অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৯, ২০২৪
১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৯, ২০২৪
১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কামরুল ইসলাম  -
সংগীতমণি বুলবুল মহলানবীশ : স্মৃতি তর্পণ

১.

নবজাগরণ প্রসঙ্গে ডিরোজি’র ভাবনার সাথে বুলবুল মহলানবীশের উদার চিন্তার আধুনিক মনস্বিতার পরিচয় পেয়ে অভিভূত হয়েছিলাম। ডিরোজিও ইউরোপীয় ভাবনার বাদ-বিবাদে বিতর্কের বিদ্যাবত্তা নিয়ে উনিশ শতকে মুক্তচিন্তার ঝড় তুলেছিলেন। ফ্রান্সিস বেকনের Knowledge of Power ভাবনায় গঠিত Academic Association-এর আলোচনায় জন লক, ডেভিড হিউম, জেরেমি বেন্থাম, টমাস পেইনসহ পাশ্চাত্যের অগ্রসর চিন্তাবিদ দার্শনিকদের সৃষ্টিকর্ম স্থান পেত। পঠনপাঠনের জ্ঞানভিত্তিক তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে ডিরোজিও নতুন ভাবধারার উন্মেষ ঘটান।

কথাপ্রসঙ্গে মহলানবীশ বললেন, এখন সৃজনশীল আলোচনা লক্ষ্য করা যায় না। এমনই কথোপকথনের সময় তার ধৈর্য স্বতন্ত্র মহিমায় উদ্ভাসিত বলে মনে হয়েছে। তবে ভারতের ঐতিহ্য যে শক্তিশালী তা আধুনিক বাঙালি রামমোহন রায় সকলকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাশ্চাত্যবোধের প্রখর চিন্তাশক্তির সাথে প্রাচ্যের সমন্বয় সাধন করে রামমোহন রায় বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিশ্বে তুলে ধরতে সক্ষম হন। বাঙালির অস্তিত্ব অনুসন্ধান করা প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তা দর্শন কার্যকর বলে তিনি মন্তব্য করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথই রামমোহন রায়কে ভারতপথিক অভিধায় অভিহিত করেছিলেন। পরিচয় হওয়ার পর থেকে এমন সব আমার কৌতূহলের কারণে তিনি বিব্রত বোধ করেননি।

মনে পড়ে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ, বুলবুল মহলানবীশের জন্মদিন মিরপুর রোড সংলগ্ন টাইম স্কয়ারে পালিত হয়েছিল। জন্মদিন পালনের আনন্দ-আড্ডা-সভায় দেশের বিশিষ্টজনেরা এসেছিলেন। সেই সভায় তাকে ‘সংগীতমণি’ উপাধিতে ভূষিত হতে দেখলাম। বড্ড ভালো লেগেছিল, উপাধিটা। বৃষ্টির মধ্যে বহু কীর্তিমানেরা তার মহান মুক্তিযুদ্ধ ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল অবদানের কথা তুলে ধরেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ ‘পারস্য উপসাগরের তীরে’ (ভ্রমণকাহিনী), ‘সংহিত সংলাপ’ ( কবিতাগ্রন্থ), ‘নীল সবুজের ছড়া’ (ছড়ার বই), “মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব প্রস্তুতি ও স্মৃতি ’৭১”সহ আরও কয়েকটি গ্রন্থের আলোচনা ও পাঠ উন্মোচিত হয়েছিল।

মহীয়সী সংগীতশিল্পীর সাথে কোনো কোনো অনুষ্ঠানে পরিচয় হলেও দীর্ঘ আলাপচারিতা ছিলে না। ‘সুন্দরম’ পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার পর সম্মানিত কবি, লেখক, শিল্পীদের সাথে সখ্য গড়ে উঠতে থাকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, গবেষক ড. আবুল আজাদের সাথে ২০১৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় তার বাসগৃহে আমন্ত্রিত হই। সেই সন্ধ্যাটায় পরিচয় হয় সাব-সেক্টর কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা সরিত কুমার লালা’র সাথে, যা অনন্য মর্যাদার সময় বলে মনে করি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলো। বিশেষ করে নজরুলের সংগীত সাধনা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বিষয়াদি নিয়ে আলোচনায় আনন্দবোধ করেছিলাম। খাপছাড়া বিষয়ে কখনো লালন, কবিগুরু প্রসঙ্গ এসে আড্ডাটা পরিপূর্ণ করে দেয়।

২.

২০১৬ সালের এপ্রিলে গঠিত হয়েছে বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ। কমিটির সর্বোচ্চ পরিষদ সভাপতি সংসদ। সংগীতশিল্পী সভাপতি সংসদের সদস্য হিসেবে যুক্ত হলেন। ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি, পরিবাগ সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গীয়’র সংগীত বিভাগের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। সভায় বলা হয়, ‘ভারতীয় সংগীত সমাজ’ (১৮৯৮)-র ঐতিহ্যে বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদের সঙ্গীত বিভাগ পরিচালিত হবে।

সেইসময় তার বক্তব্যে উঠে আসে, বাংলাদেশ সংগীতের দেশ, শুধু এদেশ নয়, পুরো ভারতবর্ষকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংগীতের মহাদেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ বিশ্বকবির ভাবনাকে মৌলিক বিবেচনা করেই অগ্রসর হবে। সেই সভার আলোচনার সারাংশ উত্থাপিত হলো—

১৮৯৮ সালের ২৭ জানুয়ারি ‘ভারতীয় সংগীত সমাজ’-র উদ্বোধন হয়, যার প্রধান কর্মকর্তা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বিশ্বকবি এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা সদস্য ছিলেন। সংগীতচর্চায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বিশেষ ঐতিহ্য সবসময় বিদ্যমান। সংগীতের ক্ষেত্রে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মসমাজের সংগীতের আদর্শে সংগীত চর্চায় এই পরিবার মুখ্য ভূমিকা পালন করে। যুগের ধারায় ঠাকুর পরিবারই ভারতীয় সংগীতচর্চার প্রধান মিলনক্ষেত্র বিবেচনা করা হয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রত্যক্ষ প্রচেষ্টায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংগীতে বাল্যকাল হতে পারঙ্গম হয়ে ওঠেন। বাংলা গানের ইতিহাসে আকারমাত্রিক স্বরলিপির উদ্ভাবক ও সুররচনার পথিকৃত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারই প্রত্যক্ষ শিক্ষা ও প্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা গানের প্রধানতম নির্মাতা হিসেবে বিবেচিত। ভারতীয় সংগীত সমাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্বকবির ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ যুগান্তকারী সৃষ্টিকর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৭ সালের জুলাই মাসে প্রকাশ করেন ‘বীণাবাদিনী’ নামক সংগীত বিষয়ক মাসিক পত্রিকা, যা দুই বছর প্রকাশিত হয়। ভারতীয় সংগীত সমাজ প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর ১৯০১ সালে সংগঠনের মাসিক মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘সংগীত প্রকাশিকা’, যা দশ বছর ধরে প্রকাশনা অব্যাহত থাকে। ভারতীয় সংগীত সমাজই সংগীত সংগ্রহ, স্বরলিপি রক্ষা ও প্রচারে উনিশ শতকের সাংস্কৃতিক জাগরণের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়। সবর্ভারতীয় সংগীত সাধকদের আসর, সংগীত সভা, গীতিনাট্য সহ নাট্যানুষ্ঠান, বহু সংগীতাচার্যের শিক্ষা প্রদান (অন্যতম রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী) ইত্যাদি বহুমুখী কার্যক্রমে বিশেষ অবদান রাখে ভারতীয় সংগীত সমাজ।

ভারতীয় সংগীত সমাজকে ঐতিহ্যের মূল বিবেচনা করে বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদের সঙ্গীত বিভাগের কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

বাংলা গানের আধুনিক কালের যুগদ্রষ্টা হিসেবে পাঁচজনকে বিবেচনা করা হয়, তারা হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন ও কাজী নজরুল ইসলাম। বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদের সংগীত বিভাগ বাংলা গানের যুগ দ্রষ্টাদের সারথি করে অগ্রসর হবে, সেই পথচলায় সংযুক্ত হবে বাংলার লোক সংগীত, যাত্রা, পাঁচালি, কথকতা, কবির গান, পালাগান, বাউল, কীর্তন ইত্যাদি। উচ্চসংগীত ও জনসংগীতের মিলনস্থল হবে বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদের সঙ্গীত বিভাগ।

তখন আমি বিশ্বকবির উদ্ধৃতি তুলে ধরি— ‘আত্মপ্রকাশের জন্যে বাঙালি স্বভাবতই গানকে অত্যন্ত করে চেয়েছে। সেই কারণে সর্বসাধারণে হিন্দুস্তানি সংগীতরীতির একান্ত অনুগত হতে পারেনি। সেজন্যেই কানাড়া আড়ানা মালাকোষ দরবারি তোড়ির বহুমূল্য গীতোপকরণ থাকা সত্ত্বেও বাঙালিকে কীর্তন সৃষ্টি করতে হয়েছে। গানকে ভালোবেসেছে ব’লেই সে গানকে আদর করে আপন হাতে আপন মনের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করতে চেয়েছে। তাই, আজ হোক কাল হোক, বাংলা গান যে উৎকর্ষ লাভ করবে সে তার আপন রাস্তাতেই করবে, আর- কারো পাথর-জমানো বাঁধা রাস্তায় করবে না।’ (শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সংগীতের স্থান)।

এসব আলোচনা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত তার সাথে বর্ণিল স্মৃতি তাড়িত করে।

বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বর্ষপূর্তির নয়দিনব্যাপী উৎসবের ঢাকার সমাপনী দিনে (২১ বৈশাখ ১৪২৪; ৪ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যা ৬ টায়) সংগীত পরিবেশন করেছিলেন ভারতের বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী শ্রেয়া গুহঠাকুরতা ও বাংলাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী বুলবুল মহলানবীশ।

অনুষ্ঠান বুঝতে পারি, বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষীদের ঐক্যের স্থান ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ বিশ্বব্যাপী ‘যেখানে বাংলাভাষী, সেখানেই বঙ্গীয়’ এই আহ্বান নিয়ে কার্যক্রম বিস্তৃত করছে। যার মূল চেতনা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ (১৮৯৪), ভারতীয় সংগীত সমাজ (১৮৯৮), মহান মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) এবং অনুপ্রেরণায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

সেই সময় বুলবুল মহলানবীশ বলেন, শিল্পের সকল শাখায় চর্চা, গবেষণা অব্যাহত রেখে সকল পর্যায়ে সৃজনশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহ প্রদানে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আর্থিকভাবে অসচ্ছল ও অসুস্থ লেখক শিল্পীদের সহায়তাকল্পে একটি সমন্বিত তহবিল গঠন এবং লেখক শিল্পীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ভবন বরাদ্দের আহবান জানান।

জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ে বিশ্বে বসবাসকারী বাংলাভাষীদের নিয়ে বিশ্বজনমত গঠনে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বক্তাগণের অভিমতকে তিনি সমর্থন করেন।

৩.

বিশ্বভারতী বাংলা ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিশ্ববোধের তীর্থস্থান বলে আমি মনে করি। সেই সময়ের স্মৃতিকথা সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরেছিলাম। এই ধারণা প্রবাহে বুলুবল মহলানবীশের প্রজ্ঞা আমার মানস চেতনাকে উদ্ভুদ্ধ করে। বিশ্বভারতী পরিদর্শনের পর মনের ভাব তুলে ধরি—

পূর্ণতার এমন আলো, যা অবাক বিস্ময়ে হৃদয়ের নিবিড় আলোয় কখন যেন মিশে গেছি, ঐ ছাতিমতলার নির্জনে। ধ্যানস্থ শক্তির সাথে কর্মস্পৃহার সংযোগ, যা প্রকৃতির সাথে, উন্মুক্ত আকাশের সাথে মৈত্রীর বন্ধন সৃষ্টি করে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রচলিত ও পাশ্চাত্য শিক্ষা পদ্ধতির বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবয়বে বিশ্বযোগের জন্য বাংলা ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির সর্বাঙ্গীন জীবনযাত্রার মহামিলনক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুললেন শান্তিনিকেতন।

উৎসব আনন্দে বিশ্বভারতী ও শ্রীনিকেতন

শ্রাবণ মাসে হলকর্ষণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসব হয়ে থাকে। সেই উৎসব স্বচক্ষে দেখার অভিপ্রায়ে কবিগুরুর আশ্রমে। ৭ আগস্ট ২০১৭ তারিখে ঢাকা থেকে আমরা রওনা হয়েছি। দলগত নেতৃত্বে সংগীতশিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল মহলানবীশ। কলকাতা এয়ারপোর্টে নামার পর দেখা মিলল কারুভাষ পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশক মানসী কীর্তনীয়ার সঙ্গে। কিছুটা সময় বিরাতিতে এবং তার বাসায় দুপুরের আহার (উপাদেয় খাবারাদি) সেরে হাওড়া স্টেশন। ৪টার ট্রেন ধরে যেতে যেতে সফরসঙ্গীদের উচ্ছ্বল আনন্দ মনে রাখার মতো। আমার পাশে যিনি, ট্রেনেই পরিচয়, নাম উত্তরা শেঠি, সংগীত শিল্পী। তার সন্তান যেন সারাক্ষণ নৃত্য-আনন্দে তাল মিলিয়ে চলছে। শেঠি আমাকে বিভিন্ন স্থানের সাথে পরিচয় করে দিতে থাকল। বিনম্র নির্মলতাকে ঘিরে আছে তার, অচেনা জন কেমন করে জানি অতি পরিচিত হয়ে ওঠে। বাউলরা উঠেছে, নানাভাবে গাইছে, কাছের জনেরা নানা ঝাল মশলা, মিষ্টি খেয়ে-দেখে আনন্দে পৌঁছাল সেই তীর্থস্থানে। কোথা হতে যেন এক উন্মাতাল হাওয়া মনের ভেতর ডাক দিয়ে গেল। কেউ আছে, কেউ বোঝে, তবুও রাত, অপেক্ষায় চিত্রশিল্পী সাদেক, তার কল্যাণে নির্ধারিত স্থানে সবাই রইল। আমি এলাম সাদেক ভাইয়ের স্থানে। কী সুন্দর সেই বাড়ির নাম— ‘আমাদের বাড়ি’। এই বাড়ি নাট্যজন জিন্নাহ’র।

রাত অবধি সাদেক ভাইয়ের বহু কথা শুনলাম, জানলাম সেসব। নিবিড় পল্লী হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা। ভোর বেলায় সূর্য হেলতে দুলতে উঁকি দিয়ে চলছে। ২২ শ্রাবণ, কবিগুরুর মহাপ্রয়াণের দিন, তিরোধানের দিন, অমৃতলোকের সাথে মিলিত হওয়ার দিন।

শুরু হয়েছে ব্রহ্মমন্দিরে প্রার্থনা সংগীত। নিস্তব্ধ প্রান্তর, শোকে বিহ্বল, তবু আনন্দ অমৃতরূপে প্রকাশ। শুরুর হয়েছে গান। ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’ ও পিতাঃ নমঃ সম্ভাবনাং; ব্রজ্র্যে তোমার বাজে বাঁশি, সেকি সহজ গান!/ সেই সুরেতে জাগব আমি, দাও মোরে সেই কান। শান্ত হ রে মম চিত্ত নিরাকুল, শান্ত হ রে ওরে দীন! হেরোইনের চিদম্বরে মঙ্গলে সুন্দরে সর্বচরাচরে লীন। এই মনের আবেশ নিয়ে কবিগুরুর তটে সময় যেন চলে যায়।

পরে কচুরী সব্জির নাস্তা, গরুর দুধের চা, যেন অমৃতেরই আরেক প্রকাশ। তবুও কোথায় যেন হৃদয়ের ডাক শুনতে পাই, বিকেলের আয়োজনে।

এই তটে কলাভবনের সামনে সজ্জিত হয়েছে মঞ্চ, মাঠের একপাশে বৃক্ষরোপণের নির্দিষ্ট স্থান। দূর থেকে সারিবদ্ধভাবে শিশু-কিশোররা নৃত্যের তালে তালে প্রবেশ করে মাঠে। আর বয়ে আনে চারা। প্রকৃতির প্রতি কবিগুরুর যে দৃষ্টি তা যে বিশ্বব্যাপী পালিত হতে পারে। তাই তো কবিগুরু বলেন, ‘মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরণ্য সম্পদকে রক্ষা করা সর্বত্রই সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে।… আমাদের যা সামান্য শক্তি আছে তাই দিয়ে আমাদের প্রতিবেশে মানুষের কল্যাণকারী বনদেবতার বেদী নির্মাণ করব এই পণ আমরা নিয়েছি। আজকের উৎসবের দুটি অঙ্গ। প্রথম, হলকর্ষণ— হলকর্ষণ আমাদের প্রয়োজন অন্নের জন্য, শস্যের জন্য; আমাদের নিজেদের প্রতি কর্তব্যের পালনের জন্য এই হলকর্ষণ। কিন্তু এর দ্বারা বসুন্ধরার যে অনিষ্ট হয় তা নিবারণ করবার জন্য আমরা কিছু ফিরিয়ে দিই যেন। ধরণীর প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য, তার ক্ষতবেদনা নিবারণের জন্য আমাদের বৃক্ষরোপণের এই আয়োজন। কামনা করি, এই অনুষ্ঠানের ফলে চারি দিকে তরুচ্ছায়া বিস্তীর্ণ হোক, ফলে শস্যে এই প্রতিবেশ শোভিত আনন্দিত হোক।’ (অরণ্যদেবতা)

হলকর্ষণের ( ৯ আগস্ট ২০১৭) দিন মাঠের চারপাশে লোক বসেছে, কেউ দাঁড়ানো। সেখানেও নৃত্যগীতে শিশুকিশোরদের মাঠ পরিভ্রমণ। পরে তারা হলকর্ষণের স্থান ঘুরে এসে মাঠে বসে। চাষ করার জন্য নির্ধারিত স্থান পত্রপল্লবে ঢাকা, লাঙল-জোয়ালে গরু প্রস্তুত। এই হলকর্ষণ উৎসবে কৃষকদের পুরস্কার দেওয়া হলো। বৃক্ষ দেওয়া হলো কৃষকদের।

ঘুরেছি, দেখেছি , তবুও অতৃপ্ত বাসনা। সরকারি ছুটি থাকার কারণে সর্বত্র প্রবেশ করা যায়নি। তবু যা পেয়েছি, তা যে অনন্ত পাওয়া।

শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন ও বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার কিছু কথা বলতেই হয়।

বিশ্বকবির পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৩ সালে ভুবনডাঙা গ্রামে রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহের নিকট থেকে বিশ বিঘা জমির মৌরসি পাট্টা গ্রহণ করেন। আধ্যাত্মিক শান্তির সাধনার উদ্দেশ্যে এই জনশূন্য প্রান্তরে মহর্ষি অতিথিশালার ভিত্তি স্থাপন করে, নাম দেন ‘শান্তিনিকেতন’। এই শান্তিনিকেতন আশ্রমে কবিগুরু ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন একটি বিদ্যালয়, যার নাম ব্রহ্মচর্যাশ্রম। বিশ্বভারতী স্থাপিত হয় ১৯১৮ সালে। বিশ্বভারতী বলতে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন উভয়কেই বোঝায়। এপ্রসঙ্গে উমাদাশগুপ্ত তার ‘শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন’ গ্রন্থে বলেন, ‘প্রথমটির রূপ ছিল শুধুই আধ্যাত্মিক; দ্বিতীয়টির লক্ষ্য ছিল ব্রহ্মচর্য আদর্শে বালকদের জীবনযাপন এবং শিক্ষালাভ; শেষটির লক্ষ্য মানবতা ও সাংস্কৃতিক চর্চায় পূর্ব ও পশ্চিমের যুক্ত উদ্যোগ।’

১৯১২ সালে রায়পুরের সুরুল গ্রামে পল্লী সংগঠনের কাজে জঙ্গলে পরিপূর্ণ কুঠিবাড়ি ক্রয় করেন। ১৯২৩ সালে শ্রীনিকেতন নামের ব্যবহার পাওয়া যায়। যে পল্লীসংগঠনের কাজ শুরু করেছিলেন নওগাঁর পতিসরে, তারই পূর্ণতা পায় এই শ্রীনিকেতন। গ্রামে কৃষি শিক্ষা স্বাস্থ্য সমাজকে সামগ্রিক উন্নতির জন্য শ্রীনিকেতনের সৃষ্টি। এই বিশেষ কর্মে ইংল্যান্ড থেকে আসেন লেনার্ড এলমহার্স্ট ( ১৯২১ সালে), তার সাথে শান্তিনিকেতনের ২ জন শিক্ষক ও ১০ জন ছাত্র নিয়ে কাজ শুরু হয়।

কেমন ছিল শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন, কবিগুরুর কিছু উদ্ধৃতি থেকে জানতে পারি—

১. বোধহয় সকলেই জানেন, আজ শান্তিনিকেতনে যে অতি-প্রাচীন যুগল ছাতিম গাছ মালতীলতায় আচ্ছন্ন, এককালে মস্ত মাঠের মধ্যে ঐ দুটি ছাড়া আর গাছ ছিল না। (আশ্রমের রূপ ও বিকাশ)

২. এই শান্ত জনবিরল শাল বাগানে অল্প কয়েকটি ছেলে নিয়ে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সহায়তায় বিদ্যালয়ের কাজ শুরু করেছিলুম। আমার পড়াবার জায়গা ছিল প্রাচীন জামগাছের তলায়। (প্রাগুক্ত)

৩. ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈদিক পৌরাণিক বৌদ্ধ জৈন মুসলমান প্রভৃতি সমস্ত চিত্তকে সম্মিলিত ও চিত্তসম্পদকে সংগৃহীত করিতে হইবে; এই নানা ধারা দিয়া ভারতবর্ষের মন কেমন করিয়া প্রবাহিত হইয়াছে তাহা জানিতে হইবে। এইরূপ উপায়েই ভারতবর্ষ আপনার নানা বিভাগের মধ্য দিয়া সমগ্রতায় উপলব্ধি করিতে পারিবে। (বিশ্বভারতী)

৪. আমি যদি কেবল দুটি-তিনটি গ্রামকেও মুক্তি দিতে পারি অজ্ঞতা অক্ষমতার বন্ধন থেকে, তবে সেখানেই সমগ্র ভারতের একটি ছোটো আদর্শ তৈরি হবে-এই কথা তখন মনে হয়েছিল, এখনো সেই কথা মনে হচ্ছে।

এই কখানা গ্রামকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করতে হবে— সকলে শিক্ষা পাবে, গ্রাম জুড়ে আনন্দের হাওয়া বইবে, গান-বাজনা কীর্তন-পাঠ চলবে, আগের দিন যেমন ছিল। তোমরা কেবল কখানা গ্রামকে এইভাবে তৈরি করে দাও। আমি বলব এই কখানা গ্রামই ভারতবর্ষ। তা হলেই প্রকৃতভাবে ভারতকে পাওয়া যাবে। (শ্রীনিকেতনের ইতিহাস ও আদর্শ)।

কবিগুরুর বিশ্বভারতী এভাবেই ভিন্ন অবয়বে বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির যেমন তীর্থস্থান, ঠিক সেভাবেই শ্রীনিকেতন হয়ে গেল পল্লী উন্নয়নের আদর্শ মডেল। শ্রীনিকেতনে সমবায়, গবেষণা, গ্রামশিল্পের উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সমবায়, শিল্পশিক্ষার আদর্শ স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়। তথ্যে জানা যায়, ১৯২৭ সালে বীরভূমের তিনটি থানায় দুশোটি সমবায় গড়ে ওঠে। কৃষকদের ঋণদানের মধ্য দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলার প্রচলন তখন থেকেই।

বিশ্বভারতীতে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথমে কলাভবন সংগীতভবন, পরে পাঠভবন শিক্ষাভবন বিদ্যাভবন। ১৯২১ সালে কলাভবনে সংগীত ও কলাবিদ্যা, ১৯৩৩ সালে স্বতন্ত্র সংগীত ভবন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৭ সালে চীনভবন, ১৯৩৮ হিন্দিভবন প্রতিষ্ঠিত হয়। বলা যায়, শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন মিলেই বিশ্বভারতীর সামগ্রিক রূপ পাওয়া যায়। কবিগুরু ১৯২২ সালে তার সমস্ত গ্রন্থ বিশ্বভারতীকে স্বত্ব দান করেন, যেন আর্থিক সংগতি লাভ করতে পারে। ১৯২৩ সালে যাত্রা শুরু হয় বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের।

শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠাকালে কবিগুরু তার পুরীর বাংলো বাড়ি বিক্রয় করে দেন এবং মৃণালিনী দেবী তার গণনা দান করেন। কবিগুরু আর্থিক অভাব কাটিয়ে তোলার জন্য বিভিন্ন রাজার অনুদান, প্রতিষ্ঠানের অনুদান নিয়েছেন। মহাত্মা গান্ধী প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে দেন। ১৯৪১ সালের কবিগুরুর মহাপ্রয়াণের পর এক বছরের মধ্যে রবীন্দ্র ভবনের যাত্রা শুরু হয়। অর্থাৎ রবীন্দ্র সংগ্রহশালা। আর কবিগুরু মৃত্যুকালে বিশ্বভারতীর দায়িত্ব দিয়ে যান গান্ধীজির উপর। গান্ধীজি দায়িত্ব পালন করেন। রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজির প্রয়াণের পর ভারত সরকার ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতীকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করলেন।

এই তট বাঙালির, বাংলার তথা বিশ্বের মানুষের। বিশ্বের সকল মানুষের মিলনক্ষেত্র, ‘সার্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চা কেন্দ্র’।

আজ ভাবতে বসেছি, এই পবিত্র স্থানের। কবিগুরুর মহাপ্রয়াণের নিবেদন কর্মসূচি হলকর্ষণ ও বৃক্ষরোপণ। বাংলাদেশে এর প্রচলন হতে পারে, তাহলে প্রকৃতি পরিবেশ জীবন পদ্ধতির উন্নতি হতে পারে। এসব বহু ভাবনার মন্ত্রে আমরা ভাবিত হই, তারপর বলতে ইচ্ছে করে—

বীণা বাজাও হে মম অন্তরে॥

সজনে বিজনে, বন্ধু, সুখে দুঃখে বিপদে—

আনন্দিত তান শুনাও হে মম অন্তরে॥ ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

(১৮ আগস্ট ২০১৭ সালে লেখা, পর্ব-১, শান্তিনিকেতন পর্ব। ভ্রমণের তারিখ : ২২ শ্রাবণ ১৪২৪)

আজও আনন্দিত তান শুনতে পাই।

এইসময় মনে হয়েছিলো, একজন মা যেমন সন্তানকে শিক্ষা দেন, তিনিও ঠিক আমার অন্তরে বীণা বাজিয়ে দিলেন।

৪.

বহু স্মৃতি সুন্দরে তার অভাব বোধ করি। বঙ্গীয়র উদ্যোগে ২০১৯ সালে ৩১ মার্চ, ১ ও ২ এপ্রিল শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বসভা। সেই সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন। বিশ্বে নব সভ্যতা সৃষ্টির জন্য লেখক শিল্পী চিন্তকের সর্ববৃহৎ ঐক্য চাই’ আজও সরব উপলব্ধির বলে বিবেচিত হয়েছে। বলা যায়, সমকালের বিশ্বে দেশে দেশে অমানবিক পরিস্থিতি ভয়ংকর বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। ক্ষমতা-শক্তির লড়াই ও অসম বাণিজ্য বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ শরণার্থী। এই বিপর্যয় থেকে উত্তরণের জন্য মানবিক ভাবনার পরিবর্তন হওয়া জরুরি। সেই পরিবর্তনের জন্য দার্শনিক লেখক চিন্তকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শিল্পীরাই সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে উন্নত সমাজ গঠনে সাহায্য করতে পারে। বঙ্গীয়’র বিশ্বসভা সেই পথের সূচনা করে। বঙ্গীয় তীর্থে তার অবদান বহুবিধ।

রবীন্দ্রসংগীত একাডেমির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বুলবুল মহলানবীশ। আমি দেখেছি, তার কর্ম সাধনা, সৃজনশীলতা। রবীন্দ্র একাডেমির আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমাকে প্রবন্ধ উপস্থাপনের তিনি সুযোগ দিয়েছিলেন। আমিও তার নানা সৃজনশীল প্রয়াসে যুক্ত থেকেছি। তার অনুপ্রেরণায় লিখেছিলাম, ‘বিশ্বকবির সভ্যতার সংকট; সমকালের প্রেক্ষিত’সহ বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ। রবীন্দ্র একাডেমির পত্রিকা রবীন্দ্রলোক সম্পাদনা করতেন।

বঙ্গীয় এবং রবীন্দ্র একাডেমির যৌথসভা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার কনফারেন্স হলে ১১ মার্চ ২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও এসেছিলেন। এটাই আমার জানামতে তার উপস্থিতির সর্বশেষ সভা ছিল। আজও স্মৃতিপটে সেই চিত্র অন্যরকম আবেগাপ্লুত করে দেয়। কবিগুরু ঠিকই বলেছেন— ‘বাঙালি একটি সত্যবস্তু পাইয়াছে, ইহা তাহার সাহিত্য। এই সাহিত্যের প্রতি গভীর মমত্ব স্বতই বাঙালির চিত্তকে অধিকার করিয়াছে। এইরূপ একটি সাধারণ প্রীতির সামগ্রী সমগ্র জাতিকে যেরূপ স্বাভাবিক ঐক্য দেয় এমন আর কিছুই না। স্বদেশে বিদেশে আজ যেখন বাঙালি আছে সেখানেই বাংলা সাহিত্যকে উপলক্ষ করিয়া যে যে সম্মিলন ঘটিতেছে, তাহার মতো অকৃত্রিম আনন্দকর ব্যাপার আর কী আছে।’ (সাহিত্য সম্মিলন, বৈশাখ ১৩৩৩)

বুলবুল মহলানবীশ তার কবিতায় সময়কে নানাভাবে উপলব্ধি করেছেন।

১.

একুশের পদাবলী

আমার চোখের জলে ভিজছিল

ঘাস আর ঘাসফুল

কীট-পতঙ্গ, পিঁপড়ের দল।

বাতাসের হাহাকার ভেঙে ভেঙে

ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসা চিরন্তনী সুর—

থমকে দাঁড়ালো আমার নোয়ানো চোখে।

চোখ তুলে তাকাতেই আকাশের ছাদ ছুঁয়ে

শ্বেতশুভ্র মায়ের প্রতিচ্ছবি।

বুকে তার আগলে রেখে সন্তানের ক্লেশ—

বুলেট-কামানে পোড়া ঝাঁঝরা শরীর

জেগে ওঠে বারবার।

সব আয়োজন শেষ হলে

অন্ধকার রাতে

একলা দাঁড়াই যখন বেদীর তলায়—

আমার চারপাশে অনাহত সুর ভাসে

শাদা-কালো-বাদামি মানুষেরা

সমস্বরে গায়— একুশের পদাবলী।

২.

একুশ ও উনিশ

চারপাশে বিষাক্ত কিলবিলে কীট

ঘুটঘুটে অন্ধকার—

হোঁচট খেতে খেতে রক্তাক্ত পা

তবুও আলোর প্রচণ্ড তৃষ্ণায়—

আমি নিরন্তর বেঁচে থাকি।

দেয়ালের ফাটল ফুঁড়ে ওঠা—

আমি বনসাই বট;

একদিন বোধিবৃক্ষ হবো বলে

সহস্র বছর বেঁচে থাকি।

উদ্বাস্তু শিবিরে জন্ম নেয়া যে শিশু

হাড্ডিসার দুগ্ধহীন স্তন চুষে চুষে

ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ক্লান্ত শিথিল—

তাকে জন্মভূমির অধিকার ফিরিয়ে দিতে

আমি যুগ যুগ বেঁচে থাকি।

আমি এক বিকলাঙ্গ শিশু

হামাগুড়ি দিয়ে চলতে চলতে

কোনো একদিন—

রফিক-শফিক-জব্বার-বরকত কিংবা

সালাম হবো বলে, একজন কমলা ভট্টাচার্য হবো বলে—

বুকের তাজা রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকি।

আরেকটি নতুন একুশ হবো বলে

আরো একটি নতুন উনিশ হবো বলে

শহীদ মিনারের মতো মাথা উঁচু করে

অনন্তকাল বেঁচে থাকি।

তিনি অনন্তকালের অভিযাত্রী হয়েছেন। তবুও তার স্মৃতি মনের অন্দরে মঙ্গলের বার্তা দিয়ে যায়। স্মৃতি তর্পণে তা খণ্ডিত অংশ মাত্র প্রকাশ পায়। বৃহৎ যা, তা অন্তর্লোকে মহিমা দেয়, দীপ্যমান করে রাখে।

পরিশেষে তার ফেসবুকে থেকে নেওয়া স্মৃতি কথা তুলে ধরছি—

“১৯৬৫তে পাক-ভারত যুদ্ধের পর, পাক সরকার রেডিও-টেলিভিশন ও মঞ্চে রবীন্দ্র সংগীত ও রবীন্দ্রনাথবিষয়ক সবকিছুই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই ঘোষণার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসচেতন মানুষ প্রতিবাদ করে এবং সরকারি নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্রচর্চা অব্যাহত রাখে।

ছবিটি ১৯৬৭ সালে জগন্নাথ কলেজে অনুষ্ঠিত বসন্ত উৎসবের। সুখেন্দু চক্রবর্তীর সংগীত পরিচালনায় অনুষ্ঠান হয়েছিল জগন্নাথ কলেজের বিশাল মাঠে। কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সাথে অতিথি শিল্পী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সেই সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী জাহেদুর রহিম, ফ্লোরা আহমেদ ও এই অভাজন বুলবুল মহলানবীশ। আমি তখন নবম শ্রেণির মাঝামাঝি সময়ে। অনুষ্ঠানের শতকরা নব্বই ভাগ গান ও কবিতাই ছিল রবীন্দ্রনাথের রচনা।

বাবু ভাই (জাহেদুর রহিম) ঠিক করে দিয়েছিলেন আমার একক গান। গান দুটি ছিল ‘বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা এবং ‘আসে বসন্ত ফুলবনে’। প্রথমটি রবীন্দ্রসংগীত আর দ্বিতীয়টি নজরুলগীতি (তখন তা-ই বলত)। ফ্লোরা গেয়েছিল দুটো রবীন্দ্রসংগীত— ‘আমার মল্লিকা বনে…’ এবং ‘রোদনভরা এ বসন্ত ‘। প্রায় দশ হাজার দর্শক সেই অনুষ্ঠান উপভোগ করেছিল। পরে খোকাকাকুর কাছ থেকে শুনেছিলাম এই অনুষ্ঠানটি করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই তখনকার অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানকে অনুরোধ করেছিলেন। সাইদুর রহমান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক। আমার সৌভাগ্য যে সেই অনুষ্ঠানে আমি অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম।” (২৫ আগস্ট ২০২০)

বুলবুল মহলানবীশ বাংলাদেশের গৌরবের অধ্যায়ের সাথে মহৎস্বরূপে বিরাজ করছেন। সত্য সাধন কর্মে তার মহিমায় সকলে অনুপ্রাণিত হবেন।

কামরুল ইসলাম : সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ

 

+ posts

Read Previous

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৫ম সংখ্যা

Read Next

মেঘ পাহাড়ের ডাকে

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *