আমি নামের আগে কখনও ‘ডক্টর’ লিখি না। কেননা ‘ডক্টর’ আমার নাম নয়। নামের কোনো অংশও নয়। কিন্তু কয়েকটি ক্ষেত্রে কিছু প্রতিষ্ঠান আমার নামের আগে এটা বসিয়ে দেয়। তখন নিজেকে খুব লজ্জিত এবং ভণ্ড বলে মনে হয়। কারণ ‘ডক্টর’ লেখাতে উদ্ধত অথবা অহংকারের প্রকাশ বলে মনে করি।ডক্টর ডিগ্রি সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে কোনো মাপকাঠিই নয়। বহু সাহিত্যিক আছেন যাঁদের কোনো ডিগ্রিই নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ডিগ্রি বা যোগ্যতা লাভ করার পর চাকুরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা হয়, যা আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে। তারপর পছন্দের বিষয় কবিতা নিয়ে গবেষণাপত্র রচনা করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-পদ্ধতি মেনে জমা দিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রাপ্তিও। এটাও চাকুরি পরবর্তী জীবনে কিছুটা অর্থনৈতিক উৎকর্ষতা এনে দিয়েছে।
কিন্তু তাই বলে এই নয় যে, একাডেমিক কোনো ব্যাপার বহির্ভূত ক্ষেত্রেও সর্বত্রই নামের আগে তা লিখে জানাতে হবে। যখন দেখি আমার নামের আগে এটা লিখে দিয়ে কোনো সম্পাদক আমার কোনো সৃষ্টিকর্ম প্রকাশ করেছেন, তখন মানসিকভাবে আমি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। এটা লেখা যেমন বাহুল্য, তেমনি পীড়াদায়কও। বহু অযোগ্য ব্যক্তি এই ‘ডক্টরেট’ লেবেলটি লাগিয়ে নিয়ে বাজারে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করেন। যদি কোনো স্রষ্টার সৃষ্টিকর্ম মানুষের মনের দরজা খুলতে পারে, উপলব্ধির কাছে আবেদন রাখতে পারে, তাহলে কি এটি লেখার প্রয়োজন হয়? এটি একটি বাড়তি প্রটেকশন অথবা নিজেকে ইম্পরট্যান্ট করে তোলার পন্থা হতে পারে। সুতরাং এটি ব্যবহারের মধ্যে একটা ভণ্ডামির কৌশল অথবা আত্মগর্বী প্রচ্ছায়ার স্বপ্ন বিরাজ করে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত এক দুর্বলতারই লক্ষণ। সুতরাং সর্বতোভাবে এটি লেখার ঘোরবিরোধী আমি। শুধু নামটুকুই যথেষ্ট। কারণ আমি কে এবং আমি কী তা পাঠক মাত্রই জানেন।
দীর্ঘদিন সাহিত্য নিয়ে পথ হাঁটা শুরু হলেও এখনও কলকাতার কলেজ স্ট্রিটই ঠিকমতো আমি চিনি না। কোনো পত্রিকা দপ্তরও যাইনি। একমাত্র ‘দৌড়’ পত্রিকা দপ্তরেই প্রথম যাওয়া নব্বই দশক থেকে। ‘দৌড়’ পত্রিকাতেই প্রথম লেখা প্রকাশ এবং সেই সূত্রেই কলকাতায় আগমন। তার আগে অবশ্য ছাত্রজীবনে ‘মিছিলের লোক’ হিসেবে এক্সপ্ল্যানেড ময়দানে বহুবার আগমন ঘটেছে।
রাস্তার ধুলো মেখে ট্রেনে চেপে ঝুলে ঝুলে ২২০ কিমি পথ পরিক্রমা করেছি। তখনও কবিতা ছিল হৃদয়ে, কিন্তু প্রকাশ ছিল না। ধীরে ধীরে তা মুকুলিত হচ্ছিল। পরবর্তী জীবনে সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই বহু কবিতা রচিত হয়েছে। সাহিত্যের বহু শাখায় বহুরূপে তা প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতার এবং বাংলাদেশের বহু পত্র-পত্রিকায় সেইসব সৃষ্টিকর্ম প্রকাশের সুযোগও ঘটেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো নামকরা সাহিত্যিকের সঙ্গে সেইভাবে পরিচয় হয়নি। কারো কাছাকাছি গিয়ে একটা ফটোও তুলতে পারিনি। নিজের আড়ষ্টতা কাটিয়ে একটা কাব্যগ্রন্থ অথবা একটা গদ্যের বই নিয়ে গিয়ে বলতে পারিনি ‘আমার এই বইটা পড়ে একটু মতামত দেবেন’।
দুজন বিখ্যাত সাহিত্যিক চিঠি দিয়ে তাঁদের সঙ্গে একবার দেখা করতে বলেছিলেন। আমার সেই সৌভাগ্যও হয়নি ২২০ কিমি পথ অতিক্রম করে কলকাতায় এসে তাঁদের সঙ্গে দেখা করার। নিজের প্রয়োজনে যখন এসেছি বিনা ডাকেই, তখন আর দেখা পাইনি। তবে কলেজ স্ট্রিট না চিনলেও, কেউ যখন কলেজ স্ট্রিট থেকে আমার বই কিনে ফোন অথবা চিঠিতে জানায়, তখন ভালোই লাগে। খুশি হয়ে কলেজ স্ট্রিটকে কল্পনার চোখ দিয়ে দেখে নিই। শুধু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার ছাত্রাবস্থায়-ই একবার করে সাক্ষাৎ ঘটেছিল। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় দীর্ঘ আলোচনায় বলেছিলেন: “কবিতা লিখে কখনও যশের কাঙাল হইও না। যশের লোভ সৃষ্টি হলে তোমার সাধনায় ব্যাঘাত ঘটবে।” কথাটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করি।
কবিতা এক জীবনরসায়ন। জীবনের ভাঙন, অভিমান, শূন্যতা, একাকিত্ব, ক্ষরণ- সব নিয়েই এই আত্মরসায়নের সৃষ্টি। এই আত্মরসায়নের সম্পূরক শব্দবন্ধে রচিত হয় কবিতা। সৃষ্টির প্রবল আসক্তি কবিতা লেখাতে সাহায্য করলেও প্রাপ্তির প্রগাঢ় উদাসীনতা সুখ-ঐশ্বর্য, যশ-খ্যাতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। স্বাভাবিকভাবেই এক বৈরাগ্যযাপনের তাৎপর্য অনুধাবন করেই সৃষ্টির এই পথটিকে সমৃদ্ধ করতে হয়। তা-না হলে আমি কীসের সাধক? কীসের কবি? কীসের স্রষ্টা? নির্মোহ প্রজ্ঞা থেকেই এই বৈরাগ্যযাপনের সূত্রপাত। তাই কবিতাচর্চা করে কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আজও করি না। বড়ো কবির সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা যে নেই তা নয়, কিন্তু সাক্ষাৎ করা-ই যে আমার মূল উদ্দেশ্য সেটাও নয়। দৈবাৎ সাক্ষাৎ হলে হতে পারে। কাছেও যেতে পারি। সম্মান- শ্রদ্ধাও জানাই। কিন্তু নিজে বিখ্যাত হওয়ার জন্য ফটো তুলে প্রচার করা বাহুল্য মনে করি।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে আমরা সকলেই তাঁর সম্মুখে জিজ্ঞেস করেছিলাম- ‘সোনার মাছি’ খুন করার তাৎপর্য কী?’
‘সোনার মাছি’ কথাটি পেয়েছিলাম তাঁর কবিতা থেকেই-
“সোনার মাছি খুন করেছি ভর দুপুরবেলা”
কবি উত্তরে জানিয়েছিলেন- ‘বিবাহপূর্ব জীবনে কবিপত্নী মীনাক্ষী দেবী ছিলেন সোনার মাছি। বিবাহ পরবর্তী জীবনে সেই সোনার মাছিই খুন হলেন। যে রোমান্স, যে প্রেমের মাধুর্য ছিল— বিবাহে তা সীমাবদ্ধ হলো। নষ্ট হয়ে গেলো হৃদয়ের আকুতি ও টান। প্রেমের মৃত্যুই সোনার মাছির খুন হওয়া’। তারপর কবি হলেন ‘অস্ত্রের গৌরবহীন একা’। সেই দিনই বুঝেছিলাম, অধরা প্রেমই কবিতা লেখাতে পারে। প্রেমের সার্থকতা বিবাহে নয়, বিরহে এবং বিচ্ছেদে। রোমান্সের এবং প্রেমের আকুতি চিরন্তন হতে পারে যদি সেই প্রেমে দূরত্ব থাকে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমাদের ছাত্রজীবনে সেই শিক্ষা দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি লেখায় পড়েছিলাম- “বিচ্ছেদের দুঃখে প্রেমের বেগ বাড়িয়া ওঠে”।
পরবর্তী জীবনে এ-সবই পাথেয় হয়ে উঠেছিল। আরও পড়েছিলাম-
“I fell in love with her when we were together, then fell deeper in love with her in the years we were apart.”
(Nicholas Sparks, Dear John)
অর্থাৎ যখন আমরা একসাথে ছিলাম তখন আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম, তারপরে আমরা যে বছরগুলিতে বিচ্ছিন্ন ছিলাম, তার প্রেমে আরও গভীর হয়েছিলাম।
আমেরিকান ঔপন্যাসিক, চিত্রনাট্যকার এবং সমাজসেবী, যিনি ২২টি উপন্যাস এবং ২টি নন-ফিকশন বই প্রকাশ করেছেন, যাঁর সবকটিই নিউইয়র্ক টাইমসের সেরা বিক্রি হওয়া বই। বিশ্বব্যাপী ১১০ মিলিয়নেরও বেশি অনুলিপি ৫০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সেই নিকোলাস স্পার্কসের উপলব্ধিতে সেই কথারই প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছিলাম।
কবিতা লিখতে আসা তখন একজন তরুণের পক্ষে এই অভিজ্ঞতাই কি কম অভিজ্ঞতা? প্রেম-বিচ্ছেদের কষ্টগুলি তখন কবিতা লিখতে শেখাচ্ছে, নিজের কবিতা বারবার নিজেরই পছন্দ হচ্ছে না, ভেতর থেকে আবার নতুন করে লেখার পরামর্শ আসছে। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের আর এক ভাই সত্যসাধন চট্টোপাধ্যায়, যাঁকে আমরা ‘জেঠু’ বলে সম্বোধন করি। তিনিও ইংরেজির অধ্যাপক আমাদের কাছাকাছি থাকেন, আমাদের ভালোবাসেন। নিত্যনতুন ইংরেজি কাব্যসাহিত্যের বিভিন্ন দিকগুলি আলোচনা করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর কাছেই সময় কেটে যায়। সাহিত্যের বাঁকগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভালো লেগে যায় টি এস এলিয়টকে। জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তাঁকেও আত্মস্থ করতে থাকি।
‘জেঠু’ কবিতা লিখলেও এবং সাংসারিক মানুষ হলেও সর্বদা নিজেকে আত্মগোপন করে রাখতেন। সংসারেই তিনি ছিলেন সন্ন্যাসী। তথাকথিত যশ-খ্যাতির ঊর্ধ্বে এক নির্বাসিত জীবন তাঁর। আমাদের খুব পছন্দের ছিল। আমরাও তাঁর মতো নির্বাক নিস্তব্ধ হতে শিখেছিলাম। মনে হতো, কবিতা লিখলেই তা সর্বদা সকলকে জানানোর দরকার কী! লেখা হোক, লেখা কারেকশন্ হোক, পাঠ হোক, আলোচনা হোক, আবার তা নতুন করে লেখা হোক। অবেলায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে কোনোদিন সন্ধ্যা হয়ে যেতো। তখন জোরে সাইকেলের বেল বাজাতাম। কবিতাকে নতুন করে আবিষ্কারের আনন্দ হতো। সেই আনন্দ তবু ওই সাইকেলের বেল বাজানো অবধিই সীমাবদ্ধ থাকতো।
কবিতা লিখে একবার চরম আনন্দের মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছিল আর পরক্ষণেই সেই আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়েছিল। ২০০২ সালে ‘দেশ’ পত্রিকা প্রথম কবিতা প্রকাশ করেছিল। তখন আমার টিউশনিই জীবিকা। দুজন ছাত্রীকে এক রেল-কোয়াটারে সকালবেলা পড়াচ্ছিলাম। সকালবেলা এক কাগজওয়ালা খবর দিলো, ‘এই সংখ্যা ‘দেশ’ পত্রিকায় তোমার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।’ পড়িমড়ি করে রেল-কোয়াটার থেকে বেরিয়ে পুরোনো সাইকেলে চেপে ছুটছি। আসার সময় উঠোনের তারে শুকোতে দেওয়া একটা ব্লাউজের হুঁক আমার পরে থাকা সোয়েটারে আটকে যায়। পেছনদিকে আটকে যাবার ফলে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। যত জোরে সাইকেল চালাই, ব্লাউজটি পতাকার মতো আমার পিঠে ততো উড়তে থাকে। রাস্তার সব লোক হাঁ করে তাকিয়ে দ্যাখে। এরকম করে ব্লাউজ উড়িয়ে কোনো পাগলও সাইকেল চালায় না। হঠাৎ হুঁশ ফেরে রাস্তার একজনের বকুনিতে। নিমেষের মধ্যে মুখটা চুপসে যায়। ছাত্রীর মায়ের ব্লাউজটি ফেরত দেওয়ার কঠিন মুহূর্তটি ভাবতে থাকি। সেদিন কীভাবে পরিত্রাণ পেয়েছিলাম তা উপলব্ধি করে আজও শিউরে উঠি। সে কথা না বলাই ভালো। তবে একটি শিক্ষা হয়েছিল, কবিতা প্রকাশের পর অধিক আনন্দ ওভাবে না প্রকাশ করাই ভালো।
একজন কবি যখন নামের আগে ‘ডক্টর’ লিখে কবিতা লেখেন (একাডেমিক কোনো ব্যাপার ছাড়া), তখন সেই কবির প্রতি কেনো জানিনা, আমার শ্রদ্ধাবোধ জেগে ওঠে না। নামের আগে ডিগ্রির কী প্রয়োজন ছিল এটাই ভাবি। আজও যখন কেউ আমার বিবৃতি তুলে বা কোনো বইয়ের ভূমিকা লিখে দিলে ‘ডক্টর’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তখন নিজেকে একজন অপরাধী ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না। উক্ত ডিগ্রিটি থাকার ফলে আমার বেতন কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে বটে, তাছাড়া অন্য কিছুই লাভ হয়নি। ডিগ্রির দ্বারা সামাজিক মর্যাদা কখনোই বৃদ্ধি পায় না। লেখার ক্ষমতা না থাকলে, ডিগ্রি কখনও লেখাতে পারে না। ডিগ্রি-ওয়ালা লোক চাকরি-বাকরি না পেলে কোনো মেয়ের পিতাও তার সঙ্গে বিয়ে দিতে চান না। সুতরাং ডিগ্রির কোনো সামাজিক মূল্য আছে একথাও আমি মানি না।
আজও বহু পত্রপত্রিকায় লিখি, কলকাতার এবং অন্যান্য রাজ্যের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমাকে পুরস্কারও দিয়েছে। পুরস্কার আনতে যাওয়াও এক বিড়ম্বনার ব্যাপার। একে তো পথের দূরত্ব, তারপর তাঁদের নামকরা প্রতিষ্ঠান হলেও আমি রাস্তাঘাট চিনি না বলে আমার পক্ষে একা যাবারও সাধ্য হয়নি। বহু প্রতিষ্ঠানকে আমি এ-কথা জানিয়ে পুরস্কার নেওয়ার অসম্মতিও জানিয়েছি। তবু কয়েকটি জায়গায় আমাকে সঙ্গী নিয়ে উপস্থিত হতে হয়েছে। অবশ্য পুরস্কারের মূল্য কোথাও ১০ হাজারের বেশি ছাড়িয়ে যায়নি। যেসব পত্রপত্রিকা লেখা ছাপে তাঁরা ডাকযোগেই লেখা নেয়। ডাকযোগেই বই পাঠায়। আমার এমন কোনো আত্মীয় নেই কিংবা এমন কোনো আপনজন নেই যাঁরা কোনো বড় চাকুরি করেন অথবা বড়ো পদে আসীন। আমি ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার।
পিতা সামান্য লেখাপড়া জানতেন (ষষ্ঠ শ্রেণি)। মাতা একেবারে নিরক্ষর। তবু কীভাবে চাঁদ দেখতে শিখেছিলাম জানি না। ঢেঁকি পেতে ধান ভানার সুর আর খেজুর পাতার তালাই বোনার শিল্পে আমি উজ্জীবিত হয়েছি। ছেঁড়া কাপড় জোড়া দিয়ে দিয়ে কাঁথা সেলাই করার মাধুর্য আমাকে প্রসন্ন করেছে। লণ্ঠন জ্বেলে আবছা অন্ধকারে আমার পাঠ শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে শব্দ-অক্ষরগুলি রহস্যময় মাছের মতো লুকোচুরি খেলেছে। এই ফাঁকে ফাঁকে জেগে উঠেছে কল্পনা। সামান্য জীবনকে অসামান্য নিসর্গ সীমানায় মুক্তির আলো অন্বেষণে ব্যস্ত রেখেছি। সামাজিক আভিজাত্য নেই, জীবনযাপনেও কখনও বিলাসিতার ছায়াপাত ঘটেনি। বিত্ত-সম্পদের প্রাচুর্য মোহাবিষ্ট করেনি। অনাহার-অর্ধাহার সহ্য করে করে সহ্যশক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি হয়ে চলেছে। না-পাওয়ার বেদনা থাকলেও তা কখনও হিংস্রতায় পর্যবসিত হয়নি। প্রেম ছিন্ন হলেও প্রেমের মর্মমূলে যে আকুতি ও নিবেদন বিরাজ করেছিল, আজও তা ক্ষুণ্ন হয়নি। এই জীবনবোধ, এই ইতিহাস, এই শূন্যতাই আমার পথ চলার সোপানকে মসৃণ করে তুলেছে। তাই নাম-যশ নয়, লেখাটাই বড়ো। উপলব্ধিটাই মূল বিষয়। আমার নাম থাকুক আর না-ই থাকুক, আমি চাই আমার সৃষ্টি বেঁচে থাকুক।