অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আনোয়ার রশীদ সাগর -
আনোয়ার রশীদ সাগর – গুচ্ছকবিতা

অন্তর্দাহ

রাতের চন্দ্রহাসি হেসে হেসে স্বপ্নময় করে ঘুম,

ঘুমের রাজ্যে পাখামেলে ঝিঁঝিঁ-ঝাউগাছ ছাড়িয়ে

উড়ে উড়ে জুড়ে বসে শূন্যের শ্মশানে;

আকাশ তো নয়, শূন্যতা চারিদিকে চোঁ চোঁ করে—

অস্পষ্ট ভোঁভোঁ শব্দের সান্ত্বনা খুঁজে খুঁজে ফিরে

অদৃশ্য অলোকে শুধু দুঃখদের বসবাস সেখানে বা

এখানেও।

প্রাচীন পদ্যের পদে পদে পাখা ঝাপটিয়ে ঝাঁজালো

এক মোহময় মদির মাহাত্ম্য মহাশূন্যেই খুঁজে খুঁজে ফিরি;

মধ্যরাতের মহাপরিব্রাজক— বিপ্লবীর ঘোড়দৌড়ে

সূর্যাধার ডিঙিয়ে

পৃথিবীতে ফিরতে চাই সাম্যবাদের জয়গান নিয়ে।

খসে খসে পড়ে পড়ে ভেঙেচুরে বৃক্ষমূলে জন্মাবার

নতুন গল্পের উল্টোপিঠে উপেক্ষিত (আমি) আত্মঘাতী হই,

দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘশ্বাসে আলো দেখি— আলোকিত করি

কৃষ্ণগহ্বর,

অবশেষে জেগে দেখি স্বপ্ন নয়, রাত নয়, পূর্ণিমাও নয়;

জ্বলন্ত এক মস্তিষ্ক বিচ্ছুরিত বিস্তীর্ণ দুরভিসন্ধি

অভিসারে অভিমানে অবয়বহীন এক ব্যর্থ কুরুক্ষেত্র।

 

রঙহীন অভিমান

জানালায় শামুকের কোলাহল

ভেসে ভেসে লেগে থাকে জোঁকের মতো ফ্রেমে,

বৃষ্টিভেজা শরীরে চকচকে আলোকবর্তিকা

ভেঙে ফেলে প্রাচীরের পাথর।

লালার জলরং ছাপে স্বপ্নেরা উড়ে উড়ে

মেঘের ভেলায় খেলে যায় খেলা,

গোধূলির কাশবনে জলোচ্ছ্বাস হয় দিকে দিকে

নবান্নের আগত ঠোঁটে সাইক্লোন ভেঙে ভেঙে

চন্দ্রবাতাস হয় গ্রিলে।

আশ্বিনের সংসারে ঝাপটা ঝাপটেও শামুকের

চন্দ্রভাসা ঢেউয়ে—

ভরাডুবি হয় এলোচুলের জঙ্গলে

আহা মধ্যরাতের অপেক্ষা স্বপ্নলোকে,

ধানে-ঘাসে খুলে খুলে খসে পড়ে মেঘবালক

ভবঘুরে জীবনের দৃশ্যঘাতী সুখে এঁটে থাকে

দূর্বামাঠে।

ঝিঁঝিঁদের বিন্দু চোখে আঁকেনি সঙ্গম

যৌনাচারের বাঁশিতে সুর তোলে মাকড়সার জাল

কাকাতুয়া কৃষ্ণকলির মতো অভিসারী হয়,

জ্যোৎস্নামাখা মুখে নরম তুলোর জোড়ালাগা

ফাঁদে—

পরস্পর ঈশ্বরের ঘনঘটায় পরিযায়ী মন

গুনগুন গণিতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে হয় রক্তাক্ত ভ্রুণ।

 

আকাশ হব

তুমি আমি একদিন আকাশ হয়ে যাব

নীল আকাশে নীলাভ শাড়ি হয়ে মেঘে মেঘে সাঁতার কাটব।

ভাদরের আদরে সিঁদুর মেঘে ভেসে ভেসে সোনালি আলোয় আলোকিত হব,

কুসুম কুসুম বাতাসে ধীরে অতি ধীরে উড়ে উড়ে

শূন্য অরণ্যে রেখে যাবো স্মৃতিচিহ্ন।

তারপর আকাশ বেয়ে চন্দ্রালো এসে তোমার আমার

স্বপ্ন নিয়ে যৌবনের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তুলবে।

নির্জন এক শূন্যতায় আমাদের ভরিয়ে দেবে বাসন্তীয় ডাকে,

সে ডাকে ঝরাপাতার ঝরঝর সুরের মাঝে হেসে উঠবে নতুনের হাসি।

আবার,

তুমি আমি আকাশ হয়ে যাব—

বৃষ্টিমাখা দুপুরে ভিজে ভিজে ঝরে পড়ব

আমন ধানের সবুজ মাঠে, সেখানে ডাহুকের  বাসায় হারিয়ে যাব, হারিয়ে যাব সবুজের বনে

কলরবে পাখিরা স্বাগত জানিয়ে উড়ে যাবে, হারিয়ে যাবে আমাদের প্রেমময় জীবনের সাথে।

শুধু আমরাই জেগে রব এ পৃথিবীর দূর আকাশের নীল সমুদ্রে।

তারপর আ-বা-র আকাশ হব।

 

অস্পষ্টতা

মাঠে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, দূর-সুদূরে,

চেনা-অচেনা সব জায়গায় শুধুই অন্ধকারে দেখি।

এ সংসার অন্ধকারের, এ জীবন অন্ধকারের,

অন্ধকার পথচলায়;

কৃষক-কৃষাণীর বুভুক্ষু চেহারায় অন্ধকার,

মুটে-মজুরের ঘাড়ে অন্ধকার

চারিদিকে অন্ধকার ও অন্ধকারের ছায়া।

জনতার সুখ-দুঃখে, হাঁটা-চলায়, কথায় বলায়ও

ঘোর অন্ধকারের তীব্রতা,

মা-বাবা, ভাইবোন, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, প্রতিবেশী

কাউকে দেখি না অন্ধকার সরাতে

সকলেরই চোখে-মুখে আতঙ্কের বিস্ফোরণ;

তাহলে কি বিস্ফোরণ হবে কখনও!

কখনও বিগ-ব্যাংয়ের মতো

বিস্ফোরিত হতে হতে আঁধারের ছায়া হারাবে, খুঁজে পাবে নতুন যুগের ঠিকানা?

আমি অন্ধকারের রহস্য বুঝতে পারি না

বুঝতে পারি না অন্ধকারের চলার পথ।

 

জীবনের সংজ্ঞা

ছায়ার ভিতর ছায়া দেখলে

দেখা যায় স্তরের পর স্তর সাজানো

জীবনের স্বপ্নালোক।

জলের ভিতর জল দেখলে

দেখা যায়  গভীরে হাঁটাহাঁটি করে

অনেক পথ গেছি চলে।

জীবনের ভিতর জীবন খুঁজলে

নিজের অস্তিত্ব ফিরে পাওয়া যায়

ফিরে পাওয়া যায়  অসীমের ঠিকানা

বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে ছায়া দেওয়া যায়

মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে।

দেওয়া যায় না আবেগ অনুভূতি ও টুকরো স্বপ্ন,

সুখ বা দুঃখভরা ছায়া জেগে থাকে

বেঁচে থাকে নিরন্তর পথচলায়;

এও এক জীবন

যে জীবনের পূর্ণতা পায় না কোনোকালে

কোনোদিনও।

 

বৃক্ষ

মৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে

বৃদ্ধ বৃক্ষের মতোন

অবহেলা আর অনটনে

চলে যায় সময়; আমার

নবপ্রজন্মেরা স্বপ্নে বিভোর আগামীর জন্য।

চৈত্রখরায় বাকল খসে খসে পড়ে

হলুদ ক্যানভাস আঁকে প্রবীণ চোখে

পাতাদের সংসার ক্ষয়ে ক্ষয়ে  মাটির বুকে

আছড়ে, ভেঙে ভেঙে পড়ে শরীর-অরণ্য।

নতুন জয়োৎসব চারদিকে—

চকচকে রোদে উত্তরাধিকার সূত্রে গাঁথা

জীবনবৃত্তান্ত নামের সঙ্গীত।

বৃক্ষের ছায়া ও স্বপ্ন, ব্যথাতুর জীবনের গল্পে—

দেখে দেখে নাটকের মঞ্চ মনে হয়

পৃথিবীর আয়ুষ্কাল ভর।

আমি কী যৌবনে যৌক্তিক গাছ ছিলাম!

সে গাছের ছায়ায় ঘুরে ফিরে বেড়ে উঠেছে প্রজন্ম!

সে প্রজন্মেরই কোলাহল দিকে দিকে!

সমাপ্তি

আঁধারের বিরানভূমি ছুঁয়ে  চন্দ্রালো পূর্বদিগন্তে উঁকি দিতে শুরু করেছে

দীর্ঘ বৃক্ষছায়া অবনত শিরে ছোটো হয়ে আসে মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে

মৃত্যুর সারিতে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ কঙ্কাল সার খেজুর গাছটি নিঃশব্দে বুকের পাঁজর ভেঙে ভেঙে  স্মৃতির পতাকা উড়াই—

ভরা যৌবনে কত কত মাটি খোঁড়া কৃষক শরীর চষে চষে রসে রসে ভরে নিত কলস

কখনোবা সে রসের রসালো কলসে পরকীয়ায় মেতে উঠতো কিশোর নাগর,

টসটসে সুস্বাদু স্তনে ঠোঁট লাগিয়ে চুষে চুষে হেসে হেসে পালিয়ে যেত

কৃষকের চোখ ফাঁকি দিয়ে।

যৌবনরসে এখন আর কেউ ধারালো ছুরি ধরে না

স্তনবোঁটার ওমওম কুয়াশাভরা জ্যোৎস্নায় মেতে ওঠে না গাঁয়ের পালানো কিশোর;

জীর্ণ শীর্ণ শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কাঁটাওয়ালা মাথাভরা রংচটা চিকন পাতায় বিরহিণী,

কখন অথবা কবে ইটভাটার গনগনে আগুনে পোড়াবে কেউ  হয়তো-বা

করবে টুকরো টুকরো, কুড়াল চালায়ে বাকলগুলো ছুলে ছুলে ফেলবে চুলার ধারে

অপেক্ষা এখন জীবনের পরিসমাপ্তির।

 

আনোয়ার রশীদ সাগর

চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা কোর্টপাড়ায় বসবাস।

পেশা : শিক্ষকতা।

কবিতা, গল্প ও উপন্যাসসহ মোট ২০টি বই প্রকাশিত হয়েছে।

arsagor1965@gmail.com

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

ঈর্ষা

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৬ষ্ঠ সংখ্যা (জুন-২০২৪)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *