অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কিশোয়ার জাবীন -
মা

বেশ অনেক বছর আগে, বড়ভাইয়ের বিয়ের দিনের ঘটনা। কাজিনরা মিলে পার্লার থেকে চুল বেঁধে, সমস্ত মুখে
গিরগিটির মতো রং মেখে বাসায় ফিরেছি। বাসাভর্তি আত্মীয়স্বজন। সবাই রেডি হচ্ছেন। বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে চারতলায় রুমা আপাদের বাসায় চলে গেলাম শাড়ি পরতে। শাড়ি পরে বাসায় ঢুকতেই দেখি মা।
আমাকে দেখে মা ভীষণ রেগে গেলেন! ধমক দিয়ে জানতে চাইলেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলাম! যত বলি, রেডি হচ্ছিলাম, মা তত রেগে যাচ্ছিলেন। বকা দিচ্ছিলেন।
ভীষণ মন খারাপ করেছিলাম। কিন্তু, মায়ের রেগে যাওয়ার কারণটা বুঝতে পারিনি।
আজ, এত বছর পরে, বুঝতে পারি মা কেন রেগে গিয়েছিলেন!

আরেক দিনের ঘটনা।
২০০০ সালে মা পল্লবী থেকে মা ধানমন্ডি শিফট করবেন। কয়েকদিন মাকে জিনিসপত্র প্যাক করতে সাহায্য করলাম। হলমার্ক কার্ড শপগুলোর মধ্যে কম্পিটিশন শুরু হলো, মিলেনিয়ামে কার দোকান সবচেয়ে বেশি হয় বিক্রি করতে পারবে। ব্যস্ত হয়ে গেলাম নিজের ব্যবসায়িক কাজে। মায়ের বাসা বদলের চেয়ে আমার কাছে অনেক জরুরি হয়ে গেল নিজের দোকানে সময় দেওয়া।

তো, যেদিন মা প্রথম ধানমন্ডির বাসায় থাকতে গেলেন, সেদিন রাতের খাবার নিয়ে হাজির হলাম মায়ের বাসায়।
আমাকে দেখে মা ভীষণ রেগে গেলেন! রেগে বারবার বলতে লাগলেন, কেন খাওয়া নিয়ে গেছি।

মন খারাপ করার পাশাপাশি কিছুটা বিরক্তও হয়েছিলাম। কিন্তু মায়ের রেগে যাওয়ার কারণটা বুঝতে পারিনি।
আজ, এত বছর পরে, বুঝতে পারি, মা কেন রেগে গিয়েছিলেন!

২০১০ সালের ঘটনা।
আমার জীবনের ব্যস্ততা তখন উত্তুঙ্গে। মায়ের আস্তে আস্তে ডিমেনশিয়া গ্রো করছে। প্রচণ্ড মুড সুইং করে। ডিপ্রেশনে চলে যায়। বুঝতে পারি কিন্তু কিছু করতে পারি না। সময়ও দিতে পারি না। এরকম সময়ে মা একদিন বলল, তার পিঠ ডলে গোসল করিয়ে দিতে। অনেক দেরি করে গিয়ে দেখি, গোসলখানায় ছোট একটা টুলে বসে মা একা একাই গোসল করে ফেলেছে। নিজে নিজেই সাবান ডলে গোসল সেরে গায়ে পানি ঢালছে। আমি ধরতে যেতেই, ভীষণ রেগে গেলেন। কিছুতেই তার গায়ে একমগ পানিও দিতে দিলেন না। মায়ের রেগে যাওয়ার কারণটা সেদিনও বুঝতে পারিনি।

আজ, এত বছর পরে, বুঝতে পারি মা কেন রেগে যেতেন! এখন বুঝি, সেসব দিনগুলোতে আমার মায়ের আমাকে প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজনের সময়গুলোতে মা আমাকে পাশে পাননি। তার না পাওয়ার অভিমানটা রাগ হয়ে প্রকাশ পেয়েছিল!

বড়ভাইয়ের বিয়ের দিন হয়তো শাড়ির কুচিটা ধরার জন্য, আমাকে মায়ের প্রয়োজন ছিল। বাসা শিফট করার পুরোটা সময় নানান কাজে সাহায্য করার জন্য, আমাকে মায়ের প্রয়োজন ছিল। মায়ের ব্রেইন যখন আস্তে আস্তে সব ভুলে যাচ্ছিল, তখন একটু যত্নের জন্য, আমাকে মায়ের প্রয়োজন ছিল। এরকম নানান প্রয়োজনের সময় মা আমাকে পাশে পাননি।

যেহেতু আমার প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অনেক বেশি, তাই এক্সপেকটেশনও ছিল বেশি। যে তিনটা দিনের কথা বললাম, সে তিনটা দিনে মা আমার উপর রেগে গিয়েছিল কারণ আমি তার এক্সপেকটেশন পূরণ করতে পারি নাই। নিজেকে প্রায়োরিটি দিয়েছি অনেক বেশি, মাকে না। শুধু এই তিনটা দিনে না, আরও বহু-বহুদিনে, আমি নিজেকেই প্রায়োরিটি দিয়েছি! আমি মাকে প্রায়োরিটি দিয়েছি যখন আমার প্রয়োজন হয়েছে।

যখন আটাশদিন মা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তখন নিজের মানসিক শান্তির জন্য হাসপাতালে থেকেছি। যখন মা অথর্ব, অচল হয়ে গেছে, তখন নিজের দায়িত্ববোধ থেকে সপ্তাহে তিনদিন মাকে গোসল করিয়েছি।
যখন মাকে নয় মাস ন্যাজাল ফিড দিতে হয়েছে, তখন ঠিকই সময়মতো লিকুইড খাবার নিয়ে পৌঁছে দিতে গিয়েছি মায়ের বাসায়। যেদিন মাকে শেষবারের মতো গোসল করিয়েছি, সেদিন সমস্তটা শরীর ডলে ডলে ধুয়েছি কারণ, জানতাম আমি আর কোনোদিন আমার মাকে স্পর্শ করতে পারব না। এগুলো আমি করছি আমার প্রয়োজনে। আমার মানসিক সান্ত্বনার জন্য। মায়ের প্রয়োজনে না!

মায়ের যখন আমাকে প্রয়োজন ছিল, তখন আমি মায়ের পাশে ছিলাম না। তখন আমি আমাকে নিয়ে, আমার জীবন নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত ছিলাম! হয়তো এটাই স্বাভাবিক; হয়তো এটাই জীবনের নিয়ম! তাই যদি হবে, তবে আজ কেন এত অপরাধ বোধহয়?

কেন মনে হয়, মাকে আর একটু সময় দেওয়া উচিত ছিল— আর একটু মনোযোগ পাওনা ছিল আমার মা’টার!
কী অদ্ভুত জীবন আমাদের! সময় থাকতে থাকতে জরুরি বিষয়গুলো বুঝতে পারি না! সময়, সুযোগ ও মানুষ হারিয়ে ফেলার পরে বুঝতে পারি— হারিয়ে ফেলেছি!

যাদের এখনো সুযোগ আছে তাদের উচিত সময়ের সদ্ব্যবহার করা। কে জানে কখন সময় ফুরিয়ে যাবে! বড্ড অবেলায় ভেতরটা গুমরে গুমরে জানান দেবে— বেলা শেষ!
ফিরে গিয়ে সংশোধনের উপায় নেই! এখনই সময়!

সময় চলে গেলে সুযোগ আসে না!

 

Read Previous

জলছবির প্রতিচ্ছবি

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৪র্থ সংখ্যা (এপ্রিল-২০২৩)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *