ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে রাজত্ব করেছিল প্রায় দুশো বছর। অধিকাংশ সময়ই তারা কলকাতায় থেকে রাজত্ব কায়েম করেছে কারণ তখন রাজধানী ছিল সেটা। দিল্লিকে রাজধানী করে কলকাতা তথা দ্বিতীয় লন্ডনকে পরিত্যাগ করে চলে গেলো সেখানে ১৯১১ সালে স্বদেশি আন্দোলনের সূতিকাগার বাংলাকে দুর্বল করা যাবে মনে করে। কিন্তু হয়নি। দুর্জয় বাঙালি দিল্লিতেও গেছে। মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর ‘দিল্লি ষড়যন্ত্র’ তো ঐতিহাসিক প্রমাণই। লর্ড হার্ডিঞ্জকে মারার পরিকল্পনা করেছিলেন সামরিক হামলার মাধ্যমে।
সেটা ফলপ্রসূ হয়নি হিন্দিভাষী এক দুর্বল বিপ্লবীর বেঈমানির কারণে, তার নামটি মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে রামদাস ওই রকম কি নাম, আমার রাসবিহারীকে নিয়ে লিখিত প্রবন্ধে অবশ্য উল্লেখ করেছি। সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসকের দিল্লির সিংহাসনে অভিষেকের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই এই মহাপরিকল্পনা করা হয়েছিল। ষড়যন্ত্রটি ব্যর্থ হলেও বৃটিশের শাসনের ভিত্ কাঁপিয়ে দিয়েছিল এই বঙ্গসন্তান। এরপর মাত্র ৩৬ বছর ছিল ভারতবর্ষ তথা দিল্লির মালিক বৃটিশরাজ।
দিল্লি রাজধানী হওয়ার পর বাঙালির মন ভেঙে গিয়েছিল এটা তো অস্বীকার করা যাবে না, কিন্তু এরপর বাঙালি দিল্লি জয়ের লক্ষ্যে অভিযাত্রা করেছেন ক্রমাগত। খ্যাত-অখ্যাত বাঙালির অনেকেই দিল্লিতেই ঠিকানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিশ্বদরবারে ভারতকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে পূর্ববাংলার বাঙালি আদৌ কম নয়। কি রাজনীতি, কি শিক্ষা, কি ব্যবসা, কি সংস্কৃতি, কি প্রশাসন, কি গবেষণা, কি কুটনীতি এমন কোনো ক্ষেত্র নেই বাঙালি কাজ করছেন না বা খ্যাতির স্বাক্ষর রাখেননি। দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কেই বসত গেড়েছেন পূর্ববাংলার দশ লক্ষ শরণার্থী ভারত ভাগের পর পরই। নবভারতের ভাগ্যবিধাতা পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু ছলে-বলে-কৌশলে যেভাবেই পারেন প্রধানমন্ত্রীত্ব হস্তগত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেসব বহু অম্লমধুর ইতিহাস! তিনি এই দেশত্যাগী পূর্ববঙ্গীয় বাঙালিদের অভিবাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন।
এখন তারা আদতেই খারাপ আছেন বলে মনে করার কারণ আছে বলে আমার মনে হয়নি। বরং আজকের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়। দ্বিতীয়-তৃতীয় প্রজন্মের প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠিত বলা যায়। দারুণ সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে তারা কালাতিপাত করছেন বলেই মনে হলো। কারো কোনো ক্ষোভ, অতৃপ্তি বা বাদ-প্রতিবাদ আচার-আচরণে চোখে পড়লো না। তবে যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে একটা চাপা আক্ষেপের সুর ধ্বনিত হচ্ছিল: পূর্বপুরুষের জন্মভূমির জন্য মন কাঁদে। প্রবল মমতাবোধ বা পিছুটান এখনো টানটান কয়েক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরও। কেউ কেউ যথেষ্ট বয়স তুলেছেন, বললেন তাদের দেশভাগের স্মৃতিময় তিমির হননের দুঃসহ সময়ের কথা; ছেলেবেলা, নদনদী, মাঠ-ঘাট-দিঘি ছুঁয়ে থাকা দুরন্ত শৈশবের কথাও বললেন। দেশত্যাগের ওপর কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের একটি বিখ্যাত কবিতা আছে, তার করুণ সুর শুনতে পেলাম আমার মনের মধ্যে।
২০০৭ সালের কথা। তখন আমি কলকাতায়। একদা জাপান প্রবাসী বন্ধু কবি ও গল্পকার বিপুলকৃষ্ণ দাসের বাসায় উঠেছি। সে জাপানি ভাষাশিক্ষার স্কুল ‘সাকুরা একাডেমী’র প্রতিষ্ঠাতা। আমি গিয়েছিলাম একটি গ্রন্থ প্রকাশ করার জন্য ‘জানা অজানা জাপান’-এর প্রথম খণ্ড। সেটা দিয়েওছিলাম আনন্দ নামে একটি ছেলেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার বইটি মনমতো করতে পারেনি ছেলেটি তখন ভাবছিলাম জাপানে ফিরে যাবো। সেইসময় কলকাতা বইমেলা চলছিল বাইপাসের কাছে। বিপুলের অগ্রজপ্রতিম বন্ধু সালাম আজাদ এলেন কলকাতায় কারণ বইমেলায় তার বই প্রকাশিত হয়েছে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দিসহ আরও নানা ভারতীয় ভাষায়। বিশাল এক পাঠকগোষ্ঠী তার বইয়ের ভক্ত যদিও আমি জানতাম না। সালামভাইয়ের আগমনের প্রাক্কালে বিপুল আমাকে সব খুলে বললো তার সম্পর্কে। বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখক, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী সালাম আজাদ তখন দিল্লিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ‘ভাঙামঠ’ নামক একটি উপন্যাস নিয়ে সমস্যার উদ্ভব হলে পরে তিনি আর দেশে ফিরতে পারেননি জেনেভা থেকে। সেখানে তখন তিনি একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মানবাধিকার সংক্রান্ত গবেষণাপত্র পাঠ করার আমন্ত্রণে অবস্থান করছিলেন। তার বিরুদ্ধে সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা জুড়ে দিলে তিনি হলেন প্রবাসী এবং শেষমেষ ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে তিনি ভারতে অবস্থানের অনুমোদন লাভ করলেন ভারতের একাধিক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের সহায়তায়। সেই থেকে তিনি দিল্লিতে।
সালাম আজাদ কলকাতায় এলেন। বিপুল আমাকে নিয়ে গেলো তার হোটেলে। সেখানে পরিচয় হলো। তারপর তিনি বিপুলের বাসায়ও এলেন, কারণ তারা পারিবারিকভাবে পূর্বপরিচিত ও ঘনিষ্ঠ। তখন তিনি আমার বইটি দেখে বললেন, ‘খুব মূল্যবান প্রবন্ধগুলো। অজানা ইতিহাস। এক কাজ করুন এটা হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আপনি দিল্লি আসুন বিপুলকে নিয়ে। আমার বাসায় বেড়াবেন।’
বাহ্! কী সহৃদয় আমন্ত্রণ! আর কী অভাবিত প্রস্তাব! আমি তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম। সালাম ভাই বললেন, ‘আপনার লেখা পড়ে থাকি বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায়। এই বইয়ের প্রথম প্রবন্ধটি আপনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় পাঠিয়েছিলেন তাই না? আমি একবার ওখানে গিয়ে দেখি সেটা সাহিত্য সম্পাদকের টেবিলে পড়ে আছে। তার কোনো আগ্রহ না দেখে সেটা ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকায় নিয়ে গেলাম। তারা লুফে নিয়ে প্রকাশ করেছিল। কারণ জাপান সম্পর্কে এমনিতেই আমরা কিছু জানি না। তার ওপর জাপান-বাংলা সম্পর্ক কতো গুরুত্বপূর্ণ সেই ইতিহাস নিয়ে আপনি কাজ করছেন! প্রকাশিত হওয়া জরুরি।’
ঘটনাটি অবশ্য বিপুল আমকে বলেছিল। আমি সালাম ভাইকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালাম। এরপর সালাম ভাই চলে গেলেন দিল্লি। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি আমি ও বিপুল দিল্লি রওয়ানা হলাম। কলকামেল না কি যেন দ্রুতগামী লাল ট্রেনটা মনে নেই। খুব পরিষ্কার ঝকঝকে একেবারে উড়ে চলছিল জাপানের দ্রুতগামী সুপার এক্সপ্রেস শিনকানছেন বা বুলেট ট্রেনের মতো। কামরাগুলো পরিসর এবং আরামদায়ক। ঘনঘন চা পান করা যায়, পত্র-পত্রিকা, বই পড়ার জন্য দারুণ একটি বাহন বলতেই হবে। ব্রিটিশরা রেললাইন বসিয়েছিল আর স্বাধীন ভারত আধুনিক ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে কম নয় কিন্তু!
ট্রেনের আরামদায়ক দুলুনিতে ঘুম আসার বদলে আমার বুকের ভেতরে আনন্দের বারুদ জ্বলে ওঠার জন্য উশখুশ করছিল থেকে থেকে। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর মতো আমারও কেমন যেনো দিল্লি জয়ের প্রত্যয়ে পেয়ে বসলো। এই পথেই দুঃসাহসের মূর্ত প্রতীক বিহারী বসু ব্রিটিশ-ভারতের সুরক্ষিত রাজধানী দিল্লিতে গিয়েছিলেন ভারতমাতার মুক্তির আশায়। যদি লর্ড হার্ন্ডিঞ্জ সেদিন বোমার আঘাতে মারা যেতেন তাহলে কী হতো সুবৃহৎ ব্রিটিশ উপনিবেশটির? জানি না।
নদীর মতো ইতিহাসের শাখা-প্রশাখাও অনেক সময় বিলীন হয়ে যায়। ব্যর্থ দিল্লি ষড়যন্ত্রও তাই। কিন্তু আমাকে দিল্লি জয় করতে হবে। দিল্লির ভাষা হিন্দি। ভারতের অধিকাংশ মানুষ হিন্দিতে কথা বলে। এই ভাষায় আমার বই প্রকাশিত হবে ভাবাই যায় না! কারণ এই পর্যন্ত আঙুলে গোনা কজনের মাত্র বই হিন্দিতে অনূদিত হয়েছে যেমন সালাম আজাদ, তসলিমা নাসরীন আর কে কে? খুঁজে পাচ্ছি না। তারপর কি আমার? যদি প্রকাশক রাজি হন। হবেন বলেই আমার বিশ্বাস কারণ জাপান বলে কথা!
সালাম ভাইয়ের দিল্লিতে মালভিয়া নগরের বাসায় গিয়ে উঠলাম। চার তলায় ছিমছাম সুপরিসর বাসাটি। সোহেলী ভাবির সঙ্গেও পরিচয় হলো। মোগল বংশের রক্তধারা তার মধ্যে প্রবাহিত তাই যেমন সুন্দরী তেমনি ফর্সা। খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে ভাবি আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। সালাম ভাইও খুশি।
পুরে সুস্বাদু ভোজন সেরে বেরোলাম দিল্লি ভ্রমণে। যদিও-বা প্রচণ্ড গরম কিন্তু বেশ ফুরফুরে হাওয়া আছে কারণ দিল্লির মহাসড়ক জুড়ে যে সবুজ বৃক্ষের সমারোহ তা সৃষ্টি করে দিয়েছে জাপান। তা না হলে ৪০-৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট উত্তাপে আলুসিদ্ধ হতে হতো দিল্লিবাসীকে। হিমাচল প্রদেশ বলে হিমালয়ের কাছাকাছি দিল্লি তাই প্রচণ্ড শীতও পড়ে। বেশ পরিসর ও পরিচ্ছন্ন দিল্লি। ট্যাক্সিতে চড়ে ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম সংসদ ভবন, রাষ্ট্রপতি ভবন, শেরশাহের সমাধি আরও কি কি।
মহাভারত যুগের ইন্দ্রপ্রস্থ, কুরুক্ষেত্র এই দিল্লিতেই। একটি অভিনব জাদুঘরে নিয়ে গেলেন সালাম ভাই সেখানে খোপের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আর্য দেব-দেবীর মূর্তি দেখতে পেলাম যেগুলো ইন্দ্রপ্রস্থে খুঁড়ে পাওয়া গেছে। আর্য-বৈদিক যুগের আরও চমৎকার সব দুর্লভ নিদর্শন দেখে তৃপ্তির স্বাদ মেটালাম। বিকেল হয়ে গেলো। তিনি আমাদেরকে নিয়ে গেলেন বিখ্যাত চিত্তরঞ্জন পার্কে বাঙালি উপনিবেশে। একটা বাজার দেখলাম সেখানে, গমগম করছে বাঙালিতে। সবাই বাংলা বলছেন। অবশ্য শুদ্ধ বাংলায় যদিও-বা সবাই বাঙাল বা বাঙালের বংশধর। কারো কারো সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন সালাম ভাই। চা খেলাম। বেশ বড়ো কাঁচাবাজার বাংলাদেশের সব মাছই সেখানে দেখতে পেলাম, দামও সস্তা।
সেখান থেকে গেলাম দিল্লির বিখ্যাত সাহিত্য কাগজ ‘উন্মুক্ত উচ্ছাস’র সম্পাদক বিকাশ বিশ্বাসের বাড়িতে। চিত্তরঞ্জন পার্কেই। দ্বিতল বাড়ির সামনে তিনি ও মালা বৌদি হেসে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। বেশ বয়স্ক মানুষ, ব্যবসা করছেন তরুণ বয়স থেকে। তারাও কুষ্টিয়ার লোক। বিশ্বখ্যাত আইনজ্ঞ বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের আত্মীয় হন বলেই জানি। বিকাশদা ষাটের দশকে জাপানে ছিলেন দীর্ঘদিন। দামি পাথরের ব্যবসা করতেন আর লেখালেখি ছিল নেশা। সাহিত্য পত্রিকা ‘দেশ’-এর সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। ‘উদিত ভানুর দেশ’ না কি ‘জাপানের চিঠি’ নামে তার একটি নিয়মিত কলাম ছিল। পরে সেটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা স্যার আমাকে বিকাশদার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন, তখন রাধাবিনোদ পালকে নিয়ে একটা কাজ করছিলাম আমি। আজুমা স্যার বললেন, তিনি বিচারপতি পালের আত্মীয় হন, আপনি আলাপ করুন। সেই থেকে আলাপ ও মেইলে মতবিনিময় হয়েছে নিয়মিত। তিনি এই পত্রিকাগোষ্ঠীর মধ্যমণি। অক্লান্ত তরুণ সাহিত্যকর্মী।
বাড়ির দোতলায় তার অফিস। সেখানে আগেই আয়োজন করা হয়েছিল ছোটোখাটো আড্ডার। বেশ কয়েকজন এলেন সহ-সম্পাদক কবি আদিত্য সেন, আবৃত্তিকার শৈলেন সাহা ছিলেন। দু-তিনজন মহিলাও ছিলেন। আমরা ঘন্টা দুই আড্ডায় মশগুল হলাম। চা-জল খাওয়ার পর সন্ধ্যে নেমে এলো। সেখান থেকে বেরিয়ে সালাম ভাই নিয়ে গেলেন মাঝপথে এমন একজন মানুষের বাড়িতে যাঁর নাম জানি না কিন্তু দেশ-বিদেশে খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী ধীরাজ চৌধুরী। তার ‘ভারতমাতার চাপাকান্না’ খুবই বিখ্যাত শিল্পকর্ম। তিনি ও বৌদি আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন।
বার্ধক্যে এসেও ধীরাজদা অসামান্য সৃজনযজ্ঞে নিযুক্ত আছেন। দোতলায় তার বেশ বড়ো স্টুডিওতে নিয়ে গেলেন। বিপুল ছবি এঁকেছেন, আঁকছেন। কী রং, কী আঙ্গিক, কী তুলির টান! অবাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম কারণ এর আগে কোনো শিল্পীর স্টুডিও দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার, এটাই প্রথম। সিরিজ ছবি আঁকছিলেন কোথায় যেন প্রদর্শনী হবে তাই ব্যস্ত। কিন্তু স্বদেশের লোক অর্থাৎ ধীরাজদা পূর্ববঙ্গের মানুষ দেশভাগের পর এখানেই বড়ো হয়েছেন, প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেছেন। ১৫টির বেশি জাতীয় পুরস্কার, পদক পেয়েছেন পরিপূর্ণ জীবন তবুও বুকের ভেতরে প্রকম্পিত সাদা রুমালের মাঝখানে একটা চিকন চিঁড় আছে: যা জন্মভূমিকে ছেড়ে আসার দুঃখবোধের চিহ্নবিশেষ।
ধীরাজদার কাজ দেখে সত্যি মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। ১৯৩৬ সালে জন্ম। পৃথিবীর বহু দেশে গিয়েছেন, ১০০টির বেশি প্রদর্শনী হয়েছে। বনলতা সেন, বাউল, কম্পোজিশন, স্পিরিচুয়াল লাইট, হোয়ার দেয়ার ইজ হোপ, গোল্ডেন কর্প তার উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম। অসংখ্য স্ক্যাচ করেছেন তার সুদৃশ্যমান বৃহৎ গ্রন্থও আছে। আছে একাধিক শিল্প সংকলন। সবই তিনি আমাকে দিলেন। আমার ‘মানচিত্র’ পত্রিকা তাকে দিলাম, যেটি বিশেষ একটি সংখ্যা বিপুলের বাসায় বসে তৈরি করেছি, ছাপিয়েছে ‘পাক্ষিক সানন্দা’ যেখানে ছাপা হয় স্বপ্না প্রিন্টার্স মধ্যম গ্রামে। ‘মানচিত্র’ ৫৬ পৃষ্ঠার কাগজ পুরোটাই ছিল গ্লোসি পেপারে বহুরঙা। সল্টলেকের মানসদা (মানস ভদ্র) ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ফেরার পথে ধীরাজদা দুটি সিডিতে করে তার প্রচুর চিত্রকর্মের ছবি আমাকে দিয়েছিলেন। যেগুলোর ওপর ভিত্তি করে জাপানে ফিরে গিয়ে ‘মানচিত্রে’ একটি ফিচার লিখেছিলাম। উল্লেখ্য যে, দুটি বিশেষ সংখ্যা মানচিত্রের প্রকাশক ছিল বন্ধুবর মো.জসীমউদ্দিন। তাকে জানাই অজস্র ধন্যবাদ।
সন্ধে উতরে রাত। আমরা গেলাম একটা মিলনায়তনে সেখানে তখন চলছিল ‘উন্মক্ত উচ্ছ্বাস’ এর আয়োজনে একটি সঙ্গীতানুষ্ঠান। জমজমাট বাঙালির আসর। বুঝতে পারলাম কাগজটি খুবই জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী। বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপ হলো। প্রায় সবাই সালামভাইকে ভালোভাবেই চেনেন জানেন। ‘উন্মুক্ত উচ্ছ্বাসে’র অনেকগুলো সংখ্যা বিকাশদা আমাকে দিয়েছিলেন। সবগুলোই পড়েছি অসাধারণ তথ্যবহুল একটি কাগজ এটা। কলকাতার প্রায় সব বিখ্যাত লেখক শক্তি, সুনীল, তারাপদ, শ্যামল, উৎপল, আলোকরঞ্জন, শরৎ মুখোপাধ্যায়সহ নবীনরাও লিখেন।
রাতে ফেরার পথে আশ্চর্য হয়ে গেলাম এমন একজন মানুষের দেখা পেয়ে যা ভাবতেই পারিনি! তিনি প্রিয়ভাজনেষু গুণদা! কবি নির্মলেন্দু গুণ। তিনি সার্ক লেখক সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লিতে অবস্থান করছিলেন। তার হোটেলে নিয়ে গেলেন সালাম ভাই। জম্পেশ আড্ডা হলো। আরও দেশি-বিদেশি কবি, সাহিত্যিকরা ছিলেন। গুণদাকে নিয়ে এলাম সালাম ভাইয়ের বাসায়। তারপর গভীর রাত পর্যন্ত চললো ঝাঁঝালো পানি ও বিয়ার পানের আড্ডা। নানা কথা। কতো ইতিহাস।
সকালবেলা গুণদা চলে গেলেন। তারপর এলেন প্রকাশক মি.শর্মা। দীর্ঘদেহী, মধ্যপ্রদেশে জন্ম, মধ্যবয়সী মানুষ। ইংরেজি ও হিন্দিতে কথা বলেন। তিনি সালাম ভাইয়ের প্রকাশক। আমার পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে সালাম ভাই তুখোড় হিন্দিতে ব্যাখ্যা করলেন চা-পানের ফাঁকে ফাঁকে। শর্মাজী জাপানের কথা শুনেই খুশি। ‘হিরোশিমা’ নিয়ে তার প্রকাশনা সংস্থা দেশ প্রকাশন থেকে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে লিখেছেন একজন ভারতীয় গ্রন্থটি বেশ চলছে। জাপান নিয়ে ভালো পাণ্ডুলিপি পেলে বই প্রকাশ করতে তিনি আগ্রহী। ব্যাস, পাকা কথা হয়ে গেল। পাণ্ডুলিপি দিতে হবে হিন্দিতে অনুবাদ করে। তথাস্তু, সালাম ভাই কলকাতায় একজন বিখ্যাত অনুবাদিকা আছেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। রয়্যালিটি ও বিক্রির ভাগ নিয়েও কথা হয়ে গেলো। সাইন বিনিময় হলো। দিল্লি জয় হয়ে গেলো আমার। সপ্তাহখানেক রাজত্ব করলাম মুকুটহীন বাঙালি আমি, বিভিন্ন জায়গায় গেলাম।
কলকাতায় ফিরে বিপুলকে পাণ্ডুলিপি ও অনুবাদের ২০ হাজার টাকা দিয়ে জাপানে ফিরে গেলাম। ২০০৮ সালে আমার গ্রন্থ ‘জানা আনজানা জাপান’ প্রকাশিত হলো হিন্দি ভাষায়। ডাকে কয়েক সংখ্যা হাতে পেলাম টোকিওতে, আমার জাপানি স্ত্রীও দারুণ খুশি। কারণ তার উৎসাহ না পেলে এতো দূর আসতে পারতাম না।
আর সালাম ভাই এবং বিপুল তাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই! শেষ হয়ে যাক চাইও না। বন্ধুত্ব এমনই জিনিস চিরঅম্লান। আমার দিল্লিজয়ের সঙ্গে তারাও সহযাত্রী। আমরা বাঙালি, আমরা জয়ী হবোই।
আলোকচিত্র:
১.দিল্লিতে কবি মির্জা গালিবের সমাধিতে
২.শিল্পী ধীরাজ চৌধুরীর সঙ্গে বিপুলকৃষ্ণ দাস ও সালাম আজাদ
৩.দিল্লিতে কুতুব মিনারের সম্মুখে সালাম আজাদের সঙ্গে