অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৩, ২০২৪
২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৩, ২০২৪
২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অশোক অধিকারী -
ফার্স্টম্যান, নোরা অথবা আর্টেমিস

“দেখব না ওই সিনেমা।” কী এমন হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের।কী সিনেমা আর কেনইবা তিনি দেখবেন না! ক্ষমতার ঊর্ধ্ব শরীর নাড়িয়ে আধিপত্যবাদী শক্তি যখন এমন কথা বলে, তখন পাশ ফিরে শুতেই হয়। ২০০৫। মার্কিন দেশের ডাকসাইটে অধ্যাপক জেমস আর হ্যানসেনের সেই বিখ্যাত বই, ‘ফার্স্টম্যান : দ্য লাইফ অব নিল এ আর্মস্ট্রং’ প্রকাশ পেল। ২০১৮ সালে এই জীবনীগ্রন্থ নিয়ে সিনেমা করলেন অস্কারজয়ী পরিচালক ডেমিয়েন শ্যাজেল। ১৯৬১ সালে আর্মস্ট্রং যখন নাসার পাইলট হিসেবে কাজ করছেন, সিনেমার শুরু সেখান থেকে। শ্যাজেলের দুঃসাহসিক কাজের একটা বদনাম(!) আছে। সিনেমার শেষ দৃশ্যকে তিনি বদলে দিলেন। চন্দ্রজয়ের পর চাঁদের বেয়াড়া খানাখন্দের ওপর দাঁড়িয়ে মার্কিন দেশের পতাকা ওড়ানোর কোনও দৃশ্য শ্যাজেল রাখলেন না। এতবড় বিশ্বজয়ী অভিযানের শেষে চাঁদের মাটিতে সে দেশের বিজ্ঞানীদের আতিথ্য গ্রহণের উল্লাস পতাকায় কেন নাড়লেন না তা নিয়ে দেশজুড়ে যখন হল্লা চলছে, তখন রায়ান গসলিং (আর্মস্ট্রংয়ের চরিত্রাভিনেতা) শ্যাজেলকে ভয় তাড়িত হয়ে জানালেন, এবার কী না কী হয়ে যায় আর কি! শ্যাজেল সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিলেন, “রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ওই সিনেমা বানাননি। সিনেমাতে চাঁদে যাওয়ার এই গোটা ঘটনাকে তিনি শুধু মার্কিন দেশের নয়, গোটা মানবজাতির অভ্যুদয় হিসেবেই তিনি দেখিয়েছেন।” সিনেমায় আর্মস্ট্রংয়ের স্ত্রী (জ্যানেট) যখন তার ছেলে (রিক)-কে বলে, তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ যে, তোমার বাবা চাঁদে যাচ্ছেন! রিকের অভিজ্ঞতায় তখনও ছিল যে, বাবার চাঁদে যাওয়া আসলে কোনো ঘটনাই নয়। তাই সে বিস্মিত তো হয়ইনি উপরন্তু, বাবার এই অভিযান যে নিছক গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া তা মা’র কাছে কবুল করতেও তার এতটুকু দ্বিধাবোধ হয়নি।

     পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে’ যখন গান করলেন মান্না দে, তখন সুর ও গায়কী মিলে যে তোলপাড় তাঁর কণ্ঠে খেলে গেল, তাতে প্রেমিক ও অপ্রেমিক মিলে গায়ক যে শুধু সাধুবাদ দিলে তাই নয়, তাদের কণ্ঠ রবীন্দ্রনাথও খেলে গেল আশ্চর্য অনুপমায়, ‘আমরা দু’জনা স্বর্গ খেলনা খেলিব না ধরণীতে।’ মান্না দে’র ঐ গানের মাঝে আছে, ‘ঝলমল করিও না গো তোমার ঐ অতো আলো/বেশি রূপ হলে পড়ে সাবধানে থাকাই ভালো।’ একুনে জনাবারো মানুষ এখন পর্যন্ত যে চাঁদে গিয়েছেন তারা কেউ চাঁদের প্রেম আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল হয়ে নেচে নেচে এই গান গেয়েছে কিনা এখন পর্যন্ত তার কোনো ‘পেগাসাস’ রিপোর্ট ভারতবর্ষ অথবা মার্কিন দেশের সংসদকে তোলপাড় করেনি, তবে এটা জানা গেছে যে, দ্বিতীয় মানব হিসেবে চাঁদে নামতে গিয়ে প্রস্রাব করে ফেলেছিলেন এডউইন অলড্রিন। এও হয়! আহা পদ্য লেখার শীতল জাজিম জুড়ে এত প্রাকৃতিক দস্যুতা লুকিয়ে আছে। চাঁদমামা কী লুকিয়ে সেদিন একফালি গেয়ে দিয়েছিল , কে জানিত আসবে তুমি গো/অনাহূতের মতো। ফার্স্টম্যান আর্মস্ট্রংয়ের জীবনীগ্রন্থে এ-ও জানিয়েছেন, চাঁদে তো বাতাস নেই তাহলে মার্কিন পতাকা উড়বে কেমন করে! ট্রাম্পের বইটি পড়া উচিত ছিল, তাহলে আর গোসা থাকত না।

     “বাউলদের মতে, নারী ও চাঁদের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।…এখানে বলা দরকার, বাউলদের মতে, পুরুষরা সবসময়ই উর্বর থাকে না। পূর্ণিমার সময় পুরুষদের উর্বরতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। সব শুনে মযহারুল বললেন, “সব কথাই ঠিক লিখেছে, আর এসব কথা তো বাউল গানেই আছে।। ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’ শোনেননি? আরেকটা গান আছে ‘অমাবস্যায় চাঁদের উদয়’ শুনেছেন (গভীর নির্জন পথেঃ সুধীর চক্রবর্তী)। জীবনানন্দের ‘জানি না তো কিছু মনে হয় শুধু এমনি তুহিন চাঁদের নিচে/কত দিকে দিকে-কত কালে কালে হয়ে গেছে কত কী যে!’ পড়লে চাঁদের গায়ে পড়ার স্বভাব তো যাবেই আবার অমাবস্যার রাতেও চাঁদ উঠতে দেখে ফাঁকা শ্মশানেও কেউ জড়ানো গলায় চিৎকার করে উঠবে, ‘বাবা শালাতো মরেইছে, ঢাল এক গোলাস।’ চাঁদকে নিয়ে এই চাঁদা তুলে দেখনদারি কখনও হাতের ওপর হাত রেখে প্রাতিষ্ঠানিক সিঁদুর পরিয়েছে যুগল মূর্তিতে। আবার কখনও শিশিরের চাঁদ সাক্ষী থেকেছে কে এল, আর কেই-বা গেল এই নশ্বর প্রেমে। ‘নোরা’ তেমনই একজন মেয়ে, এই উপমহাদেশের আবিষ্কার তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আসল নাম নোরা আল মাক্রশি। আরব আমিরাতের ২৮ বছর বয়সের এই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তরুণী নাসার জনসন স্পেস সেন্টার থেকে দৌড় লাগাবে চাঁদে। তার সঙ্গী হিসেবে যাবে ৩২ বছরের মোহাম্মদ আলমুল্লাহ। নোরা শব্দের অর্থ: উদার বা বন্ধুত্বপূর্ণ। ইবসেনের নোরা (অ্যা ডলস হাউস) পুরুষশাসিত সমাজের গালে এক সপাট থাপ্পড়। তার ব্যক্তিত্বের মাধুর্য পুরুষকে জাতে তোলে। কখনও তাকে নারীমুক্তির বিশ্বপ্রতীক, আবার কখনও জাতীয় প্রতীক হিসেবে ইতিহাসকাররা অলঙ্কৃত করেছেন। আরব বিশ্বের নোরা যে প্রথম মহিলা হিসেবে চাঁদের রসট্রামে হাঁটতে চলেছে একি ‘বামন হয়ে চাঁদ ধরতে’ চাওয়ার ইচ্ছে! অর্ধেক আকাশের পূর্ণ মায়ায় চন্দ্রপৃষ্ঠ যখন ২০২৪-এর মধ্যে কীর্তিত হতে চলেছে, তখন বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠছে জেনে যে, সদ্য তালিবান দখলে যাওয়া কাবুলে মেয়েদের পড়া লেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে বলে তারা গোপনে নেট ব্যবহার করে পড়াশোনা চালাচ্ছে। প্রজন্ম যাতে পিছিয়ে না যায়, তাই এই গোপন মনন চর্চা তাদের। নোারার ক্ষেত্রে কী সুন্দর খেলে যায়, চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা…। চন্দ্রজয়ের (১৯৬৯) বাহান্ন বছর পরে যা সব ঘটতে চলেছে, তাতে আর্মস্ট্রংদের বাজার গেল আর কি! তাদের লেগেছিল তিনদিন। আর নোরা’রা চাঁদে খেলবে, গাইবে নেচে বেড়াবে সাতদিন। ধর্মনিরপেক্ষ চাঁদমামা’র ঘরে যাতে সাম্প্রদায়িক হাওয়া লাগতে না পারে নাসা কী সেই উদ্দেশ্যেই এই ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নোরা নিজেই জানিয়েছে, ছোটবেলায় পড়তে বসে কাগজ আর কার্ডবোর্ড দিয়ে বানিয়ে তুলত মহাকাশযান। স্বপ্ন দেখত চাঁদে যাচ্ছে সে। এখন তা সত্যি হতে চলেছে। ‘আয় আয় চাঁদমামা/টি দিয়ে যা’ আর নয়। এবার নোরা সাদা জ্যোৎস্না আনতে যাচ্ছে চাঁদে। অন্তরের শিশুটিকে জাগতে দেখে আমাদের মাঠ, বন, বনান্তর আলোয় ভেসে যাবে। নোরা যাবে ‘আর্টেমিস’-এ চড়ে। আর্টেমিস আসলে নাসার সেই প্রজেক্ট, যা কিনা এই অসাধ্য সাধন করতে চলেছে। আর্টেমিস। গ্রিক মিথোলজির আ্যাপোলোর (সংগীত ও আলোর দেবতা) যমজ বোন আর্টেমিস। জঙ্গল, পাহাড় ও চাঁদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে তাকে মনে করা হয়। বিষ্ণু দে তাঁর ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ কবিতায় লিখছেন, “আজো তাই লাবণ্যের ঘরে/আমার চেতনা ছেয়ে মায়া জাগে লাবণ্যের নিশ্বাসের স্বরে।” অথবা, “ক্লান্ত স্থির আকাশের বুকে/দূরগামী সূর্য আজো ঢেলে দেয় তবু/গলন্ত তামার দীপ্ত রক্তিম চুম্বন।” দূরগমনের মায়া থেকে রাতের তারায় জাগার চিরন্তনী সুধা রাত্রির চাঁদ। নোরা তার আর্টেমিসের আতিথ্য নিয়ে স্বপ্নের বাস্তব উজ্জীবন। এখানেই একটি উড়ান সার্থকতা পায় তার তৎপুরুষ অধ্যায়ে। ‘বাঁশি’ যেমন খুন করতে পারে আবার চাঁদনীরাতও আলিঙ্গনে যেমন তৃপ্ত করে নর ও নারীর উন্মত্ত ভাসান। সেখানে রাত্রি গভীরের নীরবতায় জেগে থাকে মন, আলো আর সংকলিত স্মৃতিচিহ্ন। তার বুকে মানবের পদচিহ্ন সৃষ্টির উল্লাসে মুখর কবিতা। চাঁদ কী জানে যারা আসে, যারা যায় আরও যারা আসবে বলে ভগবৎ গীতা অথবা প্রিয়মানুষের শেষ লেখা চিঠি নিয়ে চন্দ্র অভিযানে যায়, তাদের নস্টালিক হতে কোনও বাধা নেই, যদি পায় মাতৃস্তনের গন্ধ অথবা মাতৃজঠরের উলুধ্বনি।

     উপগ্রহের বদনাম তার ঘুচবার নয়। আবার সূর্যের ধার করা আলো নিয়ে তার ডব ডবানি, সে-ও থামবার নয়। তারপরেও তাকে নিয়ে আদর করার আর অন্ত নেই। ‘তোমার প্রেম হত যে মিছে’-এ কথা সে বলতেই পারে! তাকে সাক্ষী রেখে ফাঁকা মাঠে মাথায় আলোর সামিয়ানা টাঙিয়ে যত প্রেম, বিরহ, হনন, সংহার আর রক্তপাত। আবার না থাকলেও তো বিপদ। তাহলে, এই অভিযোজনে মত্ত প্রকৃতি সত্তার তো অন্তর্জলি। অভিকর্ষ অনুভূতি ছাড়া সমুদ্রের এই উড়নচণ্ডী খেয়াল আসত কী করে। ঋতুর বন্ধ্যা ক্ষরণ দিয়ে কী জীবন আসত! “এই ফাগুনী পূর্ণিমা রাতে, চল্ পলায়ে যাই।” -এই পলায়ন প্রবৃত্তির যে কনসেপ্ট, তার পেছনে যাবতীয় আবিষ্কারের মিলনান্তক পরিণতি আমাদের ছুটিয়ে বেড়ায় যতক্ষণ না অন্ধকার নেমে আসে। কিন্তু এই উভলিঙ্গ সত্তায়, কখনও চাঁদের বুড়ির হেঁটে পার হওয়া দৃশ্যের সঙ্গে চাঁদমামার অস্তিত্ব- চন্দ্রা, ইন্দু অথবা হিমাংশু, শীতাংশুর সঙ্গে বেশ মানিয়েই তো ঘর সংসার করছে। ‘আমরা প্রত্যেকেই এক একটি চাঁদ’, তার অবশেষে আমাদের পরকীয়া: ‘চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি।’

Read Previous

ঐতিহ্যময় নাগরীলিপির নবজন্ম, স্বপ্নদ্রষ্টা মোস্তফা সেলিম

Read Next

যুগলবন্দী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *