অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

শামীম আহমেদ -
থ্রিলার জনরা ও একজন ঘোস্ট রাইটার শেখ আবদুল হাকিম

দেশের রহস্য রোমাঞ্চ-থ্রিলার উপন্যাসের অন্যতম প্রধান জনপ্রিয় লেখক ও অনুবাদক শেখ আবদুল হাকিমের জন্ম ১৯৪৬ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। যখন তার বয়স ৪ বছর তখন হুগলি থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন পরিবারের সাথে। শেখ আবদুল হাকিম গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে দেশের অন্যতম প্রকাশনা সংস্থা সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পেশাদার লেখক হিসেবে কাজ করছিলেন। এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয় রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস সিরিজ ‘কুয়াশা’ ও ‘মাসুদ রানার’ অনেক বইয়ের নেপথ্য লেখক ছিলেন তিনি। এ ছাড়া নিজ নামেও তিনি এই ধারার বহু জনপ্রিয় রোমাঞ্চ উপন্যাসের অনুবাদ এবং মৌলিক উপন্যাস রচনা করে পাঠকসমাজে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বিশেষ করে তাঁর অনুবাদে মারিও পুজোর গডফাদার এ দেশের পাঠক সমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। মরহুম শেখ আবদুল হাকিম ছায়া লেখক বা ঘোস্ট রাইটার হয়ে ২৬০টি মাসুদ রানা ৫০টি কুয়াশা লিখেছেন, সামান্য কিছু তিক্ততার কারণে এই অর্জন হারিয়ে যাবে না অবশ্যই। শেখ আব্দুল হাকিমের লিখিত কাজী আনোয়ার হোসেনের সম্পাদিত মাসুদ রানার বইগুলোতে সহযোগী লেখক হিসেবে তার নামের অন্তর্ভুক্তি সময়ের দাবি। রানা সিরিজের শত শত বইয়ে তার অবদান অস্বীকার করার মতো নয়। বইয়ের সম্মানী নিয়ে একটা পর্যায়ে সেবা প্রকাশনীর প্রকাশক ও জনপ্রিয় লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে শেখ আবদুল হাকিমের মতান্তর ঘটে। এই নিয়ে তাঁদের প্রায় সাড়ে চার দশকের প্রীতিময় সম্পর্কের অবনতি হয়। বিষয়টি অদালত পর্যন্ত গড়ায়। তিনি সেবা প্রকাশনীর পাঠকপ্রিয় গোয়েন্দা কাহিনি ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের প্রথম ১১টি বইয়ের পর ২৬০ পর্ব পর্যন্ত এবং ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে দাবি করেছিলেন। গত বছর জুনে কপিরাইট অফিস তাঁর দাবির পক্ষে রায় দিয়েছিল। এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশকের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়।

সেবা প্রকাশনী থেকে বেরিয়ে এসে শেখ আবদুল হাকিম দেশের বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিয়মিত অনুবাদ ও মৌলিক গ্রন্থ রচনার কাজ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা বিপুল। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে স্কুলগণ্ডি না পেরোনো এই মানুষটি অনুবাদ রূপান্তর করেছেন বিশ্বসাহিত্যের খ্যাতিমান জনপ্রিয় সব থ্রিলার। অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে তা করে গেছেন। থ্রিলারের জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে এবং পাঠক তৈরিতে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ১৯৬৬-৬৭ সালে কুয়াশা-১০ দিয়ে শুরু। মাত্র বাইশ বছর বয়েসে হাকিম ভারত ভাগের পটভূমিতে একটি অসাধারণ ‘মৌলিক’ উপন্যাস ‘অপরিণত পাপ’ রচনা করেন। তার বড় ভাই প্রথম লেখা উপন্যাস ‘অপরিণত পাপ’ কাজী আনোয়ার হোসেনকে পড়তে দিয়েছিলেন। পাণ্ডুলিপিটি পড়ে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সেবা থেকেই ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে প্রথম প্রকাশিত হয় এই বইটি এবং প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, “যদি লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনের আন্তরিক মত জানতে চানে, তাহলে আমি বলব বইটি সত্যিই আমাদের সাহিত্যে একটি ব্যতিক্রম। পাণ্ডুলিপিটি পড়ে আমি এতই বিস্মিত, মুগ্ধ এবং উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম যে সারাটা দুপুর আমাকে বারান্দায় পায়চারি করে বেড়াতে হয়েছিল।” কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু ‘আপত্তিকর’ তথ্য বা মন্তব্য এবং যৌনতার ‘বাড়াবাড়ি’র কারণে বইটি কিছুদিন পর নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং দীর্ঘদিন পরে পুনঃপ্রকাশিত হয়।

শেখ আব্দুল হাকিম ছিলেন রুগণ শরীরের ছটফটে ও বাকপটু মানুষ। তার অনুবাদ বা এডাপটেশনে মুন্সিয়ানার পরিচয় ছিল। সঠিক এক্সপ্রেশন ও বাহুল্যবর্জিত অনুবাদ, মোদ্দাকথা, প্রাঞ্জল অনুবাদ না হলে পাঠক ধরে রাখা কঠিন। ঝেড়ে ফেলতে হয় মেদ। নিজস্ব কিছু কেরামতি অবশ্যি থাকতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে এসবের সাহিত্য মূল্য নিয়ে বিতর্ক করা যায়। কিন্তু শেখ আবদুল হাকিম, যিনি থ্রিলার-রোমাঞ্চ জনরাকে পাঠকপ্রিয় করার পিছনে পোক্ত ভূমিকা রেখেছেন, তার কাছে এই জনরার লেখার সাহিত্যমূল্য নিয়ে কচকচানি ছিল অত্যন্ত বিরিক্তিকর। তার মতে, লিখে টাকা পাই; এই জন্যই লিখি। আমি কি হত্যাকারী?, আততায়ী, দরাবাজ স্পাই এসকল অ্যাডভেঞ্চার, থ্রিলার রোমান্টিক সব জনরার ক্ষেত্রেই তার পারদর্শিতা আছে।

সবই প্রচলিত অর্থে বাজারি বই, সস্তা মানের ছেলে ভোলানো বই। মৌলিকত্বের ধার না ধেরে বুদ্ধিদীপ্ত ভঙ্গিতে অনুবাদ করে গেছেন। একমাত্র উদ্দেশ্য জনপ্রিয়তা ও বিক্রি। নিছক বাজারি হলেও সাহিত্যমূল্যে সস্তা দরের হলেও সেগুলো কোনোভাবেই ফেলনা বিষয় নায়। ১৯৭৩ সালের দিকে অন্য প্রকাশনী থেকে মাসুদ রানার আদলে সৃষ্টি করেন দেশী আর এক ‘বিসিআই’ এজেন্ট ‘জাকি আজাদ’ সিরিজ। বিষবৃক্ষ, ওস্তাদ সাবধান, বিপদ ভয়ংকর, জিপসি জাদু, অপারেশন শেম লেডি ইত্যাদি। কিন্তু বইগুলোর বিক্রি তেমন আশাপ্রদ না হওয়াতে তিনি আবার ‘সেবা’তেই ফিরে যান। শেখ আবদুল হাকিমের অন্য এক পিঠ-ক্লাসিকস অনুবাদক আবদুল হাকিম। গোয়েন্দা কাহিনিকে ধরা হয়, সাময়িক ইস্যু; কোনো একটি সমস্যার সমাধান হওয়া মাত্র তা ফুরিয়ে যায়। হাকিমের মতে, তিনি লেখা শুরুর পরই জনপ্রিয়তা বাড়ে এই সিরিজের। ১৯৭০ সালের দিকে এই সিরিজের বই তাকে লিখতে বলা হয়। তিনি লেখা শুরু করার পরই এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। মাসুদ রানার প্রথম ছয়, কি আটটি বই মৌলিক, পরে প্রেসের খরচ ওঠাতে বাধ্য হয়েই কাজী আনোয়ার হোসেনকে ছায়া অবলম্বনের পথে যেতে হয়। দরকার হয়ে পড়াতে উনি ঘোস্ট রাইটার/অদৃশ্য লেখকের সন্ধানে নামলেন। শেখ আবদুল হাকিম তাদের অন্যতম। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে এবং নন্দিতা, সবুজ আক্রমণ, ললিতার প্রতি শ্রদ্ধা, মধুবালা, কাঠফাটা এবং একজন উদ্যম। টেকনাফ ফরমুলা, জুতোর ভেতর কার পা, জল দাও জল, মুঠোর ভেতর তেলেসমাতি, ঋজু সিলেটীর প্রণয়, আতঙ্ক, সোমালি জলদস্যু, আইডিয়া, তিতলির অজানা, লব্ধ সৈকত, জ্যান্ত অতীত, তাহলে কে?, চন্দ্রাহত, সোনালি বুলেট, কামিনী প্রভৃতি। অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে এরিক মারিয়া রেমার্কের ‘দ্য ব্ল্যাক অবিলিস্ক’, ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’, ভিক্টর হুগোর ‘দ্য ম্যান হু লাফস’, জুলভার্নের ‘আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ’, মার্ক টোয়েনের ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব হাকলবেরি ফিন’, মেরি শেলির ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’, আলেকজান্ডার দ্যুমার ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’, ডগলাস ফ্রাঞ্জ ও ক্যাথেরিন কলিন্সের ‘দ্য ম্যান ফ্রম পাকিস্তান : নিউক্লিয়ার স্মাগলার আবদুল কাদির খান’ এবং কেন ফলেটের ‘দ্য ম্যান ফ্রম সেন্ট পিটার্সবার্গ’র বাংলা ‘আততায়ী’। পরিশ্রমসাধ্য কাজ করতে হতো তাকে। সেই সঙ্গে একটি মাসিক পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের গুরুভার, রীতিমতো অমানুষিক পরিশ্রম! যেসব অনুবাদের কথা উল্লিখিত হলো তা ছাড়াও রয়েছে বিষদাঁত, প্যাট্রিক সাসকিন্ড-এর পারফিউম, পাঁচ ডলার সাত সেন্ট, লোতানি গুপ্তধন, আমি কি হত্যাকারী?, মার্সেনারি, অধরা কুমারী, ফকিরের কেরামতি (হরর কাহিনী), দ্বিতীয় ধরন (সায়েন্স ফিকশন), মানুষটা মরেনি (গোয়েন্দা উপন্যাস), গুমখুন (রহস্যোপন্যাস), কি বিপদ (ফ্যান্টাসি), কি ছিল ওটা? (ভৌতিক), ফুর্তি (রহস্যোপন্যাস), নার্সারি (ফ্যান্টিাসি), চারপেয়ে মানুষ (হরর), ভেনম (রহস্যোপন্যাস), দুঃস্বপ্ন (সায়েন্স ফিকশন), ইত্যাদি।তিনি ওয়েস্টার্ন লিখেছেন। ছদ্মনামে টিনএজ রোমাঞ্চ সিরিজ লিখেছেন। রোমান্টিক উপন্যাস লিখেছেন।

রোমাঞ্চধর্মী এই লেখাগুলো এডাপটেশনের বাহিরেও অন্য কিছু। যদিও ছায়া অবলম্বনে, মূল কাহিনিকে বাইপাস করা বা অনুবাদ কাহিনি ও চরিত্রের বিন্যাস করে তিনি লিখে গেছেন নিজস্ব স্টাইলে। এমন একসময় ছিল যখন দেশের পত্রিকাগুলোর ঈদ সংখ্যাগুলো তার রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস ছাড়া প্রকাশ পায়নি। মূলধারা সাহিত্য সাময়িকীগুলোতে থ্রিলার সাহিত্যের জন্য জায়গা করে নিলেন তিনি। প্রায় সব বড় প্রকাশনী তার বই প্রকাশ করেছে। আমাদের দেশে থ্রিলার জনপ্রিয় করে তোলার পিছনে তার ভূমিকা অপরিসীম। শেখ আবদুল হাকিম প্রচলিত অর্থে পাল্প ফিকশন, ঘোস্ট রাইটার। বেশিরভাগ বইগুলোর মূল লেখক- উইলবার স্মিথ, ফ্রেডরিক ফরসাইথ, রবার্ট লুডলাম, ক্লাইভ কাসলার, হ্যামন্ড ইনস, জন গ্রিশাম, জেফরি আর্চার, ডেসমন্ড ব্যাগলি, ইয়ান ফ্লেমিংসহ আরও অনেকে। মাসুদ রানার প্রথমদিকের বইগুলো বেশিরভাগ জেমস হ্যাডলি চেজ আর অ্যালিস্টার ম্যাকলিনের লেখা। উনি কিন্তু শুধু হিরোর নাম চেঞ্জ করে মাসুদ রানা করেন না, সব ক্যারেক্টারের নাম চেঞ্জ করেন।

সাহিত্যের বিশ্লেষণে তাকে হয়তো ধর্তব্যের মধ্যে আনা যাবে না, কিন্তু সেই আশির দশকের সময় আবহের প্রেক্ষাপট বিবেচনায়,- যখন মানুষের মৌলিক চাহিদাই পূরণ হওয়া দুষ্কর- তখন নতুন জনরার সাহিত্য করে পাঠক তৈরি করা সাহসের ব্যাপার।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সেবা প্রকাশনীর আরেক সিরিজ ‘কুয়াশা’র দশম কিস্তি দিয়ে প্রকাশনীটির সঙ্গে যুক্ত হন শেখ আবদুল হাকিম। সেবার সঙ্গে প্রায় চার দশক যুক্ত ছিলেন তিনি। রহস্য পত্রিকা ঘটা করে বের হয় ১৯৮০’র দশকের মাঝামাঝি থেকে, ১৯৮৪ সালের নভেম্বরে প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তার আগে ১৯৭০ সালে চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘সেবা’র রহস্য পত্রিকা কাজী আনোয়ার হোসেনেরই সুদক্ষ সম্পাদনায় নতুন করে আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করলে শেখ আবদুল হাকিম সেটার অন্যতম সহকারী সম্পাদক হিসেবে জীবনের নতুন পর্বে পা রাখেন। প্রকাশক ও সম্পাদক কাজী আনোয়ার হোসেন ততোদিন মাসুদ রানার স্রষ্টা হিসেবে দেশখ্যাত। সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার। সেবা থেকে একের পর এক বেরোচ্ছে মাসুদ রানা সিরিজের স্পাই থ্রিলার, কিশোর ক্লাসিক, বিশ্বসাহিত্যের সেরা ক্লাসিকগুলোর কিশোর উপযোগী অনুবাদ, কিশোর থ্রিলার, রহস্য উপন্যাস। রহস্য পত্রিকাও স্বাভাবিকভাবে বাজার মাত করে ফেলল শুরুতেই। সে সময়কার বিভাগীয় সম্পাদকদের অন্যতম ছিলেন শেখ আবদুল হাকিম। ভারী চশমা চোখে শেখ আবদুল হাকিমকে দেখেই মনে হতো এ লোকটার সাধারণ মানুষের শ্রেণিতে পড়েন না। তিনি সেবার নামকরা লেখক ও অনুবাদক হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। উপন্যাস দড়াবাজ স্পাই বের হয়েছে দুই পর্বে। রহস্য পত্রিকাতিই ধারাবাহিকভাবে কেন ফলেটের আ ম্যান ফ্রম সেন্ট পিটার্সবার্গ অনুবাদ করতে থাকেন যা আততায়ী নামে প্রকাশিত হয়। তিনি অনেক বিষয়ে কথা বলতেন, কিন্তু নিজের সম্পর্কে তেমন বলতেন না। অতি অমায়িক এবং সরল ছিলেন। তার মৃত্যুতে গভীরভাবে ব্যথিত হয়েছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সেবা প্রকাশনী থেকে খ্যাতি পাওয়া অনুবাদক নিয়াজ মোরশেদ ওরফে প্রিন্স তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘হাকিম সেবা প্রকাশনীর সাথে দীর্ঘদিন পথ চলেছেন, তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। যে ধরনের সাহিত্যের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাকে ক্রিয়েটিভ বা সৃজনশীল সাহিত্য হিসেবে দেখা হয় না। অথচ সঠিক মূল্যায়ন হলে অনেক উঁচুতে স্থান পাবেন তিনি। ছায়া-লেখক হিসেবে সেবার পাঠকদের অনেকেই তাঁকে জানতেন।’ তিনি ছিলেন প্রচণ্ড আড্ডাবাজ একজন মানুষ। সাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী ও মাহমুদুল হকসহ আরো অনেকের সাথে তাঁর সখ্য ছিল বলেও জানান নিয়াজ।

‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে মালিকানা স্বত্ব দাবি করে কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে কপিরাইট আইনের ৭১ ও ৮৯ ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ দাখিল করেছিলেন শেখ আবদুল হাকিম। নয় বছরেও অভিযোগের কোনো সুরাহা না পাওয়ায় কপিরাইট অফিসে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন তিনি। কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী জানান, মাসুদ রানা সিরিজের প্রায় ৪৫০টি বইয়ের মধ্যে ২৬০টি বইয়ের লেখক হিসেবে শেখ আবদুল হাকিমের দেওয়া তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে তিনিই বইগুলোর লেখক। সেই সঙ্গে কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখকও তিনি। কাজী আনোয়ার হোসেন ‘বাজারজাত করার স্বার্থে’ প্রকৃত লেখকের পরিবর্তে মাসুদ রানার বইগুলোতে নিজের নাম ব্যবহার করতেন। বিষয়টি নিয়ে শেখ আবদুল হাকিমের আপত্তি না থাকলেও রয়্যালিটি নিয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়। মাসুদ রানা সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে দাবি করে কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে একই ধারায় অভিযোগ দায়ের করেছেন আরেক লেখক ইফতেখার আমিন। মাসুদ রানার নেপথ্য লেখক হিসেবে অবশ্য আরও যারা কাজ করেছেন বলে জানা যায় তারা হলেন শাহাদত চৌধুরী, সাজ্জাদ কাদির, রকিব হাসান, ইসমাইল আরমান, ইফতেখার আমিন প্রমুখ।

বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষেতে এতদিনের কর্মস্থল ‘সেবা’ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল তাকে। শামসুদ্দিন নওয়াব নামে অসংখ্য বই অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনূদিত গডফাদার, আততায়ী, কামিনী পড়লে বোঝা যায় কি শক্তিশালী লেখক তিনি। মাসুদ রানার কিছু কিছু বই আর চরিত্র বহু পাঠকের মন ছুঁয়ে গেছে, কাঁদিয়েছে। মূল বই থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে তিনি চরিত্রগুলোকে নতুন করে প্রাণ দিয়েছেন। এখানেই তার মুন্সিয়ানা! তার লেখা মাসুদ রানা সিরিজের অকস্মাৎ সীমান্ত, নীল ছবি, আক্রমণ বা সংকেত, আই লাভ ইউ ম্যান, অগ্নিপুরুষ পড়লে অবাক হতে হয়, কীভাবে অনায়াসে তিনি পরিবেশ পরিস্থিতি পর্যন্ত পাল্টে দিয়েছেন! কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করেছি নাম বা খ্যাতির প্রতি তার বিন্দুমাত্র মোহ ছিল না। স্রেফ পেশাদারের মতো একের পর এক কাজ করে গেছেন। মাসুদ রানার লেখক স্বত্ব নিয়ে কাজীদা’র সাথে বিরোধ বাঁধলে সেবার অনেক লেখককে তার পক্ষে সাক্ষী দিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু আশানুরূপ সাড়া পাননি, অথচ মাসুদ রানা যে তার হাত দিয়েই লেখা, সেটা ছিল সর্বজনবিদিত। খোদ কাজীদা’ও বিভিন্ন সময় সেটা স্বীকারও করেছিলেন। জনপ্রিয় আর এক লেখক রকিব হাসানকে সেবা প্রকাশনীতে নিয়ে এসেছিলেন শেখ আবদুল হাকিম। পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। ২০১৫ সালের আগস্ট সংখ্যায় কিশোর আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই স্মৃতির কথা জানিয়েছিলেন রকিব হাসান।

বিপুলসংখ্যক থ্রিলার পাঠক জানেন ভৌতিক তার উপস্থিতি। ভৌতিক না হয়ে যায়ই না, কারণটা সোজা, তিনি তো ‘ঘোস্ট রাইটার’, ভূতুড়ে লেখক! সার্বক্ষণিক তার উপস্থিতি, কিন্তু থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। দীক্ষিত পাঠক জানেন আবদুল হাকিম ভৌতিক লেখক নন, মৌলিকও লেখকই বটে।
কাজী আনোয়ার হোসেনের মস্তিষ্ক প্রসূত মাসুদ রানা নামে হাকিম লিখেছেন প্রায় আড়াইশ বই। কাজী আনোয়ার হোসেন যখন জনপ্রিয়তার প্রবল প্রতাপে লিখে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না, তখনই যুক্ত হয়েছিলেন শেখ আবদুল হাকিম। কাজটি ছিল টাকার বিনিময়ে কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে লেখা। ব্যাপারটি আমাদের দেশে খুব বেশি স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচিত না হলেও পৃথিবীর বহু ভাষার সাহিত্য ও লেখালেখিতে মান্য রীতি। মাসুদ রানার একেকটা মিশন ছিল দীর্ঘ এক সফর। আর তাই মাসুদ রানাকে যে, যিনি কিংবা যারা তৈরি করতে পারেন তাদের জন্য তারুণ্যের ভালোবাসা প্রখর। শেখ আবদুল হাকিম সে ভালোবাসা পেয়েছেন। থ্রিলার, গোয়েন্দা কাহিনি ধরনের সাহিত্যিক ধারার কাজ স্বাভাবিক এই মানবিক প্রবৃত্তি নিয়ে।

আমাদের দেশে পাঠকের কাছে গোয়েন্দা কাহিনি যতখানি জনপ্রিয়, অ্যাকাডেমিকের কাছে তা প্রায় ততোটাই ।অথচ আমাদের সাহিত্যেই আছে ব্যোমকেশ, ফেলুদা, মাসুদ রানা। ইউরোপ-আমেরিকান বিদ্যায়তনে গোয়েন্দা কাহিনির ভাষ্য উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। ক্ষমতা-রাজনীতির সম্পর্ক বুঝতে গোয়েন্দা কাহিনি সহায়তা করে থাকে। আমরাও দেখতে পারি, গোয়েন্দা কাহিনিতে কীভাবে প্রতিফলিত হলো বাংলাদেশের আত্মপরিচয়, নিরাপত্তা প্রতিরক্ষা ও বিশ্ব রাজনীতির সম্পর্ক। সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে তার সম্পর্কটা ৪২ বছরের। সেটা ভেঙে যাওয়ার অনেক দিন পর আইনি লড়াইয়ে নেমেছিলেন তিনি । ফলটা পক্ষে পাওয়ায় খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু সমঝোতার একটা রাস্তা খোলা ছিল। সেবা প্রকাশনী যদি পাওনা রয়ালটি বুঝিয়ে দেয় তাহলে সেখান থেকে বইগুলো প্রকাশে কোনো আপত্তি ছিল না তার। রয়্যালিটি না পেলে অন্য যেকোনো প্রকাশনীকে বইগুলো দিয়ে দেবার স্পষ্ট অবস্থান ছিল হাকিমের। লেখক বুলবুল চৌধুরী ও শওকত হোসেন, শিল্পী হাসেম খান এবং সেবা প্রকাশনীর প্রাক্তন ব্যবস্থাপক ইসরাইল হোসেন খানের লিখিত মতামতের ওপর ভিত্তি করে ১৪ জুন, ২০২০ তারিখে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস আবদুল হাকিমের পক্ষে রায় প্রদান করেন। ‘ওনার নামে বই ছাপা হোক, তাতে আমার সম্মতি ছিল। আমি তো একা না। অনেকেই তো এভাবে লিখেছেন’। ঘটনার এখানেই সমাপ্তি হতে পারত, যেহেতু এই উক্তির মাধ্যমেই আবদুল হাকিম ঘোস্ট রাইটার/অদৃশ্য লেখক হিসেবে সেবার সাথে যুক্ত থাকার স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। প্রাপ্ত রায়েও উল্লেখ আছে, সেবা প্রকাশনীর অন্যান্য লেখকের মতো আবদুল হাকিম পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে টাকা নিতেন। বই বিক্রির পর আরও টাকা পেতেন। কিন্তু সমস্যা হয়ে যাচ্ছে রায়ের দ্বিতীয় বাক্যটিতে, ‘বই বিক্রির পর আরও টাকা পেতেন’। এতে বোঝা যাচ্ছে তিনি ঘোস্ট রাইটার/অদৃশ্য লেখক হয়তো ছিলেন না।

গত ২৮ আগস্ট ২০২১ তারিখে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। শ্বাসকষ্টজনিত রোগে একদার থ্রিলার-রোমাঞ্চ-রহস্য ঘরানার এই পাঠকপ্রিয় লেখক ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন।

শামীম আহমেদ

+ posts

Read Previous

ভাষাসৈনিক রিজিয়া খাতুন আমাদের অহংকার

Read Next

গোলাম কিবরিয়া পিনু’র কবিতা: দেশপ্রেমের বহু বর্ণিল দ্রোহের স্ফুলিঙ্গ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *