয়ন্ত্রণ হারানো সাবমেরিনের মতো।

আট.

যখন কোনো কবিতা লিখতে শুরু করি তখন আমার মাথায় কোনো নির্দিষ্ট ‘ছন্দ’ থাকে না। তবে কয়েকটি লাইন লেখার পর যদি দেখি নির্দিষ্ট কোনো ছন্দ এতে চাগিয়ে উঠছে তবে তাকে আমি প্রশ্রয় দিই। এগিয়ে যেতে দিই। এভাবে দুয়েকটি কবিতা লেখা হয়েছে। তবে একে ব্যতিক্রম হিসেবেই ধরতে হবে। কেন না কবি কবিতা লেখেন, ছন্দ লেখেন না।

পিয়েতা

নরম ঘাসে চোখের পাতা ভেজা

চাঁদটা আধখোলা কবিতা বই

এ হল শুরু, আর জলপাথর

খেলতে থাকে স্বাধীনতাকে নিয়ে

সব নদীই শুয়েছে রোদ বুকে

বাড়তে থাকে পরমাণুর খিদে

ঘাম ও পলি এদেশে পরিচিত

পুরনো ঘরে ওড়ে বায়ুর ঝাঁক

তোদের আমি হারিয়ে যেতে দিই

আবার যাতে তোদের ফিরে পাই

অসুখী খাদে ঘড়িটা শুয়ে আছে

জরুরি কাজে নামতে পারে বায়ু

দেয়ালে তবু আমরা কান পাতি

দেয়ালে চীর, এক টুকরো আলো

রুপালি হাড়ে হাসির কথা বলে

শুকনো ঘাসে ছড়িয়ে পড়ে ধ্বনি

অজানা কিছু ছিল না তবু আছে

লাল গোধূলি নিরব হয়ে এল

পশুর খুরে জড়িয়ে এলো ঘুম

শেষ ও শুরু মূলত এক কণা

আমার ধারণা, কবিতার যারা নিয়মিত পাঠক বড় কোনো বিঘ্ন ছাড়াই তারা কবিতার শেষ লাইন পর্যন্ত পড়তে পারবেন। সহজ ও সাধারণ সব শব্দে প্রতিটি লাইন এমন সরলতা পেয়েছে যা পাঠককে ছন্দ নিয়ে ভাবতে দেয় না। অর্থাৎ এই লেখায় ছন্দ যদি কবিতার চেয়ে বড় হয়ে উঠত হবে তাকে আমি বিসর্জন দিতাম।

পাঠক এতক্ষণে বুঝে গিয়েছেন ‘পিয়েতা’ কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা। সাদা চোখে এই কবিতায় ছন্দের কোনো চ্যুতি খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে খুঁতখুঁতে মনে পাঠক যদি তাকান তাহলে দেখতে পাবেন এর পর্বগুলো একইভাবে চলেনি। কোনো লাইনে ৫/৭ মাত্রার পর্ব, কোনো লাইনে ৭/৫ মাত্রার। এটা আমি ইচ্ছে করে করিনি। তবে লেখা শেষ করার পর আমার মনে হয়েছে আমাকে মোটেই একঘেয়েমিতে পায়নি। আর নিশ্চিত এর প্রভাব পাঠকের উপর পড়বে।

বাংলা কবিতার ট্রাডিশনাল চলনকে মান্যতা দিয়ে লেখা হলেও এই কবিতায় গোছানো কোনো বিষয় নেই। তবে একটা অনুভূতি তো মগজে চরে বেড়ায়। শব্দের পর শব্দ বসিয়ে যখন এক দৃশ্যকল্পরূপে তাকে আমি পেতে চাইছি তখন হঠাৎ পাওয়া এই ছন্দ যেন এক সহায়।

এই কবিতায় আসলে কোনো যীশু নেই। অথবা আমরাই যীশু। অথবা রক্তাক্ত জন্মভূমি। জাতির বিপুল সম্ভাবনাময় স্বপ্নের বিশাল বিপর্যয়কে বর্ণনা করতে আর কী শব্দসরলতা কবি পাবেন? সেই স্বপ্নগুলো তো এখন কেবল এক অনুভূতি। যদিও এই অনুভূতির ভার বহন করা কঠিন। ছন্দ বা শব্দের কী সাধ্য?

তবে এক্ষেত্রে আমাকে আশকারা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কবিতায় ছন্দ মানতে গিয়ে যদি কান বিরক্ত হয় বা সঠিক ভাব ফুটে উঠতে বাধা পায় তাহলে ছন্দকে অবজ্ঞা করতে বাধা নেই।

কোনো কোনো পাঠক আছেন যারা কবিতা পাঠ শেষে নির্দিষ্ট একটা মেসেজ প্রত্যাশা করেন। আর কোনো কোনো কবিতায় তারা তা পান না। কিন্তু কবিতা পড়েন। ভালো লাগে। কেন? উত্তরটা এই প্রশ্নের ভেতরেই লুকোনো রয়েছে।

ছোট একটা কবিতা তুলে দিচ্ছি। পাঠক ইচ্ছেমতো শিরোনাম বসিয়ে নেবেন।

কফিনে ফুটেছে সাঁঝতারা

বিছানায় অজানা জ্ঞান

টর্চের আলোয়

স্তব্ধ

এই কবিতায় কী বিষয় আছে? আমার ধারণা, কবিতার যারা নিয়মিত পাঠক তারা এখানে কোনো বিষয় খুঁজতে যাবেন না। কবিতায় নির্দিষ্ট এক বা একাধিক বিষয় কেন থাকতেই হবে? এই ফতোয়া কে দিয়েছে যে নির্দিষ্ট বিষয়ের সংস্থান রেখে কবিকে কবিতা লিখতে হবে?

কবিতাটি পাঠের পর চেতনার প্রকৃতি অনুযায়ী একেকজন পাঠক একেক ধরনের অনুভূতির অনুরণন চেতনায় উপভোগ করবেন। অথবা বলা যায় পাত্রভেদে এর প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হবে। আধুনিকতার মরচেধরা ক্যাননগুলো এখানে অনুপস্থিত।

কবি কি সর্বদা জানেন যে কী হতে যাচ্ছে বা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে? কবি কি সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা কোনো জীব? তিনি সেটুকুই বলবেন যেটুকু তিনি জানেন। তাহলে সাধারণের সঙ্গে তার পার্থক্য কী?

সোনালি ব-দ্বীপ

—মৃত্যু কী?

আমি বলব, জরুরি একটা কাজ

যদি তা তোমার নিজের হাতে থাকে।

চায়ের টেবিল

খবরের কাগজ

সবুজ ধানখেত

এই কবিতার প্রথম স্তবক, বলা যায়, যে কোনো সাধারণ মানুষের চিরন্তন জিজ্ঞাসা ও দ্বিধান্বিত অনুভব। কবিতার দ্বিতীয় অর্থাৎ শেষ স্তবকে কোনো সিদ্ধান্ত নেই। শেষ পর্যন্ত এই কবিতা থেকে কোনো বক্তব্যই পাওয়া যায় না। পাঠকের মনে হবে কবিতাটি অপূর্ণ। এক ধরনের অতৃপ্তি তার ভেতরে কাজ করবে। শেষ তিন লাইন প্রথম তিন লাইনকে রহস্যে জড়িয়ে ফেলেছে। এর থেকে পাঠকের মুক্তি নেই। হয় তো এই মুক্তিহীনতাই শিল্প।

জানি না আমার অবস্থা রুজেভিচের হয়েছিল কি না। পোল্যান্ডের কবি তাদেউশ রুজেভিচ। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষ আর জন্তু-জানোয়ারদের একইভাবে জবাই করা হয়’। এই বক্তব্যে কী বোঝায়? লাইনটা সময় এবং স্থান থেকে কবি তুলে এনেছেন। এখানে কোনো উত্তর নেই। আছে প্রশ্ন।

আমার উপরোক্ত কবিতার ছয়টি লাইন লেখার পর দীর্ঘদিন এই অবস্থায় পড়ে ছিল। মনে হয়েছিল আরও লিখতে হবে। কী লিখব? কী লিখব কী লিখব করে দগ্ধ হচ্ছিলাম। তারপর মনে হল, কেন, দায়িত্বটা কেন আমার ঘাড়েই চাপবে? পাঠকের সুযোগ কোথায়? কবিতার শেষ বলে কিছু আছে?

কবির যেখানে শেষ পাঠক সেখান থেকে শুরু করুন না!

শিশির আজম : শিক্ষক, কবি। জন্ম ২৭.১০.১৯৭৮; এলাঙ্গী, কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ আটটি।

 

+ posts

Read Previous

একজন মন্ত্রীর একদিন

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন- ৩য় সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *