অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৯, ২০২৪
১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৯, ২০২৪
১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ওয়াহিদুর রহমান শিপু -
অনিমেষ-মাধবীলতার স্রষ্টা – চিরন্তন বিপ্লবী সমরেশ মজুমদার

ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার গত ৮ মে ২০২৩ কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলার সমাজ পরিস্থিতি নিয়ে তার অমূল্য রচনা বাংলা, ভারত ও বিশ্ববাসীর মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের দৈহিক মৃত্যু হয়েছে ঠিকই কিন্তু তার সৃজিত চরিত্রগুলোর নাম যুগ যুগ ধরে উচ্চারিত হবে। তার অনন্তযাত্রায় শান্তি কামনা করি।

যশস্বী কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ১৩৪৮ সনের ২৬ ফাল্গুন, ১০ মার্চ ১৯৪২। তার শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের চা বাগানে। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল থেকে। তিনি বাংলায় গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে, মাস্টার্স সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবনে তিনি আনন্দবাজার প্রকাশনার সাথে যুক্ত ছিলেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তার প্রচণ্ড আসক্তি ছিল। তার প্রথম গল্প ‘অন্যমাত্রা’ লেখাই হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসেবে, আর সেখান থেকেই তার লেখকজীবনের শুরু।

সমরেশ মজুমদারের দীর্ঘ সাহিত্য-যাপনের সূচনা কাল যে উপন্যাসটির নামকরণের যথার্থতা লক্ষ করি। দৌড় উপন্যাসের উৎসর্গে লিখেছিলেন— ‘দৌড় আমার প্রথম উপন্যাস, প্রথম প্রেমে পড়ার মতো’। এ উপন্যাসের যবনিকাপাতটাও মনে রাখার মতো: ‘মেয়েদের চোখের দৃষ্টি মাঝে মাঝে এক হয়ে যায় কী করে! মায়ের, নীরার অথবা এখন এই জিনার? যে চোখ শুধুই বলে— ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো— ঈশ্বর, তবে কেন বুক জ্বলে যায়!’

উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ— এই ট্রিলজি উপন্যাসের ওপরই বোধকরি দাঁড়িয়ে আছে সমরেশ মজুমদারের পাঠকপ্রিয়তার মসনদ। অনিমেষ আর মাধবীলতা, সমরেশের পাঠকের কাছে আপসহীন বিপ্লবীর প্রিয় দুটো নাম। অনিমেষ নামে এক মফস্বলে ছেলের উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে কলকাতায় স্থানু হওয়া সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির নির্ঘোষ অগ্নিগর্ভ পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত— হওয়া সেই সঙ্গে আত্ম-অনুসন্ধান ও নিরীক্ষামূলক গল্প উত্তরাধিকার। অনেকটা পূর্ব দিগন্তে বিপ্লবী লাল সূর্য উঠছে এরূপ ঘরানার উপাখ্যান, বাস্তবতা সম্বন্ধে ধারণাহীন সহজ-সরল এক তরুণের উপলব্ধির উন্মেষকালের গল্প উত্তরাধিকার।

তারপর কালবেলা। পাঠকপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী এক উপন্যাস। রাজনীতিতে অনিমেষের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়া, আদর্শের সঙ্গে বাস্তবতার বিপুল ফারাক উপলব্ধিজনিত হতাশা এবং তারপর তার জীবনের এক উজ্জ্বল উদ্ধার, যার নাম মাধবীলতা। মাধবীলতা যেন তার জীবনের ধ্রুপদি লয়ে ঝড়, ঝঞ্ঝা, সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে যে অনিমেষকে থির করে রাখে। কালবেলা আমাদের জানায়, বিপ্লব ও প্রেম পরস্পরবিরোধী হতেই হবে এমন কথা নেই, পরম বিশ্বাসে একে অন্যের হাতে হাত ধরেও তারা চলতে পারে। কালবেলার পাঠকরা কি কখনও ভুলতে পারবেন সেই উক্তি— বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা! এই ট্রিলজির তৃতীয় উপন্যাস কালপুরুষ।

প্রজন্ম বদলে গেছে। সিনেমার রিলের মতো প্যানারমাময় ক্লাইম্যাক্সের মতোই অনিমেষের হাত থেকে ব্যাটন তুলে নিয়েছে তার পুত্র অর্ক। নিজের আদলে পুত্রকে গড়তে চেয়েছিল অনিমেষ, কিন্তু পঙ্কিল সমাজব্যবস্থার ঘূর্ণাবর্তে পড়ে অর্ক হয়ে পড়ল অ্যান্টিসোশ্যাল। চরম দারিদ্র্যে জার জার হতে হতে জীবনযুদ্ধ করতে থাকা অনিমেষের কাছে জীবনটাকে মনে হয় ট্র্যাজিক কোনো এপিকের মতো। কোথাও আলোর কোনো রশ্মি নেই ঘোর অমাবস্যা যেন ত্রিলোকের বাইরের এক অসূর্যলোক। অভাব, দারিদ্র্য, অসুস্থতা, পুত্রের ডিরেইল্ড হয়ে যাওয়া— একের পর এক বিপদ আর তুঙ্গ পর্যুদস্ত তার জীবন। কিন্তু জীবনসায়াহ্নে এসে নিকষ কালো মেঘের মান্দাসের আড়ালে সুবর্ণরেখার মতোই এক টুকরো শুভাকাঙ্ক্ষা হয়ে আসে পুত্র অর্কের আত্মোপলব্ধি।

সমরেশের আরেক মাস্টারপিস সাতকাহন। বহু প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে স্রোতের বিপরীতে এক মহিয়সীর এগিয়ে চলার গল্প সাতকাহন। নাম তার দীপাবলি। যেন প্রজ্জ্বলিত মশাল। কণ্টকময় পথ। সমাজ, পরিবার, স্বজন- সবাই যেন বাঁধার সঙ্গিনের দাঁত কেলিয়ে ভেংচি কাটে। দ্বিধা আর লড়াইটা খোদ নিজের সঙ্গেও। তবু চক্রব্যূহ ভেদ করে অভিষ্ঠ সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যায় দীপাবলি। সকল নারীই যেন দীপাবলির মধ্যে নিজেকে আরশীর মতো দেখতে পায় এবং নিজেকে ভাঙে-গড়ে, ঘুরে দাঁড়ায়। মানুষ অতিপ্রাকৃত প্রাণী নয়। দীপাবলির মধ্যেও সহজাত ত্রুটি লক্ষণীয়। কিন্তু তার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকার যে একরোখা জিদ, সেটিই তাকে অনন্যতা দিয়েছে বোধকরি। তার দিকে তাকিয়ে বহু নারী ভাবতে শিখেছে, ‘দুঃখ, দহন, সন্তাপ, মৃত্যু, বিরহদহন’ সত্ত্বেও ম্রিয়মাণ হয়ে থাকা যাবে না। পরিস্থিতি যাই হোক, পেছনে ফেরার সুযোগ ও ফুরসত নেই। একটা প্রজন্মের অসংখ্য নারী দীপাবলি হতে চেয়েছে। সব মিলিয়ে সমরেশের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে দীপাবলি অনন্য, যা উপন্যাসটিকেও একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে।

সমরেশ প্রাইভেট লিমিটেড-এর সাথে যুক্ত ছিলেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তার প্রচণ্ড দুর্বলতা ছিল। তার প্রথম গল্প ‘অন্যমাত্রা’ মঞ্চনাটককেন্দ্রিক গল্প, আর সেখান থেকেই তার সাহিত্যযাপন শুরু। তার লেখা অন্যমাত্রা ছাপা হয়েছিল দেশ পত্রিকায় ১৯৬৭ সালে। সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ ছাপা হয়েছিল দেশেই ১৯৭৫ সালে। তিনি শুধু তার সাহিত্যসাধনা গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী থেকে গোয়েন্দাকাহিনী, কিশোর উপন্যাস লেখায় তার মুন্সিয়ানা উল্লেখযোগ্য। তার প্রত্যেকটি উপন্যাসের বিষয়বস্তু ভিন্ন, রচনার গতি ও গল্প বাচনিক বিভঙ্গ পাঠকমহলকে আন্দলিত করে। চা বাগানের মদেসিয়া সমাজ থেকে কলকাতার প্রাকৃতজনরা তার কলমে উঠে আসেন নতুন নতুন আঙ্গিকে। সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

অনেক অসাধারণ গল্পের জাদুকর সমরেশ। খুঁটিমারি রেঞ্জ’, ‘খুনখারাপি’, ‘কালিম্পং-এ সীতাহরণ’ ইত্যাদি গল্পে দুরন্ত রহস্য সমাধান করে অর্জুন। তার লাল মোটরবাইক কার্যত এক ‘আইকনিক’ অংশ হয়ে ওঠে গল্পের। লেখক অর্জুনকে শুধু বাংলাতেই আটকে রাখেননি। নিয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকায়, অর্জুন কেস ধরেছে একেবারে নিউইয়র্ক সিটিতে।

উত্তরবঙ্গের সমস্ত সৌন্দর্য, আবেগ, রহস্য ধরা দিত তার কলমে। কলকাতাবাসী বহু পাঠক তার লেখাতেই চিনেছিল জলপাইগুড়ি শহরের কদমতলা, রূপমায়া সিনেমা, হাকিমপাড়া, শিল্প-সমিতিপাড়া, রায়কতপাড়া।

সমরেশ আন্তর্জাতিকভাবেও অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮২ সালে আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার ও আইয়াইএমএস পুরস্কার জয় করেছেন। চিত্রনাট্য লেখক হিসাবে জয় করেছেন বিএফজেএ, দিশারী ও চলচ্চিত্র প্রসার সমিতির এওয়ার্ড। সমরেশ কলকাতা ও বাংলাদেশ এর সর্বকালের অন্যতম সেরা লেখক হিসেবে পাঠকমন জয় করেছেন। সমরেশের জন্মের কালে বাতাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা আর বারুদের গন্ধ। দেশে উত্তাল স্বাধীনতা আন্দোলন। তার পরিপক্ব হওয়া, উত্তরবঙ্গকে পাখির চোখে দেখা, জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল, কলকাতায় আসা, স্কটিশ চার্চ কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা— সামষ্টিক বিশ্ব ক্লাসিক সাহিত্য পঠন পাঠন তার ছিল তার বিভিন্ন উপন্যাসে তার প্রতিবিম্ব হয়ে ধরা পড়েছে বটে। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক চেতনাবোধ ও প্রলেতারিয়েতদের উড়ুক্কু জীবন সমরেশের মনন ও কথন— এ এক আদর্শিক চেতনাবোধ জাগ্রত করেছিল সমসাময়িক তরুণ পাঠকদের। আর এই আদর্শ অনেক সময় ফ্যান্টা‌সি বা ইউটোপিয়া হয়ে তরুণ তরুণীদের বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েতদের ফারাকটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন এটা বোদ্ধমহল বলে থাকেন। বোদ্ধগণ এও বলেন যে আজীবন সমরেশ করপোরেটেড জীবনযাপন করেছেন তাহলে তার নিজেকে সমাজতান্ত্রিক হওয়ার কারণ নেই। বিয়সটি সত্য হলেও তা কিন্তু প্রতিষ্ঠা পাইনি। পাইনি একারণে যে সমরেশ দেখিয়েছেন রাষ্ট্রের গণহিস্টরিয়ার মতো নকশালবাড়ি আন্দোলনকে চিহ্নিত করল। আর গভীর ফ্যান্টা‌সি ও ইউটোপিয়াপ্রবণ ছেলেমেয়েদের শেষ পরিণতি তিনি বাস্তবতার নিক্তিতে তুলে দেখাতে পারলেন। আদপে তিনি মনেপ্রাণে একটি তুঙ্গ কাপালিক কমিউনিস্ট সত্তাকে মননে প্রথিত করেছিলেন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত জীবন ততটা গুরুত্বপূর্ণ তো নয়ই বরং এটা আড়াল হয়ে গেছে তার লেখার পাহাড়সম শক্তিমত্তার কাছে বোধকরি। সমরেশের লেখার ভূমি হলো উত্তরবঙ্গ ও কলকাতা। তবে কালবেলা-য় বীরভূমের লাল মাটের সোঁদা গন্ধবহ মহক পাঠকরা দীর্ঘদিন ধরে শুঁকছেন, ঠিকানা ভারতবর্ষ-তে পলাশ ফুলের মাটি পুরুলিয়া, দক্ষিণবঙ্গের অনুষঙ্গও এসেছে তার নিজের মতো করেই অবশ্য।

সমরেশের দৈহিকভাবে মৃত্যু হয়েছে ঠিকই কিন্তু তার সৃজিত চরিত্রগুলোর নাম যুগ যুগ ধরে বাংলা কথাসাহিত্যের পাঠক কমিউনিটিতে উচ্চারিত হতেই থাকবে। তার চরিত্ররা অনন্তকাল আমাদের তরুণ-তরুণীদের সমাজতান্ত্রিক চেতনা বিনির্মাণে সম্মোহিত করবে। সমরেশের নিঃসঙ্গ মানস ছিল একজন বিপ্লবীর, একজন প্রলেতারিয়েতের। এখানে তিনি খুব নিঃসঙ্গ কারণ তার যাপিত জীবনের আশপাশ সবকিছুই করপোরেটেড অন্যদিকে চেতনা হলো সমাজতান্ত্রিক। বিপ্লবীদের মৃত্যু নেই যেমন নির্মেদ সত্য তেমনি আমরা বলতে পারি তার প্রস্থান হলেও তার সৃষ্টিভাণ্ডার বিপ্লবীদের ভাবনার অন্তরালে, দোলাচলে একজন চিরন্তন বিপ্লবীর কথকতা হিসেবে বাস করবে এবং ক্ষণে ক্ষণে পুঁজিবাদী পেটিবুর্জোয়া জাতিরাষ্ট্রের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ক্ষীণ কিংবা বৃহৎ সমাজতন্ত্রের ঝাণ্ডা উত্তোলন করবে।

 

Read Previous

ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি 

Read Next

লর্ড ডানসানি’র সাতটি উপকথা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *