এলিজি তথা, শোকগাথা সাহিত্যের একটি অন্যতম প্রাচীন শাখা। এলিজির সৃষ্টি এবং বিকাশ প্রাচীন গ্রিসে। গ্রিক এলিগস্ থেকে আধুনিক এলিজির বিবর্তন ঘটে। প্রাচীনকাল থেকে প্রায় মধ্যযুগ পর্যন্ত ব্যক্তিগত ও জাতীয় শোককাহিনিকে উপজীব্য করে এলিজি রচিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সামাজিক বা পারিবারিক বা রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে প্রতি ক্ষেত্রেই বিশেষশ্রেণিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে ভিন্ন উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন কবি রকিবুল হাসান। তার এলিজির শুরুতে ভাই হারানোর শোক প্রকাশ পেলেও তা ধীরে ধীরে পারিবারিক ও জাতীয় স্বার্থকে নান্দনিকতার সাথে তুলে এনেছেন, যা যে কোনো সাহিত্য বিচারে নতুন মাত্রার সংযোগ করেছে।
প্রাচীন সাহিত্যে হোমারের ইলিয়াডে হেক্টরের মৃত্যুতে প্রাইমের মাধ্যমে হোমারের কষ্ট ও বেদনার করুণরস পাঠক হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু সে বেদনা ব্যক্তিবিশেষে এবং একান্তই ব্যক্তিগত ছিল। আবার কিং ইদিপাসের ট্র্যাজিডির মধ্য দিয়ে সফোকলিসিসের বেদনার কথা জানা যায়। কিন্তু সেগুলোকে এলিজি বলা যায় না। কেননা সে সময়ে গ্রিক ও রোমান সাহিত্যে হেক্টামিটার ও পেন্টামিটার চরণে লেখা হতো এবং পুরো কাহিনি একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই রচিত হতো।
ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত কোনো গভীর ভাবগম্ভীর চিন্তাসমৃদ্ধ কবিতাকে এলিজি বলা হতো, যা পরবর্তীতে আর স্বীকৃতি পায়নি। ফলে বলা যায়, প্রকৃত এলিজি সপ্তদশ শতাব্দীর পরেই সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। ইংরেজ কবির বন্ধু আর্থার হ্যালামের মৃত্যুতে টেনিসন কর্তৃক রচিত ‘ইন মেমোরিয়াম’ এবং ডব্লিউ এস ওডেন রচিত ‘ইন মেমোরি অব ডব্লিউ বি ইয়েটস’ বেশ গুরুত্বপূর্ণ এলিজি। তবে ইংরেজি সাহিত্যে টমাস গ্রের ‘এলিজি রিটন আন কান্ট্রি চার্জ ইয়ার্ড’ সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের জন্য।
টমাস গ্রে এ এলিজিটি ১৭৪১ সালে শুরু করেন এবং ১৭৪৫ সালে শেষ করেন। এখানে তিনি প্রথাকে ভেঙে কোনো ব্যক্তি বিশেষকে প্রাধান্য দেননি। বরং প্রান্তিক জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কীভাবে ধর্মীয় আবরণ ও তথাকথিত সামাজিক রীতির মাধ্যমে শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি করা যায় এবং একটি জনগোষ্ঠীকে দমিয়ে রাখা যায় তা উল্লেখ করেছেন। অকালে ও অবহেলায় হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো সুযোগ পেলে সফলতার শীর্ষে উঠে দেশ ও জাতিকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে তা দেখিয়েছেন।
গ্রে গ্রামীণ অবহেলিত জনগণের সম্ভাবনাকে নিখুঁতভাবে তুলে এনেছেন। কবিতাটি স্টেনজা বা পর্বে লেখা। আর রবিকুল হাসান তার বেদনাকে প্রকাশের জন্য ৩৯টি স্বকীয় কবিতা লিখেছেন ভিন্ন শিরোনামে, যা শেকসপিয়ারের সনেট সিক্যুয়েন্সের সাথে তুলনা করা যায়। গ্রে তার কবিতায় সন্ধ্যা ও কবরস্থানকে আশ্রয় করেছেন দিনের শেষ মানে জীবনের শেষ বোঝানোর জন্য। আর কবরস্থানকে দেখিয়েছেন প্রত্যেক মানুষের শেষ পরিণতির পর চিরস্থায়ী ঠিকানাকে নির্দেশ করতে। গ্রে রূপক ও কল্পনাপ্রসূত হয়ে লিখেছেন। কিন্তু রকিবুল হাসান বাস্তবতার আলোকে সব তথ্য উপস্থান করেছেন রূপকাশ্রিত ও কাব্যশৈলীর মাধ্যমে। উল্লেখ্য ‘বুলবুলবেদনাকাব্য’ শীর্ষক প্রথম কবিতাতে তিনি সময়কে নির্ধারিত করেন এভাবে:
বুলবুল, একত্রিশ মে পাঁচটা সাত মিনিটে তোর ফোন এলো
কী সুন্দর মুগ্ধতা মেখে বললি, মেজো ভাই, কেমন আছেন?
কাব্যর রেজাল্ট নিয়ে তোর আলোভরা মুখটা-…
সেই একটু পর আর কোনদিন এলো না
কোন পথে কোথায় সূর্য অস্ত যাবার মতো হারিয়ে গোলো
কোনদিনই আর তোর ফোন
বেজে উঠলো না- কস্মিনকালেও না।
গ্রে-র কবিতার সূচনা বেশ লক্ষণীয়। তিনি ‘এলিজি রিটন আন এ কান্ট্রি চার্জ ইয়ার্ড’ কবিতায় বলেন,
ক্লান্ত দিনের শেষের ঘণ্টাধ্বনি বাজে,
বন্ধুর পাহাড়ি উপত্যকা ছুঁয়ে হাওয়া ধীরে ধীরে বয়ে যায় ঘাসপ্রান্তরে,
ক্লান্ত চাষা ধীর পায়ে ফিরে আসে ঘরে,
আমাকেও অন্ধকারে ছেড়ে যায়
দৃষ্টি হতে সরে যায় প্রকৃতির রূপছায়া,
চারদিকে নীরবতা স্তব্ধ বিশাল আকাশ,…
মজার বিষয় হলো গ্রে-র চাষিরা ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরে আসে দিন শেষে এবং সেখানেই পরিবারের কাছে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু রকিবুল হাসানের কাব্যে বুলবুল কাব্যের রেজাল্ট পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বাসায় ফোন দেয় এবং বাসায় আর ফিরে না। সোজা হাসপাতালে এবং সেখান থেকে কবরস্থানে। গ্রে-র সাধারণ চাষিরা পরিবারের কাছে মনের শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারলেও বুলবুল পারেনি। ‘কান্না এবং একটি প্রার্থনা’ কবিতায় কবি বুলবুলের শেষ পরিণতি কথা উল্লেখ করে বললেন,
মিলন মলিন কণ্ঠে বললো, সেজো ভাই স্ট্রোক করে পড়ে গিয়ে
মাথা ফেটে গেছে। কোন সেন্স নেই। অ্যাম্বুলেন্সে করে দ্রুত
নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে।
এরপর এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি। নিরাস কণ্ঠে বলছেন,
…। গতকাল সন্ধ্যা থেকে ভাই হারানোর শঙ্কায় কাঁদছি।
রাতে কখন কী হয়! দিনের আলোটা… তারপর…তারপর…
আমার ভাইটা ফিরবে তো!
তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে কবির হৃদয় ফাটা কান্নার মাঝে সবার কাছে প্রার্থনা,
আপনাদের কাছে, খুব করে অনুরোধ করছি, আমাদের মা-মরা
ভাইটার জন্য প্রার্থনা করুন, আমাদের ভাইটা যেন বেঁচে ওঠে,
আমরা যেন তাকে আবার ফিরে পাই।
এরপর কবি নানা উপমার মাধ্যমে জীবনের শেষ বেলাকে তুলে এনেছেন তার কাব্যে। বেদনাভরা শোককে প্রকাশ করেছেন করুণ রসের মাধ্যমে। এ রূপক এবং রস কাব্যশক্তির প্রমাণ দিয়েছে নানামাত্রিকতার মাধ্যমে। কেননা, তিনি যখন বললেন,
আমি একটু বুঝতে পারিনি
নদীর মতো তুই চলে যাচ্ছিস-কী এক ভীষণ অভিমানে
আর কখনো ফিরবি না-ফেরা হবে না কখনো আর।
এ আর্তনাদ গগনবিদারী হয়ে ওঠে কবি কণ্ঠে যখন শুনি,
এ কেমন অন্ধকার তোকে খুঁজি-পাঁজরভাঙা ঝড়-ঝাপটা আর্তনাদ
আমিও তো ডুবে গেছি অতল অন্ধকারে-নিজেও পাই না নিজের
বুকের গহীনে বিক্ষুব্ধ ঢেউ গুমোট কান্না-ভয়াবহ বিদ্যুৎ চমকায়;
অথবা,
পথের দিকে চোখ পেতে থাকি তোর আসার ক্ষণ গুণে
বাতাসে বুক পেতে থাকি-তোর গায়ের গন্ধ পাবো বলে
নদীর স্রোতে কান পেতে থাকি-তোর কণ্ঠধ্বনি শুনবো বলে
মোবাইলে তোর নম্বরটা চোখের জলে অন্ধ চোখে দেখি
জীবনকষ্ট জড়ানো তোর গায়ের শার্ট কতোবার জড়িয়ে ধরি বুকে
অবাধ্য বৃষ্টির মতো কান্নায়-তোর বুকের সবটুকু কষ্ট নেবো বলে।
বুলবুলবেদনাকাব্য নানা কারণে বহুমাত্রিক। বিশেষ করে আঙ্গিক, বিষয়বস্তু ও নানামাত্রিক মোড় কখনো এ কাব্যগ্রন্থকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এলিজিসমূহের সাথে আবার কখনো বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এলিজিসমূহের সাথে তুলনা করে বিশ্লেষণ করলে এর মহত্ত্ব ফুটে উঠে।
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিন্তা তরঙ্গিনী’, রাজকৃষ্ণ রায়ের ‘মিত্রবিলাপ’, বিহারীলাল চক্রবর্তীর ‘বন্ধুবিয়োগ’, অক্ষয় কুমার বড়ালের ‘এষা’, সত্যেন্দ্র নাথ দত্তের ‘কবর-ই-নুরজাহান’, বনফুলের ‘পরিমল গোস্বামী’, প্রেম মিত্রের ‘তিনটি গুলি’, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উদ্দেশ্য’, হরচন্দ্র নিয়োগীর ‘নির্বান প্রদীপ’, গোবিন্দ দাসের ‘বঙ্কিমবিদায়’, রবীন্দ্রনাথের ‘সতেন্দ্রনাথ দত্ত’, হেমচন্দ্রে বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিদ্যাসাগর’, নবীনচন্দ্র সেনের ‘মাইকেল মধুসূধন দত্ত’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘রবিহারা’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পাথরের ফুল’সহ অনেক এলিজি বাংলা কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এর সাথে রকিবুল হাসানের বুলবুলবেদনাকাব্যও সমৃদ্ধ করেছে। তবে বুলবুলবেদনাকাব্য অন্য সব কবিতার চেয়ে একেবারে ভিন্ন বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের জন্য।
উল্লেখ্য, প্রতিটি মৃত্যু ব্যক্তিবিশেষে এবং সামাজিক বা জাতিগতভাবে একটি অপূরণীয় ক্ষতি। যার প্রেক্ষাপটে প্রাচীন ও মধ্যযুগের এলিজি বর্তমানে এসে রূপ পাল্টায় এবং প্রত্যেক মানুষের প্রতি সমান গুরুত্বারোপ করে এবং এমনকি কোনো ব্যক্তির ভাগ্যের উপর পুরো জাতি বা সমাজের ভাগ্য নির্ভর করলেই তাঁকে কেন্দ্র করে এলিজি লিখতে হবে এ ধারণা পাল্টিয়ে দেয়া হয়। বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্যে গ্রে-র এলিজি এবং বাংলা সাহিত্যে জসীম উদদীনের ‘কবর’ কবিতা। গ্রে গ্রামীণ চাষাদের জিনকে তুলনা করেছেন সে সময়ের বা পূর্ববর্তী বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সাথে। কোনো কোনো অংশে তিনি উল্লেখ করেছেন সুযোগ পেলে তারা তাদেরও ছাড়িয়ে যেতে পারতো। কিন্তু জসীম উদদীন সীমাবদ্ধ ছিলেন বক্তার স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের অন্য সদস্যদের বিয়োগে। কারণ তার জীবনে নেমে আসা অন্ধকার ও অনিশ্চয়তা। সেসব সদস্য বিয়োগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি সমাজ বা রাষ্ট্র। তথাপি ‘কবর’ হয় অন্যতম শ্রেষ্ঠ এলিজি।
জসীম উদদীন তার এলিজিতে গ্রামীণ প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছেন। এ প্রকৃতির মতো কোমল হৃদয় ছিল ‘কবর’ কবিতার বক্তার স্ত্রী-পুত্র-পরিজন। চাকচিক্য রঙিন শহরের বাহিরে নীরব গ্রামীণ প্রকৃতি ছিল তার কাছে সুখের। কিন্তু সে সুখ হারিয়ে যায় একের পর এক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। সাদামাটা জীবনে অন্ধকার, দুঃখ আর বেদনার রূপ ফুটে উঠেছে কেবল মাত্র। জসীম উদদীনের কবিতায় শোনা যায় , “এইখানে তোর বাপজি ঘুমায়, এইখানে তোর মা,/কাঁদছিস তুই? কী করিব দাদু! পরাণ যে মানে না।”
ঠিক তেমনি আর্তনাদ শোনা যায় রকিবুল হাসানের কণ্ঠে,
মেঘভাঙা কী এক ভীষণ আর্তনাদ-বুলবুল-বাপ রে আমার-
কথা ক’ সোনা আমার-একবার কথা ক’-শুধু একবার…
ভেঙে পড়ে বুক-ভেঙে পড়ে পুরো আকাশ-কান্না! আর্তনাদ!
ভেঙে পড়ে বৃক্ষ-জীবনহীন জীবন-শূন্যতার দিকে।
এ অংশে রোমান্টিক কবি এস টি কোলরিজের বিখ্যাত কবিতা ‘রাইম অব দ্য এনসিয়েন্ট মেরিনার’-এর ‘লাইফ ইন ডেথ’-এর প্রতিধ্বনি সুস্পষ্ট।
রকিবুল হাসানের কাব্যে প্রকৃতি এসেছে। পৃথিবীর মায়া কেবল শহুরে জীবনকে ঘিরে। ‘একটুও ভাল নেই’ শীর্ষক কবিতায় প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে,
হাওর-বাঁওর বিল-ঝিল
মাঠভর্তি থৈ থৈ পানি
কলার ভেলায় গ্রামের পর গ্রাম
গলায় জড়ানো লাল শাপলার মালা
কণ্ঠভরা মুর্শিদী গান
এখন সেখানে বুকপোড়া বিরান ভূমি
স্বপ্নহীন বিধবাশরীর যেন রয়েছে দাঁড়িয়ে
শহরের মতো প্রাণহীন প্রাসাদ এখন এখানেও তোলে মাথা
কিন্তু সে সুন্দর প্রকৃতির বর্ণনা বিবর্ণ হয়ে যায় বুলবুলের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তাই উপমাশ্রিত বর্ণনার মাধ্যমে তিনি বললেন,
হাটুরেবাজার ভেঙে গেলো
নতুন ঝড়ের কালবৈশাখী থাবায়
হাছন-লালন চলে গেলো
গাঁও-গেরামের আসর ছেড়ে
রাজপ্রাসাদের সৌখিন উৎসবে।
নিরান্দ জীবনের কথা ফুটে উঠেছে ‘আমার শ্মশানদাহ আমারই থাকুক’ কবিতায়। চরম হতাশার মাঝে তাকে বলতে শোনা গেল,
আমার ভরাই বুকে বর্ষা নদীর মতো
থৈ থৈ স্বপ্ন ছিল
প্রবল মাতাল স্রোতে ভেসে গেলো সব
পুকুরভর্তি মাছের মতো অচেনা হাওরে
তবুও ভালো থাকুক অধিকার হরণের গল্প।
রকিবুল হাসানের বুলবুলবেদনাকাব্য কখনো মনে হয় এটি একটি আত্মজীবনীমূলক রচনা। কেননা পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত সবকিছু এখানে উঠে এসেছে। যেমন ‘পূর্বপুরুষের দীঘল নিঃশ্বাস’ কাব্যে তিনি বলেছেন:
পূর্বপুরুষের দীঘল নিঃশ্বাস শূন্য বাতাস থেকে নিয়ে নিই
আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে গভীরতায় বুক ভরে।
অথবা তিনি ‘কতোবার ভাবছি রকিবুল বুলবুল’ কবিতায় বলেন:
আমার মা হেড স্যারকে চিনতেন না। মা বাড়ির ভেতর থেকে
বললেন, বাবা, এ বাড়িতে রকিব নামে কেউ নাই।
আমি তখন ঘরের ভেতর থেকে শুনছি, কী বিপদ! মুহূর্ত দেরি না
করে বললাম, মা, আমি রকিব। মা বিস্মিয়ে বললেন,
তুই রকিব হলি কি করে?
বুলবুল যেদিন মারা গেলেন ঠিক ছত্রিশ বছর আগে একদিন কবি এসএসসির রেজাল্ট পেলেন। আর সেদিন তিনি হারালেন মাকে। নিজের এবং মেয়ের রেজাল্টের দিন মা ও ভাইকে হারানোর বেদনা কবিকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে কোন এক অজানায়। তাই তার মধ্যে বিলাপ ফুটে উঠেছে একে একে। প্রথমে ‘কান্না এবং একটি প্রার্থনা’ কবিতায় তিনি বললেন,
ছত্রিশ বছর আগে আমি এসএসসি প্রথম বিভাগে তিনটি লেটার
মার্ক নিয়ে পাস করার পর পাগলের মতো কেঁদেছিলাম। আমার
সব ভাইবোনও কেঁদেছিল। সারারাত…জীবনভর সেই কান্না।
বুকভাঙা বেদনার কান্না। মাকে চিরকালের মতো হারানোর কান্না।
এরপর তিনি ‘এ কি নিয়তি! কেমন নিয়তি!’ কবিতায় তিনি উল্লেখ করলেন,
মায়ের মৃত্যুর পরের দিন আকাশ ভেঙে
বৃষ্টির কান্না নেমেছিল।
তেমনিভাবে বোনের অসুস্থতাসহ নানাভাবে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কথা বলেছেন। উল্লেখ করেছেন খালি হাতে ঢাকায় এসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সবাই মিলে। তবে এ কাব্য গ্রন্থের আরো বৈচিত্র্যতা এসেছে তিনি এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে যে এলিজি লিখেছেন এবং ‘কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে না’ কবিতায় স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বিক অধঃপতন এবং বিশৃঙ্খলাকে তুলে এনে অনাগত নৈরাজ্যের জন্য আগেই এলিজি লিখেছেন। প্রথমে এটি এফিটাফ মনে হলেও ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে তিনি লিখেছেন,
আপন স্বার্থে উন্মাদ-হার মানে হিংস্র শকুন হায়েনা
কল্যাণ লেবাসে বেচে নাম অদ্ভুত প্রণাম সালাম তাদের।
…
কবিতার শব্দ যদি না হয় সুন্দরের প্রার্থিত বৃষ্টি;
একালে এ সত্য কবিতার বুকে বিষলক্ষ্মা তীর।
…
অন্যায়ের উদ্যত বুকে সেই সাহসী রোদ্দুর ভয়ার্ত ছোবল
কবিতার ফণা বিষহীন ঢোঁড়াসাপ এখন-সরীসৃপ জন্ম।
পরিশেষে দৃঢ়চিত্তে বলা যায় বহুমাত্রিকতা ও বিষয়বৈচিত্র্যের কারণে রবিকুল হাসানের বুলবুলবেদনাকাব্য বাংলা সাহিত্যে এলিজি সিরিজ হিসেবে সংযোজিত হয়ে থাকবে। চিরভাস্মর ও অম্লান হয়ে পাঠকচিত্তে নতুন ভাবনার সঞ্চার ঘটাবে।
লেখক নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ-এর ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। (৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিঊ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা।)