অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৩, ২০২৪
২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৩, ২০২৪
২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফারহানা রহমান -
চিরবাউন্ডুলে কবি জ্যঁ আর্তুর র‌্যাঁবো

কাব্যপ্রেমিদের কাছে ফরাসি কবি আর্তুর  র‌্যাঁবো সবসময়ই একটি বিশেষ আগ্রহের  বিষয়। তাঁর কবিতার উচ্চমান, স্টাইলের নতুনত্ব এবং বহু বর্ণিল ও জীবনমুখিতা কবিতাগুলোকে খুব সহজেই সে সময়কার সাহিত্য সমাজের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে  পেরেছিল। তাঁর বিষাদময় প্রতীকী কবিতাগুলোর অভিনব ভাষা এবং নির্মাণশৈলী যুগের পর যুগ ধরে পাঠক সমাজের কাছে আকর্ষণীয়, বহুল পঠিত এবং অপরিসীম আগ্রহের বিষয় হয়ে রয়েছে। প্রেম, দর্শন, নিসর্গবোধ ও ব্যক্তিগত আবেগ মিলেমিশে গিয়ে তাঁর কবিতাকে এক উচ্চপর্যায়ের শিল্পে পরিণত করেছে, যা পাঠককুলকে করেছে একইসাথে সন্তুষ্ট ও আকৃষ্ট। র‍্যাবোঁকে মনে করা হয় বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে নন্দিত ও নিন্দিত কবিদের একজন। তাঁকে তৎকালীন ফরাসি সাহিত্য চিহ্নিত করেছিল, ‘নাস্তিক দার্শনিক ও চিরকালের অভিশপ্ত আত্মা’ হিসেবে। ফলে তাঁকে যেমন অনেকেই একদিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তেমনি ওর ডাকে সাড়া দিয়েছেন দুনিয়ার বহু বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকগণ। আর সে কারণেই ওঁর রয়েছে পৃথিবীব্যাপী অগুনিত ভক্তপাঠক। কবি র‌্যাঁবো নামটি উচ্চারিত হয় ঊনবিংশ শতকের অন্যান্য  স্বনামধন্য ফরাসি কবি আলফানস ডি লামারটিন, ভিক্টর হুগো, শার্ল  বোদলিয়ার, পল ভ্যালেরি এবং স্টেফান মালারমের সঙ্গে।

১৮৫৪ সালের ২০ অক্টোরর বেলজিয়ামের সীমান্তের কাছে মেজ নদীর তীরে, ফ্রান্সের আরদেন অঞ্চলের শার্লভিল শহরে জঁ নিকোলা আর্তুর র‌্যাঁবোর জন্ম হয়।  শিশু বয়স থেকেই মার চাপিয়ে দেওয়া নানা নিয়ম-কানুন এবং  ধর্মের অনুশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন র‌্যাঁবো। আর সেখান থেকেই তিনি সঞ্চিত করেন বিষাদের শক্তি। ফলে চরম বৈরী পরিবেশেই একেবারে কিশোর বয়সেই তার কবিতায় ফুটে উঠেছিল এক অভিনব স্বর। আবিষ্কৃত হয়েছিল কবিতার নতুন মাত্রা, নতুন পথ, নতুন ধ্যান-ধারণা। তাঁর গভীর ধ্যানমগ্ন, দুর্দান্ত স্বেচ্ছাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ত সব কবিতাগুলোই লেখকপাঠক সমাজে তাঁকে করে তুলেছিল একেবারে অনন্য সাধারণ এক ব্যতিক্রমধর্মী কবি।

১৮৭০ সালের মার্চ মাসে এই ষোল বছর বয়সী কিশোর লিখে ফেললেন Sensation বা সংবেদন নামের এক  দুর্দান্ত কবিতা। ২৪ মে ১৮৭০ সালে এই কবিতাটির কথা উল্লেখ করে থিয়োদর দ্য বোঁভিলকে একটি চিঠি লেখেন র‌্যাঁবো। তিনি লেখেন—

প্রিয় অধ্যাপক,

আমরা কিন্তু প্রেমের মাসগুলো অতিবাহিত করছি। আর এখন আমার বয়সও সতেরো হলো। এটাই তো আশা-নিরাশায় দোলার বয়স! সবাই বলে এ বয়সী বাচ্চারাই অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। আর আমি তো সেই বয়সেই পড়েছি। এই যে কবি হওয়ার জন্য আমার এই আশা, আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস ও অনুভূতি, তা যদি আপনার বিরক্তির কারণ হয়ে থাকে, তবে আমি সত্যি বলছি, আমি খুবই দুঃখিত। কিন্তু একেই আমি বলি বসন্তের ছোঁয়া!

আমার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই আপনাকে কিছু কবিতার পঙক্তি পাঠাচ্ছি, আমার ভেতরের কবিত্ব থেকেই। আমি সব কবিদেরকেই খুব ভালোবাসি। যেহেতু তাঁরা সৌন্দর্যের অনুরাগী ফলে তাঁদের মধ্যে স্বভাবতই কবিত্ব রয়েছে। ল্যামির( কবি ও প্রকাশক) একজন ভালো প্রকাশক এবং আপনি নিজেই একজন কলাদেবীর বরপুত্র সৌন্দর্যের পূজারী। আপনি হচ্ছে ১৮৩০ এর সেরা কবিদের কবি। রোম্যান্টিক কবি। আর এজন্যই আমি আপনার অন্ধ ভক্ত। জানি বোকার মতো শুনাচ্ছে, তবু বলবো সত্যি বলছি…

আগামী এক-দুই বছরের মধ্যেই আমিও প্যারিসের সৌন্দর্যের (পারনিসিয়ান) কবি হয়ে উঠবো। আমি এখনও ঠিক জানি না আমার ভেতর ঠিক কি চলছে। উদ্গীরণের সাথে কি বেরিয়ে আসতে চায়। আমার ভেতর যে শৈল্পিক অনুপ্রেরণার উৎস রয়েছে কথা দিচ্ছি হে, প্রিয় অধ্যাপক! আমি সবসময় তার পূজা করবো। আমার এই জীবনে আমি শুধুমাত্র দুইটি দেবীর পূজাই করবো। আর তারা হচ্ছে স্বাধীনতা ও সৌন্দর্যের তীব্র আকাঙ্ক্ষা!

দয়া করে আমার কবিতা পড়ে মুখ ভেংচাবেন না। আমাকে আশাহত না করে বরং উৎসাহিত করুন। প্রিয় অধ্যাপক দয়া করে প্যারির সৌন্দর্যের পূজারী কবিদের মধ্যে আমাকে একটু জায়গা করে দিন। আমি আসলেই পারনিসিয়ান কবিদের ভেতর নতুন একজন সদস্য হতে চাই। আমি হতে চাই তাঁদের গর্বের বস্তু। আহ! কী ভীষণ উচ্চাকাঙ্ক্ষ! কী ভীষণ পাগলামি!

ইতি

আর্তুর র‌্যাঁবো।

গ্রীষ্মের নীলাভ সন্ধ্যায় হাঁটবো আমি মেঠো পথ ধরে,

ভুট্টাক্ষেত পায়ে দেবে সুড়সুড়ি, কচিকচি ঘাসের ওপরে,

পায়ে লাগবে সতেজ পরশের অনুভব স্বপ্নের ভেতর;

শীতল বাতাস বয়ে যাবে খোলা চুলের ওপর

নিরবতা মেনে নেবো, করবো না চিন্তাভাবনা আর

শুধু ঐশ্বরিক প্রেম ভরে রবে হৃদয়ে আমার

দূরে বহুদুরে গ্রামে, ভ্রমণে বেড়িয়ে যাবো ভবঘুরে হয়ে

প্রেমিকা আমার সুখেদুখে পাশে রবে হৃদয়ে, ঈশ্বরী হয়ে!’

(সংবেদন ।। ২০ এপ্রিল, ১৮৭০/ অনুবাদক- ফারহানা রহমান)

২.

দু’ভাই আর দু’বোনের মধ্যে র‌্যাঁবো ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। তার চেয়ে এক বছরের বড়  ছিল ভাই ফ্রেদেরিক ও ছোট দু’বোন। তৃতীয় বোন ভিতালীর জন্ম ১৮৫৮ সালে এবং সবচেয়ে ছোট বোন ইসাবেলার জন্ম ১৮৬০ সালে। র‌্যাঁবোর বাবা ফ্রেদেরিক র‌্যাঁবো ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। তিনি তাঁর  আর্মি ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরেই কাটিয়েছিলেন। ১৮৪৪ থেকে ১৮৫০ পর্যন্ত তিনি আলজেরিয়া জয়ের কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। এসময় তাঁর পারফরমেন্সের জন্য তাঁকে লেজেন্ড অব ওনার দেওয়া হয়। তিনি মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভদ্র এবং শান্ত স্বভাবের ছিলেন। তাঁর লম্বা বড় গোঁফের জন্য তিনি সবার কাছে বেশ জনপ্রিয়ও ছিলেন।  আর মা ভিতালী কুইফ ছিলেন ফ্রান্সের অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত আরডেইনাস পরিবারের মেয়ে। ক্যাপ্টেন বাবা ফ্রেদেরিক খুব অল্পদিন তাদের সাথে একসাথে ছিলেন। শুধুমাত্র অফিসিয়ালি ছুটির দিনগুলোতে তিনি তাঁর পরিবারের সাথে সময় কাটাতেন। যদিও বা সে সময়েও অত্যন্ত একগুয়ে স্বভাবের স্ত্রী ভিতালী কুইফের সাথে তাঁর মনোমালিন্য লেগেই থাকতো। ফলে ভীষণ ধার্মিক এবং দায়িত্বপরায়ণ, একগুয়ে নারী র‌্যাঁবোর মা ভিতালী কুইফের হাতে সন্তানদের দায়িত্ব তুলে দিয়ে তিনি ১৮৬০ সাথে স্থায়ীভাবে সংসার ত্যাগ করে চলে যান। তাদের মধ্যে কখনো  ডিভোর্স হয়নি কিন্তু তাঁরা দুজনেই চিরদিন বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করেছেন। এদিকে ধর্মপরায়ণ অথচ উচ্চাকাঙ্ক্ষী মা সহজ-সরল ছোট ছেলে র‌্যাঁবোর উপর তার সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা চাপিয়ে দিতে চাইলেন। ফলে সংসারত্যাগী পিতার মতোই বালক র‌্যাঁবোও  বারবার সুযোগ পেলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে লাগলেন।

এদিকে বালক র‌্যাঁবোর পড়াশোনায় কখনোই কিন্তু মন বসেনি অথচ ক্লাসে তিনি সবসময় প্রথম স্থানই দখল করতেন।  আর এই অনন্য মেধার অধিকারী বিস্ময় বালক একেবারে অল্প বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু  করেছিলেন। তিনি সর্বসাকুল্যে পাঁচ বছর লেখালেখিতে নিবেদিত ছিলেন। তাঁর বয়স যখন ১৬ তখন থেকে শুরু করে ২০ বছর হতে না হতেই লেখালেখির জগত থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে দাঁড়ান র‌্যাঁবো। ২১ বছর বয়সে এসে ঘোষণা দেন যে, তিনি যতটুকু লেখার লিখে ফেলেছেন। এরপর কোনো কিছু লেখা মানেই তা হবে কেবলই পুনরাবৃত্তি।  আর এই বিস্ময়কর প্রতিভাকেই বিদগ্ধ সব ফরাসি কবিরা কেউ কেউ বলেছেন, সে তো মানুষ নয় বরং একজন দানব। আবার কেউ কেউ বলেছেন, দানব নয় সে হচ্ছে একজন দেবদূত! ভবঘুরে জীবন থেকে শক্তি আহরণ করে তিনি যেভাবে একটি পরিপূরক জীবনবোধ গড়ে তুলেছিলেন তা থেকে রস সঞ্চয় করেই সৃষ্টি হয় তাঁর প্রথম সংকলন Posic. কুড়িটি কবিতা ছিল তাতে। আর এই কাব্য সংকলনটিতে রয়েছে ফরাসি কাব্যের সিম্বলিজম এবং স্যুরিয়ালিজমের ছাপ, যা ঊনিশ শতকের সাহিত্য ও শিল্পের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে এক নতুন আলোর ঝলকানি। অ্যাঁরি মিশো, আপ্লিনিয়ের, ক্লোফেল থেকে ককতোঁর নগ্ন কবিতা অথবা অডেন বা স্পেন্ডের কবিতার নতুন উন্মোচন। ফলে র‌্যাঁবোর কবিতা পাঠককে তার কল্পজগত ও বাস্তবের সীমারেখাকে এলোমেলো করে তাকে নিজে যায় অজানা রহস্যের কোনো এক জগতে। পাঠকের কাছে তখন সেই শিল্প হয়ে ওঠে তার নিজের প্রাচীনবোধ ও ধারণার প্রতি আক্রোশ ও বিদ্রোহের হুমকিস্বরূপ। আর ভেতরের সেই অস্থিরতাই র‌্যাঁবোকে দিয়ে সৃষ্টি করায় নানা বিচিত্র সব  চিত্রকল্প,–

বড় বড় জায়গার কেন্দ্রস্থলে আমরা বসাবো, পুজো করবো

বিশ্বনন্দিত গণিকালয় এবং

নির্দয়ভাবে হত্যা করবো সমস্ত যুক্তি বিদ্রোহ।

টক ঝাল গন্ধময় মদে মক্ত এই দেশ,

বিপুল শোষণ শিল্পে সেনায়।

(অনুবাদ- গৌতম গুহ রায়)

শব্দকে র‌্যাঁবো নির্মাণ করেছিলেন একান্তই নিজের শক্তি প্রয়োগে। তিনি কবিতার আবহ ও ধারণক্ষমতার  এতটাই বিস্তার ঘটালেন যে তা মনের সূক্ষ্ম অনুভূতির নিয়ন্ত্রণকে ছিঁড়ে বেরিয়ে গেলো। ১৮৭১ সালে তার লেখা “সাত  বছরের কবিরা” নামক কবিতায় তিনি তাঁর সে সময়ের মনোভাব ও বিদ্বেষ প্রকাশ করেন এভাবে,-

মা বাড়িতে পড়ালেখা করার বইটিকে বন্ধ করে

সন্তুষ্ট এবং গর্বিত ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেলেন,

অথচ তিনি একবারের জন্যেও তাকিয়ে দেখলেন না পর্যন্ত

তাঁর শিশুটির  কুঁচকানো কপালের নিচের

নীল চোখগুলোতে তাঁর প্রতি ঘৃণায় ভরে ওঠা আত্মাটিকে…”

র‌্যাঁবো সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে হেনরি মিলার বলেছিলেন, ‘র‌্যাঁবো আমার কাছে একজন পার এক্সেলেন্স ক্রমবিবর্তনবাদ কবি। এই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে র‌্যাঁবো তাঁর প্রথম অর্ধেকটা জীবন অতিক্রম করেন। এটি পরবর্তী অর্ধেকাংশের জীবনের তুলনায় বিস্ময়কর। আমরা এই অংশের র‌্যাঁবো সম্পর্কে ততটা সচেতন নই, যখন তিনি পরবর্তী অংশে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আর এই বিরাট বিবর্তনের সামনে এসে তিনি দিগন্তসীমার নিচে ছিলেন। এইসব মানুষ সবসময় যুদ্ধ জারি রাখেন।  মনে হয় এই পৃথিবীতে তাঁদের জন্ম হয়েছে তাঁদের  স্বভাবের সবচাইতে গূঢ় কিছু তত্ত্ব প্রকাশ করার যুদ্ধ জারি রাখার জন্যই। এরা সময়ের দেহের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে থাকেন, জুড়ে থাকেন সেইসব সমস্যার সঙ্গে যারা তাঁদের সময়ের সঙ্গে এঁটে থাকেন, সময় সতত পরিবর্তনশীল ও অনুঘটক।’

১৮৬২ সালে আট বছর বয়সে র‌্যাঁবোকে রসেট (Rossat) ইনস্টিটিউটে ভর্তি করে দেওয়া হয়। তিনি পড়ালেখায় এতোটাই মনোযোগী ছিলেন যে তাকে স্কুল থেকে ১৮৬৬ সালে ডবল প্রমোশন দেওয়া হয়। ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানেই অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পড়ালেখা করেছিলেন। স্কুলজীবনে তিনি ছিলেন শান্ত-শিষ্ট ঈশ্বরভীরু এক পড়ুয়া বালক। এসময় তিনি বাইবেলের পাশাপাশি পড়েছেন জেমস ফেমিমোর, কুপার এবং গুস্তাভ আইমারডের লেখা গল্পগুলো। পরবর্তীতে বোদলেয়ার, মুসে এবং লুসের  কবিতাসহ আরও অসংখ্য কবিদের কবিতা তার পাঠের অন্তর্গত ছিল। শিক্ষকরা তার প্রতিভা  দেখে সবসময়ই বিস্মিত হতেন। আর সেই অল্প বয়সেই তিনি ফরাসি, ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায় বেশকিছু কবিতাও লিখে ফেলেছিলেন।  মাত্র তেরো বছর বয়সে তিনি ল্যাটিন ভাষায় লিখলেন ষাট পঙক্তির একটি কবিতা এবং তা পাঠিয়ে দেন সম্রাট ৩য় নেপোলিয়ানের ছোট ছেলের কাছে। তবে সেই কবিতার কোনো অনুলিপি পাওয়া যায়নি।

পড়ালেখায় ভালো ফলাফলের জন্য তার স্কুলজীবনে র‌্যাঁবো অনেকগুলো পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তার কবি জীবন ছিল সর্বসাকুল্যে ১৮৭০-৭৪ এই চার বছর। এই কবি জীবন অতিবাহিতকালীন সময়ে ১৮৭০-৭২  সালকেই মনে করা হয় তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে। এ সময় তিনি Sensation বা সংবেদন, Roman বা প্রেমাভিযান, Ma Bohime বা ফ্যান্টাসির মতো কবিতা লিখে ফেলেছেন। ইতোমধ্যে ভেরলেনকে পাঠিয়েছেন বেশকিছু কবিতা, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উন্মাদ তরণী বা Le Batemiire.  ভেরলেন র‌্যাঁবোর কবিতা পড়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন। এবং এসব কবিতা প্যারির তৎকালীন তরুণ কবিদেরকে পড়তে দেন। তরুণ কবি ফিলিপে বাতি, শারল ব্রুস ও লিও ভালদো, র‌্যাঁবোর কবিতা পড়ে চমকে ওঠেন। তাঁরা শার্লভিলের তরুণ কবি র‌্যাঁবোকে প্যারিতে আসার আমন্ত্রণ জানান। সেইসঙ্গে ট্রেনের টিকেটের টাকাও পাঠিয়ে দেন। আমন্ত্রণ পেয়ে ১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে র‌্যাঁবো প্যারিতে এসে উপস্থিত হন। স্টেশনে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে আসেন প্যারির তরুণ কবিরা। অথচ তাঁরা কেউ কাউকে চিনতে পারেন না। ফলে ঠিকানা ধরে র‌্যাঁবো একা একাই হেঁটে চলে এলেন ভেরলেনের শ্বশুরবাড়িতে। উস্কোখুস্কো, নোংরা, ছেঁড়া কাপড় পরা র‌্যাঁবোকে দেখে চমকে উঠলেন ভেরলেনের স্ত্রী মতিলকে।

৩.

 তার পাঁচ বছরের কবি জীবনের অনেক কবিতাই লেখা হয়েছে ১৮৭০ সালটিতে।  এসময় তিনি ল্যাটিন ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং ল্যাটিন ভাষায় কবিতা লেখা শুরু করেন। প্রিয় শিক্ষক জর্জ ইযামবার র‌্যাঁবোর সাথে ভিক্টর হুগো, বভিল সহ অন্যান্য বিখ্যাত সব ফরাসি  সাহিত্যিকদের সাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ১৮৭০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম তার ল্যাটিন ভাষায় লেখা কবিতা প্রকাশিত হয় এবং কবিতাটির জন্য তিনি স্কুল থেকে পুরস্কার পান। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন হতে থাকে। ধীরে ধীরে তার মধ্যে বিদ্রোহের রূপটি প্রকট হয়। সেই বিদ্রোহ প্রথমে ঘোষিত হয় সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়ম-কানুনের বিরুদ্ধে।

১৮৭৩ সালে লেখা ‘নরকে এক ঋতু” কাব্যগ্রন্থে তাঁর সেই বিদ্রোহী মনোভাবেরই প্রকাশ পেয়েছে–

“নরকে এক ঋতু” থেকে কয়েকটি লাইন পড়লেই বোঝা যাবে কবির সেই সময়ের মনোভাব কেমন ছিল–

এটাই সত্যি যে খানিকক্ষণ আগপর্যন্ত আমার জীবনটি ছিল একটি দীর্ঘ উৎসবমুখর জীবন

সেই প্রশস্ত গভীর হৃদয়ে বয়ে যেত শরাবের নহর।

এমনই একরাতেই তো আমি বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম জগতের সমস্ত সৌন্দর্যকে

আর এখন আমি আমার জীবনের উপর ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠেছি

আর সেইসব ন্যাকান্যাকা সৌন্দর্যকে এখন আমি নিকুচি করি

নিজেকে সদা প্রস্তুত রেখেছিলাম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করব বলে

কিন্তু হায় শেষ রক্ষা হলো না, আমি সব ছেড়ে ছুড়ে ভেগে গেলাম

হায়রে ছলনাময়ী! হায়রে দুঃখদুর্দশাগ্রস্ত এই জীবন!

হায় কী বিদ্বেষ ভারাক্রান্ত এই মন! আমার সমস্ত সহায়সম্পত্তি তোমার হাতেই গচ্ছিত করে গেলাম।

আর এখন আমি আমার মন থেকে আমি আমার সকল মানবিক আশা আকাঙ্ক্ষা

মুছে ফেলতে পেরেছি

হিংস্র প্রাণির মতো আমি আমার সমস্ত আনন্দ উল্লাসকে ছোবল মেরে গলাটিপে মেরেছি।

আমি জল্লাদদের ডেকেছিলাম যাতে মরার সময় আমি তাদের বন্দুকের বাঁট কামড়ে ধরতে পারি

আমি মহামারীদের ডেকেছিলাম আমাকে ধুলোয় আর রক্তের বন্যায় মিশিয়ে দেয়ার জন্য।

দুর্ভাগ্যই আমার ঈশ্বর। আমি কাঁদায় লুটোপুটি খেয়ে চলেছি।

শরীর শুকিয়েছি অপরাধের নিঃশ্বাসে। আর মশকরা করেছি উন্মত্ততার সাথে।

এবং এই সুন্দর বসন্তকাল নির্বোধের মতো

ভয়াবহ হয়ে ভেংচি মারা হাসিটিকে উপহার দিয়েছিল আমাকে।

অতঃপর, খুব সম্প্রতি যখন নিজেকে শেষ চিৎকারের ভেতর আবিষ্কার করলাম!

এটি আমাকে আবারো সেই প্রাচীন উৎসবের চাবি খুঁজে নিতে উদ্বুদ্ধ করলো

যেখানে আমি আরও একবার আমার ক্ষুধাকে ফিরে পেতে পারি।

পরোপকার হলো সেই চাবি।

আর এই অনুপ্রেরণাই প্রমাণ করে যে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম!”

(নরকে এক ঋতু/ অনুবাদ- ফারহানা রহমান)

৪.

এদিকে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই অর্থাৎ ১৮৭০ সাল থেকেই র‌্যাঁবোর বাড়ি থেকে পালানো শুরু হয়। আর এই ১৬ বছর বয়সেই কবিতাতে তার নিজস্ব একটি স্বরও ফুটে ওঠে। একেবারেই তার নিজের ভাষা যার সাথে অন্য কোনো কবির কবিতার ভাষার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তার  উঠতি বয়সের আশা-আকাঙ্ক্ষা, হতাশা, স্বাধীনতার প্রতি তার একাগ্র মনোভাব এসব কিছুই ফুটে ওঠে কবিতাগুলোর মধ্যে। ১৮৭০ সালের জুলাই মাসে যখন ফ্রান্স আর জার্মানির মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে সে সময় র‌্যাঁবো রাজনীতির ব্যাপারে হঠাৎ করেই খুব উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ওই সময় স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াতে র‌্যাঁবোর স্কুলকেন্দ্রিক ফরমাল পড়ালেখাও জীবনের মতো শেষ হয়ে যায়। এবছরের আগস্ট মাসে প্রথম তিনি নিজ শহর শার্লভিল থেকে বিনা টিকেতে ট্রেনে করে প্যারিসে চলে আসেন। স্টেশনে নামামাত্রই স্থানীয় পুলিশ র‌্যাঁবোকে গ্রেফতার করে মাজাসের কারাগারে আটকে রাখে।  সেখান থেকে তার প্রিয় শিক্ষক ইযামবার তাকে উদ্ধার করে বাড়ি পৌঁছে দেন, কিন্তু দেখা যায় মাত্র একমাস পরেই তিনি আবারো পালিয়ে যান বেলজিয়ামের দিকে। বাড়িতে থাকা অবস্থায় র‌্যাঁবো এতোটাই অস্থির হয়ে ওঠেন যে, তিনি এসময় তার শিক্ষক জর্জ ইযামবারকে লেখা একটি চিঠিতে নিজের অবস্থা এভাবে উল্লেখ করেন,-

“দেখুন এভাবেই আপনাকে দেওয়া আমি আমার কথা রেখেছি। কিন্তু এভাবে প্রতি মুহূর্তে আমার শুধু মৃত্যুই হচ্ছে। এই জীবন আমাকে বিকারগ্রস্ত করে ফেলছে। কারণ এটি একেবারেই অতি সাধারণ, আটপৌরে এই বিচ্ছিরি জীবন। এই একঘেয়েমি জীবন আমাকে রীতিমতো পাগল বানিয়ে ফেলেছে। আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে হয়ে উঠছি। আপনি জানেন যে, আমি কত একগুয়ে একজন মানুষ। আমি ভয়ংকরভাবে স্বাধীনতাকে ভালোবাসি। আমার এই জীবনে স্বাধীনতাই সবকিছু। চারপাশে যা কিছু ঘটছে তা দেখলে আমার ঘৃণা হয়। আমি ঘর ছেড়ে আজকেই বেরিয়ে পড়তে চাই। আর সেটা আজই। আমার যদি কিছু নতুন কাপড় থাকতো তাহলে আমার ঘড়িটাকেই বিক্রি করে দিয়ে এখনই পালিয়ে যেতাম। জয় হোক স্বাধীনতার!”

(চিঠির অনুবাদ- ফারহানা রহমান)

৫.

এরপর তিনি সত্যি সত্যি ঘর ছেড়ে পালালেন। প্রথমে শারলরোয়াতে কিছুদিন থেকে র‌্যাঁবো সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে বেশ কিছু কবিতা লিখে ফেলেন এবং পরে আবার ব্রাসেলসে ফিরে যান। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পুলিশের সহায়তা নিয়ে মা তাকে নিজ শহর শার্লভিলে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু ১৮৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আবারো পালিয়ে যান প্যারিসে। এসময় তিনি কপর্দকহীন অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান, পত্রপত্রিকা পড়েন ও ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খান।  অসহনীয় দারিদ্র্যের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে সে বছরের মার্চ মাসেই তিনি আবারো  শারলভিলের দিকে পায়ে হেঁটে রওয়ানা দেন। এসময় সে খুব মনোযোগ দিয়ে লাইব্রেব্রিতে পড়ালেখা শুরু করেন। তিনি এবার বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও সমাজতন্ত্রীদের রচনাবলীর সাথে পরিচিত হন এবং আরদেন উন্নয়ন নামক পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু এপ্রিলে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে আবারো তিনি প্যারিসের পথে যাত্রা করেন। র‌্যাঁবোর জীবন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তার দূষিত রক্ত কবিতাটির বর্ণনার মাধ্যমে কিছুটা বোঝা যায়,-

“কোনো রকম পেশার কথা শুনলেই আমার গা গোলায়। মালিক বা শ্রমিক, সবাই গ্রাম্য, নীচ। যে হাত কলম ধরে আর যে হাত লাঙল চালায়– এ দুয়েরই সমান দাম। এ শতাব্দীতে দেখি হাতই সবকিছু, কী দারুণ এক হাতের শতাব্দী এটা। আমার কখনই  হাত থাকবে না। এরপর চাকর বাকরের ওপর অতি নির্ভরতার কারণে আমরা নানা জটিল ঝামেলায় জড়িয়ে যাই। ভিক্ষাবৃত্তির সততা আমাকে কষ্ট দেয়। দুষ্কৃতকারী আর ছিন্নমুস্ক নপুংসক এই দুজনকে দেখলেই আমার বমি পায়। আমি, আমি এখনো অক্ষত আছি এবং এতে আমার কিছু যায় আসে না।”

(দূষিত রক্ত/অনুবাদ- শিশির ভট্টাচার্য)

র‌্যাঁবো একটি কথা স্পষ্ট করেই বলে গেছেন যে, “কবিতা লেখা হয়, লেখা যায় না। কবিরা কবিতা লেখেন না বরং কবিকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে কাব্য রচিত হয়। কবি মাত্রই জন্মগতভাবে কবি, জোর করে কবি হওয়া যায় না।”

 র‌্যাঁবো মনে করতেন কবিরা হচ্ছে মিস্টিক বা বাউল, যারা নিজের মন ও শরীরকে  ব্যবহার করে অজানার সন্ধান করেন এবং অনির্বচনীয় জগতের সন্ধান পাবার পর সেই জগতের বিভিন্ন দিক সাধারণ মানুষের কাছে বর্ণনা করার চেষ্টা করেন। প্রচলিত ভাষার শব্দ ও বাক্য যেহেতু অনির্বচনীয় জগতের বর্ণনা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, তাই কবিরা উপমার আশ্রয় নেন। তবে শুধু উপমাই কবিতা নয়। উপমা অবশ্যই কবিতার অন্যতম উপাদান তবে উপমা, ছন্দ ও কবির অভিজ্ঞতা সব কিছু মিলিয়েই একটি কবিতা সৃষ্টি হয়। বাস্তব জগত থেকে কবির আবিষ্কৃত জগত যত বেশি আলাদা হয়, উপমার দুর্বোধ্যতা ততই বাড়তে থাকে আর কবিতায় চলে আসে পরাবাস্তবতা।

৬.

আর্তুর র‌্যাঁবো প্রকৃতপক্ষেই লিখেছেন একেবারেই কম সংখ্যক কবিতা। সবমিলিয়ে তার মাত্র আশিটির মতো কবিতার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। ১৮৭০–১৮৭৪ এই পাঁচ বছর মাত্র তার কাব্যজীবন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম লেখা শুরু আর প্রথমদিকে তিনি অন্য আর সব কবিদের মতোই অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতা লেখা শুরু করেন। শেষ দু’বছর তিনি কাব্যময় গদ্যরচনা করেছিলেন। তিনি যে পাঁচ বছর কবিতা রচনা করেছেন সেসময় তার নিজের কবিতার মান নিয়ে তিনি খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। র‌্যাঁবো মনে করতেন তার কবিতার যে স্টাইল ও নতুনত্ব সেটি একেবারেই অনন্য। কবিতার উচ্চমান নিয়ে তার ভেতরের আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া মাত্রই তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য দূর দেশে পাড়ি দেন। গবেষক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে দোকানের কর্মচারী, হস্তীশিকারী, অস্ত্র বিক্রেতা ইত্যাদি হেন পেশা নেই যে, তিনি অর্থ উপার্জন করার জন্য নেননি। তবে আশ্চর্যজনকভাবে পরবর্তীতে তিনি তার কবি জীবন নিয়েই শুধুমাত্র লজ্জিত হয়েছিলেন। কিশোর বয়সের কবিতাগুলো নিয়ে তিনি প্রায়ই হাসিঠাট্টা করতেন।

 ১৮৭৩ সালে “নরকের ঋতু” আর ১৮৭৪ সালে  “বোধি” নামক দুটি চমৎকার পরাবাস্তব গদ্যকাব্য রচনা করেন তিনি। স্বাধীনতার পূজারী, চিরবাউন্ডুলে, খ্যাপাটে স্বভাবের বিদ্রোহী এক মন নিয়ে বেড়ে ওঠা আর্তুরের কাছে নিজের লেখা পাণ্ডুলিপিগুলো একবার পড়েই ছিঁড়ে ফেলা বা ফেলে দেওয়াটা একটা খেলায় পরিণত হয়েছিলো। আর তাই তার যেটুকু রচনা তিনি নষ্ট করার সুযোগ করে উঠতে পারেননি শুধু সেটুকুই পাঠক পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে কবিতা লেখা ছেড়ে দেওয়ার যুক্তি হিসেবে তিনি সাফাই দিলেন এই বলে যে, নরকে এক ঋতু লেখার পর তার আসলে আর নতুন কিছু লিখার বাকি ছিল না। তিনি যা কিছু কবিতায় বলতে চেয়েছিলেন অর্থাৎ স্বর্গ-নরক অথবা ঘুম আর নির্ঘুমতা তার সবকিছুই এখানে তিনি বলে ফেলেছেন। আর কখনো কবিতা লেখেননি। তবে ছাড়েননি পথচলা আর বাউন্ডুলেপনা। বহু দেশ ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর বেশিরভাগই তাও আবার পায়ে হেঁটে। আজন্ম অস্থির ও পরিব্রাজক র‌্যাঁবো কোথাও বেশিদিন স্থির হয়ে কাটাতে পারতেন না।

৭.

১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কবি পল ভারলেন (Paul Verlaine) তাকে প্যারিসে আসার আমন্ত্রণ জানান। আর তখন থেকেই শুরু হয় ভারলেনের সাথে র‌্যাঁবোর রহস্যময় সেই কিংবদন্তি প্রেমের। ১৮৭২ সালের পুরোটি বছর দু’বন্ধু মিলে প্যারিসের ক্যাফেগুলো চষে বেড়ান আর ঘুরে বেড়ান ইউরোপে মহাদেশের বহু শহর গ্রাম আর অলিগলি। র‌্যাঁবোর সাথে ভারলিনের মাত্রাতিরিক্ত সম্পৃক্তায় ভারলিনের স্ত্রী মাতিলদে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ফলে এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের কথাবার্তা  চলতে থাকে। ১৮৭২ সালের জুলাই মাসে মাথিলদে অসুস্থ হয়ে পড়লে ভারলিন স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনতে রাস্তায় বের হন এবং সেসময় র‌্যাঁবোর সাথে আবারো দেখা হয়ে গেলে তিনি ঘরসংসার সবকিছু ত্যাগ করে র‌্যাঁবোর সাথে ব্রাসেলস এ পালিয়ে যান।   কয়েক মাস বেলজিয়ামে অবস্থান করে সেপ্টেম্বরে দু’বন্ধু মিলে লন্ডনে এসে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। এসময় তাঁরা ইংরেজদের কাছ থেকে ইংরেজি ভাষা শিখতে  চেষ্টা করেন এবং তার পরিবর্তে তাদের ফরাসি ভাষা শেখান। নভেম্বরের দিকে আর্থিক অবস্থার চরম অবনতি হোলে র‌্যাঁবো শারলভিলে ফিরে আসেন। কিন্তু ভারলিন লন্ডনেই থেকে যান। ১৮৭৩ সালের মে-জুলাই মাসের দিকে দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। ফলে র‌্যাঁবো ব্রাসেলস ছেড়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। আর এ সময়ই ভারলেন র‌্যাঁবোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পেরে তাকে গুলি করেন। যদিও র‌্যাঁবো শুধুমাত্র  হাতেই সামান্য কিছুটা আঘাত পেয়েছিলেন। কিন্তু ভারলেনকে এই অপরাধের জন্যই দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। জুলাইয়ের শেষের দিকে র‌্যাঁবো তার বিখ্যাত কাব্য “নরকের এক ঋতু” এর কাজ শেষ করেন। অক্টোবরে লেখাটি বাজারে মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়। এরপরের কয়েক বছর র‌্যাবো একা একাই সারা দুনিয়া চষে বেড়ান। ১৮৭৪ সালে প্রথমে আসেন লন্ডন। এখানে তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে পড়ালেখা চালিয়ে যান এবং ইলিউমিনিশন বা ‘বোধি’ কাব্যটি সমাপ্ত করেন।–

বোধিঃ মহাপ্লাবনের পরে

মহাপ্লাবনের ধারণাটি যখন নিজেই বসে গেল,

তখন চারণভূমির ঘাস আর দোদুল্যমান ঘণ্টার ভিতরে থেমে গেল এক খরগোশ এবং এরপর খরগোশটি মাকড়সার জালের ভেতর দিয়ে রঙধনুর কাছে প্রার্থনা শুরু করলো।

আহা! কতো কতো মণিমুক্তা লুকিয়েছিল সেখানে,– কতো কতো ফুল তখনি চোখ মেলে তাকাতে শুরু করেছিল।

যে বড় রাস্তাটি খুব নোংরা সেখানে সব পণ্যের পসরা বসানো হচ্ছিল, আর খোদাইচিত্রে যেমনটি দেখা যায়, তেমনি করে উপরে বহুতল সমুদ্রের দিকে গুন টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল জাহাজগুলোকে। …………………………………

কারণ যখন থেকে ওরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে,– সব পালাতে থাকা মণিমুক্তা আর পাপড়ি খুলে থাকা সব ফুল!—এটা খুবই বিরক্তকর। এছাড়া রানি, সেই ডাইনি যে কিনা মাটির হাঁড়িতে কয়লার আগুন দিচ্ছে, সে কখনই আমাদের বলবে না সে কী কী জানে আর আমরা কী কী জানি না।

(জানুয়ারিমার্চ, ১৮৭৪/ অনুবাদশিশির ভট্টাচার্য)

বছরের শেষের দিকে তিনি হুজুগের বসে পিয়ানো বাজানো শিখতে শুরু করেন।

৮.

১৮৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম থেকেই তিনি জার্মানির স্টুটগারডে জার্মানি ভাষা শেখার জন্য বসবাস শুরু করেন। এসময় তিনি পায়ে হেঁটে সুইজারল্যান্ড ও আল্পস পর্বতমালা অতিক্রম করে ইতালিতে ঢোকেন। ইতালির মিলান শহরে এসে র‌্যাঁবো ভীষণ  অসুস্থ হয়ে পড়েন। জুনের দিকে কিছুটা সুস্থ হলে স্প্যানিশ ভাষা শেখার উদ্দেশ্যে স্পেনে চলে যান। এরপর স্পেন থেকে প্যারিস হয়ে অস্ট্রিয়ায় যান। ১৮৭৬ সালের এপ্রিল মাসে ভিয়েনা পৌঁছানোর সাথে সাথে অস্ট্রিয়ান পুলিশ তাকে ভিয়েনা থেকে বের করে দেয়। এসময় তিনি পুরো দক্ষিণ জার্মান অঞ্চল পায়ে হেঁটে ফ্রান্সে এসে পৌঁছান। সে বছরের মে মাসের দিকে হল্যান্ডের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে জুলাই মাসে ইন্দোনেশিয়ার জাভায় এসে পৌঁছান। সেখান থেকে মাত্র তিন সপ্তাহ পরে পালিয়ে গিয়ে আবারও ইউরোপে ফিরে আসেন। ফিরে আসার ভাড়া না থাকায় জাহাজের খালাসীর কাজ করে ভাড়া পরিশোধ করেন। ১৮৭৭ সালে সুইডেন ও ডেনমার্ক ভ্রমণ করেন সার্কাস দলের সাথে। সে বছর মে মাসে আমেরিকান কনস্যুলেটে গিয়ে আমেরিকান নেভিতে চাকরির দরখাস্ত করেন। সেপ্টেম্বরে আসেন ফ্রান্সের মার্সেই শহরে। কিছুদিন পর আবার রোমে চলে যান। ১৮৭৮ সালে সুইজারল্যান্ড হয়ে মিলান তারপর জাহাজে করে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছান। সেখান থেকে সাইপ্রাসে যান বাড়ি তৈরির ঠিকাদারি করার জন্য। এরপর ১৮৮০ সালের মার্চ মাসে সাইপ্রাসে এসে ট্রুডো পাহাড়ের চূড়ায় ইংরেজ গভর্নর জেনারেলের বাড়ি তৈরির কাজের সুপারভাইজার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানেও বনিবনা হয় না। ফলে লোহিত সাগরের বিভিন্ন বন্দরের দিকে রওয়ানা হন এবং জেদ্দা, সুয়াকিম, মাসাউয়া, হোদেইদা ইত্যাদি জায়গায় কাজের সন্ধানে ঘুরতে থাকেন। এ সময় মারেজান নামক এক কোম্পানিতে কাজ নিয়ে এডেন বন্দরে আসেন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হয়ে জেলিয়া বন্দর থেকে এক তি কারাভানের সাথে সমালিয়ার মরুভূমিসহ ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তিনি ডিসেম্বরে ইথিওপিয়ার হায়ার শহরে এসে পৌঁছান।

৯.

১৮৮৬ সালের অক্টোবর মাসে রাজা মেনেলিকের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন তিনি। সেই চুক্তি অনুযায়ী ২ হাজার বন্দুক, ৭৫ হাজার কার্তুজের একটি চালান, ৩০টি উট আর ৩৪ জন চালক ও একজন দোভাষী নিয়ে শোয়ার রাজধানী আনকোবারের পথে রওয়ানা হন। চার মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভ্রমণের পর গিয়ে পৌঁছান আনকোবারে। ওখানে গিয়ে জানতে পারলেন যে রাজা মেনেলিক অন্য কোথাও যুদ্ধ করতে চলে গেছে। কবে ফিরবেন অথবা আদৌ ফিরবেন কি না কেউ জানে না। ফলে চালানের সমস্ত টাকা লোকসান হতে একপ্রকার পথে বসলেন র‌্যাঁবো। মানসিক অবসাদগ্রস্ত র‌্যাঁবো ১৮৮৭ সালের শেষের দিকে বাম হাঁটু এবং উরুতে ভীষণ ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। এদিকে কিছুটা সুস্থ হতেই ১৮৮৮ সালের মার্চ মাসে তিনি অস্ত্রের গোপন চালান নিয়ে অম্বাদু রওনা হলেন। ঘোড়ার পিঠে করে ১১ দিনে ৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে অম্বাদু পৌঁছান। ওখান থেকে চলে আসেন ওবোকো শহরে। এরপর ৮৮ সালের মে মাসে তিনি অস্ত্রের ব্যবসা পুরোপুরি ছেড়ে দেন। অতপর হারারে পৌঁছে নিজের টাকায় একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান খোলেন।

পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে র‌্যাঁবোর কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তার বোন ইজাবেল লিখেছেন,

“আর্তুর যখন খুব ছোট ছিল, তখন সে শুধু মজা করার জন্য লিখতো। ওর বয়স যখন দশ হয়েছে, কি হয়নি তখন (আরদেনের বাড়িতে) দীর্ঘ সন্ধ্যা কাটতো আমাদের আর্তুরের লেখা অজানা দেশে দারুণ সব কাল্পনিক ভ্রমণের বিবরণ শুনে। মরুভূমি আর মহাসাগর, পর্বতমালা আর নদীনালার মাঝে ছিল সেই সব দেশ। এ ধরনের ভ্রমণকাহিনি লেখা ছিল স্বাভাবিকভাবেই তার বাচ্চা বয়সের একটি খেলা। পড়া হয়ে যাবার পর আর্তুর তার পাণ্ডুলিপিগুলো ছিঁড়ে ফেলতো এবং ফেলে দিতো। পড়ে যেসব লেখা সে লিখেছে পনের থেকে আঠারো বছর বয়সে, তখন্সেগুল সে লিখেছে নিছক আনন্দ পাবার জন, সম্ভবত অতি উৎসাহের কারণে এবং (পাঠকদের প্রতি) তার অতিরিক্ত দয়ার্দ্র মনোভাবের কারণে।

আর্তুর কখনও তার লেখা ছাপাতে চেষ্টা করেনি। ‘নরকের ঋতু’ রচনাটি মুদ্রিত হয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছানোর আগে সে মুদ্রিত বইগুলো সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিল। ওর নিজের কাছে যত পাণ্ডুলিপি, কবিতা, গদ্য ছিল সব সে নষ্ট করে ফেলেছে। নিজের রচনা নিয়ে আর্তুর ঠাট্টা করতো, হাসাহাসি করতো। যেদিন সে তার সম্পূর্ণ রচনাবলি পুড়িয়ে ফেললো (এবং খুবই আনন্দের সাথেই কাজটি করেছে সে, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি) সেদিন থেকে আর্তুর আর সাহিত্য নিয়ে কখনও একটি কোথাও বলেনি।”

১০.

এদিকে ১৮৯১ সালের মাঝামাঝি এসে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ডান পায়ে প্রচণ্ড ব্যথাসহ র‌্যাঁবো হাসপাতালে ভর্তি হন। এসময় তিনি তাঁর মাকে চিঠি দিয়ে আসতে বলেন। মে মাসের শেষে তাঁর পা অপারেশন করে কেটে ফেলা হয়। জুলাইতে রেলয়ের এক ওয়াগনে করে নিজবাড়িতে ফিরে আসেন। আগস্ট মাসে বোন ইজাবেলকে সাথে নিয়ে মারসাই শহরের দিকে রওনা হলে পথে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে আবারো হাসপাতালে ভর্তি হন। ক্যানসার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লে আগস্টের ২৫ তারিখে একজন যাজকের কাছে পাপ স্বীকার করেন তিনি।

১৯৯১ সালের ১০ নভেম্বর সকাল দশটায় স্বেচ্ছায় সকল ইন্দ্রিয় নিয়ে ছুটে চলা এই বিস্ময়কর বাউন্ডুলে কবি মাত্র ৩৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

(পরবর্তীকালে আর্তুর র‌্যাঁবোর জীবন কাহিনি অবলম্বন করে ক্রিস্টোফার হ্যাম্পটন ১৯৬৭ সালে একটি নাটক লিখেন। পরবর্তীকালে এই চিত্রনাট্যটিকে নিয়ে চলচ্চিত্রকার আগনিয়েস্কা হল্যান্ড ১৯৯৫ সালে টোটাল  ইক্লিপস নামে একটি জীবনীমূলক-নাট্য চলচ্চিত্র তৈরতিতেন। ১৯শ শতকের দুই ফরাসি কবি জ্যঁ আর্তুর র‌্যাঁবো ও পল ভারলেইনের মধ্যে আবেগপ্রবণ যে সম্পর্ক ছিল এবং যেটি সবসময় সাহিত্যজগতের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সেই সম্পর্কটিকে কেন্দ্র করেই সিনামাটিতে মূলত তৈরি করা হয়েছে। যদিও এতে আসলে র‌্যাঁবোর সম্পূর্ণ জীবনকেই চিত্রায়িত করা হয়েছে। এখানে র‌্যাঁবোর চরিত্রে অভিনয় করেছেন  লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও ও পল ভারলেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডেভিড থেলিস।)

তথ্যসূত্র:

. Arthur Rimbaud | French poet | Britannica

. Arthur Rimbaud- Wikipedia

. Arthur Rimbaud: Complete Works

. Rimbaud: A Biography

. The Time of the Assassins: A Study of Rimbaud

. A Season in Hell & The Drunken Boat

. র‌্যাঁবো নির্বাচিত কবিতা পত্রাবলি (অনুবাদ: শিশির ভট্টাচার্য)

Read Previous

জার্মান সাহিত্যের যুবরাজ গ্যোটে

Read Next

রকিবুল হাসানের বুলবুলবেদনাকাব্য : এলিজি সৃষ্টিতে সাহিত্যে নতুন দিগন্ত

One Comment

  • পড়েছি, সমৃদ্ধ একটা লেখা । র্যাবো সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। টোটাল ইক্লিপস দেখার ইচ্ছে রাখি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *