
প্রথম পরিচয়, পড়ালেখার ভেতর দিয়ে। তিনি পোস্টমডার্ন তত্ত্বের চর্চা করতেন। আমরা চিহ্ন-পত্রিকার ধারাবাহিক কাজের অংশ হিসেবে একসময় পোস্টমডার্ন-চর্চার দিকে আগ্রহী হই। ভেবে নেই, ক্রোড়পত্র করা যায় কি-না। সেইটা সূত্র। তখন ১৯৯৩ কি ’৯২-র দিকের একটা পুরনো কাজের ফর্দ পেয়ে যাই- ‘পোস্টমডার্ন মানচিত্র’। দেখি প্রভাত চৌধুরীর অনবদ্য একটি লেখা। মনে হচ্ছিল, খুব রাশভারী বয়স্থ রাগী মানুষ হবেন তিনি। যোগাযোগও সহজ হবে না। বুড়োদের তো বুঝিবা ঘুম আর আরামের সময় ধরে চলতে হয়! কলকাতায় খবর নেই। পটলডাঙার বাড়িতে লোক পাঠাই। টুকরো টুকরো অনেক ঘটনা! কিন্তু বাজে কিছু ঘটলো না। তিনি অত্যন্ত দ্রুত বন্ধু হয়ে গেলেন। একেবারে কল্পিত ভাবনার বিপরীত। তারপর অবাধ ও উন্মুক্ত। কতোবার দেখা হয়েছে, বাসায় গেছি- একদম আলাদা। বিশিষ্ট ভদ্রলোক। খুব এম্বিশাস, নিরহংকার কিন্তু দগদগে দাপটের ঝলকানি- সবটা মিলে প্রসার ও প্রকাশের স্বভাবে অতুলনীয়।
কোনো গল্প নয়, তাঁর কবিতা নিয়ে, কবিতা পাক্ষিক নিয়ে কিছু বলবো। কবিতা ও কবিতা পাক্ষিক একাকার, নেতৃত্বে প্রভাত চৌধুরী। বয়স পেরুলো, আটাত্তর করে করে আশি উত্তীর্ণ। পটলডাঙার বাড়িটাও প্রভাত চৌধুরীর মতোই। কতো পুরনো বাড়ি, ঘোরানো-প্যাঁচানো সিঁড়ি, ঠিক তিনতলা নাকি আড়াইতলা- তারপর চতুষ্কোণ লন, ছাদটা প’ড়ো প’ড়ো স্বভাবের। প্রভাত দা, ফোন করলেই অপেক্ষা, কই- কদ্দুর গো! যূথিকা (স্ত্রী) বসে আছে। পৌঁছেই একগাদা বই, আর তখন কেউ না কেউ ত থাকবেনই। হয় নাসের দা, রুদ্র কিংশুক বা আর কেউ। সবার নাম মনে নেই। হায়! করোনা… নাসের দা নেই, প্রভাত দা নেই, আমাদের আনিস স্যার নেই, দেবেশ দা নেই, হাসান স্যার নেই- সব নেই, এখন আমরা অথর্ব-কুল বেঁচে আছি! কবিতা পাক্ষিকের আদর্শ পোস্টমডার্ন। আমরা যখন পোস্টমডার্ন সংখ্যা করি তখন প্রভাত দা খুশি হলেন- ‘কলকাতা বইমেলায় কবিতা পাক্ষিকের স্টলে ‘চিহ্ন’ থাকবে, অবশ্যই দেবে।’ সেবার মেলাটা খুব মজেছিল, এরকম বিবিধ- নানা কারণে।
কবিতা কী? কেন কবিতা? এসব প্রশ্নের উত্তর সেই বিরানব্বুইয়ে পাওয়া পোস্টমডার্ন বুকলেটটা কাজে লাগে। বলা আছে : ‘দ্য অনেস্ট শার্ট’, ‘দ্য ক্যাটস আই’, ‘ব্লু বক্স’। সময়ের সাথে কবিতাচিন্তার নবায়ণ। ‘পোস্টমডার্নিজম কোনো আন্দোলনের নাম নয়। পোস্টমডার্নিজম শব্দটি একটি কলখণ্ডকে চিহ্নিত করার জন্য আমরা ব্যবহার করি।… উচ্চপ্রযুক্তিবিপ্লবের পর পোস্টমডার্ন যুগের শুরু।’-কবিতা একরকম হয় না। ভাষাটা আসে ভেতর থেকে। ভেতরের সেই ভাষা সমাজদ্বন্দ্বের ফল। ইতিহাসের ধারা। কবিতা পিছিয়ে থাকে না। ছন্দটাও সে জুড়িয়ে নেয়। সবমিলে একটা আকৃতি তার পেয়ে বসে- নিয়ে নেয়। বলার অপেক্ষা নেই। তাঁর কবিতায় হাত বুলিয়ে পরম পরশে তিনি বলেন, আধুনিকতা তো উত্তর আধুনিক নয়! আধুনিকতার ভেতরেরই একটা ফর্ম। সেটি প্রকৃত কবিকে প্রসব করতে হয়। তারপর পড়া শুরু। ধ্বনিকে ধ্বনন করে দুন্দুমার পড়তে থাকেন, বলতে থাকেন- নাসের ভাই সৌম্যসত্তায় সেসব নির্বিকার শুনে যান, যূথিকাদি তখন এক ভান্ড ‘দরবেশ’ (কলকাতার পুঁটিরামের মিষ্টান্ন) নিয়ে হাজির। এবার প্রভাতদা থেকে কিছু উদ্ধৃতি নেই-
(ক)
প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সূর্যের চোয়াল খসে পড়ে
শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসা উত্তাপ পায়ের চেটোয়
জম করে কে তুমি আঘাত করো আমার শরীরে
বুকের পাঁজর ভেঙে থেতলে দাও হৃদপি্ণড
আমি জ্বলে উঠি সূর্যের মতন
প্রজ্বলিত শরীর নিয়ে ছুটতে থাকি দারুণ তৃষ্ণায়
(খ)
গুণচিহ্ন সম্পর্কে সর্বশেষ সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে
গুণচিহ্নরা মূলত নিরামিষাশী, তাদের উপাসনাগারে
যে কটি বিগ্রহ থাকে, সেই বিগ্রহের মাথায়
যে কটি বিগ্রহ থাকে, সেই বিগ্রহের মাথায়
যে চাঁদোয়াটি টাঙানো হয়, সেই চাঁদোয়ার
চারকোণে কোনো নৈশপ্রহরী থাকে না, অথচ
আমরা জানি নৈশপ্রহরী ছাড়া যে কোনো চাঁদোয়াই
উড়ে যেতে চায় চাঁদের দিকে- গুণচিহ্নগুলি,
সচেতন গুণচিহ্নগুলি চাঁদোয়ার এই প্রবণতার কথা
জানা সত্ত্বেও উপাসনাগারে হলুদ মোমবাতি
যে ভাষায় আলো দেয়, সেই ভাষাতেই
যে কোনো বিজোড় সংখ্যার সঙ্গে কথা বলে।
এসব কবিতা বিশ্লেষণের ইচ্ছে এখানে নেই। কবিতার কাজ কেমন সেইটির পরিচয় এতে দেখা যায়। সেই ধ্বংসকালীন কবিতান্দোলন, ষাটের সেই শ্রুতি থেকে কবিতাকে রক্তমাংসে নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত বিসর্জিত হয়েছিল তাঁর কবিতায়। আমরা হয়তো জানি না, কবিতা কীভাবে সংক্রমিত হতো তার জীনে ও জীবনে কিন্তু তিনি পাগল, নিরঙ্কুশরূপে কবিতাপাগল বান্ধব- সন্দেহ নেই। ইন্টারভিউয়ে জিজ্ঞেস করি, কেন কবিতার জন্য এতো পদক্ষেপ, বিসর্জিত হওয়া! তিনি বলেন, আমার নিঃশ্বাস কবিতা, অক্ষরসমুদ্র। হ্যান্ডবুক, নোটবুক, সম্পাদকীয়, কবিতাপাক্ষিক, মাসিক-দৈনিক কবিতা সবটাই আমার কবিতা, আমার জীবন। এই প্রাণ নিয়েই তো আমার চলা। রবীন্দ্রনাথের অনেক গানে, নিসর্গকে চেতনার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। এমনকী লেখনীকেও। প্রভাতদার প্রিয় রবীন্দ্রনাথ যেন তাকেও প্রকৃতির মধ্যে মিশিয়ে নেয়। কতোসব বিচিত্র লেখা আর লেখক তৈরি, ক্লান্তিহীন তার গ্রহণ ও শ্রবণক্ষমতা। ব্রাত্য-অব্রাত্য সকলকেই জায়গা দিয়েছেন। কাছে টেনেছেন, প্রেরণা দিয়েছেন। বদলাতে বলেছেন। বিনিময়ে শূন্য। একলা চলাই যার পাথেয়, তার সবই তো শূন্য, নির্ভয়- নিঃশঙ্ক তিনি।
নিরন্তর লিখেছেন নিজে, কবিতানামে নিজেকে করেছেন নমস্য- তবে একলা নয়, সকলকে নিয়ে, যখন শতভিষা নেই, কবিকৃতি নেই, কৃত্তিবাস নেই তখনই কবিতা পাক্ষিকের ঝোঁক তৈরি হয়। শূন্য ক্ষেত্রটি তিনি চিনে নিয়ে তাকেই নিজের সম্প্রসারণের ক্ষেত্র তৈরি করেন। এ প্রসঙ্গে সমীর রায়চৌধুরীর কথাটি এমন যে- ‘ভাষা জীবনের প্রধান খনিজ। ভাষার মধ্যেই ভিতর বাহির, পরিমেয়-অপরিমেয়। ভাষা থেকে বিষয়ের দিকে বা ইস্যুর দিকে আলাদাভাবে পাড়ি দিচ্ছেন না প্রভাত। ভাষার মধ্যেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চান তাঁর সম্ভাব্য পাঠককে। সেখানেই তার মুক্তি। তিনি কেবল অর্গল খুলে দিচ্ছেন। তারপর বৃহত্তর পাড়ির দায় পাঠকের।’ এ কথাগুলো বলা সহজ, কাজটা কঠিন। এই কঠিনকে তিনি সত্য করেছেন। একত্রিতকরণের যে বাছাই, সেটির বিচ্ছুরিত কিরণরেখার লালন ও পরিচর্যা অতঃপর তাকে এগিয়ে দেওয়া এবং নিজেও এগিয়ে নেওয়া; সেটি শেষদিন পর্যন্ত তিনি করেছেন। তাঁর দীর্ঘকবিতা, কবিতার নোট- উপাদেয় অহংকারে পরিপ্লুত। এগুলো পরিশ্রমের কাজ কিন্তু অপরিশ্রান্তরূপে করে যাওয়ার শক্তি তিনি পান নিজের ভেতরের আক্রান্ত মেডিটেশনে।
ষাট থেকে এই শতকের দ্বিতীয় দশক, কতো পরিচয় কতো অজানার উন্মোচন, কতো দৃশ্যপট, কতো সংবেদ আর প্রত্যয়, বাঁকুড়া থেকে কালিঘাট, কালিঘাট থেকে রাসবিহারী, পটলডাঙা নিরন্তর সেঁধিয়ে থাকা- আরও চলা বইমেলা, লিটলম্যাগমেলা, কবিতামেলা- কাটোয়া, বহরমপুর, মালদা, কোচবিহার আবার খড়গপুর, মেদিনীপুর সর্বত্র ছোটা- শুধুই কবিতার জন্য- তিনি বলেছেন, যতোদিন মানুষ স্বপ্ন দেখবে ততোদিন কবিতা থাকবে- কবিতায় শিরোধার্য- এই প্রভাত চৌধুরী।
বাংলাদেশের কবিদের সঙ্গে প্রভাতদার তেমন যোগাযোগ ছিল না। তবুও চিনতেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবু হাসান শাহরিয়ারসহ অনেককেই। তাঁদের লেখা পড়তেনও। তবে বাংলাদেশের কবিতার যে কাব্যভাষা সে সম্পর্কে নিবিড় কোনো ধারণা তার ছিল বলে মনে হয় না। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দেন, ছায়ানট- সনজীদা খাতুনদের সহায়তা দিয়েছিলেন- মুক্তিযুদ্ধের সময়- রিফুউজি সংস্থানে, কিন্তু সাতচল্লিশ যে কতো ক্ষতি- বাংলা কবিতার জন্য- সেটি তার উপলব্ধিতে ছিল। জিজ্ঞেস করলে আক্ষেপ করতেন। আমাদেরও খুব হতাশা আছে, প্রভাত চৌধুরীর মতো কবিতা-নিবেদিত মানুষ বাংলাদেশে তেমন পরিচিত পাননি। অথচ একই ভাষা-সংস্কৃতির উপযোগ ও চর্চা আমাদের উভয় অঞ্চলের। একেকটা মানুষের কাজের ধরণ ও রকম আলাদা, কেউ কারো রকম নন- ছোট-বড়ও করা চলে না। কিন্তু লেখালেখির কলকাতায় প্রভাত চৌধুরী উচ্চতা কম নয়। সান্নিধ্য পেয়েছেন তিনি অনেকের- আমাদের আইকনসুলভ ব্যক্তিদের সঙ্গে আসর জমানো মানুষ তিনি- অন্তত শ্যমল, সুনীল, শক্তি, সুভাষ, উৎপল বসু, প্রণবেন্দু, বীরেন্দ্র প্রমুখের কথা তো বলাই যায়! একই জীবনের পাটাতনে ছিল তাদের। প্রভাত চৌধুরীও কমবেশি একই সারির প্রায়। হয়তো কবিতান্দোলন, কবিতার কাগজ করা, কবিতার সংগঠক হওয়া, কবিতার মেলা করা সবই তাকে করতে হয়, নিজের লেখাটাও তার ভেতর দিয়ে চালিয়ে যেতে হয়। সে সব তো কারুণ্যগাথা- মহাকাব্য।
তবে যেটা বলার কথা, বাংলাদেশটা পশ্চিমবঙ্গের অনেকের কাছেই এখনও নানাভাবে অনুপস্থিত। অথচ, বাংলা কবিতার যে অর্জন গত পঁচাত্তর বছরে সেটি বাংলাদেশ বিচ্যুত হলে বা এখানে প্রভাত চৌধুরী অপরিচিত থাকলে- সেটা তো সার্বিকরূপে কবিতারই ক্ষতি! আর তা হয়েছে বলেই মনে হয়। এ জন্য কে দায়ি আর কে অপরাধী সে প্রশ্ন নয়, প্রভাত চৌধুরীর পঞ্চাশ বছরের কবিতা জীবনে আমাদের ঈষৎ যে সান্নিধ্য- তা এসব ভাগ-বিভক্তির অভিমানী দেয়ালগুলোকে যে শুধু কাতরই করে তোলে! এর বাইরে আর কী বলা যাবে। আমরা হয়তো মোহগ্রস্ত হই। কিন্তু কিছুই তো অবাস্তব নয়! আর এখন তো উপায়ও নেই- প্রযুক্তি আমাদের বেগ বাড়িয়েছে, বিচ্ছিন্নতাও বাড়িয়েছে- ফলে অতঃকিম্।
প্রভাত চৌধুরী পঠিত হোন, কাজের ভেতর দিয়েই তিনি আমাদের পাঠ্য থাকবেন। তাঁর ‘পোস্টমডার্ন’ ধারণাটির যে প্রসারণ, সেটি গুরুত্বপূর্ণ, তাঁর সাহিত্যও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কবিতার বই, গদ্যের বই আকর্ষণীয়। অনুপম কাহিনি তাঁর বেশ আস্বাদনযোগ্য গদ্যের পুস্তক। তবে সবচেয়ে বড়ো সৃষ্টিশীলতার তো মরণ নেই। সৃষ্টিই অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাঁর সৃষ্টিই তার সর্বদিক উন্মোচন করবে, নতুন দিগ্বলয় তৈরি করবে। সেখানে তিনি নির্ধারিত কালখণ্ডের থাকবেন না কালজয়ী হবেন, সেটি যুগান্তের প্রশ্ন। বোধ করি কোনো লেখক এসব ভেবে লেখেন না। সৃষ্টির প্রণোদনাই তাকে লেখকরূপ গড়ে তোলে। সেখানে তিনি তো সর্ববিচারের ঊর্ধ্বে- সকলেরই। অমরত্ব নয়, তিনি সকলের থাকুন; পঠিত হোন- খুঁজে নিক সকলে তাঁর লেখাসমূহ।