চলে গেলেন বাংলা গানের কিংবদন্তি তুল্য গীতিকার, সুরকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে তার সমকক্ষ কেউ নেই। গত ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চির বিদায় নেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি গানের মধ্যে ৩টি গানই তাঁর রচনা। গান ৩টি হচ্ছে (১) ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়…’ (২) এক তারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল…’ (৩) ‘জয় বাংলা বাংলার জয়…’ তাঁর এই প্রস্থান বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার ১৯৪৩ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে রেডিও পাকিস্তানে গান লেখা শুরু। ১০৬৪ সালে ‘আয়না’ ও ‘অবশিষ্ট’ সিনেমার জন্য প্রথম গান লেখেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ার ২০ হাজারের বেশি গান রচনা করেছেন। তাঁর গান ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা ছিল। ১৯৬৯ সালে ‘সমাধান’ সিনেমার প্রযোজনার মধ্য দিয়ে এই রূপালি জগতে তাঁর যাত্রা শুরু। প্রায় ৩৩টি ছবি তিনি প্রযোজনা করেছেন। পরিচালনা করেছেন অনেকগুলো সিনেমা । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘স্বাক্ষর, ‘সন্ধি, ‘স্বাধীন, ‘সমাধি’, ‘স্বীকৃতি, ‘ক্ষুধা, ‘পরাধীন, ‘আর্তনাদ। তাঁর পরিচালিত প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘নান্টু ঘটক। এটি ১৯৮২ সালে মুক্তি পায়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেলে তিনি সিনেমা নির্মাণ বন্ধ করে দেন। তিনি ২০০২ সালে পেয়েছেন একুশে পদক এবং ২০২১ সালে পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক। গীতিকার হিসেবে পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে গীতিকার সম্মাননা গ্রহণ করেছেন। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কার হচ্ছে বাংলার মানুষের ভালোবাসা। ছিলেন সার্বজনীন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিল্পীকে সকল সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠতে হবে। তাছাড়া শিল্পী সত্যের পথে অবিচল থাকতে পারবে না।
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কিছু কালজয়ী গান
ইশারায় শিস দিয়ে আমাকে ডেকো না
‘বন্দিনী’ সিনেমায় ছিল এই গান। সুর করেছিলেন পারভেজ আনোয়ার। কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন। আলাউদ্দিন আলীর সংগীতায়োজনে গানটি এখনও সব শ্রেণির শ্রোতার কাছে জনপ্রিয়।
একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনারগাঁয়
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের এই গান আজো আমাদের অন্তরে দেশপ্রেমকে জাগ্রত করে। লেখা গানটি দেশাত্মবোধক গানে আরেক সংযোজন। এই গানেরও সুর করেছেন আনোয়ার পারভেজ। গেয়েছেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ।
জয় বাংলা বাংলার জয়
১৯৭০ সালের মার্চ মাসে গানটি লেখেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। একাত্তরে বাঙালির স্বপ্ন ও মুক্তির আশা জাগিয়ে তুলে এই গান। অমর এই গানটিতে সুর দিয়েছেন আনোয়ার পারভেজ। শাহনাজ বেগম ও আব্বুল জব্বার দিয়েছেন কণ্ঠ। ‘জয় বাংলা’ চলচ্চিত্রের জন্য গানটি লেখা হলেও মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালির সাহস ও স্বপ্নের প্রতীক হয়ে ওঠে গানটি।
একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল
গাজী মাজহারুল আনোয়ার-আনোয়ার পারভেজ-শাহনাজ রহমতুল্লাহর যৌথ সৃষ্টিশীলতার আরেকটি উদাহরণ ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল।’ বিবিসির সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের তালিকায় গানটি উনবিংশ স্থানে উঠে আসে।
আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার
১৯৭৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করা হয়। আলাউদ্দিন আলীর সুরে গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। পর্দায় ঠোঁট মিলিয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন। ছবিটি মুক্তির পর দ্রুত গানটি দেশব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আকাশের হাতে আছে এক রাশ নীল
‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গানটি ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ সিনেমায় ব্যবহৃত হয়। গানটি এখনও শ্রোতাদের পছন্দের তালিকায় রায়েছে। গানটিতে সুর করেছিলেন সত্য সাহা। শিল্পী ছিলেন বশীর আহমেদ ও আনজুমান আরা বেগম। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পাওয়া আয়না ও অবশিষ্ট সিনেমায় অভিনয় করেন আজিম, সুজাতা, সুচন্দা।
এই মন তোমাকে দিলাম
তরুণ শিল্পী মাহতাম সাকিব জনপ্রিয় হন এই গান গেয়ে। গানটি প্রথম ব্যবহার হয় ‘মানসী’ সিনেমা। গেয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন। সুর করেছিলেন আনোয়ার পারভেজ। মানসী পরিচালনা করেন অভিনেতা ও পরিচালক ফখরুল হাসান বৈরাগী।
গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে
গানটি নায়করাজ রাজ্জাকের স্বরলিপি সিনেমার। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে। এ গানের মাধ্যমে বাংলা সিনেমায় প্রথম কণ্ঠ দেন রুনা লায়লা। রুনা লায়লা তখন লাহোরে বসবাস করতেন। লাহোর গিয়ে গানের রেকর্ড করা হয়। সুবল দাসের সুরে গানে কণ্ঠ দেন রুনা লায়লা ও মাহমুদুন নবী।
চোখ যে মনের কথা বলে
‘যে আগুনে পুড়ি’ সিনেমায় গানটি ব্যবহৃত হয়। গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন খন্দকার নুরুল আলম, সুরও দিয়েছিলেন তিনি। এরপর ‘আজ গায়ে হলুদ’ সিনেমায়ও গানটি ব্যবহার করা হয়। মৌসুমী, আমিন খান ও মাহফুজকে গানের সঙ্গে পর্দায় দেখা যায়। গান গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। এই সিনেমার জন্য গানটিতে নতুন করে সুর দেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
নীল আকাশের নিচে
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের আরেকটি জনপ্রিয় গান ‘নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা’। ‘নীল আকাশের নিচে’ সিনেমায় গানটি গেয়েছেন খন্দকার ফারুক আহমেদ। গানটির সুর করেছেন সত্য সাহা।
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের আরো বেশ কিছু জনপ্রিয় গান রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ‘কারো আপন হইতে পারলি না অন্তর’, ‘চক্ষের নজর এমনি কইরা’, ‘হয় যদি বদমান হোক আরো’, ‘দুনিয়াটা মস্ত বড়’সহ অনেক গান।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে চির অমর হয়ে রবেন বাঙালির হৃদয়ে।