শব্দে শব্দে স্বপ্নরং মিশিয়ে শিশুদের স্বপ্নজগতের অজস্র ছবি এঁকেছেন আলী ইমাম। জাদুর কলমের টানে টানে রচনা করেছেন ছয় শতাধিক গ্রন্থ। এ এক বিরল ঘটনা। প্রখর কল্পনাশক্তি, নিবিড় শিল্পভাবনা ও শ্রমে নতুন নতুন সৃষ্টির আলোয় সমৃদ্ধ করেছেন শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডার। জয় করে নিয়েছেন শিশুদের সবুজ কোমল মন।
কী লেখেননি তিনি? প্রকৃতি। পরিবেশ। বিজ্ঞান। বিজ্ঞান কল্পকাহিনী। প্রাণিজগত। ইতিহাস। ঐতিহ্য। পুরাকীর্তি। প্রাচীন সভ্যতা। ছড়া-কবিতা। গল্প। উপন্যাস। নাটক। জীবনী। ভ্রমণকাহিনী। অনুবাদ। গবেষণা প্রবন্ধ। প্রতিটি বিভাগেই তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। সুদক্ষ কারিগর। তাঁর সৃষ্টিশীল হাতের ছোঁয়ায় আলোকিত হয়নি— শিশুসাহিত্যে এমন কোনো বিষয় হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। লিখেছেন বড়দের জন্যও। তাঁর লেখা প্রায় প্রতিটি গ্রন্থই রোমাঞ্চে ভরা। সুখপাঠ্য। যেকোনো পাঠকের মনে তুমুল আলোড়ন তোলার মতো বৈচিত্র্যময় বিষয় আর নানা রঙের উপাদানে পরিপূর্ণ। গ্রন্থগুলোর নাম শুনলেই পড়তে ইচ্ছে করে। যেমন, চাঁদের রাজকন্যা। এক যে ছিল মটরশুটি। পঙ্ক্ষিরাজের ডানা। কল্পলোকের চাবি। জাদুর তুলি। হিজল কাঠের নাও। সবুজ খাতা। বুনোহাঁসের পালক। অপারেশন কাঁকনপুর। শাদা পরী। রুপোলি ফিতে। আলোর পাখি। আলোর ফুল। পাতাবনে ঝিকিমিকি। দানব পাখির রহস্য। সোনার কৌটা। নক্ষত্রের কাহিনি। মহাকাশের রহস্যময় কাহিনি। প্রাচীন পৃথিবীর খোঁজে। সাগরতলের প্রাণী। কাছের পাহাড় দূরের পর্বত। হিমকুঁড়ির জঙ্গলে। গাঙচিল দ্বীপের বিভীষিকা। ভয়াল ভয়ংকর। আকাশ ভরা সূর্য তারা। নীল চোখের ছেলে। যুগটা ছিল ডাইনোসরের। বাংলা নামে দেশ। সোনালি তোরণ। সেসুলয়েডের পাঁচালি। এমন সুন্দর সুন্দর শিরোনামের তথ্য সমৃদ্ধ শিল্পমানসম্মত আরও কত কত বই রয়েছে তাঁর। সেগুলোর মধ্যে দশখণ্ডে লেখা ‘ছোটোদের বিজ্ঞানপিডিয়া’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মজার মজার তথ্য, মজার মজার গল্প, রঙিন রঙিন চিত্র আর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, কলাকৌশল ও পরীক্ষা-নীরিক্ষায় ঠাসা এই বিজ্ঞান সিরিজ শিশু-কিশোরদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা আনন্দে ডুবিয়ে রাখবে। মনের বাগানে ফোটাবে জ্ঞানের কুসুম।
মনভোলানো অনেক ছড়া-কবিতাও লিখেছেন আলী ইমাম। ‘হিরে কুচি’ নামের ছড়ার কয়েকটি লাইন এরকম—
কানের কাছে বাতাস এসে
ফিসফিসিয়ে বলে
জোনাকিরা আসর বসায়
গহিন বনতলে।
তোমার কাছে এলাম নিয়ে
জোনাক চিঠির খাম
নীলাভ আলোয় তাতে লেখা
আছে তোমার নাম।
আলী ইমামের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার সোনালি ছেলেবেলা’ থেকে জানা যায়— তিনি ইশকুলজীবনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বুড়ো আংলা’ পাঠ করে লেখালেখির প্রতি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। রোমাঞ্চকর অভিযানের কাহিনিভিত্তিক লেখা বইটির জাদুকরী ভাষায় অবাক করা দৃশ্যের বর্ণনায় তিনি রহস্যময় এক পৃথিবীতে হারিয়ে গিয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের প্রচ্ছদে কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বুড়ো আংলা। এটি লেখা হয়েছিল প্রখ্যাত সুইডিশ লেখিকা, নোবেল পুরস্কার পাওয়া একমাত্র শিশুসাহিত্যিক সেলমা লাগের্লোফ-এর ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল অ্যাডভেঞ্চার অব নিলস’ অবলম্বনে। এই মূল বইটিও আলী ইমাম পড়েছিলেন। তখন থেকেই তাঁর মানসভ্রমণ শুরু হয়েছিল। মনটা বুনোহাঁসের মতোই উড়ে গিয়েছিল ফিয়র্ড ভরা আইসল্যান্ডে। ল্যাপল্যান্ডে।
প্রখ্যাত এ লেখকের প্রথম লেখা বইটি হচ্ছে ‘দ্বীপের নাম মধুবুনিয়া’। গল্পের বই। প্রকাশকাল ১৯৭৫। প্রকাশ করেছিল ঢাকার ‘বর্ণমিছিল’। সেই থেকে শুরু হয়েছিল তাঁর বর্ণাঢ্য সাহিত্য জীবন। লেখালেখির স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ স্বর্ণপদক, নওয়াব সলিমুল্লাহ পদক, ছোটোদের কাগজ শিশুসাহিত্য পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।
তিনি শুধু খ্যাতিমান সাহিত্যিকই ছিলেন না, ছিলেন দক্ষ সংগঠক এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ টেলিভিশন (২০০৪-২০০৬) এবং চ্যানেল ওয়ানের (২০০৭-২০০৮) মহাব্যবস্থাপক হিসেবে।
এই বিরলপ্রজ লেখকের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর। জন্মের ৬ মাস পরই পরিবারের সাথে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। পুরো পরিবারসহ থাকতেন পুরান ঢাকার ঠাটারীবাজারে। তাঁর শৈশব কেটেছে ওয়ারী, লিংকন রোড, নয়াবাজার, নওয়াবপুর, কাপ্তান বাজার ও ফুলবাড়িয়ায়।
মহাবিশ্ব, মহাকাশ, চাঁদের কাহিনী, সূর্যের কাহিনী, তারা ও নক্ষত্রদের কাহিনী লিখতে লিখতেই ৭২ বছরের জীবনে এল ২১ নভেম্বর ২০২২। লাখো পাঠক, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে কাঁদিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আকাশের নক্ষত্র হয়ে গেলেন বাংলা ভাষার শিশুসাহিত্যের আলোঘর, শিশুমনে নতুন নতুন স্বপ্নবোনা প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক আলী ইমাম। তাঁর সৃষ্টিজুড়ে বেঁচে থাকবেন তিনি। নাক্ষত্রিক আলো ছড়াবেন যুগ যুগ ধরে। তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।