অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লুনা রাহনুমা -
পাঠ প্রতিক্রিয়া – দ্বিতীয় শ্রাবণের প্রথম কদম

উপন্যাস: দ্বিতীয় শ্রাবণের প্রথম কদম
লেখক: দীলতাজ রহমান
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০২২
প্রকাশক: অনুপ্রাণন প্রকাশনী
মূল্য: ২০০ টাকা

দীলতাজ রহমানের লেখা উপন্যাস পড়লাম প্রথমবারের মতো। এর আগে উনার বেশ কিছু বড়ো গল্প পড়েছি। এই উপন্যাসটির প্রধান উপজীব্য বিষয় হচ্ছে একজন নারী, যার স্বামী মারা যাবার পর তিনটি ছেলেকে নিজের হাতে বড়ো করে নিজে একটি একাকী সাংসারিক বলয়ে আবদ্ধ এবং নিরস জীবনযাপন করে যাচ্ছিলেন। দুই ছেলে বিয়ে করে নিজেদের ছেলেমেয়ে নিয়ে ব্যস্ত, এক সময় মাকে এবং বেকার ভাইটিকে রেখে আলাদা বাড়িতে গিয়ে সংসার আরম্ভ করে। স্বামী মারা যাওয়া এই মূল চরিত্রটির নাম আকলিমা খানম, যার জীবনে দমকা বাতাসের মতো পরিবর্তনের ঢেউ নিয়ে উপস্থিত হয় ছোটো ছেলের বান্ধবী- বুবলি। দুটি নারী চরিত্রকে পাশাপাশি অনেকটা পথ হাঁটিয়ে নিয়ে গেলেও, একসময় গল্পের প্রয়োজনে একটি চরিত্রকে গল্প থেকে সরিয়ে ফেলেছেন উপন্যাসিকা অতি নির্মমভাবে।

পুরো উপন্যাসটি খুব দ্রুত এবং সহজভাবে পড়ে নেওয়া যায়। মাঝে মাঝে কিছু সংলাপে মন আটকে যায়, খুব সাধারণ কথা, কিন্তু কেমন করে মানুষের মনের ভেতর নাড়া দিয়ে যাওয়ার মতো শক্তিশালী বাণী! উপন্যাসটি পড়ার সময় আমার মার্ক করে রাখা অনেকগুলো লাইন থেকে কয়েকটি লাইন উল্লেখ করছি এখানে-

‘টাকা থাকলেই বুঝি খরচ করতে হয়? বাচ্চার হাতেখড়িতে প্রফেসারের দরকার হয় না!’

‘মানুষকে প্রতিদিন চিনতে হয় না। যা চেনার তা একদিনেই চেনা হয়ে যায়। বাকি জীবন তাকে প্রতিদিন নতুন বইয়ের মতো পড়তে হয়।‘

‘আমার কাছে কিন্তু সুচিত্রা সেনের চেয়ে অপর্ণা সেনকে বেশি ভালো লাগে। অপর্ণা সেনের কত কাজ। কত মেধাবী তিনি! আর সুচিত্রা সেন ছিলেন একমাত্রিক। শুধু অভিনয়ই জানতেন এবং তিনি অহংকারী এবং জেদী ছিলেন’।

‘আমি যেটুকু করলাম, এটুকুর জন্য বয়স লাগে না। লাগে সাহস। আর সব সাহসী পদক্ষেপই যে সুফল দেয়, তা কিন্তু নয়। তাই সাহস দিয়ে কেনা দুর্গতিতেও কখনো কখনো ধূপধুনো ছোঁয়াতে হয়।‘

‘……বাদানুবাদের ভেতর দিয়েও অনেক ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে যায়! মনের অনেক ভার লাঘব হয়। তখন মনে হয়, আমার যা বলার ছিল, তা তো বলেছি! কিন্তু কথা না হলে তো সব কৈফিয়ত জমতে থাকে….’

‘ভালোবাসা বিষয়টা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় করুণা না হয় সমীহ`র পথ ধরে আসে।‘

‘এইটুকু জীবনে কতরকম টানাপোড়ন পোহাতে হয়। তার কিছুটা মাত্র অনিবার্য। বাকিটা নিজের মানুষগুলো দ্বারা সৃষ্টি। যে কেউ সুখী হতে চাইলেই সে সুখী হতে পারে না। দুঃখ-যন্ত্রনা যেমন তার পরিপার্শ্ব তৈরী করে, তেমনি সুখও তো উৎপন্ন করতে হয়’।

‘সৃষ্টিতে একশোটা কুকুরের বাচ্চার চেয়ে একটি বাঘের বাচ্চা ভালো।‘

‘তিনি আরো মানুষের বাচ্চা ছুঁয়ে দেখেছেন, আর কারো বেলায় তার এমনটি হয় না! এটা শুধু তার নিজের উত্তরসূরির বেলাতে হয়। পরখ করে দেখেছেন তিনি! অথচ সেই বাচ্চাগুলোকে নাড়াচাড়া করার রহমত থেকে ছেলেরা তাকে বঞ্চিত করেছে, এই বঞ্চনায় তার দুচোখ ভরে অশ্রু উপচে ওঠে! কিন্তু তিনি তা বলেন না। এখন তিনি বুঝে গেছেন, ব্যক্তিগত হাহাকার যতই কম প্রকাশ করা যায়, ততোই নিজের কাছে নিজের সম্মানটা থাকে।‘

উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আকলিমা খানম মূলত একজন দার্শনিক, যিনি জীবনটাকে দর্শকের মতো দেখে গিয়েছেন, উপলব্ধি করেছেন, আশেপাশের চরিত্রগুলোর মনস্তত্ব ব্যাখ্যা করেছেন তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। দীলতাজ আপার সাথে আমার সামান্য পরিচয় আছে। তার সবটাই লেখা সংক্রান্ত আলাপে এবং উনার লেখা পড়ে আমার যেটুকু ধারণা হয়েছে ব্যক্তি দীলতাজ সম্পর্কে, আমার কাছে মনে হয়েছে এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আকলিমা খানমকে তিনি আসলে নিজের আদলেই নির্মাণ করেছেন। উপন্যাসের আকলিমা ঠিক যেভাবে তার চারপাশ, জীবন, সংসার, সন্তান, সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করেছে, লেখিকা দীলতাজ নিজেও ঠিক সেভাবেই দৃষ্টি ফেলেন সবখানে। একজন চিত্রকর যেমন দীর্ঘদিন বাইরের অনেক ছবি আঁকাআঁকির পর খুব যত্ন করে নিজের একটি পোর্ট্রেট আঁকেন একদিন, দীলতাজ রহমানও লেখালেখির এই পর্যায়ে এসে নিজের একটি চরিত্র নির্মাণ করেছেন পরম মমতা নিয়ে আকলিমা খানমের নামে।

উপন্যাসের আকলিমা খানম এবং বাস্তবের লেখিকা দীলতাজ রহমান- দুজনের জন্য আমার অনেক ভালোবাসা এবং শুভকামনা রইলো। দুজনেই সুস্বাস্থ্য নিয়ে দীর্ঘজীবী হন।

Print Friendly, PDF & Email
লুনা রাহনুমা

লুনা রাহনুমা

দেশের জাতীয় দৈনিক, বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা, মুদ্রিত লিটল ম্যাগাজিন ও ওয়েবজিনে নিয়মিত লিখছেন।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ "ভালোবেসে এঁকে দিলাম অবহেলার মানচিত্র"(১৯৯৯) এবং "ফুঁ"(২০০০), বিশাকা প্রকাশনী।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ "নারীবৃক্ষ" (ডিসেম্বর, ২০২১), অনুজ প্রকাশনী।
প্রকাশিত অনুবাদ গল্পগ্রন্থ "দিগন্তের দিকে হেঁটে যাওয়া মেয়েটি," (একুশে বইমেলা, ২০২২), অনুপ্রাণন প্রকাশন।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের সুইন্ডনে বসবাস করছেন।

Read Previous

কবি, কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ নূরুল হুদা’র জোড়া উপন্যাস- জন্মজাতি * মৈনপাহাড়

Read Next

রোদ-খোর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *