অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৪, ২০২৪
১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৪, ২০২৪
১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সঞ্চালি ঘোষ -
যেমন দেখেছি স্বস্তিকাদিকে

যেমন দেখেছি স্বস্তিকাদিকে

সঞ্চালি ঘোষ

স্বস্তিকাদির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় All India Radio-তে দিদির গাওয়া গানের মাধ্যমে। বাবার কাছে জানলাম শিল্পীর নাম শ্রীমতি স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। ওনার বাবা সংস্কৃত সুপণ্ডিত ড. গোবিন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায়। স্বস্তিকাদি বিশ্বভারতীর ছাত্রী।

তখন সময়টা ১৯৯০ সাল। আমার বয়স খুবই কম। ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথের গান শুনেই বড় হচ্ছি। তখন রবীন্দ্রনাথের গান বোঝার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না। শুধু একটা ভালো লাগা সৃষ্টি হয়েছিল দিদির গানের প্রতি। পরবর্তীকালে জোড়াসাঁকো ও রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠিত কবিপ্রণাম অনুষ্ঠানে দিদির গান মঞ্চে শুনেছি। বেতার ও দূরদর্শনে শিল্পী হিসাবে যখনই স্বস্তিকাদির নাম শুনতাম, মন দিয়ে গানটা শোনার তাগিদ অনুভব করতাম।

এরপর বছর সাতেক পরের কথায় আসি। তখন আমি শ্রীমতী মায়া সেনের সান্নিধ্যে সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করছি, স্নাতকোত্তর স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং বিবাহ সূত্রেও আবদ্ধ হয়েছি। সৌভাগ্যক্রমে আমার স্বামী শ্রী তরুণ কান্তি ঘোষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান ও লেখার গুণগ্রাহী। ফলত, শান্তিনিকেতনের প্রতিটি অনুষ্ঠানে আগ্রহী শ্রোতার মতো আমরা নিয়মিত যাওয়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় খুব কাছ থেকে স্বস্তিকাদির গান শোনার সুযোগ পেলাম। বসন্তোৎসব উপলক্ষে দোলের আগের দিন সন্ধ্যায় গৌড় প্রাঙ্গণের মঞ্চে দিদি গাইলেন—

বনে এমন ফুল ফুটেছে
মান করে থাকা আজ কি সাজে

এই গান এর আগে আমি কোনোদিনও শুনিনি। দিদির অপূর্ব গায়কী আমার মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি এনে দিল। বাড়িতে ফিরে গানটা তুলে ফেললাম। কিন্তু সেই অনুভূতি গানের মধ্যে ফোটাতে যে অভিজ্ঞতা লাগে, আমার তখন সেটা ছিল না।

এর কিছুদিন পর স্বস্তিকাদির কাছাকাছি আসার খুব সুন্দর একটা সুযোগ ঘটে গেল। আমার স্বামী কর্মসূত্রে কোলকাতা থেকে বোলপুরে বদলি হয়ে এলেন। আমাদের আলাপ হলো শ্রী সৌগত ধর চৌধুরীর সঙ্গে। সৌগতদা শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা। আর ছিলেন স্বস্তিকাদির খুব ভালো বন্ধু ও ছাত্র।

আমার স্বামীর কাছ থেকে সৌগতদা জেনেছিলেন, আমি স্বস্তিকাদির গানের অনুরাগী। সৌগতদা আশ্বস্ত করলেন, আমাদের সঙ্গে দিদির নিশ্চয়ই একদিন আলাপ করাবেন। শুনেই একটা ভালো লাগা আর অপেক্ষা মনটাকে ছেয়ে রইল।

সে সময় আমার স্বামী তরুণ কর্মসূত্রে বোলপুর থাকলেও, আমি আমার সঙ্গীতচর্চা ও আমার ৫ বছরের কন্যার পড়াশোনার কারণে কোলকাতাতেই থাকতাম। কিন্তু প্রায়ই শান্তিনিকেতনে যাতায়াত চলত। আর আমরা কোলকাতা থেকে গেলে কোনো হোটেলেই উঠতাম। সেই রকমই একবার West Bengal Tourist Lodge-এ উঠেছি। হঠাৎ শুনলাম দিদি ব্যক্তিগত কিছু কাজে ভুবনডাঙায় আসবেন, পরদিন উনি বাংলাদেশে যাচ্ছেন। তাই আজই আমাদের হোটেলে এসেই আমাদের সঙ্গে আলাপ করে যাবেন। আমি তো শুনে অবাক! একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীতভবনের অধ্যাপক হয়ে, আমাদের সঙ্গে হোটেলে এসে আলাপ করে যাবেন!

যেমন কথা তেমন কাজ। সৌগতদা স্বস্তিকাদিকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন সন্ধ্যেবেলা। সঙ্গে সৌগতদার হারমোনিয়াম। একদম সহজভাবে দিদি ৩ ঘণ্টা আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে দিলেন। আমারও সব জড়তা আস্তে আস্তে কেটে গেল।

দিদি আমার গান ও আমার স্বামীর আবৃত্তি শুনলেন। নিজেও গাইলেন। আর আমার কন্যা দেয়াসিনীর আধো আধো গান শুনে, ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন বিশ্বভারতীতে ভর্তি করে দিতে। দিদির গান শুনতে শুনতে সেদিন আমার পুরোনো দিনের অল্প বয়সের কথা মনে পড়ছিল, আর ভাবছিলাম এরকম সৌভাগ্য আমার হবে কে জানত…।

এর পরের বসন্তোৎসবের সুখস্মৃতিগুলো যে এভাবে লেখার সুযোগ পাব ভাবতেই পারিনি।

শান্তিনিকেতনে দোলের দিন সন্ধ্যেবেলা অনুষ্ঠান শেষে, আশ্রম মাঠ সংলগ্ন বাস্কেট বল কোর্টে গোল হয়ে বসে আমরা নিজেদের মধ্যে গানবাজনা করছি। সৌগতদাও ছিলেন। হঠাৎ আমাদের দূর থেকে বুঝতে পেরে দেখি, স্বস্তিকাদি এগিয়ে আসছেন। আর তাই দেখে আমার কন্যা ছুটে গিয়ে দিদিকে হাত ধরে নিয়ে এল। দিদিও আমাদের সঙ্গে বসে পড়লেন। চলল গান। মাথার উপর দোল-পূর্ণিমার চাঁদ। সেই চাঁদের আলোয় আমাদের আসর জমে উঠল। দিদি গাইলেন ‘পূর্ণ চাঁদের মায়ায়’, ‘মম অন্তর উদাসে’ ইত্যাদি।

অসাধারণ অনুভূতি। এ অনুভূতি আর ভালোলাগা বোধহয় ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এরপর থেকে প্রতি বছর দোলের সকালের অনুষ্ঠান শেষে আমরা স্বস্তিকাদির বাড়িতে চলে যেতাম। সকলে মিলে চলত গান আর খাওয়া-দাওয়া।

এর কিছুদিন পর কোলকাতার কলামন্দিরে ‘বসন্ত বন্দনা’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান সংঘটিত হলো। তাতে কোলকাতার শিল্পীদের সঙ্গে শান্তিনিকেতন থেকে স্বস্তিকাদিও এসেছিলেন সঙ্গীত পরিবেশন করতে, আর সঙ্গে এনেছিলেন দিদির বিশিষ্ট কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে। তারাও গান গেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে আমাকেও সুযোগ দিলেন গাইতে। সৌগতদার মারফত খবর পাঠালেন ‘নিবিড় অমা তিমির হতে’ গানটা গাইতে হবে। আমি তো তখনও মায়াদির কাছেই শিখছি। স্বস্তিকাদির সঙ্গে সুন্দর একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে শুধু। মনের মধ্যে ভয় নিয়ে গাইলাম, দিদি আমার সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজয়ে দিলেন। অনুষ্ঠান শেষে প্রশংসাও পেলাম উপরি পাওনা হিসেবে।

এদিকে ২০১২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শ্রীমতি মায়া সেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। রবীন্দ্রনাথের গান সঠিক নিয়মে গাওয়ার পাঠ আমি মায়াদির কাছেই পেয়েছি। নিজেকে ভীষণ অভিভাবকহীন মনে হচ্ছিল। কী করব? কোথায় যাব? ভাবতে বেশি সময় লাগেনি। তখন মুঠোফোনের যুগ এসে গেছে, একটু ইতস্তত করতে করতে রাত করে ফোন করেই ফেললাম স্বস্তিকাদিকে। বললাম, আমি পঞ্চকবির গান শিখতে চাই আপনার কাছে। দিদি সম্মতি জানালেন। প্রথম ক্লাস শুরু করলাম কোলকাতার রাণীকুঠিতে অরবিন্দ আশ্রমে। অনেকের মধ্যে গিয়ে বসলাম। শিখলাম—

তুমি গাও, তুমি গাও গো
গাহো মম জীবনে বসি

এই থেকেই শুরু হলো দিদির সঙ্গে আমার সাঙ্গীতিক যাত্রা। দিদির কাছেই শিখেছি গান গাইবার সময় কোন শব্দের মাঝে কতটা Gap দিলে গানের বক্তব্য স্পষ্ট করে বোঝানো যায়।

এরপর রবীন্দ্রজন্মোৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রসদনে কবিপক্ষের অনুষ্ঠানে, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বয়সের জন্মদিন উদ্‌যাপন নিয়ে রচিত চিত্রনাট্য ‘জন্মদিন’-এর রিহার্সাল শুরু হলো শান্তিনিকেতনে স্বস্তিকাদির বাড়িতে। ‘জন্মদিন’ আলেখ্যতে দিদি আমার জন্য ১টি গান রাখলেন— ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’। আর আমাকে বললেন ‘দেখি কেমন গাইতে পারো?’

অনুষ্ঠান শেষে ২/৪ জন শ্রোতা বন্ধু এসে স্বস্তিকাদিকে ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’ গানটির পরিবেশনা শ্রুতিমধুর লেগেছে, সে কথা জানান। দিদি শুনেই সাজঘর থেকে আমাকে ডাকিয়ে এনে ওনাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন এবং আমার সদ্য প্রকাশিত অ্যালবাম ‘হে বন্ধু’র কথাও ওনাদের বলেন।

এভাবেই দিদির সঙ্গে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেয়েছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘শ্যামা’। এই নৃত্যনাট্যের রিহার্সাল চলাকালীন, শান্তিনিকেতনের অনেক গুণী মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। এ নৃত্যনাট্যের রিহার্সাল হতো, সঙ্গীতভবনের মুক্তমঞ্চে। রিহার্সাল শুরুর দিনই স্বস্তিকাদি বললেন, আমাকে শ্যামা চরিত্রের প্রথম অংশের গানগুলো গাইতে হবে। আর পরের অংশটুকু গাইবেন দিদি। আমি তো কিছুই ভাবতে পারছি না! শান্তিনিকেতনের সব গুণী মানুষের সঙ্গে সঙ্গীতভবনে রিহার্সাল দিচ্ছি, এটা ভেবেই আমি আবেগতাড়িত হয়ে উঠেছিলাম, তার সঙ্গে আবার শ্যামা চরিত্রের গান! কেমন ঘোরের মতো লাগছিল। আর একটা অজানা ভয় আমায় ছেয়ে ফেলেছিল, পারব তো? দিদির পাশে বসেই সেদিন শ্যামার গান গেয়েছিলাম। দিদির স্নেহ ও আশীর্বাদে উতরে গিয়েছিলাম।

পরবর্তীকালে কোলকাতায় নানা রকম ব্যস্ততার কারণে, বেশ কিছুদিন অন্তর শান্তিনিকেতনে এসেই আমি স্বস্তিকাদির কাছে ক্লাস করে যেতাম। এরপর দিদিও বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিভাগীয় প্রধান হয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমার কন্যাও বড় হয়ে অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা শুরু করল। এতদিনে দিদির কথা আমরা রাখতে পারলাম।

২০১৯ সালের ঘটনা লিখে লেখায় ইতি টানব। সে বছর বসন্তোৎসবের সকালের অনুষ্ঠানে গান গাইবার বাছাই পর্ব চলছে। আমার কন্যা দেয়াসিনী বাছাইপর্বে উত্তীর্ণ হয়েছে খবর পেয়েই স্বস্তিকাদি দেয়াসিনীকে ডেকে বললেন, ‘তুই আমার দলে থাকবি, ২টা গান বলে দিচ্ছি, লিখে নিয়ে আগামীকাল রিহার্সালে আসবি’। আবার বকাও দিলেন, গতবছর ২৫ ডিসেম্বরের ক্যারলে গানের দলে নাম না দেওয়ার জন্য। দারুণ আনন্দ করে সে বছর দেয়াসিনী স্বস্তিকাদির পরিচালনায় গান গেয়েছিল।

এর পরপরই কোভিডের করাল গ্রাসে সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগ গেল বিচ্ছিন্ন হয়ে। দিদিও ব্যাঙ্গালোরে চলে গেলেন বেশ কিছুদিনের জন্য। তারপর অসুস্থতা নিয়ে একেবারেই চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। দিদির সঙ্গে কাটানো সেই সুন্দর মুহূর্তগুলোর স্মৃতি আমাদের মনের মাঝখানটাতে চিরদিন থেকে যাবে।

দিদি চির শান্তিতে থাকবেন।

সঞ্চালি ঘোষ : সঙ্গীতশিল্পী ও শিক্ষক, কোলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ

Read Previous

জলছবির প্রতিচ্ছবি

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৪র্থ সংখ্যা (এপ্রিল-২০২৩)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *