অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আহমেদ টিকু -
স্খলনকালের গল্প: শব্দের আলপনায় আঁকা জীবনের প্রতিচিত্র

বইয়ের নাম: স্খলনকালের গল্প

লেখকের নাম: শিবশঙ্কর পাল

প্রকাশকাল: ২১শে বইমেলা, ২০১৯ খ্রি.

প্রকাশক: এবং মানুষ প্রকাশনী

প্রচ্ছদ শিল্পী: এম. আসলাম লিটন

মূল্য: ১৫০.০০ টাকা।

শিবশঙ্কর পাল। একজন নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ, আত্মনিমগ্ন মানুষ। দৈনিকের সাহিত্যপাতায় তার উপস্থিতি কম। তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন লিটলম্যাগে। ‘স্খলনকালের গল্প’ তার দ্বিতীয় গ্রন্থ।

লেখক তার গ্রন্থের দশটি গল্পে নব্বই দশকের গ্রামীণ জীবনের বাস্তবচিত্র তুলে ধরেছেন দক্ষশিল্পীর মতো সুনিপুণ হাতে। একজন সচেতন লেখক হিসেবে তিনি সমাজের ভেতর থেকেই চলমান ঘটনাপ্রবাহকে প্রত্যক্ষ করেছেন নিবিড়ভাবে। কালির আঁচড়ে শিল্পিত করেছেন ঘটনার পেছনের ঘটনাও।

বইয়ের প্রথম গল্প ‘একজন পল্লীচিকিৎসক’। গল্পটিতে লেখক আমাদের চিরচেনা একটি গ্রামীণ চরিত্র অঙ্কন করেছেন অত্যন্ত দরদের সাথে। আর দশজন গ্রাম্যচিকিৎসকের মতোই তার জীবনযাত্রা। পারলে মানুষের উপকারই করেন আশফাক ডাক্তার। তার ব্যবসার প্রসারও ভালো। কিন্তু রাশিদুল নামে এক বখাটের সাথে পূর্বশত্রুতার জের ধরে ডাক্তারের জীবনে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। রাশিদুলের বউ ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য যায়। রাশিদুল তার বউয়ের শ্লীলতাহানির মিথ্যে অভিযোগ এনে ডাক্তারকে মারাত্মকভাবে প্রহার করে। ডাক্তার চরমভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। গ্রামের মানুষের আলোচনারবস্তু হয়ে যায় রাশিদুলের বউ আর ডাক্তারের মধ্যকার কল্পিত ঘটনাটা। এক্ষেত্রে প্রকৃত ঘটনা না জানা মানুষদের দোদুল্যমান মানসিকতা লক্ষ করা যায়। আশফাক ডাক্তারের ভাই রাশিদুলের নামে মামলা করলে, গ্রামের লোকেরা ডাক্তার বা রাশিদুল কারো পক্ষেই স্থিরভাবে দাঁড়াতে পারে না।  ক্ষণে ক্ষণে তাদের মত পরিবর্তন হতে থাকে। বছরখানেক পর ডাক্তার রাজশাহী, ঢাকা ঘুরে সুস্থ হয়ে গ্রামে ফিরে আসে। গ্রাম্যরাজনৈতিক নেতা আর প্রধানদের মধ্যস্থতায় উভয়পক্ষ মামলা তুলে নেয়। রাশিদুল ডাক্তারের পা ধরে মাফ চেয়ে নেয়। ডাক্তার আবার তার ব্যবসা শুরু করে। আগের মতোই তার কাছে রোগীরা আসতে থাকে।

‘একদা এক চাঁদের বুড়ি’ গল্পে লেখক ঠাঁই-ঠিকানাহীন, আত্মীয়-পরিজনহীন এক রহস্যময় বুড়ির জীবনের সাময়িকচিত্র এঁকেছেন। নীরেন নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে হঠাৎ করেই রহস্যময় বুড়ির আগমন ঘটে। অনেক কাকুতি মিনতি করে বুড়ি নীরেনের মনে করুণার উদ্রেক করে। বাড়ির বারান্দায় ঠাঁই হয় বুড়ির। দিনে গ্রামে ঘুরে ভিক্ষে করে বেড়ায় বুড়ি। বিকেলে এসে রান্নাবাড়া করে খেয়ে রাতে গুটিসুটি মেরে ঘুমায়। বুড়ি ভিক্ষে করে কিছু টাকা জমলে টিনের কৌটায় সেগুলো গোঁজ করে রাখে। হিসাব না জানা বুড়ি বলে বেড়ায় ‘ঘরে ঘরে শ’-পঞ্চাশ। নীরেন এ কথার অর্থ না বুঝলে কৌশলে বুড়ির ব্যাগ হাতিয়ে শ’-পঞ্চাশের রহস্য উন্মোচন করে। হঠাৎ একদিন শুনতে পায় বুড়ি কেঁদে বলে বেড়ায় ‘কারো কিচ্ছু নাই মা রে, কারো কিচ্ছু নাই।’ কষ্টের সম্বল হারিয়ে বুড়ি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। তার শরীরে দেখা দেয় জ্বর। নীরেনের বউ বুড়ির সেবাযত্ন করে। নীরেন বুড়ির টাকা হারানোর সংবাদে মনে কষ্ট পায়। হঠাৎ একদিন বুড়ি ভোর হবার আগেই যেভাবে এসেছিল সেভাবেই আচানক কোথায় চলে যায়। গল্পটি পাঠে পাঠকের মনে দাগ কেটে যাবে। বুড়ির জন্য অন্তরে জাগবে সূক্ষ্ম নীরব চিরাচরিত মমতা।

‘নয়না উপাখ্যান’ গল্পে শান্তি নামে এক স্বামী পরিত্যক্তা মহিলার জীবন সংগ্রামের আখ্যান পাই। শান্তির স্বামী অন্য মেয়েকে বিয়ে করে ঘর পেতেছে। শান্তির এক ছেলে, দুই মেয়ে। বড় মেয়ের নাম নয়না। নয়নার উঠতি বয়স। শরীরে যৌবনের জোয়ার আসতে শুরু করেছে। শান্তি মুড়ি ভেজে ছেলের মাধ্যমে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায়। একদিন মুড়ির ধান আনতে তার বাপের গ্রামে গেলে প্রতিবেশী নকুল দাশের বউকে নয়নার সাথে রাতে থাকতে বলে। গ্রামের প্রভাবশালী পরিবারের বখাটে সন্তান অপরাজনীতির ছত্রছায়ায় আশকারা পাওয়া আলম ও রোকন। তাদের নির্দেশে কুদ্দুস ও লাবু নামে দুই লম্পট নয়নাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যেতে থাকে। লোক জানাজানি হলে তারা নয়নাকে বিলের ধারে ফেলে পালিয়ে যায়। পরদিন গ্রাম্যসালিসে তাদের নির্দিষ্ট অঙ্কের জরিমানা ধার্য করা হয়। কথা হয় তিনদিনের মধ্যে এই টাকা উঠিয়ে শমসের মন্ডলের মাধ্যমে নয়নার মাকে দেয়া হবে। কিন্তু বেঁধে দেয়া সময় দশবার পার হয়ে যায়। নয়নার মা শান্তি বারবার তাগাদা দিয়েও টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়। শেষবার শমসের মন্ডলের কাছে গেলে তার সুর বদলে যায়। সে তার দুই মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে টাকা আদায় করে দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। নয়নার মা মন্ডলের মেয়ে দুটোর মধ্যে নিজের মেয়েদের দেখতে পায়। তার মাতৃত্ববোধ প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে ওঠে। সে টাকার দাবি ছেড়ে দেয়। গল্পটিতে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। সমাজে অসহায় দরিদ্রদের লাঞ্ছনা-বঞ্চনার আবহমান ধারা।

‘ছৈরুদ্দি বৃত্তান্ত’ গল্পে মোহাম্মদ ছহির উদ্দিন প্রামানিক নামের সরল গ্রাম্যযুবকের জীবন বিড়ম্বনা চিত্রিত করেছেন লেখক। ছহির উদ্দিনের নাম কালানুক্রমে ঘটনাক্রমে ছৈরুদ্দিন, ছৈরুদ্দি, ছরদ্দি, ছয়রুদ্দি, গুয়া, পচা, ব্যাটারি, বিবিসি লন্ডন, বাটাল থেকে সর্বশেষ ছ-কলায় এসে ঠেকে। বিয়েবাড়িতে বৌভাতে বাজি ধরে পায়েস খেয়ে ডায়রিয়া হয়েছিল তার। লোকচিকিৎসা মতে বিচেকলা খেলে ডায়রিয়া ভালো হয়। তাই ছৈরুদ্দি বাজারে দু’হালি বিচেকলা কিনে দোকানে বসেই একদমে ছ’টা কলা খেয়ে ফেলেছিল। তাতে নাকি তার ডায়রিয়া ভালো হয়ে গিয়েছিল। একথা সে শিশুসুলভ সরলতায় সবাইকে বলে বেড়িয়েছিল। এতে সবাই তাকে ছৈরুদ্দি-ছয়কলা শেষে শুধু ছ-কলা বলে ক্ষেপাতে থাকে। ফলে ছৈরুদ্দির বাইরে বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। গরীব মানুষ ঘরের চাল টাকা সব শেষ হয়ে গেলে বৌ তাকে কথা শোনাতে যায়। ছৈরুদ্দি বাচ্চাছেলের মতো কেঁদে ওঠে। ছৈরুদ্দির ভালোমানুষি ছেলেমানুষির জন্য পাড়ার লোকেরা তাকে ক্ষেপায়। বউ এটা বুঝে সমব্যথী হয়ে ওঠে। তার মনে জেগে ওঠে স্বামীর জন্য দরদ আর এ সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

‘কানামতির দেখা না দেখা’ গল্পে মতিমিয়া ওরফে কানামতির বড়জামাই আবু কালাম। বড়মেয়ে মারা গেলে মেজমেয়ের সাথে আবু কালামের বিয়ে হয়। এক পর্যায়ে বড়জামাই তার সার-ওষুধের ব্যবসা শ্বশুরের গ্রামে স্থানান্তর করে নিয়ে আসে। ব্যবসা ভালোই জমে ওঠে। আবু কালামের মেজভাই আবু জামাল নানা প্রয়োজনে বড়ভাইয়ের শ্বশুরের বাড়িতে যাতায়াত করত। ধীরে ধীরে আবু জামাল মতিমিয়ার ছোটমেয়ে সোহেলীর সাথে গভীর প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে। এদিন সন্ধ্যার পর আবু জামাল সোহেলীর সাথে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করে। এ সময় মতিমিয়ার বউ দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। বাড়িতে লোকজন জমে যায়। আবু জামাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে থাকলে গ্রাম্যটাউট তোজাম্মেল তাকে ধরে বেদম পেটাতে থাকে। এক পর্যায়ে কাজী ডেকে ওদের বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হয়। পরদিন তোজাম্মেল একথা গ্রামের সেলুনে গিয়ে বলে চুল আঁচড়িয়ে বীরদর্পে চলে যায়। উপস্থিত বয়স্ক হায়দার মিয়া তাচ্ছিল্য করে বলে ওঠে, ‘তুমারে এভাবে বিয়া দেওয়ার লোক নাই তাই বাঁচ্যা যাচ্চো।’ হায়দার মিয়ার কথায় মানব চরিত্রের একটি বিশেষ দিক ফুটে ওঠে। মানুষ নিজের হাজার দোষ থাকলেও তা দেখতে পায় না। সে মানুষই অন্যের অনুরূপ দোষে সোচ্চার হয়ে ওঠে।

গণিকাবৃত্তি একটা প্রাচীন পেশা। তবে এ পেশায় কেউ শখ করে আসে না। জীবন-জীবিকার তাগিদে নিতান্ত নিরুপায় হয়েই মানুষ এ পথে আসে। ক্রোড়চ্যুত হয় সমাজের, সভ্যতার। জৈবিক চাহিদার তাগিদে সবাই তাদের কাছে গেলেও সমাজে গণিকাদের কোনো ঠাঁই নেই। সবাই তাদের হীন চোখে দেখে। কেউ কেউ তাদের ব্যবহার করে ধার্য পাওনাটুকুও দেয় না। এমনকি নির্মমভাবে হত্যা করে। লেখক ‘ফুটপাতে কেউ নেই’ গল্পে এমনই এক হতভাগ্য গণিকার জীবন-যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি আমাদের গোচরে এনেছেন হার্দিক দরদ দিয়ে।

আমাদের দেশে অপরাজনীতির ছত্রছায়ায় কত তরুণ যে বখে যায় তার ইয়ত্তা নেই। অল্পবয়সে অনেক টাকা-কড়ির মালিক হয়- ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, বেশভূষা, চালচলন, খাওয়া-দাওয়া, ওঠাবসা, কথাবার্তা সবকিছু রাতারাতি পরিবর্তন হয়। সে হয়ে যায় অন্য জগতের মানুষ। তাদের হাতে থাকে প্রচণ্ড ক্ষমতা। যার ফলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে না। এহেন অপকর্ম নেই যে ওরা করতে পারে না। তারপর একদিন ওরা হারিয়ে যায় নষ্ট রাজনীতির অতল চোরাবালিতে। গল্পকার এ বইয়ের শেষ গল্প ‘পাশের বাড়ির ছেলে’ গল্পে এরকমই দরিদ্র মা-বাবার এক বখে যাওয়া ছেলেকে যত্ন করে এনে তার গল্পের চরিত্রে রূপদান করেছেন। আরজু নামের সেই ছেলেটাও অকালে হারিয়ে যায়। ক্রমে বাবা-মা’র চোখের জল শুকিয়ে যায়। মানুষের স্মৃতি থেকে তার নাম ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যেতে থাকে। সমাজ-সভ্যতা আগের মতোই চলতে থাকে অজানা গন্তব্যের দিকে।

‘স্খলনকালের গল্প’ বইটির প্রতিটি গল্পই পাঠকের যাপিত জীবনের অংশ বলেই প্রতীয়মান হবে। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও বিস্মৃতিপরায়ণ মানুষ গল্পগুলো নিয়ে বারবার ভাববে। ‘উইপোকা সাদৃশ্য’, ‘একটি অমীমাংসিত গল্প’, ‘শেষ প্রহরের গল্প’, প্রতিটার কাহিনি আমাদের চারপাশে ঘটে চলা ঘটনার প্রতিচ্ছবি। পাঠক চরিত্রগুলোকে সহজেই খুঁজে পাবে তার নিজ সমাজে চেনা মুখগুলোর মাঝে।

একজন প্রচারবিমুখ নিরিবিলি জীবন-যাপনে অভ্যস্ত মানুষ হলেও গল্পকার সমাজের প্রতি তার দায়বোধ থেকে সরে আসেননি। পরম মমতায় সমাজের স্বরূপ তিনি নির্মাণ করেছেন, যা আমাদের বোধে ঘা দেয় আর প্রবৃত্ত করে সমাজের গায়ের ক্ষত সারাতে। প্রেরণা দেয় মানবিক হতে, মানুষকে ভালোবাসতে, সত্যিকার মানুষ হতে। ভাষার ব্যবহারে দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন লেখক। প্রমিত বাংলায় লেখকের বয়ান আর চরিত্রগুলোর মুখে আঞ্চলিক ভাষার স্ফুর্ত ব্যবহার গল্পগুলোকে প্রাণবন্ত করেছে। কোথাও কোথাও লেখকের বয়ানেও আঞ্চলিকতার ঝোঁক লক্ষ করা গেছে। তবে তা বলার ঢং আর বুননের দক্ষ গাথুনির কাছে উতরে গেছে। বইটির বহুলপ্রচার কামনা করি।

আহমেদ টিকু

সরকারি হাজী জামাল উদ্দিন কলেজ,

পো.+উপজেলা: ভাঙ্গুড়া

জেলা: পাবনা।

+ posts

Read Previous

সমুদ্রের নীলজলে সাঁতার দেয় কবিমন

Read Next

দু’টি বইয়ের আলোচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *