অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ২, ২০২৪
১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ২, ২০২৪
১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাণ্ডব মনদেহী -
শহীদজায়া পান্না কায়সার
দুঃখ যার প্রাণশক্তি

গুনীজনেরা মৃত্যুর পরও তাদের পদচিহ্ন এঁকে যায় পৃথিবীতে। পান্না কায়সার তেমনই একজন। তিনি তার মনের চিত্রকল্পের ছাপ এঁকে দিয়েছেন পৃথিবীর পাঠশালায়। তার জীবনীশক্তি মানুষকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জোগায়।

শহীদজায়া পান্না কায়সার জন্মগ্রহণ করেন ২৫ মে, ১৯৫০ সালে— কুমিল্লা জেলায়। তার আরেক নাম সাইফুন্নাহার চৌধুরী। কলেজে পড়ার সময় ঢাকায় এক উচ্চবিত্ত পরিবারে তার বিয়ে হয়। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। শেষে সেই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য পড়াশোনায় মনোযোগ দেন। শুরু করেন জীবনের নতুন অধ্যায়। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন কুমিল্লা মহিলা কলেজে। সেখান থেকে তিনি বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি নেন। পরে বাংলায় মাস্টার্স করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তার দুর্বিষহ জীবন থেকে ফিরে আসার সাহস দেখে অনেক নারী অনুপ্রাণিত হয়েছেন। জীবন যে, যে কোনো সময় থেকে নতুনভাবে শুরু করা যায় তা তার জীবন থেকেই বোঝা যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শহীদুল্লা কায়সারের সাথে তার পরিচয় হয়। ১৯৬৯ সালে তার বিয়ে হয় শহীদুল্লা কায়সারের সাথে। শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক ও রাজনীতিক। শহীদুল্লা কায়সার-এর সংস্পর্শে এসে তার পরিচয় হয় আধুনিক সাহিত্য ও রাজনীতির সাথে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাজাকার আলবদর বাহিনীর সদস্যরা শহীদুল্লা কায়সারকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তিনি আর বাসায় ফেরেননি। এরপর থেকে একাই তিনি তার দুই সন্তানকে বড় করে তুলেছেন। পান্না কায়সার ছিলেন সাংস্কৃতিক সংগঠক, লেখক, শিশু সংগঠক ও আন্দোলনকর্মী।

শহীদজায়া পান্না কায়সার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলেন। এই বিশেষ ভূমিকার জন্য তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে অমর হয়ে থাকবেন। এছাড়া অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে তোলায় তার ভূমিকা অনেক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তার আদর্শ ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ। এজন্য তাকে নানা সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছে।

এছাড়া তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে আংশ গ্রহণ করেন। সারাজীবন ধরে শহীদজায়া পান্না কায়সার মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার জীবনসংগ্রাম পিছিয়ে পড়া নারীদের বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জাগাবে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার ভূমিকা জন্য আজীবন স্মরণ করবে বাংলাদেশের মানুষ। তার জীবনশক্তি ছিল প্রচুর। আড়াই বছর সংসারের পর মুক্তিযুদ্ধে স্বামীকে হারিয়ে একাই জীবনসংগ্রামে সকল দুঃখ জয় করে সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন। দুঃখকে বেঁচে থাকার সম্বল করে দুঃখকেই জয় করেছেন। অধ্যাপক পান্না কায়সার বেগম বদরুন্নেসা কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। পান্না কায়সার ছিলেন ঔপন্যাসিক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।

লেখালেখির জগতে ১৯৯১ সালে প্রবেশ করেন। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে— ‘মুক্তিযুদ্ধ আগে ও পরে’, ‘নীলিমায় নীল’, ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’, ‘মানুষ’, ‘অন্য কোনো খানে’, ‘তুমি কি কেবল ছবি’, ‘রাসেলের যুদ্ধ যাত্রা’, ‘দাঁড়িয়ে আছ গানের ওপারে’, ‘আমি’, ‘না পান্না না চুনি’, ‘অন্য রকম ভালোবাসা’ ও ‘সুখ’।

শহীদুল্লা কায়সারের কাছ থেকে পান্না কায়সার শিখেছেন কীভাবে মানুষকে ভালোবাসতে হয়। বেঁচে থাকার আগ পর্যন্ত তিনি ভালোবেসে গেছেন মানুষকে। মানুষের অধিকারের জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। অপসংস্কৃতির দাবানল থেকে দেশকে রক্ষা করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

তার স্বামীর ঘাতকদের ক্ষমতায় দেখে, তার কর্মের গতি আরও বেগবান হয়। তার চিন্তাচেতনা ছিল নতুন প্রজন্মকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বে।

তার প্রথম উপন্যাস মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে। তিনি বইয়ের শুরুতে জীবনের সূচনা ঘটনাগুলো বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন তার বাবা মাইজভাণ্ডারীর ভক্ত ছিলেন। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে বাবার দুঃসাহসী ঘটনা। তার বাবা হারমোনিয়াম কাঁধে বেঁধে পূর্বপুরুষদের কবরস্থানে ভজন ও গজল গান করতেন।

মোল্লারা এবং মুরব্বিরা ক্ষেপে হারমোনিয়াম ভাঙতে এসেছিল কিন্তু বাবার দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তারা পারেনি। তার বাবার ছিল ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মাথা নত না করার বিপ্লবী শক্তি।

চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের পরবর্তীকালে দেশের রাজনীতিতে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে লেখকের কষ্ট প্রকাশ পাঠককে স্পর্শ করে। মনের কষ্টকে দূর করার জন্য যুব সমাজকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই গ্রন্থে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের দুই প্রবাদ পুরুষ শহীদুল্লা কায়সার, জাহির রায়হানের জীবন নানান দিক এবং স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার গল্প তাদের ভূমিকা এবং বাঙালির জাতির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো চিত্রায়িত করে গ্রন্থটি একটি ঐতিহাসিক মূল্য লাভ করেছে। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের মানুষের করুণতম গল্প লিখেছেন। তার গল্প পাঠে স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী মানুষদের প্রতি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা বেড়েছে পাঠকদের।

বাংলাদেশের বিজয় হয়েছে। কিন্তু তিনি প্রিয় মানুষদের জন্য অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলোর করুণ আর্তনাদ চিত্রায়িত করেছেন। দেশের মহান মানুষদের হারানোর নির্মম বেদনাগুলো তিনি যেভাবে চিত্রায়িত করেছেন, সংবেদনশীল পাঠকরা গ্রন্থটি পাঠ করে কান্না ধরে রাখতে পারেন না।

পান্না কায়সার জানেন দেশকে গড়ে তুলতে হলে শিশু কিশোরদের স্বাধীনতার চেতনায় সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিশুকিশোরদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি খেলাঘর আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালে শহীদুল্লা কায়সারের অনুগত বন্ধুরা পান্না কায়সারকে জাতীয় শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘর-এ নিয়ে আসেন। পান্না কায়সার খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। শুরু করেন জীবনের নতুন অভিযাত্রা। তিনি চিন্তা করেছিলেন শিশুরা যদি অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক, দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে ওঠে। তাহলে সমাজ পরিবর্তনের কাজ সহজ হবে। তার এই চিন্তা-চেতনা থেকে নিজেকে খেলাঘরে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি খেলাঘরের প্রতিটি শিশুদের নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন।

পান্না কায়সার ছিলেন বহুকর্মা মানুষ। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

তার লেখার মূল বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণার জন্য তিনি ২০২১ সালে সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে পান্না কায়সারকে। তিনি প্রত্যেকটি শিশুর হাসির মধ্যে বেঁচে থাকবেন চিরকাল। তিনি সারা জীবন মাটি ও মানুষের মুক্তির গান গেয়েছেন। আমরা তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

 

Read Previous

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৫ম সংখ্যা

Read Next

মেঘ পাহাড়ের ডাকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *