অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ১৫, ২০২৪
১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ১৫, ২০২৪
১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৈয়দ হাসমত জালাল -
সমরেশ মজুমদার : মানুষের স্বপ্ন ও সংগ্রামের কথাই তাঁকে করেছিল জনপ্রিয়

১৯৭৬ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দৌড়’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে সমরেশ মজুমদার নিজের একটি আসন করে নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যে। বই হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার আগে এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকায়। পরে ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’ ট্রিলজি তাঁকে প্রবল জনপ্রিয় করে তোলে। সমরেশ মজুমদার ছিলেন উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার মানুষ। তাঁর অধিকাংশ লেখায় জল, হাওয়া, গাছপালা ও মাটির গন্ধ নিয়ে উঠে এসেছে উত্তরবঙ্গ। তাঁর গল্পে-উপন্যাসে বারবার উঠে এসেছে প্রেম, হতাশা, রাজনৈতিক চেতনা এবং আধুনিক নগরজীবনের গোপন আলো-ছায়া ও ঘাত-প্রতিঘাতের কথা।

তিন প্রজন্মের কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে তাঁর ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’ উপন্যাস তিনটি৷। কিন্তু অনিমেষ চরিত্রটিই রয়েছে তার গভীর সংযোগসূত্র হয়ে৷ অনিমেষের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার জটিল আবর্ত, রাজনীতি, মাধবীলতার সঙ্গে প্রেম, বিবাহ ও পরবর্তী সময়ে তাদের পুত্র অর্ককে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের প্রবহমান রাজনীতির গতি-প্রকৃতি। একই সঙ্গে এসেছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি ও তার পরিবর্তনের চিত্রাবলি। সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলনকে লেখক এখানে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনিমেষ ও মাধবীলতার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে তুলে ধরেছেন।

সমরেশ মজুমদারের জন্ম ১৯৪৪ সালে জলপাইগুড়ি জেলার গয়েরকাটা চা-বাগানে। সেখানে কঠোর অনুশাসন ও নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে মানুষ হয়েছিলেন তাঁর ঠাকুরদার কাছে। পেশায় চা-বাগানের ম্যানেজার এই ঠাকুরদার প্রভাব ছিল তাঁর জীবনে সবচেয়ে বেশি। জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ার বাড়িতে কেটেছে তাঁর বাল্য, কৈশোর ও যৌবন শুরুর দিনগুলো। স্থানীয় বালকদের সঙ্গে খেলাধুলো করে কেটেছিল তাঁর শৈশব। সেখানকার আংরাভাসা নদীর কথা বারবার এসেছে তাঁর উপন্যাসে। চা-বাগানে থাকার সময় বাহে ও রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গেও তৈরি হয়েছিল তাঁর বন্ধুত্ব। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, তাঁর লেখার মূল বিষয় হয়ে ওঠে মানুষ, বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ।
‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসে তাঁর এই শান্ত চা-বাগানের জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখা গিয়েছে। স্বর্গছেঁড়া চা বাগানের নিরিবিলি পরিবেশ, অন্যদিকে খুঁটিমারির জঙ্গল, আংরাভাসা নদী, ভুটানের পাহাড় থেকে ভেসে আসা বিষণ্ন মেঘের দল, ওপাশে মাঠ পেরিয়ে আসাম রোড, মদেশিয়া কুলিদের লাইন এসবের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মূল চরিত্র অনিমেষের শৈশব। এই শৈশব থেকে অনিমেষের যৌবনে পা দেওয়ার কাহিনী ‘উত্তরাধিকার’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশপ্রেমের চেতনা থেকে ধীরে ধীরে রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে গড়ে ওঠা ধারণার মধ্যে দিয়ে বড় হয়ে ওঠে অনিমেষ। চা-বাগান থেকে জলপাইগুড়ি শহরের জীবন, তারপর কলকাতায় চলে আসতে হয় অনিমেষকে। কিন্তু কলকাতা শহরে পা রাখার মুহূর্তে এক নির্মম অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয় তাকে। একটি রাজনৈতিক মিছিলে চালানো পুলিশের গুলি এসে লাগে তার ঊরুতে। রাজনীতির এক ভিন্ন চেহারা দেখতে পায় সদ্য-যুবক অনিমেষ।

ব্যক্তিগত জীবনে সমরেশ মজুমদার কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় সাম্মানিক নিয়ে বিএ পাস করেন এবং পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এসময় আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তাঁকে বিভিন্ন মেসে থাকতে হয়েছে। থেকেছেন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলেও। তাঁর এই মেস-জীবনের অভিজ্ঞতার ছবি দেখা যায় তাঁর ‘কালবেলা’ উপন্যাসে। ১৯৬৭ সালে আয়কর দপ্তরের চাকরিতে যোগ দেন তিনি। সেসময়ও উত্তর-কলকাতার একটি মেসে ভাড়া থাকতেন তিনি।

‘কালবেলা’ উপন্যাসে অনিমেষ ছাত্র-রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে ঢুকে পড়ে রাজনীতির জটিল আবর্তে। দেশের আপামর সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকে সে যুক্ত হয় বিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে। কিন্তু এক তীব্র মানবিক মূল্যবোধ তাকে টেনে নিয়ে গেল উগ্র রাজনীতিতে। সত্তর দশকের সেই রাজনীতির আগুনে ঝাঁপ দিয়ে নিজেকে সে দগ্ধ করে একদিন বুঝতে পারল, দাহ্যবস্তুর কোনো সৃষ্টিশীল ক্ষমতা নেই। পুলিশের নির্মম অত্যাচারে সে যখন বিকলাঙ্গ, তখন ওই বিপ্লবের অংশীদাররা অনেকেই হয় নিঃশেষিত, আর নয়তো আপস করে নিজেদের জীবন গুছিয়ে নিয়েছে। অনিমেষের জীবনে আসে মাধবীলতা। মাধবীলতা কোনো রাজনীতি না করলেও, শুধু অনিমেষকে ভালোবেসে নিজেকে পোড়ায় আগামীদিনকে সুন্দর করতে। একদিন দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে যে বিপ্লবে জড়িয়েছিল অনিমেষ, তার হতাশায় ডুবে যেতে যেতে অনিমেষ আাবিষ্কার করেছিল বিপ্লবের আর এক নাম মাধবীলতা। এই ‘কালবেলা’ উপন্যাসের জন্য ১৯৮৪ সালে তিনি পেয়েছিলেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার।
সমরেশ মজুমদার ছাত্রাবস্থায় নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিজের দলের জন্য নাটক লিখতে গিয়েই তাঁর গল্প লেখার সূত্রপাত। গল্পটি তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ‘দেশ’ পত্রিকায়। কিন্তু সেটি প্রকাশিত না হয়ে তাঁর কাছে ফেরত আসায় তিনি ফোন করে তখনকার বিভাগীয় সম্পাদক কথাসাহিত্যিক বিমল করকে যথেষ্ট কড়া ভাষায় কিছু কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কিছু মনে না করে বিমল কর জানিয়েছিলেন, গল্পটি মনোনীত হয়েছে, কিন্তু অফিসের পিয়নের ভুলে সেটি লেখকের কাছে ফেরত চলে গিয়েছে। তারপরই গল্পটি ছাপা হয় ‘দেশ’ পত্রিকায়। সেটা ১৯৬৭ সাল। পরে ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের আমন্ত্রণে লেখেন ‘দৌড়’ উপন্যাসটি। এই উপন্যাসের জন্য তিনি পেয়েছিলেন আনন্দ পুরস্কার। এভাবেই এগোতে থাকে তাঁর সাহিত্যের পথচলা।
তাঁর বিখ্যাত ওই ট্রিলজির চতুর্থ পর্ব ‘মৌষলকাল’ প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় পরে সমরেশ মজুমদার লিখেছিলেন অনিমেষ, মাধবীলতা ও তাদের পুত্র অর্কর নতুন কাহিনী ‘মৌষলকাল’। পশ্চিমবঙ্গের এক উত্তাল সময়ের পটভূমিতে এই উপন্যাস। রাজনৈতিক পালা বদলের সেই ইতিহাসের নানান বাঁকে উপস্থিত মাঝবয়সী অর্ক। উঠে আসে প্রতিবাদের এক মুক্ত স্বর। মৌষল পর্বের পারস্পারিক অবিশ্বাসের দিনকালেও প্রৌঢ় অনিমেষ আর মাধবীলতা আরও একবার ঝলসে ওঠে। অনিমেষের মনে বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাস আর মাধবীলতার গভীর বিশ্বাস জীবনের প্রতি।

সমরেশ মজুমদারের ‘গর্ভধারিণী’ আরও একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। এক দুঃসাহসী ও অভিনব বিষয়বস্তু, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে নতুন পরীক্ষার ফলশ্রুতি এই উপন্যাস। অসম অর্থনৈতিক কাঠামোয় বড় হয়ে ওঠা চার বন্ধু, তিনজন পুরুষ ও একজন নারী, একসময়ে উপলব্ধি করল এক অদ্ভুত অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের মধ্যে নেমে এসেছে এই দেশ। কারও যেন নিজস্ব কোনো দায় নেই। দেশের ভালোমন্দের সব দায়-দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়ে অধিকাংশ মানুষ থাকতে চাইছে ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে। এই সুবিধাবাদিতার বিপ্রতীপে দাঁড়াতে চেয়েছে ওই চারজন যুবক-যুবতী। ফলস্বরূপ তাদের আত্মগোপন করতে হয়েছে নগরসভ্যতার থেকে দূরে হিমালয়ের কোণে এক নিস্তরঙ্গ গ্রামে। এরপর দেখা যায় সেই নারীর বিচিত্ৰ আত্মত্যাগ ও সাধনার সংকল্প। এ তাদের বিপ্লবের কোনো উপাখ্যান নয়, এই উপন্যাস তাদের উপলব্ধির, বিশ্বাসের, স্বপ্ন, সাধনা ও সংগ্রামের কাহিনী।

সমরেশ মজুমদারের সাহিত্যে নারী চরিত্রেরাও বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে৷ ‘কালবেলা’র মাধবীলতা, ‘গর্ভধারিণী’র জয়িতা কিংবা ‘সাতকাহন’-এর দীপাকে দেখলে এর তাৎপর্য বোঝা যায়৷ সত্তর দশকের প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও অবিচল প্রেমিকা থেকে স্ত্রী এবং পরে মা হিসেবে মাধবীলতার দৃঢ়তা, ত্যাগ ও সংগ্রাম তাকে এক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, আদর্শ নারী করে তুলেছে। আবার ‘গর্ভধারিণী’ উপন্যাসে নিজের আদর্শের কারণে প্রকৃত অর্থেই গর্ভাধারিণী হয়ে উঠেছিল যে জয়িতা, সেও বিশিষ্ট হয়ে ওঠে তার চরিত্রের দৃঢ়তায়, বিশ্বাসে ও সংগ্রামের সংকল্পে। ‘সাতকাহন’-এর দীপাকেও ভোলা সম্ভব হয় না তার দৃঢ় চরিত্র ও আদর্শে অবিচল থাকার কারণে৷ বাল্যবিবাহের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা কাটিয়ে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে চেয়ে কোনো বাধা-বিপত্তির কাছে নতিস্বীকার করেনি সে। এই মাধবীলতা, জয়িতা, দীপা কোনো ভিন্ন গ্রহের মানুষ নয়। এরা এই সমাজেরই ফসল। আর পাঁচজন নারীর মতো হয়েও তারা বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে নিজেদের মর্যাদাবোধে, বিশ্বাসে ও আপসহীনতায়।

সমরেশ মজুমদার ছোটগল্প ও নাটক রচনাতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। শিশু-কিশোরদের জন্যও লিখেছেন বহু অ্যাডভেঞ্চার জাতীয় গল্প। তাঁর গোয়েন্দা-গল্পের নায়ক ‘অর্জুন’ ছিল উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা। তবে বিভিন্ন রহস্যের অনুসন্ধানে তাকে কলকাতাতেও আসতে হতো।

আসলে তাঁর জীবন থেকে কখনোই উত্তরবঙ্গ দূরে সরে যায়নি। তাই তিস্তা, তোর্সা, করলা, আংরাভাসা নদী কিংবা জলদাপাড়া, বীরপাড়া, মালবাজার, গরুমারা ইত্যাদি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পাহাড়, নদী, অরণ্য, নদী, জঙ্গল, চা-বাগান, তাদের সমস্ত সৌন্দর্য, রহস্য ও আবেগ উঠে এসেছে বারবার তাঁর লেখার মধ্যে।

সমরেশ মজুমদারকে জনপ্রিয় ধারার লেখক বলে মনে করা হলেও তাঁর ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘গর্ভধারিণী’ বাংলা সাহিত্যে থেকে যাবে। নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা অনিমেষ-মাধবীলতার প্রেম থেকে যাবে বাঙালি পাঠকের মনে।

 

Read Previous

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৫ম সংখ্যা

Read Next

মেঘ পাহাড়ের ডাকে