অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৬, ২০২৪
১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৬, ২০২৪
১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কাজী লাবণ্য -
কবি, কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ নূরুল হুদা’র জোড়া উপন্যাস- জন্মজাতি * মৈনপাহাড়

কারো পিতা নয়, কারো পুত্র নয়, নয় অগ্রজ, অনুজ। কেবল একজন মানুষ, একটি বন্ধনহীন অস্তিত্ব- ‘রমণী’। আক্ষরিক অর্থে সংজ্ঞায়িত করলে ভ্রান্তিতে পড়বে পাঠককুল। আদতে সে রমণী দাস। লুসাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ধমনি। প্রশ্ন করলে সে হাসে- ‘জলে-ভাসা মানুষ, আমি এক লখাই, আমার কোনো ঘরবাড়ি নাই’। এই হাবশী কালো রমণীর হাতে থাকে- পেতলের একখানা গোলগাল চাঁদ। সময় অনন্তের বাঁশি, আর রমণী যেনো বংশীবাদক। সে তার হাতের গোল চাঁদ খানাকে ঢং…ঢং… করে পেটালে হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ে ইশকুলের ছেলেমেয়ের দল।

এরপরে শুরু হয় তিনজনের যাত্রা- লেখক, সূর্য আর পাখি। যাত্রা শুরু হয় মুগ্ধ পাঠকেরও। শুরু হয় ঘুড়ির আকাশ ভ্রমণ, ঝিরির পথচলা, হানিফা-সোনাবিবি, সোহরাব-রুস্তমের কাহিনি। আসে ইয়াজুজ-মাজুজ, আসে ইউসুফ-জুলেখা। আরো আসে বেদে বেদেনী, যুবতী আর নিশকুটম্ব। আসে শালিক, চড়ুই, গঙ্গা কৈতর, জালালী কৈতর।

প্রতিটি চরিত্র নিজ নিজ প্রয়োজনে আবির্ভূত হয়ে পাঠকের মনে স্থান করে নেয়। পাঠক তাদেরকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে, গল্প থেকে গল্পে, দরিয়া থেকে পাহাড়ে, আদিনাথ মন্দিরের চুড়ায়, রহস্যঘেরা পাহাড়ের পথে, অনাবিল আনন্দে। পাতায় পাতায় স্বাদুতা, অধ্যায়ে অধ্যায়ে বাঁক, রহস্যময়তা পাঠককে টেনে নিয়ে যেতে থাকে এক যাদুবাস্তবতার জগতে। এমনই কৌতূহলোদ্দীপক প্লট, ক্লাসিক্যাল থিম আর পাণ্ডিত্যপূর্ণ কিছু চরিত্র… যা পাঠকের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়।

আমীর মৌলবি অজু করে ঘরে যায়। সে এখন কোনোদিকে তাকাবে না। চোখ দুটো মাটিতে নিবদ্ধ রেখে হেঁটে যাবে। অজু করা মানুষ পাক-পবিত্র। বেগানা মেয়েমানুষ দেখলে অজু নষ্ট হয়। তাই অজু করা মানুষের ডান-বামে তাকানো না-জায়েজ। উত্তম হচ্ছে পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের দিকে চোখ রেখে হেঁটে যাওয়া। এতকিছু করেও আমীর মৌলবী কী পারে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বাসনাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে সোনা বিবিকে বিদায় করে দিতে!

রামকানাইয়ের কাছ থেকে তালিম পাওয়া নবীন জেলে কিশোরের জালে ধরা পড়ে শক্তিমান একটা কিছু, যে লাফ দিয়ে, লেজের ঘায়ে নৌকা উল্টে দিতে চায়। কিশোর ভেবে পায় না কি হতে পারে। পরে চাঁদের আলোয় দেখতে পায় এক বড়ো জাতের কোরাল। কোরালের সাথে কিশোরের দীর্ঘ যুদ্ধ, একের পর এক কৌশল ‘দ্যা ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি’র কথা মনে করিয়ে দেয়। একসময় এই জংলা পাখি অর্থাৎ কোরাল পোষ মানে।

প্রথাগত গল্প বলার ঢঙ কিছুটা এড়িয়ে তিনি হাত খুলে মন খুলে লিখেছেন এক আখ্যান যেখানে একাধিক ঘটনা নদীর স্রোতের মতো পাশাপাশি বয়ে গেছে শাখা, উপশাখা বিস্তার করে। ফলিয়েছেন প্রজ্ঞার ফসল। গহন, গভীরতার আবিষ্কারে ব্রতী হয়ে চালিয়েছেন কলম, কলমের সাবলীলতা, উপমার নান্দনিক ব্যবহার প্রশংসনীয়। উপন্যাসের শরীর জুড়ে আছে মুগ্ধকর কিছু ছড়া, কিছু গানের কলি-

খাইয়্যম দাইয়্যম জাল ফেলাইয়্যম/ধইজ্জম চিরিং মাছ/গিরিং চালর ভাত খাইয়ারে

কাইট্টম বনের গাছ।/বনত আছে রসাল বৃক্ষি/দইজ্জাত আছে মাছ/পারাই যাইয়্যম মৈনর পাহাড়/ন ফিরিয়ুম পাছ।

আক্তার মাঝির পোলা কিশোর অতঃপর বেমান দরিয়ায় বাঁকখালি, মৈশখালি আর বঙ্গোপসাগরের তিন জল-মোহনায় দেখতে পায় এক মাস্তুল। গাঙচিলের উড্ডিন ডানার দিকে চোখ রেখে, অবারিত সবুজ পেরিয়ে সে পৌঁছে যায় মৈনপাহাড়ে। পাতা, জাল দিয়ে ঢাকা সেই জংলা পাখিটাকে নৌকায় তুলে আবার ওরা যাত্রা শুরু করে। এক সময় ওই দইজ্জার কোরাল নিয়ে লখিন্দর, মাধবসহ ওরা পৌঁছে যায় মা ফিরুজার উঠোনে।

বহুদিন বাদে মাতা-পুত্রের এই মিলনে ফিরুজা দিশেহারা বোধ করে। আর এই বিশাল কোরাল দেখার জন্য ছুটে আসে গাঁয়ের সকল মানুষ। খোয়াজ খিজিরের নামের মাছটিকে মৌলবী সায়েব নিজে জবাই করেন। কাহিনির এই পর্যায়ে আবার দেখা যায় রহস্যময়ী নারী সোনা বিবিকে। সোনার কাছে ‘মাইয়া মানুষ পুরুষের কাছে হুক্কার পানি। ময়লা হলেই বদলাই ফেলা জায়েজ’। দুঃখী যুবক কিশোরের পরিণতির ইঙ্গিতে পাঠককুল ব্যথিত হয় কিংবা কৌতুহলীই থেকে যায়। ‘কিরিচটা বাতাসে ঘূর্ণি তুলে তার মাথার দিকে ধেয়ে আসে। চাঁদের আলোয় আলোয় ধাবমান সাপ আর কিরিচে কোনো প্রভেদ বোঝা যায় না’। কিশোরের মনে হয় দুটোই ভয়ংকর সুন্দর।

কবিরা যখন কবিতার কলমে গদ্য লিখেন তা হয়ে ওঠে প্রবাহমান ভাষার সৌকর্যে মাধুর্যময়। সে লিখনশৈলি হয়ে ওঠে দীপ্তময়। যা কেবল মুগ্ধতাই আনে। তবে, অগণিত পাঠকের ভালো লাগার ঐশ্বর্যবতী, মননশীল এই উপন্যাস কেনো জোড়া উপন্যাস বা আলাদা আলাদা, তা ঠিক বোধগম্য হয় না।

পরবর্তী খণ্ড মৈনপাহাড়, জন্মজাতিরই শেষাংশ বলে মনে হয়েছে। যা কিছুই হোক এটি ভাষায়, বর্ণনায়, চরিত্র সৃজনে একটি স্বাদু, সুখপাঠ্য লেখা- সেটি এককথায় অনস্বীকার্য।

সাহিত্য জগতে উজ্জ্বল তারকা, বুদ্ধিবৃত্তিক, উদ্ভাবনী এবং প্রতিভাবান কবি, কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ নূরুল হুদা।

তাঁর জোড়া উপন্যাস-
নাম- জন্মজাতি মৈনপাহাড়
প্রকাশক- কথা প্রকাশ
প্রচ্ছদ- সব্যসাচী হাজরা।
দাম- ৩০০/

+ posts

Read Previous

বৈপরীত্যের ঐক্য : বৈপরীত্য

Read Next

পাঠ প্রতিক্রিয়া – দ্বিতীয় শ্রাবণের প্রথম কদম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *