তিনি হতে পারতেন প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী। হতে পারতেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী। হতে পারতেন বিশ্বনন্দিত বেহালাবাদক। কিংবা কোনো বনেদী পেশার উচ্চপদস্থ নির্বাহী। নেহায়েত একজন প্রথামাফিক গল্পকারও হতে পারতেন। কিন্তু সে সকল পথে তিনি হাঁটলেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এই যুবক চিরকালের চেনা আঙিনা থেকে বেরিয়ে এলেন। খ্যাতিমান পিতার প্রদর্শিত পথেও হাঁটলেন না। তিনি নামলেন অন্য এক দুঃসাহসিক অভিযানে। তাঁর রক্তে তখন জোয়ার তুলেছে রহস্য ও রোমাঞ্চের ক্ষ্যাপাটে নেশা। ক্ষ্যাপা যেন খুঁজে ফেরে পরশপাথর। বাংলাদেশ বেতারের নন্দিত এই শিল্পীর রক্তে শুধু বাজতে থাকে নিষিদ্ধ রহস্যের হাতছানি। নিশিগ্রস্ত এই যুবকের কি সাধ্য সে ডাক উপেক্ষা করেন!
তিনি কাজী আনোয়ার হোসেন। বাংলা রহস্য সাহিত্যের জগতে কিংবদন্তিতুল্য চরিত্র ‘মাসুদ রানা’র স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন। ষাটের দশকের মধ্যভাগে ‘মাসুদ রানা’ নামের এই গুপ্তচর চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেন। যার পরিচয় দিতে গিয়ে প্রতিটি পর্বে একটি বাক্য ব্যবহার করতেন যা পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল। বাক্যটি হলো- ‘টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না।’ বিস্ময়করভাবে কথাগুলো মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনের বেলায়ও সত্য। তবে তিনি শুধু টানতেন না, বাঁধনেও জড়াতেন। এক জীবনে কতজনকে যে বাঁধনে জড়িয়েছেন, কতজনকে লেখক বানিয়েছেন,থ্রিলার জগতে টেনে এনেছেন, তার কোনো লেখাজোখা নেই।
শুধু স্বভাব নয়, নামের মধ্যেও ছিল যা কিছু প্রথাগত তাকে উড়িয়ে দেওয়ার তীব্র অহংকার। ডাকনাম ছিল নবাব। প্রিয়জনদের কাছে নবাব ভাই। জন্মেছিলেন ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই। বাবা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন ও মা সাজেদা খাতুন। ১৯৫২ সালে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। দুই বোন সনজিদা খাতুন ও ফাহমিদা খাতুন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেও বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। চমৎকার বাঁশি ও গিটার বাজাতেন, ক্যামেরায় ছবি তুলতেন, অবসরে ধানমন্ডি লেকে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতেন। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে শেষমেষ হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি স্পাই চরিত্র মাসুদ রানার স্রষ্টা। এই পরিচয়ই তাঁকে অনন্য এক উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করে।
তবে কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। রক্তের যে উত্তরাধিকার তাকে অস্বীকার করবেন কেমন করে? কাজী আনোয়ার হোসেনও পারেননি রক্তের উত্তরাধিকার অস্বীকার করতে। তাঁর হৃদয়ের মর্মমূলে ছিল ধ্রুপদী সাহিত্যের বীজ। কলম হাতে রহস্যের জগতে বিচরণ করেছেন; স্পাই থ্রিলার লিখেছেন; কিন্তু তার বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে দিয়েছেন ধ্রুপদী কথাসাহিত্যের মণিমুক্তো। সেই মণিমুক্তো দেখে কে বলবে এই ভাষা কোনো গুপ্তচর সিরিজের ভাষা? কে বলবে এটা ধ্রুপদী সাহিত্য নয়? উদাহরণ তো হাতের কাছেই-
“তখন গোধূলি লগ্ন। সারাদিন পৃথিবীর উপর অগ্নিবর্ষণ করে সূর্যটা বঙ্গোপসাগরে ডুব দিয়ে গা-টা জুড়োচ্ছে এখন। পশ্চিম দিগন্তে এক আধ ফালি সাদা মেঘ এখন লাল। তারই হালকা আলো এসে পড়েছে সুলতার মুখের উপর। রূপকথার রাজকন্যার মত সুন্দর লাগছে ওকে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল রানা ওর মুখের দিকে। রাস্তায় পড়ে থাকা একটা ইটের উপর হোঁচট খেলো গাড়িটা। ফিক করে করে হেসে সুলতা বলল, ‘অ্যাকসিডেন্ট করবেন নাকি?’
‘যদি করি, তবে দোষ তোমার,’ উত্তর দিল রানা।
রানার মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসা কথাটা কেমন যেন থমকে দিল সুলতাকে। কথাটা নিয়ে নিজের মনেই নাড়াচাড়া করল সে কয়েক মুহূর্ত। এত ভাল লাগল কেন কথাটা?” (ধ্বংস-পাহাড়, প্রথম প্রকাশ: মে ১৯৬৬, পৃ: ২৫)।
আরেকটা উদাহরণ-
‘জোর বাতাসে উড়ছে মিত্রার খোলা চুল। মুখের একপাশে পড়েছে চাঁদের আলো। মৃদু হাসল মিত্রা। কেঁপে উঠল যেন সারাটা আকাশ। রানা ভাবল, যে দেখেছে এমন হাসি তার জীবন সার্থক। দু’পাশের মাঠে পাকা আউশ ধান দুলছে মৃদু বাতাসে। পৃথিবীটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে রানার। ঠিক বোঝানো যায় না এই ভাললাগাটাকে। বিচিত্র মানুষের জীবন। প্রতি পদে যার মৃত্যুর হাতছানি, সেই রানা জানে এই মায়াবী পৃথিবীর কি জাদু। বেঁচে থাকায় কত সুখ। হৃদয়টা উথলে উঠতে চাইল রানার এক অসীম কৃতজ্ঞতায়। কিন্তু কার প্রতি কৃতজ্ঞতা? ঈশ্বর? প্রকৃতি? বুঝতে পারে না রানা। প্রকৃতির মায়া, বন্ধুর বন্ধন, সব মিলিয়ে তীব্র একটা ভাললাগা-এজন্যে কার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে রানা?’ (ভারতনাট্যম, প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ১৯৬৬, পৃ: ১৭৭)।
আরও একটা উদাহরণ-
‘চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স হবে মেয়েটির। কপালে কুমকুমের লাল টিপ। ঠোঁটে হালকা গোলাপী লিপস্টিক। বড় করে একটা বিড়ে খোঁপা বেঁধেছে মাথায়-তাতে সুন্দর করে প্লাস্টিকের ক’টা রজনীগন্ধা গোঁজা। সরু চেনের সাথে বড় একটা লাল রুবি বসানো লকেট ঝুলছে বুকের উপর। ডান হাতে এক গাছি সোনার চুড়ি, বাঁ হাতে ছোট্ট একটা রোলগোল্ডের সাইমা ঘড়ি। ফরসা গায়ের রঙ তার আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে স্বাস্থ্যের প্রাচুর্যে। একহারা লম্বা গড়ন অটুট স্বাস্থ্যের লাবণ্যে কমনীয়। আরও সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে ঝাঁঝাল লাল আর হলুদে মেশানো কাতান শাড়িটায়। সত্যিই এমন চেহারা সহজে চোখে পড়ে না।” (ধ্বংস-পাহাড়, পৃ: ২২)।
‘মাসুদ রানা’ সিরিজের নামকরণের যে ইতিহাস তাও মাসুদ রানার উত্থানের মতোই চমকপ্রদ। মাসুদ রানার নামকরণ করা হয় দুজন বাস্তব মানুষের নামের অংশ মিলিয়ে। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং কাজী আনোয়ার হোসেন বলেন-
‘আমাদের দুজনেরই (কাজী আনোয়ার হোসেন ও তাঁর সহধর্মিনী ফরিদা ইয়াসমিন) বন্ধু স্বনামধন্য গীতিকার মাসুদ করিমের ‘মাসুদ’ আর আমার ছেলেবেলার হিরো (নায়ক) ইতিহাসে পড়া মেবারের রাজপুত্র রাজা রানা প্রতাপ সিংহ থেকে ‘রানা’ নিয়ে নাম হলো মাসুদ রানা।‘
(সূত্র: কাজী আনোয়ার হোসেন (২২ জানুয়ারি ২০১০)। ‘মাসুদ রানা ৪০০ নট আউট: যেভাবে এলো মাসুদ রানা’, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ঢাকা।
‘মাসুদ রানা’ সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘ধ্বংসপাহাড়’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালের মে মাসে। এই ‘ধ্বংসপাহাড়’ লিখতে গিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন মোটরসাইকেলে চেপে দীর্ঘ দশ মাস কাপ্তাই-রাঙামাটি ঘুরে বেড়ান। এ ঘটনা থেকে অনুধাবন করা যায় কাহিনিতে প্রাণ সৃষ্টি করার জন্য কি পরিমাণ নিবেদিত প্রাণ ছিলেন এই সাহিত্যসাধক। এরপর তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রবল পাঠক চাহিদা পূরণ করতে তুমুল জনপ্রিয় এই সিরিজের সাড়ে চারশো’রও বেশি বই তাঁকে প্রকাশ করতে হয়। এই ধারাবাহিকতায় মাসুদ রানা যেমন হয়ে ওঠে একটি আইকন চরিত্র, তেমনি সেবা প্রকাশনীও হয়ে ওঠে একটি লেখক সৃষ্টির কারখানা। কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেও লিখেছেন, অন্যদের দিয়েও লিখিয়েছেন। মাসুদ রানা সিরিজের পাশাপাশি তিনি আরও একটি জনপ্রিয় কিশোর থ্রিলার ‘কুয়াশা’ সিরিজের প্রায় ৭৬টি বই রচনা করেন যা সমধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, অনুবাদক ও প্রকাশক।
বিস্ময়কর হলেও সত্য যে এই সব্যসাচী মানুষটি বাংলা চলচ্চিত্রেও প্লেব্যাক করেছেন। সুরকার রবীন ঘোষ ও সত্য সাহার সুরে অসাধারণ সব গান গেয়েছেন। কুয়াশা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখে ১৯৭৪ সালে বাচসাস পুরস্কার লাভ করেছেন। অর্জন করেছেন সিনেমা পত্রিকা ও জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কারও।
তিনি কুয়াশা লিখতেন বিদ্যুৎ মিত্র নামে। ‘মাসুদ রানা’ লিখতেন কাজী আনোয়ার হোসেন নামে। অন্যান্য থ্রিলার লিখতেন শামসুদ্দিন নওয়াব নামে। আমাদের উত্তর-প্রজন্মের শৈশব, কৈশোর ও যৌবন তিনি ছিনতাই করেছিলেন। কখনও পাঠ্যবইয়ের ভাঁজে, কখনও আলমারির খাঁজে লুকিয়ে রেখে তাঁকে পড়তাম। অভিভাবকদের চোখে তিনি নিষিদ্ধ ছিলেন। কিন্তু আমাদের কাছে ছিলেন ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’। কলমের জাদুতে অনায়াসে দখল করে নিতেন বাঙালির স্বপ্ন ও কল্পনার জগৎ।
কাজী আনোয়ার হোসেন এমন একটি সময়ে রহস্য সাহিত্যের হাল ধরেন, যেখানে তিনি ছিলেন প্রায় নিঃসঙ্গ সৈনিক; বলতে গেলে সংশপ্তক। কিন্তু প্রবল কল্পনাশক্তি ও আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে তিনি অবিচলভাবে লক্ষ্যে অগ্রসর হন। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক গদ্যভাষা উদ্ভাবন করেন যা পরবর্তীতে তরুণ রহস্যলেখকদের কাছেও অনুসরণীয় রীতি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ কালপর্বে কাজী আনোয়ার হোসেনের এই উত্থান নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষা ও গদ্যের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
রহস্য সাহিত্যিকের জীবনটাও কি রহস্যঘেরা হয়? তা নাহলে এক জীবনে এতো কাকতালীয় হবে কেন? ১৯ তারিখে যাঁর জন্ম ১৯ তারিখেই তাঁর মৃত্যু হবে কেন? কর্কট রাশির জাতক হয়ে কর্কট রোগেই তাঁর মৃত্যু হবে কেন? এটাও কি কাকতালীয়?
কিংবদন্তিতূল্য ‘মাসুদ রানা’ চরিত্রের স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনের শরীরী মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যে অমরতার সূচনা হয়েছে, সে অমরতা কখনও ঘুচবে না। যে শূন্যতা রেখে গেছেন সে শূন্যতাও আর পূরণ হবে না। বাংলা ভাষার রহস্যপাগল বিপুল পাঠকশ্রেণির হৃদয়ের মণিকোঠায় তিনি চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।