অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

আরিফুল হাসান -
রোদ-খোর

কপ কপ করে রোদ খেতে থাকে রহিম। দুহাতের আজলা ভরে দুপুরের রোদ। মরিচ গাছগুলো বেড়ে উঠলে পাল্লা দিয়ে বাড়ে আগাছাও। বাড়ির পাশের দেড় শতাংশ জায়গায় মরিচ ও বেগুনের আবাদ করেছে সে। শীতের সকাল একটু বেড়ে উঠলে ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে জাগে। বৌকে তরকারির জন্য দু-চার শব্দ গালমন্দ করে, আবার জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে মাঠে এসেছে। এরকম প্রায়ই হয়, হেনা তরকারিতে লবণ একটু বেশিই খায়। রহিম অতটা খেতে পারে না। ছাড় দেয় হেনা, লবণের মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে। তবু মাঝে মাঝে যে পুরনো অভ্যেস বেখেয়ালে চলে আসে না এমন নয়। কোনো কোনোদিন তরকারিতে লবণ বেশি হয়। আজ বউত্থা শাক রেঁধেছে। গতকাল এনেছিল রহিম গম ক্ষেত থেকে।

উত্তর পাত্রে তার আরও ছ’কানির মতো জমি আছে। সেখানে তিনটিতে ধানি ফলন ভালো। বাকি একটিতে সরিষা, একটিতে মসুরি ও তিশি এবং আরেকটিতে গমের চাষ করেছে সে। গমগাছগুলি বেড়ে উঠেছে ভালো। তবে আগাছা সেখানেও বিস্তর। লোকজন নিয়ে তিনদিনে নিড়ানি দিয়ে শেষ করেছে। তৃতীয় দিন আগাছাগুলি ফেলে দেয়ার সময় হঠাৎ মনে পড়েছে, বৌ বলেছিল বউত্থা শাক আনতে। শিশির দানার মতো মিহি পাউডারি পাতার এ শাক রহিমেরও প্রিয়। হেনা গতকাল রাতেই রাঁধতো। কাল একটু ভালোমন্দ খাবার ছিল। গম ক্ষেত নিড়াতে যারা রোজদরে এসেছিল তাদের বিদায়ী খানা। বড়ো রাতা মুরগীটা জবাই করেছে রহিম। বৌ রেঁধেছেও ভালো। কামলারা পেট ভরে খেয়ে মুখ ভরে প্রশংসা করে গেলো। আজ এই শাকে, এই দেড় পয়সার বউত্থা শাকে লবণ একটু বেশি দেয়ায় বৌকে বকেছে, এটি মেনে নিতে পারে না রহিম। হেনাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। হেনা মুখ ঘুরিয়ে রাখে। পেটের পাশে কাতুকুতু দেয় এবার। হেনা হাসতে গিয়ে হাসে না। জানায় পাশের ঘরে মা আছে। রহিম হেনার কপালে একটা চুমু খেয়ে কাস্তে হাতে বেরিয়ে পড়ে।

আজ মরিচ ক্ষেতটায় এসেই মেজাজ বিগরে গেছে তার। এই কদিন উত্তর পাত্রে ব্যস্ততায় থেকে মরিচ ক্ষেতটার খবর নিতে পারেনি। ঘাস একদম ধাম বেঁধে আছে। বিসমিল্লাহ বলে শুরু করে। লকলকে মরিচ গাছগুলোকে বাঁচিয়ে নানান প্রকার আগাছা তুলে মাটিকে ঝুরঝুরে করে দেয়া। একটু সময়ের কাজ। খুব বেশি এগুনো যায় না। পায়ের পাতা মেপে মেপে ফেলতে হয়। একটু উনিশ থেকে বিশ হলেই মরিচের চারা দুমড়ে যাবে। রহিম ধৈর্য নিয়ে নিড়াতে থাকে। দুপুরের রোদ তখন মাথার উপরে তাপ ফেলছে। শীতের জামাটা একটু আগে শরীর থেকে খুলে আলের বেড়ার উপর রেখেছে। এখন তাপটা কেমন জ্বালা জ্বালা করছে ত্বকে।

করিম কপালের উপর হাত রেখে সূর্যটার দিকে চায়। বোধহয় গালি দেয় মনে মনে। তারপর আবার আপন মনে কাজ করতে থাকে। গুনগুন করে একটা মারফতি গানে টান দেয়। পাশেই দু-তিন কোঠা দূরে সলিমুদ্দিন ও তার বৌ টমেটু ক্ষেত থেকে টমেটু তুলে ফিরেছে। এখন আশপাশের জমিতে কেউ নেই। বাড়ির পাশে হলেও কেমন এক নিঃসঙ্গতা বিরাজ করছে। এ পাশটায় ইরি ধানের আবাদ। বসতি থেকে দুই আড়াইশো শতক দূর থেকেই শুরু হয়েছে ডিপকলের পানিতে করা ইরি। ওই দুই-আড়াইশো কিংবা তিনশো শতকেই বাসিন্দারা মরিচ, বেগুন-টমেটু, রসুন-পিয়াজ কিংবা গোল আলুর চাষ করে। তারপর থেকে বিস্তীর্ণ ইরি ধান। শুধু জল আর জল। আর জলের স্পর্ধা ছিঁড়ে মাথা তুলে দাঁড়ানো সবুজ সতেজ ধান গাছগুলো।

মাঠের শ্রমিকেরা চলে গেছে। একজন স্কিমের কর্মী কোদাল কাঁধে ফেলে ফিরে গেছে মাঠের ও প্রান্তে তার নিজের আবাসস্থলে। এমন সময় রহিমের চোখে পড়ে, মাঠের প্রধান আলটি ধরে রোদের ভেতর এক সূর্যমানুষ হেঁটে আসছে। দুপুরের নির্জনতায় তার কাছে মানুষটিকে সূর্যমানুষ বলেই মনে হয়। লম্বা আলখাল্লা পড়ে একটি সৌম্যমূর্তি ধীর পায়ে হেঁটে আসছে। সে আবার কপালের উপর হাত রেখে আগতের দিকে চায়। চেনা যাচ্ছে না। আরেকটু কাছে এলে মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এ গায়ের কাউকে তো মনে হচ্ছে হচ্ছে না। তবে কি ভিনদেশি পথিক? যাচ্ছে কোথাও অচেনা কুটুম্বের বাড়ি। রহিম কেনো যেনো লোকটিকে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবতে থাকে। সে অপেক্ষা করে লোকটির কাছে আসার। কাছে এলে চিনতে পারে এ তার বাল্যবন্ধু ওয়ায়েস। হারিয়ে গিয়েছিল ছোটোবেলায়। পিতামাতাহীন; থাকতো বুড়ো দাদুর কাছে। সংসারের একমাত্র স্বজন দাদুটি মারা গেলে আট বছরের ওয়ায়েস হারিয়ে যায়। লোকে বলে, সম্পদ গ্রাস করতে কেউ হয়তো মেরে থাকবে। কিন্তু সম্পদ পড়ে থাকে। আজ একুশ বছর হয় কেউ তা দখল করতে আসে না। না আসে ওয়ায়েস। তার বাড়িটা একটা ভুতুরে ঝোঁপে পরিণত হয়।

ওয়ায়েসের কথা গ্রামবাসী প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। নতুন প্রজন্মের শিশুরা ওয়াইজ্জার জঙ্গল নামে তার বাড়িটি চিনে। কিন্তু কে এই ওয়ায়েস তা তারা চোখে দেখেনি। আজ, এতো বছর পর সে এসে হাজির হবে রহিমের চোখের সামনে সে তা কল্পনারও অতীত। রহিমও যে এক পলকেই যে চিনতে পারবে বাল্যবন্ধুকে সেটাও সেটাও সে ভাবেনি। কিন্তু কী অবাক করা বিষয়। রহিম চিনলো, হয়তো চিনলো ওয়ায়েসও আরও আগে। সেই দূর থেকে হাত উঠিয়েছিল রহিমের উদ্দেশ্যে। দু-বন্ধু গলাগলি করে কাঁধে। শৈশবের অজর স্মৃতি তাদের মাথার ভেতর খেলে যায়। দূরপর্দার মতো ছুটোছুটির দিনগুলি ভাসে। রহিম ওয়ায়েসের কাঁধে হাত রাখে। জানতে চায় এতোদিন কোথায় ছিল? ওয়ায়েস খেয়ালি করে জবাব দেয়।

সেই শৈশবের অভ্যেসটা এখনও রয়ে গেছে তার। কেমন একটা বাউলিপনা ছিল। পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের সাথে মিশতো না। থাকতো একা একা। সুযোগ পেলেই রহিমকে নিয়ে ফড়িং ধরতে যেতো। আর ফড়িং ধরা পরার পর দু-বন্ধু সেগুলোর ব্যথায় ব্যথিত হয়ে সেগুলোকে শূন্যে উড়িয়ে দিতো। তাদের একটি প্রিয় খেলা ছিল রোদ খাওয়া। নির্জন দুপুরে দু-বন্ধু ক্ষেতের আল থেকে আলে দৌড়ে দৌড়ে আজলা ভরে পান করতো রোদ। এক অপার্থিব আনন্দে তাদের মন ভরে উঠতো। পরে আবার রহিমের মনে হতো, এই রোদ খাওয়ার মধ্যে আসলে কী আছে? সে কোনো অর্থময়তা খুঁজে পেতো না এতে। কিন্তু ওয়ায়েস বরাবর রোদ খেয়ে আনন্দ কুড়াতে বিমলিন হয়নি। একটি সূর্যের আভা যেনো ছড়িয়ে পড়তো তার চোখে মুখে রোদ খাওয়ার পর। আজও রহিমের মনে আছে। সে বন্ধুকে প্রশ্ন করে, আজও কি রোদ খাওয়ার কথা মনে আছে তার? ওয়ায়েস ঘাড় নাড়ে। হ্যাঁ, ঠিকঠিক মনে আছে তার। তার চোখ-মুখে আবার অবিকল সেই সূর্যাভা খেলা করতে থাকে। রহিমের মনে হয়, একটি সূর্যবালক একুশ বছর আগের চেনা মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর দু-বন্ধু মিলে আবারও রোদ খায়। একুশ বছর পরে তারা ভুলে যায় এরই মধ্যে তারা পেরিয়ে এসেছে একুশটি শীতকাল।

Read Previous

পাঠ প্রতিক্রিয়া – দ্বিতীয় শ্রাবণের প্রথম কদম

Read Next

জলের গান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *