অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ইমন চৌধুরী -
প্রিয় দাদুভাই, আমাদের দাদুভাই

দেশবরেণ্য কবি, ছড়াকার, গীতিকার, শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। অনেক পরিচয় তার। তবে সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি আমাদের প্রিয় দাদুভাই। বাংলাদেশে একজনই। আশি পেরিয়েও অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক তরুণ। অফিসের ক্যান্টিনে একসঙ্গে খেতে বসলে বাসা থেকে নিয়ে আসা মাছ বা মাংসের টুকরা ভেঙে আমাদের প্লেটে তুলে দেন যত্ন করে। হয়তো আমাদের খাওয়া শেষ, দাদুভাই আবার খানিকটা ভাত তুলে দেন প্লেটে। নিজের বাটি থেকে আরও খানিকটা মাছ, মাংস বা সবজি তুলে দেন জোর করে। আমরা চেঁচিয়ে উঠি, ‘আর পারব না দাদুভাই। প্লিজ, আর দেবেন না।’

কিন্তু কে শোনে কার কথা! দাদুভাই তার স্নেহমাখা কণ্ঠে বলেন, ‘আরে খাও খাও! আরেকটু খেলে কিছু হয় না।’ এই হলেন আমাদের দাদুভাই।

২০২০ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ‘সাহিত্যদেশ’ থেকে প্রকাশিত আমার ‘অন্তহীন’ উপন্যাসটি দাদুভাইকে উৎসর্গ করেছিলাম উপরিউক্ত কথাগুলো লিখে। এই অল্প বাক্যে দাদুভাইকে সবটুকু চেনা না গেলেও কিছুটা বোঝা যায় নিশ্চয়ই। মানুষ হিসেবে দাদুভাই আমার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। দৈনিক যুগান্তরে যোগ দেওয়ার পর থেকেই আমাদের এই সখ্য। কত শত স্মৃতি দাদুভাইয়ের সঙ্গে— সবটা বর্ণনা করতে গেলে বিশাল এক পুস্তক হয়ে যাবে।

যুগান্তরে দাদুভাই ছিলেন আমাদের ফিচার সম্পাদক। ছিলেন আমাদের মেন্টর। বয়সের ব্যবধান ভুলে কখনো কখনো বন্ধুও হয়ে উঠতেন বটে। যুগান্তরের রম্য ও বিদ্রূপ সাময়িকী ‘বিচ্ছু’তে নিয়মিত প্রকাশ হতো দাদুভাই’র ছড়া ‘কুট্টুস’। এ শিরোনামেই দাদুভাই’র ছড়া বিখ্যাত ছিল পাঠকমহলে। বিচ্ছুর বিভাগীয় সম্পাদক হিসাবে প্রতি সপ্তাহে তার ছড়া আদায় করা ছিল আমার জন্য ছোটখাটো যুদ্ধজয়ের সমান। প্রতি রবিবার বিচ্ছু প্রকাশিত হয়। শনিবার সন্ধ্যার আগে আগে পেজ মেকাপ সেরে ছাপাখানায় পাঠিয়ে দিতে হয়। এই হলো নিয়ম।

আমি সব লেখা বসিয়ে সঙ্গে অলংকরণ যুক্ত করে বসে থাকি, অথচ দাদুভাই’র ছড়ার কোনো খবর নেই! আমি দৌড়ে দাদুভাই’র কক্ষে প্রবেশ করে বলি, ‘দাদুভাই, প্লিজ আমার পাতা ছাড়তে হবে। ছড়াটা ছাড়েন।’

দাদুভাই আয়েশি কায়দায় চেয়ার ছেড়ে উঠে বলেন, ‘আরে দেব দেব। আগে খেয়ে আসি। চলো বন্ধু, তুমিও আমার সঙ্গে খাবে।’

দুপুরের খাবার বিকেলে খাওয়ার অভ্যাস দাদুভাই’র। আমি আঁতকে উঠে বলি, ‘এখন আপনি খাবেন! ছড়া লিখবেন কখন?’

‘আরে হয়ে যাবে, হয়ে যাবে। টেনশন করো না বন্ধু।’

এই বলে ক্যান্টিনে ওঠেন দাদুভাই। অনেক সময় জোর করে আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যান। কখনো অফিসের ক্যান্টিন, কখনো অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে আমরা চলে যাই ভাটারা এলাকার বিসমিল্লাহ হোটেলে। আমি খেতে খেতে দাদুভাইকে অনুরোধ করি, ‘প্লিজ দাদুভাই, তাড়াতাড়ি করেন। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, পাতা ছাড়ব কখন! সাইফুল ভাই (যুগান্তর সম্পাদক) ক্ষেপে যাবেন কিন্তু।’

কিন্তু ওই যে বললাম, কে শোনে কার কথা! দাদুভাই হেলেদুলে খেতে থাকেন। নানা পদের ভর্তা-ভাজি চেখে দেখেন। খাবার সেরে অফিসে ফিরে নিজের কক্ষে এসে কাগজ-কলম নিয়ে আয়েশ করে বসেন। আমি বসে বসে ঝিমুতে থাকি। সময় বয়ে যায়। দাদুভাই এক-দুই লাইন করে লিখতে থাকেন। আমি মাঝে মাঝে সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিই।

দাদুভাই লিখতে লিখতে বলেন, ‘আরে হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। আর মাত্র কয়েক লাইন। টেনশন করো না বন্ধু।’ অগত্যা আমার আবার ঝিমুনি আসে।

শেষতক যখন লিখে শেষ করেন তখন হয়তো সন্ধ্যা বা সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। লিখে শেষ করে দাদুভাই বারবার পড়ে শোনাতে থাকেন। আমার তখন শোনার সময় নেই।

ওদিকে আমার পাতা ছাড়ার নির্ধারিত সময় শেষ অনেক আগেই। তবু দাদুভাই’র ছড়া নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ফের মেকাপ রুমে প্রবেশ করি। আমার হাতে দাদুভাই’র ছড়া দেখে মেকাপ রুমের সবাই মুচকি মুচকি হাসেন। বুঝতে পারেন শেষতক ছড়া লিখে শেষ করেছেন দাদুভাই।

দ্রুত কম্পোজ এবং রিডিং সেরে দাদুভাই’র ছড়া বসিয়ে পাতা নিয়ে ছুটি সাইফুল ভাই’র (সম্পাদক) কাছে। সাইফুল ভাই বিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করেন, ‘এত দেরি হলো কেন?’

আমি খানিকটা লজ্জিত হয়ে বলি, ‘দাদুভাই ছড়া লিখতে দেরি করেছেন।’

সাইফুল ভাই বুঝতে পারেন। বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করেন না। পত্রিকার সম্পাদক হয়েও দাদুভাইকে কিছু বলার সাহস করেন না তিনি। কারণ দাদুভাই যে তারও গুরু। এ দেশে লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় অনেকের গুরু আমাদের দাদুভাই। সে যাই হোক, এভাবেই বিচ্ছু প্রকাশিত হয়েছে প্রতি রবিবার। সপ্তাহের পর সপ্তাহ। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর।

এখনো বিচ্ছু প্রকাশিত হয়। কেবল কুট্টুস লেখার সেই মানুষটা আমাদের মাঝে নেই আর! মাঝে মাঝে মনে হয় এই বুঝি কেউ বলে উঠবেন, ‘আরে হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। আর মাত্র কয়েক লাইন। টেনশন করো না বন্ধু।’

দাদুভাই আমার কাছে একজন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক। তার লেখা দুটি গানের কথা অন্তত বলতে পারি, যে গান দুটি তাকে রীতিমতো অমরত্ব দান করেছে। দাদুভাই’র লেখা ‘নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা, কোন দূরে যাও চইলা’ গানটি বিখ্যাত শিল্পী আব্দুল আলীমের কণ্ঠে এখনো মানুষের অন্তরে গেঁথে আছে যেন। বাংলা গান যতদিন থাকবে এ গানের আবেদন ফুরাবে না কখনো।

এছাড়া দাদুভাই’র লেখা ‘ঘুরে ফিরে বারে বারে, ঈদ আসে ঈদ চলে যায়, ঈদ হাসতে শেখায়, ভালোবাসতে শেখায়, ত্যাগের মহিমা শেখায়’ গানটিও ঈদের গান হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে কোরবানির ঈদে এ গান যেন আমাদের ঈদের আনন্দকে খানিকটা বাড়িয়ে তোলে।

এর বাইরে দাদুভাই’র লেখা যে কিশোর কবিতাটিকে আমি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিশোর কবিতা মনে করি, সেটির কথা না বললেই নয়। যদিও দাদুভাই সেটিকে ‘আমার ছড়া’ শিরোনামে ছড়া হিসাবেই লিখেছেন। দাদুভাই’র কবিতাটি ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের যে চিরায়ত সংগ্রাম, তার যেন নিখুঁত চিত্র এ কবিতায় আমরা দেখতে পাই। এত নিখুঁতভাবে খুব কম লেখকই ফুটিয়ে তুলতে পারেন মানুষের জীবনছবি। প্রখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ কিশোর কবিতা গ্রন্থেও স্থান পেয়েছে কবিতাটি।

দাদুভাই’র কবিতাটি প্রায় নিয়মিতই আমি তার কাছ থেকে শোনার বায়না ধরতাম। কতবার যে শুনেছি দাদুভাই’র কণ্ঠে তার হিসাব নেই। যতবার অনুরোধ করেছি ততবারই আগ্রহ নিয়ে দাদুভাই কবিতাটি শুনিয়েছেন আমাকে। দাদুভাই’র অফিস কক্ষে বসে বাংলা সাহিত্য নিয়ে নানা আলোচনার ফাঁকে আমি তার এ কবিতার কথা তুলতাম। তারপর যথারীতি আমার শোনার বায়না। দাদুভাই বলে যেতেন মুখস্থ। শুনতে শুনতে বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে যেত আমার। একটি গ্রাম, একটি কুঁড়েঘর, একটি কৃষক পরিবারের ছবি ফুটে উঠত আমার চোখে। সঙ্গে ফুটে উঠত হঠাৎ ধেয়ে আসা ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের চিত্র। বাঁচার জন্য সেই কৃষক পরিবারের ছোটাছুটি। আমি যেন সব পরিষ্কার দেখতে পেতাম। কবিতাটি পাঠকদের জন্য নিচে যুক্ত করে দিলাম। আশা করি ভালো লাগবে সবার।

আমার ছড়া

রফিকুল হক দাদুভাই

গ্রামের নাম হিজুলী

ঝড়ের রাতে বিজুলী

রাত থমথম সরোবর

সুখ-দুঃখের কুঁড়েঘর।

বলতো ওমা হিজুলী,

আমার জন্যে কী থুলি?

আমার একটা নদী ছিল

নদীটার নাম ধরলা,

বদর বদর ভাদর মাসে

কী কাম তুমি করলা?

ভাগ্যে যদি ছিল তাই

এখন আমার নদী নাই।

আমার একটা গাছ ছিল

গাছটার নাম অশথ,

সেই গাছটার শাখায় শাখায়

হাজার পাখির বসত।

পাখির বাসা নড়ে চড়ে

কাল বোশেখী ঝড়ে,

মাঠের ধারে বুড়ো অশথ

হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

সে মাঠ ছিল আমার

সাত পুরুষের খামার

পুষ মাসে তুষ উড়তো হাওয়ায়

কদর ছিল ধামার

ধামা ধরতে বেহাল এখন

দাদার কিংবা মামার।

আমার একটা পাখি ছিল

পাখিটার নাম ময়না,

গান করতো মান করতো

রাগলে কথা কয় না।

দুঃখ ব্যথায় জ্বলে জ্বলে

বুকটা যখন ঝাঁজরা

পালিয়ে গেল সেই সে পাখি

ভেঙে খাঁচার পাঁজরা।

ক্ষত ঢাকলাম, কত ডাকলাম,

ফিরে আয়রে ময়না।

এমনি পোড়া কপাল আমার

সুখ কখনো সয় না।

মরেও বেঁচে থাকি তাই

এখন আমার পাখি নাই।

গ্রামের নাম হিজুলী

ঝড়ের রাতে বিজুলী

রাত থমথম সরোবর

সুখ-দুঃখের কুঁড়েঘর।

বলতো ওমা হিজুলী,

আমার জন্যে কী থুলি?

ইমন চৌধুরী : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

Read Previous

জলছবির প্রতিচ্ছবি

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৪র্থ সংখ্যা (এপ্রিল-২০২৩)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *