অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৮, ২০২৪
১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৮, ২০২৪
১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বঙ্গ রাখাল -
হাসান আজিজুল হক: জীবন-বাস্তবতার কথাসাহিত্যিক

আগুনপাখি ও টুকরো স্মৃতি

দু’চোখে স্বপ্ন, মনে আশা, জীবন-বাস্তবতাকে বোঝার চেষ্টাই দিনকে দিন হাঁকিয়ে ছুটি বাস্তবতার ঘোড়া।  সবে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে জীবনকে বোঝার চেষ্টা চলছে। আড্ডা মারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধু কিংবা পরিচিত কবিদের সাথে এ সময় পরিচয় ঘটে কবি মাসুদুজ্জামানের সাথে।  তিনি মাঝে মাঝে শিক্ষক ক্লাবে নিয়ে আমাদের খাওয়াতেন এবং আড্ডা মারতেন। এভাবেই দিন চলছে, হঠাৎ একদিন তিনি আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকলেন। আমি ক্যাম্পাসে গেলে তিনি রিকশায় করে নিয়ে গেলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। কিন্তু আসার পূর্বেও আমি কিছুই জানি না কোথায় বা কেন আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার কাছে সবকিছু উন্মোচিত হলো। এখানে গতরাতে এসেছেন বাংলার কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯-২০২১)।  তিনি মূলত কোন একটা পুরস্কার পেয়েছেন, সেই অনুষ্ঠানে এসেছেন এবং এই কেন্দ্রেই তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। এর মধ্যে থেকে একজন এসে হাসান আজিজুল হকের কাছ থেকে একটা লেখা নিয়ে গেছেন। লেখা বলতে হাসান আজিজুল হক বলছেন এবং তিনি লেখে যাচ্ছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন লোকজন কিংবা তাঁর ভক্ত অনুরাগীরা এসে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছেন। এখন আর কেউ নেই, আমি আর কবি মাসুদুজ্জামান প্রবেশ করলাম স্যারের রুমের  মধ্যে। তিনি হাসি মুখে বসতে বললেন, পরে বললেন মাসুদ তোমার খবর কি? কিছু কথাবার্তার পরেই মাসুদুজ্জামান স্যার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ওর নাম বঙ্গ রাখাল। ভালো কবিতা লেখছে প্রবন্ধও লেখে ভালো। আজিজুল স্যার কিছু সময় আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, বাহ ভালো তো, এখন প্রবন্ধের মানুষ কম। চালিয়ে যাও থামবে না। সাহিত্যের কাজ হলো চালিয়ে যাওয়া। এখানে কোনো থামার জায়গা নাই। তাই বলেই তিনি ছুটলেন ওয়াশ রুমের দিকে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আমি এবং মাসুদুজ্জামান স্যার কথা বলাবলি করছি ওয়াশ রুমে স্যারের এত সময় লাগে? না কোনো সমস্যা হলো। কিছু সময় অপেক্ষা করার পরে মাসুদুজ্জামান স্যার ওয়াশ রুমে গিয়ে টোকা দিলেন তাও কোনো সাড়া-শব্দ নাই। এবার আমাদের মধ্যে কুডাক ডাকা শুরু হলো, স্যারের কোনো সমস্যা হলো কি না? স্যারের দেখাশোনা করার দায়িত্ব যার ওপর ছিল তাকে ডেকে আনা হলো। সে এসে জানাল স্যার ওয়াশ রুমে গেলে একটু সময় নিয়েই বের হয়ে আসেন। এভাবে কথা বলতে বলতেই স্যার বের হয়ে এলেন, আমরাও একটু হাসি দিয়ে নিজেদের চেয়ারে বসলাম। এর মধ্যে কবি তুষার কবির আসলেন, স্যারকে তার কি একটা বই দিলেন এবং স্যারের সাথে এই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ক্যামেরাবন্দী করে রাখলেন। স্যারের এই সময় আমি এবং মাসুদুজ্জামান স্যার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম বেশ দীর্ঘসময় ধরে। পরে স্যার আমাকে তাঁর লেখা একটা ছোট বই উপহার দিয়েছিলেন। এভাবেই প্রথম সাক্ষাতে স্যারের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি যেন আমার জনম জনমের চেনা।

হাসান আজিজুল হক নামটার সাথে আমি পরিচিত হই তাঁর ‘শকুন’ গল্পটির মধ্য দিয়ে, পরবর্তীতে ক্যাম্পাস জীবনে পড়েছি আগুন পাখি, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন।

ষাটের দশকে তিনি কথাসাহিত্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন করেছেন, যাকে বলা হয় নির্মাণ ধারার সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত কথাসাহিত্যিক। তিনি সৃষ্টি করেছেন এক নব ভাষাশৈলী, যা একজন আজিজুল হকের নিজস্ব ভঙ্গিকেই উপস্থাপন করে। হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে ঠাঁই পাওয়া সেই সব মানুষ, যারা বিরূপ নির্মমতার শিকার, যাদের জীবন কাটে আর্থিক অভাব সংকটে, তিনি তাদের কথায় বলতে চান, যাদের জীবন নিপীড়ন অভাব-বঞ্চণার শিকার, চোর, ভিক্ষুক, দিনমজুর, চাষি হয়ে ওঠে তাঁর গল্পের মূল উপাদান। হাসান তাঁর গল্প বয়ানে সামান্য কিছুকেই মুহূর্তে অসামান্য বানিয়ে ফেলতে পারেন। আজিজুল হক নিজের চোখে দেখেছেন মানুষের এই যাতনাময় জীবন, যে কারণে তিনি বারংবার বলতে চেয়েছেন এইসব সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের গল্প। তাঁর লেখায় সবসময় উঠে আসে দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, শরণার্থী সমস্যা, পাকিস্তানের স্বৈরশাসন, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের বাস্তবতা, গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ইত্যাদি বিষয়াদিকে আশ্রয় করে তিনি লেখালেখি করেন। হাসানের লেখার মধ্যে প্রকাশিত হয় জীবন-জটিলতা কিংবা যাপনের জীবন ঘনিষ্ঠতার নানা উপাদান। তিনি তাঁর লেখায় আরোপিত বা অলিক কোনো কিছুকে এমনি এমনি এনে হাজির করেননি। কারণ তিনি তাঁর জীবন দিয়ে যা দেখেছেন, সেসব বিষয়কেই তিনি লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন মাত্র।

হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসটি পড়ে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে বসে ভেবে ছিলাম, এই লেখক এভাবে দৃশ্যগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরেন কি করে। তিনি এই গ্রন্থটির জন্য পশ্চিমবঙ্গের আনন্দ পুরস্কারও পেয়েছেন। ‘আগুনপাখি’ মূলত দেশভাগেরই গল্প। যা একজন নারীর প্রতি মমতাবোধেরই আখ্যান। ‘আরে কি মুশকিল? পাকিস্তান যাব কেন? নিজের দেশ ছেড়ে?’ বর্ধমানের একটি মুসলিম পরিবারকে কেন্দ্র করে এর ডালপালা বিকশিত হয়েছে। এখানে উঠে এসেছে দেশভাগের পূর্ব বা পরের ইতিহাস। এককথায় লেখক এই পাত্র-পাত্রীর মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দাঙ্গা-পরবর্তী মানুষের জীবন এসব কিছুই একজন নিরক্ষর নারীর দৃষ্টিতে বর্ণনা করেছেন। আমরা এই উপন্যাসে যে নারীর দেখা পাই, সেই নারী নিজের সংসার, সমাজ, ধর্ম, দেশের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এই উপন্যাসের সমস্ত কথা বলেন মেজ বউরূপী এই নারী। যে কথা শুরু হয় তার শৈশব থেকে আর পরিসমাপ্তি ঘটে দেশভাঙনের পরে তার একাকীত্বের জীবনযাপন করার মধ্য দিয়ে। মানুষের নিজের জীবনের কথা কতটুকুই-বা থাকে। শুরু হয় বাবার কথা, মায়ের কথা, বিয়ের কথা, সেই সময়য়ে সবাই মিলে মিশে বসবাস করার কথা। সংসার হয়ে গেলে কিই-বা থাকে তার কথা। বাবার সংসারে একটা মেয়ে যতটা স্বাধীন থাকে, স্বামীর সংসারে তো তাও থাকে না, কমে যায় তার কথা বলা। তাইতো তার মনের চিলেকোঠায় জন্ম নেয় অনেক না বলা কথা ‘জেবনের কুনো কাজ নিজে নিজে করি নাই, নিজের ইচ্ছা কেমন করে খাটাতে হয় কুনোদিন জানি নাই। আমি কি মানুষ না মানুষের ছেঁয়া? তাও কি আমার নিজের ছেঁয়া?’ এই উপন্যাসে কোনো নারীকেই নিষ্ঠুর রূপে দেখা যায় না। যেমন সৎ-মা বা কর্তা-মা কারও মধ্যেই এমন আচরণের দেখা মেলে না। বালিকা মেয়েটার মা ছিল না ছিল এক দাদি। তাও সে তো আপন হতে পারে না, কারণ সে ছিল বাবার খালা। কিছুদিনের মধ্যেই ঘরে আসে এক সৎমা। এই মার সাথে তার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর সম্পর্ক। তাও এটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কয়েকদিন পরে বিয়ে হয়, পোয়াতী সৎ-মা কাঁদতে কাঁদতে বিদায় দেয় তাকে। প্রবেশ করে বিশাল এক যৌথ পরিবারে। যেখানে নিজের ভাবনার কোনো সময় নেই। এখানে অন্যের হুকুম পালন করাই শ্রেয়। এই মেজ বউ তার জীবনেরই গল্প করছেন নানাভাবে, যা আমাদের সে সময়কে বুঝতে একটুও বেগ পেতে হয় না। ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের এগিয়ে যাওয়া একটি নারীর জীবনের গহীনের গল্প নিয়ে এগিয়ে যায় যেখানে হাহাকার, যন্ত্রণা, দেশভাগ, রক্তপাত এসবই যেন বহুল মানুষের অনুভব একটি মানুষের অনুভব হয়ে একজন নারীর মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। এই উপন্যাসকে হাসান আজিজুল হক এমন একটি উপন্যাস করতে চেয়েছেন, যা ভারত বিভাজনকে দেখা হবে একজন নারীর আত্মা বা হৃদয় দিয়ে এবং তিনি তা উপস্থাপন ও করেছেন ঠি সেভাবেই। নারী উপলব্ধি করেছেন তার জীবন দিয়ে, আত্মা দিয়ে আর সাম্প্রদায়িকতা, পুঁজিবাদ, দাঙ্গার বিপরীতে আবস্থান নেওয়া এই যে নারীরা সর্বদা থেকেছেন সচেতন। আমরা যতকিছুই বলি না কেন সবকিছুর বিরুদ্ধে কিংবা শিকার হয়েছে সমাজের নিচের কোটার লোকজন। তারা যেমন অবহেলিত আবার সময়ের প্রয়োজনে প্রতিবাদীও। আর হাসান আজিজুল হক সেই সব স্মৃতিকে আশ্রয় করেই নির্মাণ করেছেন ‘আগুনপাখি’র কাঠামো যা তিনি পেয়েছিলেন, সবই তাঁর মায়ের কাছ থেকে। এই মায়ের বর্ণনায় যেমন মেজ বউয়ের বয়ানিতে জীবন্ত হয়ে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় অতীতের দিকে। এই অতীতই নিজেকে চিনিয়ে দেয় বারবার সময় আর ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে। প্রবাহমান জীবনের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকে কত মানুষের জীবন হাহাকার, নির্মমতা, রক্তের দাগ, রাষ্ট্রের নানা কারসাজির মধ্যেও মানুষের থাকে বেঁচে থাকার হিম চাহনি। এই বেঁচে থাকার বোধই তো মানুষকে সংগ্রামী করে তোলে একজন মেজ বউ সেই সংগ্রামী আত্মার জীবন্ত উদাহরণ।

জীবনের গল্প আত্মজা একটি করবী গাছ

হাসান আজিজুল হক বাংলা কথাসাহিত্যের এক কিংবদন্তি স্বরূপ। ষাটের দশকে তিনি কথাসাহিত্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন করেছেন, যাকে বলা হয় নির্মাণ ধারার সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত কথাসাহিত্যিক। তিনি সৃষ্টি করেছেন এক নব ভাষাশৈলী, যা একজন আজিজুল হকের নিজস্ব ভঙ্গিকেই উপস্থাপন করে। হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে ঠাঁই পায় সেই সব মানুষ, যারা বিরূপ নির্মমতার শিকার, যাদের জীবন কাটে আর্থিক অভাব সংকটে। তিনি তাদের কথায় বলতে চান, যাদের জীবন নিপীড়ন অভাব-বঞ্চণার শিকার, চোর, ভিক্ষুক, দিনমজুর চাষি হয়ে ওঠে তাঁর গল্পের মূল উপাদান। হাসান তাঁর গল্প বয়ানে সামান্য কিছুকেই মুহূর্তে অসামান্য বানিয়ে ফেলতে পারেন। আজিজুল হক নিজের চোখে দেখেছেন মানুষের এই যাতনাময় জীবন, যে কারণে তিনি বারংবার বলতে চেয়েছেন এইসব সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের গল্প। এইসব গল্প মানুষ শুনতেও চায় এই জন্যই তো গোগ্রাসে মানুষ হাসান আজিজুল হকের গল্পকে গ্রহণও করে নিয়েছেন। আমি হাসান আজিজুল হকের প্রথম পড়েছি ‘শকুন’ গল্পটি। যা তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প। এই গল্পে তিনি সমাজের সেই সব নিম্নশ্রেণির মানুষের কথায় বলার চেষ্টা করেছেন। যেখানে তিনি বলতে চেয়েছেন শোষক-শোষিতের লড়াইয়ের কথা। তিনি তাঁর গল্পে দেশভাগ, মা-মাটি, রাজনৈতিক বিভাজন, দেশান্তর কিংবা লুটপাট, উচ্ছেদ, অপমান, ধর্ষণ, অপহরণ ইত্যাদি বিষয়গুলো তুলে ধরেন। এই লেখকের গল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গল্প ‘আত্মজা একটি করবী গাছ’। এই গল্পটিও রাজনৈতিক বিভাজন দেশভাগকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এই গল্পটি পড়তে গেলেই প্রথমে চোখ আটকে যাবে একটি লাইনে, এ যেন আমাদের কল্পনার কোনো লাইন কিংবা চাঁদনী রাতে বাইরের কোনো দৃশ্যকে লেখক পাঠকের সামনে মূর্তময় করে তুলেছেন। ‘এখন নির্দয় শীতকাল, ঠান্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারিকেল গাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায়, একবার পিঠ দেখায়।’ লেখক বাস্তবতার পথ ধরেই বলে যান জীবনের এইসব যাপন নির্ভর গল্প। তিনি চোখে দৃশ্যমান বিষয়কেই গল্পে বলার চেষ্টা করেন। লেখককে বাস্তবতার মধ্য দিয়েই চলাচল করতে হয়, তা না হলে তিনি কোনো লেখাকেই জীবনমুখী করে তুলতে পারেন না আর জীবনমুখী করতে হলে তাকে অবশ্যই জীবনের সাথে মিশতে হয়। সেই জীবন-ঘনিষ্ঠ জীবনই পেয়েছেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর মন-মননগঠিত হয়েছে রাঢ়বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি বা ভূপ্রকৃতি দ্বারা। গ্রামীণ জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখা বলেই তিনি জীবনের অভিজ্ঞতায় নিজেকে সাজিয়েছেন একজন পূর্ণ মানুষ হিসেবে। হাসান আজিজুল হক ‘আত্মজা একটি করবী গাছ’ গল্পে বলতে চেয়েছেন দেশভাগের ছিন্নভিন্ন জীবন মানুষকে জীর্ণশীর্ণ করে তুলে আর কান্নাজড়িত চোখে ভাসে নিজের ফেলে আসা জীবনের কথা…ইনাম, ফেকু আর সুহাস নাপিতের জীবনেরই এক নির্দয় অভিজ্ঞতাকে লেখক তুলে ধরেছেন এই গল্পে। যা গল্প বর্ণনায় ‘আত্মজা একটি করবী গাছ, দেশভাগের পরবর্তীকালের কোনো এক সময়কেই আশ্রয় করে গল্পের ডালপালা বিকশিত হয়েছে। মানুষের এই যে রাজনৈতিক বিভাজিতের ফেড়ে পড়ে অলিখিত জীবনআখ্যান নিয়ে মানুষকে ঘুরতে হচ্ছে- এখান হতে সেখানে যে অনিশ্চিত জীবনের কথা কারও জানা নেই। এই গল্পের শেষের দিকে করবী বিচি যেন আত্মহননেরই একটি প্রতীক বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বৃদ্ধের জীবনযুদ্ধে পরাস্ততায় যেন করবীর বিচি খেয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন। করবী গাছের চমৎকার বিচি হয় এই কথা বলে যখন ‘পানিতে ডুবে যেতে যেতে, ভেসে যেতে থাকে বুড়োর মুখ’, ইনাম তখন তেতো গলায় প্রশ্ন রাখে, ‘এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ… ইনাম যেন বলছে, ‘এ্যাহন কান্দো ক্যা, আগে ভাইবে কাজ করলি তো আর কানতি হত না’! এই গল্পে দেশভাগ একটি নীরবভাবে প্রকাশিত হলেও তা আমাদের কঠিন জীবনের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দেয়, যা একজন হাসান আজিজুল হকের পক্ষেই সম্ভব।

জীবন-বাস্তবতার কথাসাহিত্যিক

হাসান আজিজুল হককে নিয়ে অনেক আগেই লেখতে চেয়েছিলাম, অনেক লেখাও চেয়েছি দিতে, চেয়েও দিতে পারিনি কাজের নানা চাপের কারণে। তবুও লেখব বলে নানা সময় লেখার চেষ্টা করেও লেখিনি। হাসান স্যারের সাথে একদিনের স্মৃতিবিজড়িত বিষয়কে নিয়ে লেখব লেখব করে শেষ পর্যন্ত যে এভাবে লেখতে হবে তা কখনও কল্পনা করিনি। জীবনের কোন কাজটা যে কীভাবে করা হবে আমরা কেউ সেভাবে বলতে পারি না। তবুও তো এগিয়ে যেতে হয় অসীমের পানে। জীবনানন্দ দাশের মতো বলতে হয়- আপাদমস্তক আমি তার দিকে তাকায়ে রয়েছি/গগ্যাঁর ছবির মতো- তবুও গগ্যাঁর চেয়ে গুরু হাত থেকে/বেরিয়ে সে নাক চোখে ক্বচিৎ ফুটেছে টায়ে টায়ে/ নিভে যায়- জ্বলে ওঠে, ছায়া, ছাই, দিব্যযোনি মনে হয় তাকে… যদি কাউকে বলা হয় হাসান আজিজুল হকের গল্পে তিনি আসলে কি বলতে চান- যে কেউ তাঁর গল্প বা উপন্যাস পড়ে থাকলে চট করে বলে দিবেন- তাঁর গল্পে মানুষের হৃদয়ের গহীনের কথা উঠে আসে আর তিনি না বলা কথা বলেন- যা কেউ বলতে পারে না। তবে এসবের পেছনে থাকে পুঁজিবাদ, মানুষের লালসা,  দেশভাগ, রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ, ক্ষমতালোভীদের নানা কূটচাল, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা আমাদের সামাজিক যে কোনো ঝামেলার সন্ধান পাওয়া যাবে হাসান আজিজুল হকের গল্পে। যা জীবন-ঘনিষ্ঠ জীবনের নানা অনুষঙ্গই তো তাঁর সাহিত্যের মূল উপাদান। যেখানে থাকে দেশভাগের ছিন্নমূল মানুষের জীবনের কথা, ধর্ষিত মানুষের হাহাকার কিংবা অবহেলিত, সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের জীবন ইতিহাস কিংবা নিজের জীবনের গল্পই তো তিনি লিখতে চেয়েছেন। তিনি তাঁর এই দীর্ঘজীবনে সাহিত্যের এক নতুন স্টাইল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। যার দরুণ তিনি বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে যুগের পর যুগ টিকে থাকবেন এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেয়। হাসান আজিজুল হকের জীবনস্মৃতি প্রকাশিত হয়েছে- ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’ এবং ‘উঁকি দিয়ে দিগন্তে।’ এটা মূলত তাঁর চোখে দেখা জীবনকেই তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। হাসানের মধ্যে এক ধরনের শিশু বাস করলেও তিনি আবেগে নিজেকে ভাসিয়ে তোলেন না নিজের লেখক মেজাজে তুলে ধরেন- ‘সেটার বর্ণনা অন্যরকম এখানে বৈচিত্র্য কম থাকলেও তা আমাদের কাছে বেমানান লাগে বলে মনে হয় না। তিনি জটিলভাবেই সাহিত্য করতে এসেছিলেন যে কারণে কোনো ভ্রান্তিই তাকে তাঁর এই মহান কর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পারেননি আর তাঁর এই লেখক জীবনের মূলশক্তি মানুষের জীবন বাস্তবতা। হাসানের এই জীবন্ত লেখা সমাজকে এগিয়ে দিয়েছে অনেক খানিক যা মানুষকে বেঁচে থাকার রসদ জোগাচ্ছে। লেখক তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ‘লেখা এক অন্য রকম ঋণ শোধ দেয়া। বেঁচে থাকার উপকরণ জোগাচ্ছে সমাজ। কেবলই নিতে থাকলে যে লজ্জা ও অপরাধবোধ জমা হতে থাকে তা থেকেই লিখি, তাতেও তো অপরাধবোধের হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই। আমার এই ফিরিয়ে দেয়া তো শ্রম ও উৎপাদনের ফসল ফিরিয়ে দেয়ার মতো না। তার ওপর আমাদের দুর্ভাগ্যের ফলে এই দেশে আমাদের,  লেখকদের কাজ এক রকম পুরোপুরিই নিষ্ফলা থেকে যাচ্ছে। কোথাও তার কোনো জোর তৈরি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু আমি আর কী করতে পারি! আমার অন্য সব কাজ এক ধরনের যান্ত্রিকতায় নিষ্পন্ন হয়- একমাত্র লেখাতেই দেখি আমার পুরো সত্তা নিযুক্ত হতে পারছে। লেখাই হচ্ছে আমার সাধ্যায়ত্ত শ্রেষ্ঠ কাজ। লেখার আয়নায় আমার সময়কালের দেশ সমাজ পৃথিবীর বাস্তবতার কিছুমাত্র প্রতিফলন যদি ঘটাতে পারি, তাতে হয়তো এমন শক্তির উদ্বোধন ঘটবে, যাতে শ্রম ও উৎপাদনের ফলের মতো কোনো প্রত্যক্ষ ফল ফিরিয়ে দিতে না পারার সংকোচও খানিকটা কেটে যাবে।’ কিছু দায়বোধের জায়গা থেকেই অনেকে লেখতে আসেন। আবার অনেকে এই দায়বোধকে নিজেদের বিবেচনায় রাখেনও না। কিন্তু হাসান আজিজুল হক সমাজের বা নিজের ভিতরে জেগে ওঠা দায়বোধ থেকেই লেখতে এসেছেন। যে কারণে তিনি লিখতে চান মানুষের জীবন কিংবা নিজেই নিজের জীবনের গল্প। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া কিংবা মায়ের মুখে শোনা গল্পও লেখকের হয়ে উঠেছে নিজের লেখার উপকরণ। এই জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যই পারে একজন মানুষকে সত্যিকার মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। আমরা যদি হাসান আজিজুল হকের গল্পের কাছে যায়, তাহলে দেখতে পাই, ‘আর ছবিগুলো চলে গেল যেন ট্রেনটা যাচ্ছে পুল পেরিয়ে…সুহাস গতকাল থেকে গল্পটা বলছে আর আগামীকাল পর্যন্ত বলবে।… আর মামির বোনেরা যা সোন্দর তা আর কলাম না।… যা হয় সরকারদের পড়ো বাড়ির ভেঙে পড়া সিঁড়িঘরের মধ্যে বেচারির চকচকে পালক, হলদে ঠ্যাঙ কিংবা ঠোঁটের খণ্ডাংশ পাওয়া যাবে… (আত্মজা ও একটি করবী গাছ)

হাসান আজিজুল হক তাঁর লেখায় জীবন চেতনা, আশা জাগানিয়া কিংবা আশা ভঙ্গের বেদনাকে নানাভাবে সাহিত্যে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। এই লেখক মুক্তিযুদ্ধ কিংবা যুদ্ধ-পরবর্তী মানুষের জীবন সামাজিকতা কিংবা বাস্তবজীবনে একজন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বকেই তুলে ধরেন না, তাদের আশাহত মনকেও লেখক পড়ে দেখতে চেয়েছেন, অনুভব করতে চেয়েছেন তাদের মনকে হৃদয় দিয়ে। আসুন শুনে আসি লেখক ভাষ্য- “আমার গল্পের মুক্তিযোদ্ধারা হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে করতে অশ্রুহীন চোখে তীব্রকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘আমাদের কি কেউ দেখতে আইছিলো।’ শহরের রাস্তায় উদ্দাম উৎসব। হাউই ফাটছে, রাইফেলের গুলি ছুটছে হিসহিসিয়ে বাতাস কেটে।” তাঁর উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প’র মধ্যে রয়েছে- ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘শকুন’, ‘তৃষ্ণা’, ‘উটপাখি’,  ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’, ‘আমৃত্যু জীবন’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘খাঁচা’ ইত্যাদি। তিনি তাঁর গল্পকে সবসময়ই একটি আখ্যানের মতো করে নিজস্ব স্টাইলে প্রকাশ করতে চেয়েছেন এবং তিনি বলেও গেছেন সেভাবে। এটাই শেষমেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে হাসান আজিজুল হকের নতুন ফর্ম বা ইস্টাইল- গল্পবলার ধরন। তিনি যা কিছুই করেন না কোন ভাসাভাসা কোনো কিছু করেননি। তিনি যে কোনো বিষয়ের প্রতি তাঁর তীক্ষ্ন দৃষ্টি ভঙ্গিকে সর্বদা রেখেছেন স্বচ্ছ। তাইতো তিনি গল্প বলে যান আমাদের চারিপাশের মানুষকে নিয়ে, এখানে থাকে না কোনো মেকি বা অলীক কল্পনা। যা থাকে তা সত্যিই সত্যের কাঠামোর উপরে বাস্তবতার মানুষেরা এসে হাঁটাচলা করে- এই শক্তিই একজন হাসান আজিজুল হককে মহান শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

+ posts

Read Previous

গোলাম কিবরিয়া পিনু’র কবিতা: দেশপ্রেমের বহু বর্ণিল দ্রোহের স্ফুলিঙ্গ

Read Next

জার্মান সাহিত্যের যুবরাজ গ্যোটে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *