জ্যাসপার গার্সিয়া লাভিয়ানার দুটি কবিতা-
জ্যাসপার গার্সিয়া লাভিয়ানা
জ্যাসপার গার্সিয়া লাভিয়ানা। জন্ম ১৯৪১ সালে। নিকারাগুয়ার ধর্মযাজক, কবি। লাভিয়ানা গ্রামের কৃষক ও দরিদ্র জনসাধারণের ভেতরে কাজ করতে গিয়ে অবর্ণনীয় শোষণ ও অত্যাচার প্রত্যক্ষ করে সে সবের প্রচণ্ড সমালোচক হয়ে ওঠেন। লিবারেশন থিয়োলজিতে বিশ্বাসী লাভিয়ানাকে সামোজার ন্যাশনাল গার্ড দুবার গোপনে হত্যার চেষ্টা চালায়। তিনি দেশত্যাগ করে কোস্টারিকায় পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। ১৯৭৮ সালে কোস্টারিকা সীমান্তে সান্দানিস্তা গেরিলা বাহিনীর হাতে তিনি নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর নিকারাগুয়ার খ্যাতনামা কবি আর্নেস্তো কার্দেনালের তত্ত্ববধানে তাঁর লেখা পত্র ও কবিতাগুলি সংকলিত হয়।
সরোবরে ধ্যান
নদীতীরে ধ্যানস্থ এই তোমার থেকে আমি বহুদূরে
সুরচ্যুত স্বরলিপি বাঁধছি এখন পুনরায় সুরে সুরে
অবিরাম ঢেউ বুনছি নিবিড় শব্দ ফুরে ছন্দে ও ভাষায়
যেমন ছিল সে লিপি পেলাম ফেরত পুনঃতরঙ্গ আসায়
সরোবর ফের পাঠ করে যায়
জল নাচিয়ে ফেনায় ফেনায়
আবার বলে এবং আবার কণ্ঠে তুলে সেই নাম অবিরাম
মুক্তি মুক্তি মুক্তি মুক্তি মুক্তির সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম!
জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড
দাঁড়াই যখন জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের পাশে
নিজেকে আমি ভাবি এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড।
বিপ্লবে জ্বলে ওঠে দুটি চোখ আমার
দুটি চোখ আমার যেন হায়েনার চোখ
আঙুলের আড়ালে লুকিয়ে রাখা ছোট চাকু
যেন সিংহের নখর, যেন ঈগলের ঠোঁট।
সম্মিলিত জনতার সম্মুখে দাঁড়াই যখন
রক্তে আমার নাচে বিদ্রোহ আর বিপ্লব।
২) আলবেনিয়ান কবি ইসমাইল কাদারে’র দুটি কবিতা-
ইসমাইল কাদারে
ইসমাইল কাদারে; আলবেনিয়ান কবি, ঔপন্যাসিক, রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী। ২৮ জানুয়ারি, ১৯৩৬ সালে আলবেনিয়ার জিরোকাস্তারে জন্মগ্রহণ করেন এই মেধাবী লেখক। ইসমাইল কাদারের বাল্যকাল কাটে আলবেনিয়ার জিরোকাস্তারে। সেখানে স্কুলজীবন শেষ করে ভাষা ও সাহিত্যে পড়াশোনা করেন তিরানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও দর্শন ফ্যাকাল্টিতে। এরপর ভর্তি হন মস্কোর গোর্কি ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার্ল্ড লিটারেচারে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন সাংবাদিকতা। আলবেনিয়ান কম্যুনিস্ট, ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসন ও শোষিত মানুষের চিত্র তাকে তীব্রভাবে নাড়া দেয়। ১৯৫৭ সালে লিখে ফেলেন প্রথম কবিতার বই ‘ড্রিমস’ যা মস্কোতে প্রকাশিত হয়।
তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হলো দ্য ওয়েডিং (১৯৬৪), দ্য ক্যাসেল (১৯৭০), ক্রোনিকল ইন স্টোন (১৯৭১), ব্রোকেন এপ্রিল (১৯৮০), দ্য পিরামিড (১৯৯২) ইত্যাদি। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক কারণে ও ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লেখার অভিযোগে তার বই প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। এমনকি তার বিদেশ ভ্রমণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল বহুকাল। ১৯৯৬ সালে তিনি ফ্রান্সের একাডেমি অব মোরাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের আজীবন সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজসহ অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেছেন তিনি। নোবেল পুরস্কারের জন্যও তাঁকে মনোনীত করা হয়েছিল, কিন্তু শেষে দেওয়া হয়নি। তার বই পৃথিবীর পঁয়তাল্লিশটিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
জলপ্রপাত
খাড়া জলপ্রপাতের ধারাগুলো
তেজি সাদা ঘোড়ার মতো নেচে নেচে নামে নিচে,
তাদের ফেনিল, বর্ণিল কেশরগুলো যেন রঙধনু।
কিন্তু অকস্মাৎ, পাহাড়প্রান্তে
সামনের পাগুলোর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল,
আহা, ভেঙে গেল তাদের শুভ্র সফেদ পা,
এবং তারা পাথরের লাথি খেয়ে মারা গেল।
এখন তাদের পলকহীন মৃত চোখগুলোয়
তুষারশীতল আকাশের প্রতিবিম্ব।
ট্রেনের সময়সূচি
ছোটখাটো স্টেশনগুলোর ট্রেনের সময়সূচি ভালো লাগে আমার
স্যাঁতসেঁতে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অসংখ্য, অসীম রেললাইন অধ্যয়ন করি।
হঠাৎ গর্জন, পায়চারি থামে। কেউ চমকে ওঠে মুহূর্তখানেক, কী হলো?
(যেন কেউ বুঝতে পারে না স্টিম ইঞ্জিনের অস্পষ্ট ভাষা)
যাত্রীবাহী ট্রেন আসে। মালগাড়ি চলে যায়। দামি আকরিকসহ কত
মালবাহী ট্রেন, যারা একে একে আসে, যায়, সমাপ্তিবিহীন।
এভাবেই কেটে যায়, আমাদের জীবনের দিন
যার যার স্টেশনে। চেঁচামেচি, কোলাহল ও সিগন্যালপূর্ণ স্টেশন
যেখানে চলাচল করে স্মৃতির আকরিক বোঝাই সব মালবাহী ট্রেন।
৩) বেই দাও: চিনের মরমী কবির দুটি কবিতা-
বেই দাও একজন নির্জনতাপ্রিয় কবি। চিনের যে ক’জন কবি কবিতায় মরমীবাদ আগলে রেখেছেন, কবি বেই দাও তাদের মাঝে একজন। বেই দাওকে বলা হয় রহস্যবাদী কবি।
বেই দাও শব্দটির অন্য উচ্চারণ ‘পেই তাও’ এবং শব্দটির অর্থ ‘উত্তরের দ্বীপ’। কবির জন্ম ১৯৪৯ সালের ২ আগস্ট বেইজিংয়ে হলেও কবির শিকড়টি চিনের উত্তরের একটি দ্বীপে প্রোথিত। বেই দাওয়ের প্রকৃত নাম ঝাও ঝোনকাই। কবি নির্জনতা পছন্দ করেন বলেই হয়তো ‘বেই দাও’ ছদ্মনামটি বেছে নিয়েছিলেন। মরমী এ কবি চিনের লোকদের হৃদয়ে আসন করে নিয়েছেন।
সময়ের গোলাপ
যখন দারোয়ান নিদ্রিত থাকে ফটকে
আর তোমরা দলবেঁধে ঝড়ের সাথে বাড়ি ফিরে আসো
এই যে আলিঙ্গনে চলার বয়স- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
যখন পাখিদের চলাচল আকাশকে সাজায়
আর তোমরা পেছনে তাকিয়ে সূর্যাস্ত দেখো
এই যে অন্তর্ধানের মাঝে প্রত্যক্ষ- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
যখন তলোয়ার বেঁকে যায় ডুবো জলে
আর তোমরা ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে তোলো বাঁশিতে সুর
এই যে বাঁধাবিঘ্নে সজোর আর্তনাদ- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
যখন কলম আঁকে দিগন্তের রেখা
আর তোমরা প্রাচ্যের ঘণ্টাধ্বনিতে বিস্ময়ে জেগে ওঠো
এই যে ধ্বনির অনুরণনে কম্পন- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
মনের আয়নাতে বিম্বিত যে-কোনও মুহূর্ত
যা পৌঁছে দিতে পারে পুনর্জন্মের দরজায়
খুলে দিতে পারে সাগরের কপাট- তা হলো
সময়ের গোলাপ।
ফিরে আসা ধ্বনি
আকাশের পাখিগুলো সোনালি আলোতে উড়ে
ফিরে এসে বসে পাহাড়ি গাছের ডালে
রাতের ফানুসগুলো নিভে গিয়ে
পড়ে যায় মাটিতে।
আমাদের ডাক, হে প্রভু, ফিরে যায় তোমার কানে।
আমাদের চিৎকার পাহাড়ে সাগরে নদীতে
কত ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে পুনরায়।
হে প্রভু, তোমার গোপন সুর ফিরে যায় তোমার কানে।