অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মো. জাহিদুর রহমান -
গানের মানুষ শেখ লুতফর রহমান

বাংলাদেশের সংগীতের জগতে একটি সুপরিচিত নাম শেখ লুতফর রহমান। এদেশের একজন সংগীত শিক্ষক, সংগীত পরিচালক, সংগীত শিল্পী ও নিবেদিতপ্রাণ সুরসাধক হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। শেখ লুতফর রহমান ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা জেলার সুলতানপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ আব্দুল হক, মা লতিফুন নেসা। বাবা ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক ও সৌখিন সংগীতশিল্পী। শৈশবে লেখাপড়ার পাশাপাশি গানের চর্চা শুরু করেছিলেন বাড়িতে বাবার হাত ধরে। বাবার কাছে শেখা তার প্রথম গানের কলি ‘মেঘের কোলে মেঘ জমেছে আঁধার করে আসে’।

একবার ২৪ পরগনা জেলার হাকিমপুরের জমিদার আবদুল ওয়াহিদ খান সাতক্ষীরার সুলতানপুরে বেড়াতে এসে শেখ লুতফর রহমানের গান শুনে মুগ্ধ হন। কিশোর এই শিল্পীকে গান শেখানোর দায়িত্ব গ্রহণ করে নিজ তত্ত্বাবধানে নিয়ে যান হাকিমপুরে। হাকিমপুরের নিকটবর্তী তারালী গ্রামের পশুপতি চট্টোপাধ্যায়ের নিকট ৫ বছর সঙ্গীতের তালিম গ্রহণ করেন লুতফর রহমান। এখানে তিনি শিখেছিলেন উচাঙ্গ সঙ্গীতের সুর কাকতা, তেলোয়ারা, পঞ্চম সুয়ারি, নিধু বাবুর টপ্পা আর চটুল সুরের গানের ভেতর রামপ্রসাদী ও শ্যামাসংগীত। ২৪ পরগনার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেন তিনি। একপর্যায়ে হাকিমপুর ছেড়ে খুলনায় চলে আসেন লুতফর রহমান। ১৯৪২ সালে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি স্যার নাসিরুদ্দিনের পুত্র ব্যারিস্টার মাকসুদ খুলনায় এসে শেখ লুতফর রহমানের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কলকাতায় সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। লুৎফর রহমান কলকাতা গমন করেন এবং ব্যারিস্টার মাসুদের পারিবারিক সংগীত শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। বিভিন্ন জলসায় গান করার মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যিক এস ওয়াজেদ আলি, কবি জসীম উদ্‌দীন, সুরশিল্পী আব্বাসউদ্দীন প্রমুখের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হন শেখ লুতফর রহমান।

শেখ লুতফর রহমান ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে আব্বাস উদ্দীনের সহযোগিতায় ‘সঙ পাবলিসিটি’ বিভাগে চাকরি নেন। এই বছরে তিনি ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র কলকাতা স্টেশন থেকে প্রথম গান পরিবেশন করেন। এরপর থেকে নিয়মিতভাবে এই বেতার কেন্দ্রে তিনি সংগীত পরিবেশন করা শুরু করেন। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা বেতারে যুক্ত ছিলেন। এ সময় বেতারে তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন আবদুল আহাদ, তালাত মাহমুদ, আবদুল হালিম চৌধুরী, বেদার উদ্দীন আহমদ প্রমুখ।

কলকাতায় কমরেড আবদুল রাজ্জাক খানের পুত্র মমতাজ খানের হাত ধরে কলকাতায় গণনাট্য সংঘের সাথে যুক্ত হন শেখ লুতফর রহমান। ১৯৪৩ সালে ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যা দিবসে কলকাতায় গণনাট্য সংঘের অনুষ্ঠানে প্রথম গণসংগীতটি গেয়েছিলেন তিনি—

দুখের রাতের ঘোর তমসা ভেদি

স্বাধীনতা দিবস এল যে ফিরে— জাগো

জাগো জাগো জাগো,

জাগো পুরবাসী

শৃঙ্খলিত ভারতমাতা

কাঁদে মুক্তিপিয়াসী।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকভারত বিভাজনের পর, শেখ লুতফর রহমান তদানীন্তন প‚র্ব-পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা-তে চলে আসেন। ঢাকা রেডিওতে চাকরি নেন। বাসা নেন জিন্দাবাহার লেনে। সঙ্গে ছিলেন বেদারউদ্দিন আহমদ, আবদুল আলীম, আবদুল হালিম, একেএম আবদুল হক প্রমুখ।

শৈশবে এক অন্ধ ভিক্ষুকের মুখনিঃসৃত গান শুনে শুনে মুখস্থ করে ফেলেছিলেন শেখ লুতফর রহমান—

পেটের জ্বালায় কেঁদে মরি

বৃথা ধরায় ধরি প্রাণ

অভাগার মুখ কেউ দেখে না

ঝরে পড়ে অপমান।

গানটি বালক লুতফর রহমানের মনে বিপুল রেখাপাত করে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তাকে ব্যথিত করত। ইংরেজ শাসন মুক্ত নব্য স্বাধীন দেশে ঘুমপাড়ানিয়া গান ভালো লাগত না তার। বন্ধুবর কবি আনিসুল হক চৌধুরীকে তাই তিনি আহ্বান জানালেন ঘুমজাগানিয়া গান লিখতে। কবি আনিসুল হক চৌধুরী লিখলেন—

শুধু ঘুমপাড়ানি গান আজি নয়

কর্মের আহবান এল আজ ধরাময়।

জড়তার ঘোর রজনীর

ঘুম হতে জাগো আজ বীর

হের লৌহ কঠিন জিঞ্জির হলো ক্ষয়।

হের ঐ রাঙা রবি হাসে গগনে

আজাদীর এই ভোর শুভ লগনে

আজিকার এই নবোৎসবে

তুমি কি ঘুমায়ে রবে?

জাগো আজ করো কাজ

করো সবে, হবে জয়।

১৯৪৮ সালে জগন্নাথ কলেজের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এ গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে শেখ লুতফর রহমানের দেশের মাটিতে গণসংগীত জীবনের শুরু হয়।

১৯৪৮ সালের শেষদিকে আনিসুল হক চৌধুরী লিখিত ভাষা আন্দোলনের প্রথম গানটিতে তিনি সুরারোপ করেন—

শোনেন হুজুর

বাঘের জাত এই বাঙালেরা

জান দিতে ডরায় না তারা

তাদের দাবি বাংলা ভাষা

আদায় করে নেবেই।

ওরে ভাইরে ভাই

বাংলাদেশে বাঙালি আর নাই।

যারা ভিড় করে এই পথে ঘাটে

বাঙাল যাদের বল

এদেশের স্বদেশে নিজদের দশা

করে টলমল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এই গান গাওয়ার সময় পুলিশ এসে সাবধান করে দিয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে এই গান না গাওয়ার জন্য শেখ লুতফুর রহমানের নিকট থেকে কাগজে মুচলেকা নিয়ে যায়।

১৯৫০-এর দশকে পুরান ঢাকায় ‘শিল্পী সংসদ’ নামে একটি গণসংগীত শিল্পীগোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করে। উদ্যোগী শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন আলতাফ মাহমুদ, নিজামুল মুলক, মোমিনুল হক ও শেখ লুতফর রহমান। ১৯৫২ ‘অগ্রণী শিল্পী গোষ্ঠী’ নামে আরও একটি গণসংগীত শিল্পী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এই সংগঠন গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন শেখ লুতফর রহমান, আবদুল করিম, আবদুল রাজ্জাক, মন্টু খান, জাহিদুল হক, ওয়াহিদুল হক, আবদার রশীদ, আবদুল্লাহ আল-মুতী প্রমুখ।

১৯৫৩ সালে ঢাকায় কার্জন হলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সুরশিল্পী আব্বাস উদ্দীন গাইলেন— মোরা এক বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। শেখ লুতফর রহমান গাইলেন—

প্রেমের পৃথিবী

কার অভিশাপে হলো আজ মরুময়

আকাশে বাতাসে শুধু হাহাকার

দীর্ঘ নিঃশ্বাস বয়।

১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তানের করাচিতে গমন করেন। সেখানে তিনি করাচি রেডিওতে নিযুক্ত হন। রেডিওর ‘ইত্তেহাদ-এ মোসেকি’ অনুষ্ঠানে বাংলা গান গাইতেন তিনি। করাচিতে তিনি প্রায় আট বৎসর ওস্তাদ বুন্দু খান এবং হাবিব আলী খান (বীণকার)-এর কাছে রাগ সঙ্গীতের তালিম নেন। করাচি থেকে ঢাকায় ফিরে ১৯৬৪ সালে তিনি গান লেখা, সুর করা ও গান গাওয়া শুরু করেন। সে সময়ে তিনি কিছু জনপ্রিয় গান রচনা করেন। একই সময়ে তিনি বেশ কিছু বিখ্যাত কবিতার সুরারোপ করেন।

১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিকান্‌দার আবু জাফর রচিত কবিতা ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’-তে সুর দিয়ে গানে রূপান্তর করেন। তৎকালীন নানান গণ-আন্দোলনের সূত্রে তিনি আরও সুরারোপ করেছিলেন— সুভাষ মুখোপাধ্যায় রচিত ‘ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’, আবুবকর সিদ্দিক রচিত বিপ্লবের রক্তরাঙা ঝাণ্ডা ওড়ে, সুকান্ত ভট্টাচার্যের রচিত ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ’, মতলুব আলী রচিত ‘লাঞ্ছিত নিপীড়িত জনতার জয়’ প্রভৃতি গানে।

১৯৪৬ সালে (১৩৫০ বাংলা) কলকাতায় দুর্ভিক্ষের একজন চাক্ষুষ সাক্ষী তিনি। চোখের সামনে রাস্তায় অনেক বনি আদমের মৃত্যু দেখেছিলেন তিনি, দেখেছিলেন মৃতদেহকে টেনে আবর্জনার স্তূপে ফেলে দেয়ার করুণ দৃশ্য। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭৩ সালের দুর্ভিক্ষও তাঁকে নিদারুণ পীড়া দেয়। এ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যানেক্স প্রাঙ্গণে কবি সিকান্‌দার আবু জাফর, কবি সুফিয়া কামাল প্রমুখের উপস্থিতিতে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শেখ লুতফর রহমান গেয়েছিলেন—

এই স্বাধীনতা ম্লান হয়ে যাবে

যদি সর্বহারা

পেট ভরে খেতে না পায় দু’বেলা

না শুকায় অশ্রুধারা

পরনে কাপড় ঔষধ রোগে

মানবতাবোধ এই দুর্যোগে

জ্ঞানের আলোকে যদি নাহি জাগে

জীবনের ধ্রুবতারা।

শেখ লুতফর রহমান ঢাকা সংগীত মহাবিদ্যালয়ের নজরুল সংগীত বিভাগে শিক্ষক হিসেবে এবং নজরুল একাডেমিতে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বেতারে সংগীত শিক্ষার আসরের পরিচালক হিসেবেও দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

এদেশের স্বনামধন্য খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী মাহমুদুন্নবী, আবুবকর খান, শবনম মুশতারী, মহুয়া হক, আবেদা সুলতানা, রেবেকা সুলতানা, সাদিয়া মল্লিক, সাবিহা মাহবুব সহ অগণিত ছাত্র-ছাত্রী ও শ্রোতাদের হৃদয়ে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন শেখ লুতফর রহমান। তিনি একুশ পদক (১৯৭৯), নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক, জেবুন্নেসা-মাহবুব উল্লাহ কল্যাণ ট্রাস্ট পদক, বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, নজরুল একাডেমি পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, ঋষিজ পদক, মুকুন্দ দাশ পদকসহ অনেক সম্মাননা অর্জন করেন।

শুধু বেতার টেলিভিশন নয়, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, গণ অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি ক্ষেত্রে সভা-সমিতি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার গান জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে। সঙ্গীতের শ্রীবৃদ্ধি ও জাতীয় জাগরণের শিল্পী হিসেবে শেখ লুতফর রহমানের অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক

 

+ posts

Read Previous

জলছবির প্রতিচ্ছবি

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৪র্থ সংখ্যা (এপ্রিল-২০২৩)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *