অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৪, ২০২৪
১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৪, ২০২৪
১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লাবণী মণ্ডল -
বৈপরীত্যের ঐক্য : বৈপরীত্য

শিল্প-সাহিত্যে আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নিয়ে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই। কোনো শিল্পকর্ম, রচনা, বইয়ের রিভিউ বা সমালোচনা পত্রিকায় ছাপা হলে সংশ্লিষ্ট শিল্পকর্মটি সম্পর্কে পাঠক আগে থেকেই জানতে পারেন, তাতে আগ্রহ জন্মায়। আর একজন পাঠকের মতামতের উপরই ভিত্তি করে লেখকের লেখনীর গুরুত্ব।

প্রতিটি ব্যক্তির জীবনযাত্রা, পথচলা, অভ্যাস, ভাষারীতির মতো লেখালেখির বিষয়ে তার নিজস্ব দর্শন-মতাদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। যার প্রতিফলন ঘটে তার সৃষ্টিতে। যে সৃষ্টির মধ্যেই আবার বেঁচে থাকার আনন্দ। সৃষ্টির প্রতি আলাদা মমত্ববোধ, দায়িত্বজ্ঞান, প্রেম অনুভূতি না থাকলে; সে সৃষ্টি বেঁচে থাকে না। লেখক মুম রহমানও এর বাইরে কেউ নয়-

‘আমি তীব্র প্রেম কাঙাল কানাই,
ভালোবাসা পেলে সব ভুলে যাই।
লাজুক লোক আপন মনে থাকি তাই,
মনের মানুষ পেলে মাতোয়ারা হয়ে যাই।
আপনার কোনে আপনি থাকি নিরিবিলি,
চিৎকার চেঁচামেচি সযত্নে এড়িয়ে চলি।
বিবিধ বিষয় আর বৈচিত্র্য নিয়ে মত্ত থাকি
নিজের ভাবনাকেই সরবে রাখি।’

নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন টানতে গিয়ে উক্ত কথাগুলো বলেছেন লেখক মুম রহমান। একজন ব্যক্তি যখন নিজের জীবনচরিতকে এভাবে জানান দেয়, তখন তার সঙ্গে বেড়ে উঠা মানুষদের ভেতরে ভাবনা তৈরি হয়। ‘আপনার কোনে আপনি থাকি নিরিবিলি…’ এই লাইনটি আমাকে আকৃষ্ট করেছে। ‘শো-অফে’র যুগে এ রকম নিজের কোনে নিরিবিলি বেঁচে থাকাটাও একটা লড়াই।

ছোটগল্প হলো সাহিত্যের আখ্যান। ছোটো ছোটো বাক্যের ভেতর থাকে জীবনের হিসাব। জগতের বিস্ময়কর ঘটনা জানতে হলে ছোটগল্পের বিকল্প নেই। যদিও আমাদের এখানে এর চরিত্র হারিয়েছে। এক ধরনের ‘জগাখিচুড়ি’ অবস্থা। মুম রহমান লিখিত ‘বৈপরীত্য’ গ্রন্থটি ছোটগল্প নিয়ে লেখা। এখানে ৫০টি গল্প রয়েছে। প্রতিটি গল্পই ৫০ শব্দের ভেতরে লেখা। এটি যদিও বিস্ময়কর ঘটনা, তবুও সত্য করে তুলেছেন লেখক। এর আগেও তিনি ২০০ শব্দ নিয়ে ‘ছোটো ছোটো ছোটগল্প’ লিখেছেন; কিন্তু এটি শ্রমসাধ্য কাজ, একই সঙ্গে দুঃসাধ্য-কষ্টকর। কেননা, একটি গল্পকে ৫০ শব্দের ভেতরে লিখে, প্রাসঙ্গিক করে তোলা সাহসের ব্যাপার। যে সাহস দেখিয়েছেন গল্পকার মুম রহমান।

গল্পের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক আলাদা আলাদ স্কেচ রয়েছে। যে স্কেচগুলোও গল্পকে টেনে নিয়ে গিয়েছে। স্কেচ দেখলেই যেন গল্পের ভেতরের সন্ধান মিলে। ছোটগল্পের প্রতি প্রেমানুভূতি থেকেই বইটি পড়ে শেষ করলাম। যেটি নিয়ে আশঙ্কা ছিল, ৫০ শব্দে ছোটগল্প লেখা সম্ভব-লেখক তার লেখনীর মধ্য দিয়ে সেই আশঙ্কাকে দূর করতে পেরেছেন। খুব সহজ-সাবলীলভাবেই প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন প্রতিটি গল্প। ৫০টি গল্পের ৫০টি থিম তিনি দাঁড় করিয়েছেন।

৫০টি ছোটগল্পের ভেতরে যেগুলো ঘোর লাগিয়েছে-‘গ্রাম’, ‘ঢাকা’, ‘পেরেক’, ‘বাজারি স্বপ্ন’, ‘দুঃস্বপ্ন’, ‘বুদ্ধিজীবী’, ‘সময়জ্ঞান’, ‘ঘাসফড়িং’, ‘মৃত্যুশয্যা’, ‘আঘাত’, ‘ভালোবাসা’, ‘কুকুরের আত্মহত্যা’ এবং ‘দৃষ্টি’। এগুলো চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে। ভাবনার জগতে ছাপ ফেলেছে।

‘গ্রাম’ গল্পটিতে তিনি সমাজের রাজনীতি, কুসংস্কার ও অব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরেছেন। ‘গ্রাম’ গল্প থেকে ‘কাদামাখা পথে পিছলে পড়ে পা ভেঙে ছিল। দূরের হাসপাতালে নিতে নিতে ব্যথায় কাতরে ছিল। ছিল ওষুধ পথ্যের অভাব। গ্রাম্য রাজনীতি, কুসংস্কার ছিল যথেষ্টই। শিল্প সাহিত্য বুঝত না সেখানকার কেউ।…’ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও গ্রামবাংলার চিত্রে যে জনগণের জীবন আক্ষরিক অর্থে ততটা বদলায়নি, তার ছাপ রয়েছে গল্পটিতে।

যার প্রমাণ পাওয়া যায় পত্রিকার পাতা খুললে। গত তিনদিন আগে এক প্রসূতি নারীর মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশ করেছিল- ডেইলি স্টার পত্রিকা। যেখানে বিষয়টি ছিল, যানবাহনের অভাবে হাসপাতালে নিতে না পারার কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নারী ও তার গর্ভের শিশু মারা যায়। মর্মান্তিক! ভয়ংকর!

শিল্প-সাহিত্যের ভেতর যদি সমাজবাস্তবতা-গণমানুষের জীবনচরিত না আসে, তাহলে সেটি অপূর্ণতা থেকে যায়। লেখক মুম রহমান মাত্র ৫০ শব্দেও সমাজের বৈষম্য-নিপীড়ন-নির্যাতন এবং প্রকৃতিপ্রেম, সুখ-দুখ, জরাব্যাধির কথা তুলে এনেছেন। যেটাই লেখকের সফলতা।

‘ঢাকা’ গল্পে তিনি শহরের কাকগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। ‘…ঢাকার মানুষগুলোও কাকের মতোই।…’ এটি একটি লাইন; কিন্তু এর মর্মার্থ অনেক গভীর। কাকেদের নির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই, ধরাবাধা কোনো জীবনরীতি নেই; এ শহরের মানুষগুলোও যেনো ঠিক তেমন। ছুটছে তো ছুটছেই- কেনো ছুটছে, কার পিছে ছুটছে; দিশেহারা!

‘বুদ্ধিজীবী’ গল্পে তিনি আমাদের সমাজের বুদ্ধিজীবীদের চিন্তার দৈন্যতার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। এরা যে আসলেই জনগণ বিচ্ছিন্ন কিংবা নিজেদেরকে এক ধরনের আলাদা ভাবে; সেটিই তার গল্পে স্পষ্ট হয়েছে। যার বাস্তবতা আমরা প্রতিনিয়তই দেখে থাকি।

কী অপূর্ব বর্ণনায় লিপিবদ্ধ করেছেন প্রতিটি গল্পের ছন্দমালা। যেখানে অভাব রয়েছে, রাজনীতির প্রেক্ষাপট রয়েছে; একই সঙ্গে প্রকৃতির অপূর্ব দৃশ্যগুলো দৃশ্যায়িত হয়েছে। ছোটগল্প যে বিচিত্র বিষয় ও নিরীক্ষাধর্মী শিল্পরূপের বাহন, সে বিষয়টি আঁচ করা যায় এ রকম গল্প পড়লে।

শেষ করছি-

‘কোনোখানে থাকে না মুম রহমান’
অনেকেই ভাবে এ বাড়িতে থাকে মুম রহমান।
অনেকেই জানে এ অফিসে কাজ করে মুম রহমান।
অনেকেই মানে এ পাহাড়ে বেড়াতে আসে মুম রহমান।
না। না। না।
সত্যি বলছি-‘না’।

আমি বলছি যেখানে যা দেখা যায় তা মোটেও সত্যি না।

তোমরা যা জানো তা ভুল। আদতে কোনোখানে থাকে না মুম রহমান।’ ঠিক তাই তো হওয়ার কথা, শিল্পীদের নির্দিষ্ট কোনো ঘর নেই, আছে পৃথিবীব্যাপী বিস্তার করার মতো বিশালতা। যে বিশালতা দিয়েই পুরো পৃথিবীকে জয় করা যায়, শিল্প-সাহিত্যের দৈন্যতা ঘুচানো যায়।

সবশেষে বলা যায়, বৈপরীত্য বই নিয়ে রিভিউ-সমালোচনা-পর্যালোচনা-মূল্যায়ন- কোনোটাই করিনি। আমি শুধু বইটি পড়ার পর আমার নিজস্ব কিছু অনুভূতিই তুলে ধরেছি। যদি এতে পাঠকদের কোনো কাজে আসে, তাই লেখা। বইটি পাঠকসমাজের মধ্যে প্রচার হোক, সেই প্রত্যাশা করাটা কী বেশি হবে!

বই : বৈপরীত্য
লেখক : মুম রহমান
প্রকাশক : ক্রিয়েটিভ ঢাকা
মূল্য : ৩০০

+ posts

Read Previous

কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পুরস্কার পেলেন বাংলার দুই কবি

Read Next

কবি, কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ নূরুল হুদা’র জোড়া উপন্যাস- জন্মজাতি * মৈনপাহাড়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *