অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নাঈম হাসান -
ভ্রমণ অভিজ্ঞতা – টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকাবিলাস

এক.

২০১৯ সালের আগস্টে সর্বশেষ ট্যুরে গিয়েছিলাম বান্দরবানে। এরপর মারণব্যাধি করোনার ছোবলে আমাদের সবারই জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ! ভ্রমণ-পড়াশোনা-ব্যায়াম সব ছেড়ে ঘরে অবস্থান, খাওয়া-দাওয়া ঘুম এবং কবে এই করোনা থেকে মুক্তি মিলবে সে অপেক্ষা। এদিকে ভ্রমণপ্রেমী আমি এবং আমার অন্যান্য বন্ধুর মনের অবস্থাও অভিন্ন। তবে অপেক্ষার ফল যে অতি মিষ্টি হয় তা অনুধাবন করলাম ২০২১ সালের আগস্টে সুনামগঞ্জে গিয়ে। প্রায় দেড় বছর পর যখন দেশ স্বাভাবিক হতে শুরু করে এবং আমি এবং আমার বন্ধুরা প্রায় সকলেই ভ্যাকসিনের আওতায় চলে আসি। তখনই সিদ্ধান্ত নিই আর দেরি নয়, এবার সময় এসেছে ভ্রমণের। যেতে হবে দূরে! আবারও মায়ায় জড়াব আমার প্রিয় বাংলাদেশের! আমরা বরাবরই চেষ্টা করি ভ্রমণ অন্যরকমের করতে। এবার ভিন্ন রকমের আয়োজনে ছিল সুনামগঞ্জে অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকায় ভ্রমণ, রাত্রি যাপন এবং ভোজন আর সুনামগঞ্জের যত জনপ্রিয়-আকর্ষণীয় স্থান আছে তা ঘুরে বেড়ানো। তাই পরিকল্পনা হল ২৯ আগস্ট রাতে রওনা দেব এবং ৩১ আগস্ট রাতে ফিরে আসব।

যথারীতি ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় আমি চলে এলাম মিরপুর সাড়ে এগার নম্বরে। সেখানে পূর্বেই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল তন্ময় ভাই। এই ট্যুরের মূল সঞ্চালক। এরপর আমাদের গ্রুপের অন্যান্য সদস্য এসে পৌঁছালে আগে থেকে ঠিক করে রাখা হাইয়েজ গাড়িতে করে রওনা দিই কুমিল্লার উদ্দেশে। সেখান থেকে আমাদের দলের আরও কয়েকজন সদস্য যোগ দেবেন। গাড়ি চলা শুরু হতেই আমাদের মূল ভ্রমণ ও শুরু হল। সকলেই বেশ ফূর্তির আমেজেই ছিলাম তখন। কোভিডের ভয়াবহতাকে ভুলে, জীবনের সব গ্লানি দূরে ঠেলে আমাদের গাড়ি ছুটে চলছে। শুরু হল আমাদের তুমুল আড্ডা, আর গাড়িতেও বাজছে গান। বুঝলাম আজ রাতে আর কারও ঘুম হবে না। আমাদের আড্ডায় যুক্ত হলেন স্বয়ং ড্রাইভার সাহেবও, তিনি নিজের গ্রামের বাড়ি সম্পর্কে বেশ গাল-গল্প শোনালেন, যা আমরাও বিশ্বাস করিনি। যেহেতু আমরা পূর্বাচল দিয়ে কুমিল্লায় গিয়েছি তাই বেশি জ্যামে পড়তে হয়নি। রাত ১০টার মধ্যেই এসে পৌঁছালাম কুমিল্লায়। মাঝে একবার অবশ্য রাস্তায় হালকা চা-নাস্তা করে নিয়েছিলাম। কুমিল্লা থেকে আমাদের দলের অন্যান্য সদস্যকে নিয়ে এবার গাড়ি ছুটে চলল মূল গন্তব্য সুনামগঞ্জে। কুমিল্লা থেকে যুক্ত হওয়া জাভেদ মূলত বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, এদিকে আমি আর তন্ময় ভাই পড়েছি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। দলের তিনজন মুখ্য সদস্য যদি সাহিত্যের ছাত্র হয় তবে তো আর কথা নেই, গল্প হবে কবিতা-সাহিত্য নিয়ে, শিল্প নিয়ে। তাই আবারও শুরু হল তুমুল আড্ডা, আর গাড়িতে বাজছে আইয়ুব বাচ্চুর গান— আজ কবিতা অন্য কারও, দু’হাতে সে তার সুখকে উড়ায়। আমি আর আমার ফেরারি মন, মুঠো মুঠো শুধু দুঃখ কুড়াই…।

দেখতে দেখতে রাত বেজে গেল প্রায় দু’টা, আমরা ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছি ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। সকলেরই ক্ষিধে পেয়েছে ভীষণ। আমরা ড্রাইভারের পরামর্শ মোতাবেক তার পছন্দের রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। আনুমানিক আড়াইটা বাজে সকলে আবার উঠে বসলাম গাড়িতে। খাবার খেয়ে সকলের ক্লান্তিটাও জেঁকে বসেছে। সাথে সাথে ঘুম। গাড়ির অনেকেই ঘুমে কাবু হয়ে গেলেও আমার কেন যেন ঘুম আসছিল না। ফোনে কিছুক্ষণ ফেসবুক-ইন্সট্রাগ্রামে ঢুঁ মেরে আবার চেষ্টা করলাম ঘুমাতে, আমার পেছনে বসা আলাউদ্দীন ভাইয়ের নাক ডাকার আওয়াজে বুঝলাম তিনি গাড়ির এসির বাতাসে আনন্দেই ঘুমাচ্ছেন। এদিকে ড্রাইভারের পাশে বসা তন্ময় ভাই তার পছন্দের বিভিন্ন ধাঁচের গান শুনিয়ে আমাদের ঘুম পাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টায় ব্যস্ত।

এরমধ্যে দেখতে দেখতে গাড়ি প্রবেশ করল হবিগঞ্জে, এরপর সিলেটে। মোটামুটি ভোরের কিছুক্ষণ পূর্বেই আমার চোখে কিছুটা ঘুম এলেও, সিলেটে এসে গাড়ির গ্যাস নেওয়ার জন্যে থামলে আমার ঘুমটা ভেঙে যায়, গাড়ির জানালা দিয়ে প্রথম দেখি সিলেট শহর। গ্যাস নেওয়া শেষ হলে আবার শুরু হয় গাড়ি চলা এবং আমরা উপভোগ করতে থাকি সিলেটের রূপ। এবং একসময় সিলেট পেরিয়ে গাড়ি প্রবেশ করে সুনামগঞ্জে। যতই এগুচ্ছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। সম্পূর্ণ সুনামগঞ্জই যেন পানিময়। কোথাও বিস্তৃত জলরাশি আবার কোথাও হাওরের মাঝে বাড়ি। জলের মাঝে মানুষের এক অন্যরকম জীবন। সেই দৃশ্য উপভোগ করতে করতে গাড়ি এসে পৌঁছালো সুনামগঞ্জ পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে। সেখানে পানসী রেস্টুরেন্টে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাশতা সেরে নিলাম। এরমধ্যে আমাদের বোটের লোক চলে এল। সে আমাদের নিয়ে যাবে সাহেববাড়ি ঘাটে, যেখান থেকে সরাসরি আমরা উঠব নৌকায়।

দুই.

সাহেববাড়ি ঘাটে গাড়ি থেকে নেমে আবারও মুগ্ধ হলাম সুনামগঞ্জের রূপে, সামনে বিশাল জলরাশি। সকলে উঠে পড়লাম বোটে। যেহেতু আমাদের দলে যাত্রী সংখ্যা গাইডসহ মোট নয়জন। সেই তুলনায় বোট বেশ বড়ই। এখানকার স্টিল বডির নৌকাগুলো ট্রলারের চেয়েও বড় আকারেরই হয়ে থাকে। যেখানে দশ থেকে বিশজন পর্যন্ত অবস্থান করতে পারে। রয়েছে ফ্যান, মোবাইল চার্জ দেওয়ার সুব্যবস্থা। এছাড়াও বেশ ভালো মানের ওয়াশরুম। আমি নৌকার ভেতর ব্যাগ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম রেখে, চলে গেলাম ছাদে। মা’কে কল দিয়ে জানালাম তাঁর দোয়ায় অবশেষে পৌঁছেছি সুনামগঞ্জ। কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকা ছেড়ে দেওয়া হল। গন্তব্য টাঙ্গুয়ার হাওর ওয়াচ টাওয়ার। সেখানে লাইফ জ্যাকেট পরে স্নান ও সাঁতার, ভাবতেই দেহের মধ্যে এক রোমাঞ্চকর শিহরণ বয়ে গেল। ওয়াচ টাওয়ার পর্যন্ত প্রায় তিন ঘণ্টার পথ, নৌকা চলছে, নৌকার জানালা দিয়ে আসছে বিশুদ্ধ বাতাস আর চেয়ে দেখি হাওরের এক অন্যরকমের রূপ। রাতজাগা সকলে ঘুমিয়ে গেলেও আমার কোনোমতেই ঘুম আসছিল না। তাই চলে গেলাম নৌকার ছাদে। সেখানে ছিল গাইড শাহরিয়ার ও নৌকার কর্মী রুবেল। তাদের সাথে শুরু করলাম আড্ডা। জানতে চাইলাম হাওরের রূপ-রহস্য সম্পর্কে। তারা জানাল এখানে বর্ষায় এক রূপ আবার শীতে অন্যরকম, নানা জাতের অতিথি পাখি এসে ভিড় করে। আমাদের শীতেও এসে ঘুরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল তারা। আমি নৌকার একদম আগ্রভাগে বসে হাওরের রূপ দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি নিয়ে। এই সুনামগঞ্জের কিংবদন্তী মরবি কবি হাসন রাজার সেই বিখ্যাত গান ছেড়ে দিলাম মোবাইল ফোনে— আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে,আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে, আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ভারতের মেঘালয় পর্বতমালা, সেখান থেকে বয়ে আশা মিঠাপানির প্রবাহে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরের মতো এক অদ্বিতীয় জলাভূমি। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই হাওর বাংলাদেশর দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওরটি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান, প্রথমটি সুন্দরবন। শীতকালের প্রায় সাত হাজার একরের জলাভূমিটি বর্ষায় আকার নেয় প্রায় বিশ হাজার একরে।

দেখতে দেখতে বেলা এগারটা বেজে গেল। আমার অন্য বন্ধুরাও জেগে গিয়েছে। তারা চলে এসেছে নৌকার অগ্রভাগে। আমি নৌকার ভেতরে গিয়ে আরেকবার ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। কিন্তু হল না। এদিকে আমরা যতই হাওরের গভীরে যাচ্ছি ততই তার রূপ দেখে অভিভূত হচ্ছি, আর অবাক হচ্ছি এমন জলাভূমিতে মানুষের জীবনযাত্রা দেখে। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে তাদের ব্যবহার করতে হয় নৌকা, কোথাওবা জলের মাঝে একটা ছোট্ট গ্রাম। এর মাঝে আমার আরেক বন্ধু স্যারন গান ছেড়ে দিল তার ওয়্যারলেস স্পিকারে। স্যারন সম্প্রতি চীনের একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছে। তার কাছে বাংলাদেশের রূপটা ভিন্নরকম। তাই ট্যুরের শুরু থেকেই সে সব কিছুতেই মুগ্ধ হচ্ছে।

হাওরের অন্যতম মূল আকর্ষণ এখানকার গাছপালা, গাছগুলো পানির মাঝে যেন ভেসে আছে আর আমাদের জানাচ্ছে তাদের রাজ্যে স্বাগত। টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে হিজল, করচ, বরুণ, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলসী, নলখাগড়া, বল্লুয়া, চাল্লিয়া, সিংড়া, শালুক, শাপলা, গুইজ্জাকাঁটা, উকল ইত্যাদি।

টাঙ্গুয়ার হাওরের আরেক সৌন্দর্য এর উদ্ভিদবৈচিত্র

প্রায় বেলা একটার দিকে আমরা চলে এলাম ওয়াচ টাওয়ারের কাছাকাছি। এখানে পানি কিছুটা কম এবং গাছপালাও বেশ। কাজেই দুপুরের স্নান এখানেই সেরে নেব সবাই। ওয়াচ টাওয়ারের একটু পাশেই আমার নৌকা থামাল, সবাই ততক্ষণে গায়ে চাপানো শুরু করল লাইফ জ্যাকেট। লাইফ জ্যাকেট পরা শেষ হলে উঠে গেলাম সেখানেই থাকা কিছু ছোট নৌকায়। এগুলোয় চড়ে ঢুকে পড়ব জলাবনের ভেতরে। যেখানে পানির পরিমাণ কিছুটা কম আর করচ গাছের সমাহার। হৃদয়ের মাঝে তখন বয়ে যাচ্ছিল অন্যরকমের সুখ। ছোট নৌকায় করে চলে এলাম জলাবনের ভেতরে আমরা ছাড়াও অনেকেই অবশ্য সেখানে জলকেলিতে মেতেছিল। নৌকা থামালে আমাদের গ্রুপের সবাই পানিতে নেমে পড়লেও আমি ভাবলাম একটু ঝাঁপিয়ে নামি। কতইবা হল বয়স! লাইফ জ্যাকেট যেহেতু পরেছি একটু গভীর জল দেখেই ঝাঁপ দিই। বিশাল এক লাফ দিয়ে যেই না পানিতে পড়লাম লাইফ জ্যাকেট এবং আমার শরীরের ভারে তলিয়ে গেলাম কয়েক ফুট গভীরে! আমি তো ভাবলাম বুঝি গিয়েছি ডুবে, লাইফ জ্যাকেট কাজ করছে না! দিলাম এক চিৎকার! আমার চিৎকারে ঘাবড়ে গেলেন পাশেই সাঁতরানো আলাউদ্দিন ভাই। পাশেই নৌকায় থাকা এক কিশোর এসে আমার হাত ধরে, জানায় লাইফ জ্যাকেটে ডোবা অসম্ভব। ততক্ষণে সবাই আমার এমন অদ্ভুত কাণ্ডে দিয়েছে হেসে। প্রথমে লাইফ জ্যাকেটে পরে সাঁতরানোটা কিছুটা কষ্টসাধ্য মনে হলেও ধীরে ধীরে বুঝে গেলাম এবং বেশ কিছুক্ষণ সাঁতরালাম সবাই। সাঁতরাতে সাঁতরাতেই এক নৌকায় চা বিক্রি করে সেখানে চা খেলাম সবাই। আমাদের দলের আরেক কনিষ্ঠ সদস্য শিহাব, সেও চায়না থেকে পড়াশোনা শেষে বাংলাদেশে এসেছে। সে লাইফ জ্যাকেট পরে বিভিন্ন এঙ্গেলে ছবি তুলছিল আর নৌকার মাঝিদের সাথে দুষ্টুমি করছিল, তার কাছে সব কিছুই ছিল বেশ আনন্দদায়ক। জলের মাঝে ভাসতে ভাসতেই আমি হেঁড়ে গলায় গান ধরলাম— আমি ভাসব যে স্রোতে, তোমায় ভাসাব সে স্রোতে। আমি ডুবব যে জলে, তোমায় ডোবাব সে জলে…।

লাইফ জ্যাকেট পরে জলের মাঝে চা পান

হাওরে এমন অসাধারণ স্নান শেষে আমার ফিরে এলাম নৌকায়। কাপড় পাল্টে সকলে গায়ে চাপালাম ট্যুরের জন্যে নির্ধারিত জার্সি, লাল রঙের জার্সিতে সকলকেই বেশ মানিয়েছে বলা যায়। আমরা পোশাক পাল্টাতে পাল্টাতে নৌকায় ছেড়ে দিয়েছে এবার গন্তব্য মেঘালয় পাহাড়ের সীমান্ত ঘেঁষা নীলাদ্রি লেক। এদিকে আমরা নাশতা সেরেছি সেই সকাল ৭টায়। এর মাঝে পেটে চা, সিগারেট, বিস্কুট ব্যতীত তেমন কিছুই পড়েনি। তাই খিদেয় পেট করছিল চোঁ চোঁ। এদিকে বেলা বেজে প্রায় দু’টা। নৌকার ছাদে আয়োজন করা হয়েছে মধ্যহ্নভোজের। খাবারে আছে ভাত, ডাল, আলু ভর্তা আর হাওরের মাছ। প্রতিটা খাবারই ছিল অসাধারণ সুস্বাদু। সকলেই বেশ পেট পুরে খেলাম। চলন্ত নৌকায় হাওরের এমন পরিবেশে সকলে মিলে ভোজনের এক অন্যরকমের আনন্দ ছিল তখন।

হাওরের মাঝে আমাদের মধ্যাহ্নভোজ

খাওয়াদাওয়া শেষ করে সকলে জম্পেশ ঘুম দিলেও আমার কেন জানি ঘুম আসছিল না। কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করে নৌকার জানালা দিয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম রূপসী বাংলার রূপ। হাওরের মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবন। চারপাশে পানিতে ভরা, গাছপালার ঘেরা এক টুকরো গ্রাম। নৌকা চলছে আরও প্রায় ঘণ্টা দু’য়ের পানিপথ। যতই নৌকা এগুচ্ছে দৃশ্যমান হচ্ছে মেঘালয় পাহাড়! সে এক অসাধারণ সৌন্দর্য!

নৌকায় শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চোখে ঘুম লেগে এলে মাঝি ডাক দিয়ে জানায় প্রায় এসে পড়েছি। চোখ খুলে বাইরে চেয়ে দেখি মেঘালয় পাহাড়ের একদম নিকটে। আমি সেই দৃশ্য দেখে বিমোহিত হলাম। সবাইকে হাক দিলাম বের হতে। তারাও আমার মতো মুগ্ধ হল। নৌকা থেকে নেমেই হাঁটতে হাঁটতে সকলে নীলাদ্রী লেকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। তবে সেখানে অতি পুরাতন বেশকিছু কলকারখানায় ব্যবহৃত পরিত্যক্ত মেশিন, ক্রেন, রেললাইন দেখে আমার বেশ জানতে ইচ্ছে হল এখানে পূর্বে কী ছিল? গাইড জানাল এখানে পূর্বে কারখানা ছিল এবং চুনাপাথর উত্তোলন করা হত। পরবর্তীকালে স্থানীয় লোকজন এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে যা জানতে পারি, সেই ইতিহাস নিয়ে একটু পর আলোচনা করছি। নীলাদ্রি লেকের নিকটে গিয়ে লেকের স্বচ্ছ নীল পানি আর মায়াবী রূপ দেখে আমাদের মন ভালো হয়ে গেল। লেকের এক প্রান্তে উঁচু-নিচু টিলা, অপর প্রান্তে মেঘালয় পাহাড়। এবং যে কেউ চাইলেই নৌকার মাধ্যমে মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে যেতে পারবেন। স্বল্প হলেও ভারতের মাটিতে পা দেওয়ার এমন সুযোগ আমরা হাতছাড়া করতে চাইলাম না। সকলে নৌকার মাধ্যমে চলে গেলাম মেঘালয় পাহাড়ের নিকট। মেঘালয় পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে সকলেই অভিভূত, আর পাহাড়ের সাথে আমার প্রেম বহুকাল আগে থেকেই। সবুজে ঘেরা মেঘালয় পাহাড়ের চূড়োয় খেলা করছে মেঘেরা। কোনো একদিন নিশ্চয়ই এই পাহাড় আরোহণ করব, মনে মনে সেই প্রতিজ্ঞাও করলাম। পাহাড়ের সামনের বিশাল উঁচু উঁচু পাথরের উপড়ে, নিচে, পাশে থেকে সকলের ছবি তোলার হিড়িক পড়ে গেল। স্যারনের বিভিন্ন স্টাইলে ছবি তোলা দেখে আমি একটু হেসে নিলাম। এদিকে আলাউদ্দিন ভাই ছবি সকলকে দিয়ে নিজের বেশকিছু ছবি তোলালেও নিজে কারো ছবি তুলে না দিয়েই পালাচ্ছেন। আমি গ্রুপের আরেক কনিষ্ঠ সদস্য প্রভাকে দিয়ে নিজের কিছু ছবি তোলালাম। ছবি পর্ব শেষে আবারও নৌকার মাধ্যমে ফিরে এলাম নীলাদ্রি লেকের অপর পাড়ে।

নীলাদ্রি লেকের পাড়ে আমরা

নীলাদ্রি লেকের মূল নাম শহীদ সিরাজ হ্রদ বা শহীদ সিরাজ লেক। মুক্তিযুদ্ধের একজন শহীদ সিরাজুল ইসলামের নামানুসারে এই হ্রদের নামকরণ করা হয় শহীদ সিরাজ হ্রদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার ৫ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সাব সেক্টর ছিল টেকেরঘাট। মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম ছিলেন এই সাবসেক্টর টেকেরঘাটের কমান্ডার। ১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট সুনামগঞ্জের সাচনা বাজার এবং জামালগঞ্জ থানা থেকে পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করার লক্ষ্যে আক্রমণ চালায় একদল মুক্তিযোদ্ধা। এই দলে ছিলেন সিরাজুল ইসলাম তাঁর বিনিময়ে সেদিন সাচনা বাজার এবং জামালগঞ্জ পাকিস্তানি মুক্ত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর শহীদ সিরাজকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার। তাঁর স্মৃতিতে এই হ্রদের নামকরণ করা হয় শহীদ সিরাজ হ্রদ।

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া)।

তবে সেখানে যেই প্রাচীন নগরীর মতো রেললাইন, ক্রেন এবং আরও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দেখলাম সেই সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানলাম এখানে চুনাপাথরের বিশাল খনি আছে কিন্তু বর্তমানে তার উত্তোলন বন্ধ। চুনাপাথর খননের ফলে লেকটি সৃষ্টি হয়।

১৯৪০ সালে এখানে চুনাপাথর সংগ্রহ শুরু করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বিভিন্ন সমস্যা ও ব্যয় বৃদ্ধি দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় এর সকল কার্যক্রম। পরে ১৯৬০ সালে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি চালু রাখার জন্য চুনাপাথরের প্রয়োজনে ভূমি জরিপ চালিয়ে সীমান্তবর্তী ট্যাকেরঘাট এলাকায় ৩২৭ একর জায়গায় চুনাপাথরের সন্ধান পায় বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৬ সালে খনিজ পাথর প্রকল্পটি মাইনিংয়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পাথর উত্তোলন করা হয়। ১৯৯৬ সালে এই প্রকল্প একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোয়ারি থেকে চুনাপাথর উত্তোলন বন্ধ করে দেয়।

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া)

তিন.

পাহাড়ের অপর প্রান্তে এসে কিছুক্ষণ ছবি তুলে আমরা টেকেরঘাট গ্রাম এবং সেখানকার মানুষজনের জীবন-যাপন পরিদর্শনে গেলাম। একদম বর্ডারের পাশে বেশ ছিমছাম গ্রামের সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবন, হাওরের পাড়ে, বর্ডারে দেশের একদম শেষ প্রান্তে। পাহাড়ের কোলঘেঁষে অন্যরকম এক গ্রাম। সেখানে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর আমরা চলে এলাম আবার লেকের পাড়ে, সেখানে পর্যটকদের জন্য বানানো হয়েছে প্রায় ২৫ ফুট উঁচু ঘাসের কয়েকটি টিলা। রয়েছে ছাতার নিচে বিশ্রাম নেওয়ার সুব্যবস্থা। টিলার উপড়ে উঠে আমরা আবারও নীলাদ্রি লেকের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম। সেখানে কিছুক্ষণ গল্প করে ছবি তুলতে তুলতে সন্ধ্যা নেমে এল, আমারও নৌকায় ফেরার উদ্দেশ্য হাঁটা দিলাম।

নৌকায় ফিরে কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ঘোরাঘুরি করে কিছুটা ক্লান্ত সবাই। তাই একটু শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, কিছুক্ষণ পরেই নৌকা নিয়ে যাবে পাড়ের থেকে কিছুটা দূরে, হাওরের মাঝেই। কিছুক্ষণ পরে চলে এল চা আর ঝালমুড়ি। সবাই বেশ মজা করেই তা খেলাম। এরপর চলে গেলাম নৌকার ছাদে, শুরু হল আবার তুমুল আড্ডা আর হাসি-তামাশা। রাতের খাবার পূর্ব পর্যন্ত তা চলল। রাতে দেশি মুরগি, ডাল আর আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেলাম। কী যে সুস্বাদু ছিল সেই রান্না এখন ভেবেও ক্ষুধা লেগে গেল। টাঙ্গুয়ার হাওরে রাতের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে জোছনা, কিন্তু আকাশে চাঁদ না দেখে আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। হায়, টাঙ্গুয়ার হাওরে তবে কি জোছনা দেখা হবে না? যেহেতু আগস্ট মাস তাই বৃষ্টি দেখাও হয়নি। কিন্তু শেষ রাতের দিকে স্যারন এর চোখে প্রথম চাঁদের দেখা মিলল। যদিও পূর্ণিমা নয় তবুও চাঁদের রূপ আর হাওরের রূপ মিলেমিশে একাকার! এছাড়া মেঘালয় পাহাড়ের রাতের বেলা জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন রকমের লাইট যা রাতে পাহাড়ের সৌন্দর্যকে অন্যরকম করে ফেলে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আমরা চলে গেলাম ঘুমাতে। ইতিপূর্বে লঞ্চে রাত কাটালেও পানির এত নিকটে হাওরে নৌকার মাঝে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা এই প্রথম। সে ছিল এক অসাধারণ অনুভূতি। হাওয়া ঠাণ্ডা। বাতাস এসে গা জুড়িয়ে দিচ্ছিল। তাই রাতের ঘুমটা বেশ ভালো হল আমাদের।

পরের দিন সকাল আটটায় নৌকার ইঞ্জিনের শব্দে ঘুম ভাঙল আমার। দেখি অনেকেই উঠে পড়েছে, নৌকা চলে এসেছে যাদুকাটা নদীতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছাব বারেক টিলার পাড়ে। ততক্ষণে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সকালের নাশতা দেওয়া হল খিচুড়ি আর ডিম। সবাই বেশ মজা করেই খেলাম। বারেক টিলার প্রান্তে কিছু ছবি তুলে আমরা টিলায় চড়া শুরু করে দিলাম। পাহাড়ের মাঝে আঁকাবাঁকা ঢাল রাস্তা বেয়ে উঠে চলছি সেখানে, যদিও এত উঁচু নয় তবুও অনেকেই হাঁপিয়ে উঠলাম, সেখানে আবার ঘোড়ায় করেও ওঠা যায়। তাই স্যারন আর হাঁটার ঝামেলায় না গিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বসল, আর আমি আর প্রভা এই সুযোগে ঘড়ার উপর চড়ে ছবি তুলে ফেললাম। আলাউদ্দিন ভাইয়ের প্রেডিকশন ছিল আমি ঘোড়ায় চড়লে সেটার মৃত্যু হতে পারে এবং এর দায়ভার তারা কেউ নেবে না। তবে তার সেই ভবিষ্যৎবাণীকে কাঁচকলা দেখিয়ে আমি বহাল তবিয়তে ছবি তুললাম এবং ঘোড়ারও প্রাণহানি ঘটল না। বারেক টিলায় ওঠার পর দেখলাম যাদুকাটা নদীর এক অন্যরকমের সৌন্দর্য। মূলত এই টিলায় উঠলে এক ঝলকে সুনামগঞ্জের অনেকটাই রূপ দেখে নেওয়া যাবে। আসমানি রঙের স্বচ্ছ যাদুকাটা নদী কাছ থেকে অন্যরকম দূর থেকে অন্যরকম। বারেক টিলা স্থানীয়দের নিকট বারিক্কা টিলাবারেকের টিলা নামেও পরিচিত। টিলাতে রয়েছে ৪০টির মতো আদিবাসীদের পরিবার। এই এলাকায় ৩৬৫ একর জায়গাজুড়ে রয়েছে রঙ-বেরঙের নানা প্রজাতির গাছপালা। একপাশে বাংলাদেশের সীমান্ত, ওপাশে ভারতের মেঘালয়, খাসিয়া পাহাড়।

বারেক টিলা থেকে নেমে চড়ে বসলাম নৌকায় আবার সবাই, এবার গন্তব্য শিমুল বাগান। আমি নৌকার জানালা থেকে যাদুকাটা নদী আর পাহাড়ের সৌন্দর্য ভিডিও করতে লাগলাম। টাঙ্গুয়ার হাওরে যারা যেতে ইচ্ছুক এবং যাদের ছবি দেখেও মন ভরেনি তারা ইচ্ছে করলে আমার ইউটিউব চ্যানেল Naim Hasan Official থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের ভিডিওটা দেখে নিতে পারেন। ভিডিওর লিংক : https://youtu.be/w0ERkA54pQs

প্রায় আধাঘণ্টা পর আমরা পৌঁছালাম শিমুল বাগানে। বসন্তকাল ছাড়া শিমুল বাগানে শিমুল ফুলের দেখা মেলে না। তবে সবুজের সমারোহে ছেয়ে যাওয়া শিমুল গাছের পাতার সৌন্দর্য ভিন্নরকম। বাদাঘাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বৃক্ষপ্রেমী মরহুম জয়নাল আবেদীন এই বাগানের প্রতিষ্ঠাতা। ২০০২ সালে তিনি উত্তর বড়দল ইউনিয়নের মানিগাঁও গ্রামের পাশে যাদুকাটা নদী সংলগ্ন ৯৮ বিঘা অনাবাদি বালুকাময় জমিতে সারিবদ্ধভাবে তিন হাজারের অধিক শিমুল চারা রোপণ করেন। এক যুগেরও বেশি সময় পর সেই শিমুল চারাগুলো এখন পুষ্প-পত্র-পল্লবে মুখরিত।

(সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক)

শিমুল বাগানের মিলল ঘোড়ার দেখা সেখানে ১৩-১৪ বছর বয়সী দুই-চারজন কিশোরেরা ভাড়ায় ঘোড়ায় চড়িয়ে বাগান ঘুরিয়ে দেখায়। আমরা সকলে ঘোড়ায় চড়ে বাগান পরিদর্শন করলাম, ছবি তুললাম, এবং বাগানের সামনের টং দোকান থেকে চা বিস্কুট খেলাম। ভাবছিলাম এই সময়ে বাগানটা এত সুন্দর, তাহলে যখন ফুল থাকবে তখন এর সৌন্দর্য কয়েক শত গুণ যে বেড়ে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিশ্চয়ই কোনো এক শীতে এসে দেখে যাব সে মুগ্ধকর চিত্র। শিমুল বাগান থেকে ফিরে আবার চড়ে বসলাম নৌকায়, এবার যাদুকাটা নদীর নিকটের কোনো পাড়ে নৌকা থামাবে এবং নদীতেই সেরে নেব দুপুরের স্নান।

যাদুকাটা নদীর পানি এই সময় তেমন একটা নেই, আমরা তীর থেকে আরও দূরে এসে শুরু করলাম স্বচ্ছ জলে দাপাদাপি। বেশ দারুণ স্নান হল বলা যায়। আমাদের কিছুটা সামনেই শ্রমিকেরা এই নদী থেকে পাথর কয়লা বালু উত্তোলন করছিল নদী থেকে।

রেনুকা হচ্ছে যাদুকাটা নদীর আদি নাম জনশ্রুতি আছে নদীর তীরবর্তী কোনো এক গাঁয়ের বধূ তার শিশুপুত্র যাদুকে কোলে নিয়ে এই নদীর মাছ কাটছিলেন। একপর্যায়ে অন্যমনস্ক হয়ে মাছের জায়গায় তার কোলের শিশুকে কেটে ফেলেন, পরবর্তীকালে সেই প্রচলিত কাহিনি থেকেই নদীটির নাম হয় যাদুকাটা নদী। মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড় হতে বয়ে চলে যাদুকাটা নদী প্রায় বিশ মাইল পর্যন্ত ‘রক্তি; নামে সুরমা নদীতে এসে মিলিত হয়েছে।

(তথ্যসূত্র : https://vromonguide.com/place/jadukata-river)

চার.

নদীতে স্নান শেষে নৌকায় ফিরে এলাম, আমরা ফিরে আসতেই নৌকা ছেড়ে দিল। ততক্ষণে নৌকার লোকজন খাবার পরিবেশন করতে শুরু করল, আজকের আয়োজন ভাতের সাথে হাঁসের মাংস। বরাবরের মতো এবারও তাদের রান্নায় মুগ্ধ হলাম সবাই পেটপুরে খেলাম। নৌকার মাঝি থেকে শুরু করে বাবুর্চি এবং অন্যান্য স্টাফরা প্রত্যেকেই খুবই অমায়িক এবং যথেষ্ট হেল্পফুল। এটা আমার সৌভাগ্য বলতে হবে প্রতিবার ট্যুরে গেলেই এই ধরনের কিছু অসাধারণ মানুষের দেখা মেলে। খাওয়া শেষে ছাদে শুয়েই নৌকার স্টাফদের সাথে আমাদের শুরু হল তুমুল আড্ডা তখনো পার হইনি যাদুকাটা নদী, নদীর দুই পাশের অসাধারণ দৃশ্য আবারও আমাদের চোখকে শান্তির দিচ্ছিল। আরও প্রায় ৩-৪ ঘণ্টার পথ, এরপর সেই সাহেববাড়ি ঘাটে নামব, এবং সেখান থেকে যাব, হাসন রাজা মিউজিয়ামে।

যাদুকাটা নদীর স্বচ্ছ জলে লেখক

তখনো দুপুর, আকাশে রক্তিম সূর্য, আমরা আরো কিছু ছবি তুলে নৌকার পাটাতনে চলে এলাম। এসে দেখি আলাউদ্দিন ভাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। অন্যদিকে স্যারন বেশ আরাম করেই ঘুমাচ্ছে। আমাদের দলের কনিষ্ঠ ছোটভাই ধ্রুব সেও বেশ আরাম করে শুয়েছে, তার ঘুম আর ভাঙালাম না, এক তন্ময় ভাই শুধু জেগে। আমি জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম হাওরের পানিতে শিশুদের দাপাদাপি। হাওরের মাঝে এক বিচিত্র তাদের জীবন। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় আর মা কল দেননি, তাই মনে দুঃখ নিয়ে আমিই তাঁকে কল দিয়ে জানালাম আজ ফিরছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সবাই ব্যাগ গোছানো শুরু করে দিলাম। কারণ হাসন রাজার জাদুঘর দেখেই আমরা সোজা গাড়িতে উঠে পড়ব। আমাদের ঠিক করা হাইয়েজ গাড়িটি চলে আসবে ঘাটে। দেখতে দেখতে চারটার বেশি বেজে গেল আমাদের নৌকাও চলে এল সাহেববাড়ি ঘাটে। সবাই ব্যাগ-ঝোলা নিয়ে নৌকা থেকে নামলাম। যদিও আরও একদিন থেকে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু উপায় নেই। ফিরে যেতে হবে আবার সেই প্রাণের ঢাকা শহরে! হাইয়েজ নিয়ে ড্রাইভার চলে এলে আমরা আমাদের মালপত্র গাড়িতে রেখে হাঁটা দিলাম হাসন রাজার বাড়ির পথে। সাহেববাড়ি ঘাট থেকে বেশ কাছেই হাসন রাজার বাড়ি।

এই বাড়িতেই হাসন রাজা জন্মেছেন ১৮৫৪ সালে। এবং এই বাড়িতেই তিনি বিভিন্ন বিখ্যাত গান রচনা করেন। মিউজিয়ামে রয়েছে হাসন রাজার একটি মাত্র আলোকচিত্র, যা কলকাতার একটি স্টুডিও থেকে সংগ্রহ করা ১৯৬২ সালে।

১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে এই বাড়িতে ‘হাসন ফকিরের মেলা’ বলে একটি মেলা আয়োজন করা হয়েছিল। তখন থেকেই হাসন রাজার বাড়ি ও তাঁর ব্যবহৃত সামগ্রী দেখতে মানুষ ভিড় করত। এরপর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ‘হাসন একাডেমি’র জন্য ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেন। আর এই সবকিছুর ধারাবাহিকতায়ই আজকের জাদুঘর।

(তথ্যসূত্র : https://adarbepari.com/hason-raja-museum-sunamganj)

হাসন রাজা মিউজিয়ামে রয়েছে তাঁর নিজ হাতে লিখিত পাণ্ডুলিপি, তাঁর হাতের লেখা দেখে বোঝা যায় তিনি বেশ শিক্ষিত একজন মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষায় পারদর্শী।

এছাড়াও সেখানে রয়েছে হাসন রাজার ব্যবহৃত রঙিন আলখাল্লা, তরবারি, চেয়ার টেবিল যেখানে বসে তিনি গান রচনা করতেন। এবং তার স্মৃতি বিজড়িত অসংখ্য মূল্যবান দ্রব্য। যারা সুনামগঞ্জে ভ্রমণে আসবেন অবশ্যই হাসন রাজার বাড়ি পরিদর্শন করে যাবেন।

সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, রামপাশা, লক্ষ্মণশ্রী আর সিলেটের একাংশ নিয়ে পাঁচ লাখ বিঘার বিশাল অঞ্চলের জমিদার ছিলেন হাসন রাজা। পিতা ও মাতা উভয়ের কাছ থেকে পাওয়া বিশাল জমিদারির মালিকানা তার হাতে চলে আসে কিশোর বয়সে। কিন্তু কম বয়সে এমন সম্পদ লাভ করে বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। জাগতিক লোভ-লালসা, ক্ষমতায়ন, জবরদখল করেও তার প্রতিপত্তি বাড়ানোর কাজে প্রবৃত্ত ছিলেন। কিন্তু একসময় তার ভেতরের ভ্রান্তি ঘুচে যায়। তার মাঝে বৈরাগ্যভাবের সূচনা ঘটে। এক আধ্যাত্নিক স্বপ্ন-দর্শন হাসন রাজার জীবনদর্শন আমূল পরিবর্তন করে দিল। হাসন রাজার মনের দুয়ার খুলে যেতে লাগল। তার চরিত্রে এল এক সহৃদয়তা। বিলাসবহুল জীবন তিনি ত্যাগ করলেন। তিনি তাঁর সম্পদ জনকল্যাণের জন্য উইল করে দিয়ে হাওরে হাওরে ভাসতে থাকেন। সৃষ্টিকর্তার প্রেমে উন্মত্ত হাসন রাজা সেই সময় থেকেই নিজের লেখা গান গেয়ে বিখ্যাত হয়েছেন দেশে-বিদেশে। হাসন রাজার গানের মাঝে অন্তর্নিহিত রয়েছে অচিরস্থায়ী আয়ুষ্কাল এবং নিজের কৃতকর্মের প্রতি অপরাধবোধের কথা প্রসঙ্গ। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তার রচিত ২০৬টি গান নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। সংকলনটির নাম ছিল ‘হাসন উদাস’।

(তথ্যসূত্র : বণিক বার্তা, উইকিপিডিয়া)

বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছিল তাই আর সেখানে বেশিক্ষণ থাকলাম না, সেখান থেকে সোজা উঠলাম গাড়িতে গাড়ি চলতে শুরু করল। প্রতিবার ভ্রমণ শেষেই আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না, মন খারাপ হচ্ছে অপরূপ সুন্দর এক স্থান ত্যাগ করছি এই ভেবে আর আমার সাথে থাকা এতো ভালো মানুষগুলোও কিছুক্ষণ পর নিজেদের ঘরে ফিরবে, তখন তাদের সান্নিধ্যও আর পাব না।

গাড়ি চলছে, গাড়িতে বাজছে হাসন রাজার সেই বিখ্যাত গান— স্বর্গপুরী ছাইড়া কানাই আইলা এই ভুবনে,/ হাসন রাজায় জিজ্ঞেস করওইন আইলায় কী কারণে? কানাই তুমি খেইর খেলাও ক্যানে, রঙের রঙিলা কানাই….।

উৎসর্গ : স্যারন 

নাঈম হাসান : কথাসাহিত্যের নতুন তরুণ। জন্ম ১৭ ডিসেম্বর, ঢাকায়। পড়াশোনা করেছেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। লিখছেন গল্প, উপন্যাস আর কবিতা। ভালোবাসেন ভ্রমণ, সিনেমা, আবৃত্তি ও ক্রিকেট। প্রিয় লেখক সত্যজিৎ রায়, আহমদ ছফা, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে।

প্রকাশিত বই : সাহিত্যপ্রেমী পাত্রী, হ্যালোইনের রাত, অপারেশন নোয়াখালী, ভয় অমনিবাস, অপরাজিত নিরানব্বই।

 

+ posts

Read Previous

একজন মন্ত্রীর একদিন

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন- ৩য় সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *