অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

চন্দনকৃষ্ণ পাল – গুচ্ছকবিতা

 

 

বিষণ্ন তিথিগুলো-১২

চোখজুড়ে ঘুম নেমে এলেও
তোমার মুখের কাঠিন্য ভুলতে পারি না তো।
তন্নতন্ন করে কারণ খুঁজে দিন রাত্রি, বৃথা অনুসন্ধান!
বিনীতভাব উধাও হয়েছে পরিবর্তে বিদ্রূপ তাচ্ছিল্য
খেলা করে তোমার মুখায়বয়বে…
আমাকে আরোও বিষণ্ন করে আজকাল
মন্দ তিথির ভেতর দিয়েই যাত্রা শুরু হলো
শেষ জানা নেই, শূন্য হয়ে গেছে চরাচর
পূর্ণতার আশা নেই ভাবলেই
মন খারাপের পারদটা নিঃশব্দে অনেক উঁচুতে ওঠে
বিদ্রূপে মাতে, ভেঙচায়
আমার তুমুল মনোবলের সেই রোদমাখা দিনগলোকে।

তিথির মুণ্ডুপাত করে
সময়ের গায়ে রাখি ব্যর্থ পাঁচ আঙুল।

তুমি মানো কিংবা নাই মানো

এই স্নিগ্ধ সকালটি একান্তই আমার।

এখানে কারো চোখ রাঙানি নেই,
নেই অনুরোধ কোনো তদ্বিরের
ঘুমভাঙা পাখিদের কলকাকলি মগজকে প্রকৃত শান্তির
বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত
হাইরাইজের গায়ে এখনো একটু অন্ধকার লেগে আছে
হারিয়ে যাবার আগে জানান দিচ্ছে— রোদ্র ঝলসিত দিনে ভালো থাকিস।
পুব আকাশের গায়ে কী এক অসাধারণ রঙের প্রলেপ লাগছে
যার নাম জানা নেই বলে কোনো আফসোস নেই আমার
আমি জানি পৃথিবীর সব কিছু জেনে নেয়া আমার কম্ম নয়।
আর পাশে শুয়ে থাকা সুপ্তির ঘুমতৃপ্ত শান্ত মুখ
আর এই সকালের স্নিগ্ধতা একাকার হয়ে গেছে বলেই
এই স্নিগ্ধ সকালটি একান্তই আমার
সেটা তুমি মানো কিংবা নাই মানো।

ভিন্ন রুটে পদযাত্রা

অচেনা এই গোপাট ধরে হেঁটে যাই সকাল দুপুর সন্ধ্যে
নিবন্ধন করা দলিলাদি মূল্যহীন হয়ে যায় সহসাই
আমি চড়ে বসি ভিন্ন রুটের বাসে!
শাহবাগ-কাঁটাবন-জিগাতলা ছেড়ে এসে শংকরে থামি।

বাংলা একাডেমি অবাক তাকিয়ে রয়
তার চত্বর ছেড়ে হেঁটে যাই শাহবাগ পানে
প্রকৃত রুটের বাস অবাক তাকায়, আমি চড়ি ভিন্ন রুটে
গরমভাতে ফুঁ দিয়ে ভর্তা মেখে গলাধঃকরণের কথা পাল্টে যায়—
ক্লাসিক হোটেলের নান আর সব্জিতে অবলীলায় মগ্ন হয়ে যাই
সাথে গাঢ় দুধ মেশানো এক কাপ চা!

আজকাল এই হয়, হচ্ছে।
ভবিতব্য বুঝি এর নাম?

জায়গা বদল

উনিশ বছর ধরে জমে ওঠা যত জঞ্জাল
সব কিছু ভ্যানে তুলে আজ আবার জায়গা বদল
রিকশায় পরিজন, মুখে মাখা বিষাদ আবীর
পুরনো সে স্থাপনার জন্য ভালোবাসা?

আমি তো উদ্বাস্তু এক, আজ এখানে
কাল আবার অন্য স্থাপনায়
দুহাতে পারিনি আমি লুটে নিতে অর্থ বিত্ত ধন
ঘাড়ে ঋণের বোঝা, প্রতি মাসে সুদের দহন
পোড়ায় রাত্রি দিন অভাবের লাল চোখ ঐ….।

অনেকের বিদ্রূপে আহত হই নিয়মিত, তারপরও
এই হাত এগোয় না বিত্তের নকশাকাটা নিটোল জমিনে
তুলে নিতে কিছু শস্যকণা….।

খুব বেশি বাকি নেই,
জানি আমি বিদায়ের দিন এল আঁধারকে নিয়ে
তারপর?
তারপর সব কিছু গাঢ় অন্ধকারেই হবে যে বিলীন।

অলকানন্দার ব্রিজে ধূসর সকাল

খুব সাজানো গোছানো ছিলো স্বর্ণ বিকেল
আজ ভোরে এসে দেখি সব কিছু ছড়ানো ছিটানো
কার হাত ভেঙে চুরে রেখে গেছে সদাহাস্য এই প্রিয় মুখ
কার মনে হিংসার অন্ধকার সারাক্ষণ মেতে থাকে
ভেবে ভেবে সারা হই জবাব মিলে না!

সবুজের মখমলে ছাওয়া ছিল তার চারপাশ
তার সাথে পাখিদের নানা রঙ কথা,
কথাই তো, পাখিদের নিজেদের কথা
তার সাথে মিশে আছে আমাদের হিংস্রতার রেশ
তা না হলে তীব্র চৈত্র দিনে কুয়াশা মেলবে কেন
নিজেদের ডানা?

ধ্বংসের প্রান্ত ছুঁয়ে থেমে আছে স্বপ্নের দিন
তার গায়ে কুয়াশা রোদন, ঘুম ভেঙে কী দেখি?
এমন তো হতে পারে না জেনে আরো বেশি
ঝাপসা দেখতে থাকি এই দুই চোখে—
আমার অলকানন্দা ব্রিজে ঝড়ের তাণ্ডব রেখে
যারা গেছে লাভের বখরা নিয়ে আনন্দের পথে
তাদের জন্য আজ অভিশাপ রেখে যাই
বজ্রপাতের কাছে তারা ঠিক নতজানু হবে
তার আর খুব দেরি নেই…।

নির্মাই শিববাড়ী

বিলাশ পার হলেই আজ আর ছায়া নেই
ধূসরতার স্থায়ী আবাস দশদিকে
ন্যাড়া পাহাড়গুলো বেকুবের মতো তাকায়
আর অভিশাপ দেয় দুপেয়ে পশুগুলোকে!
পীচঢালা পথে পথে টেম্পুরা বিষ ছড়ায়
আঠারো ঘণ্টা প্রতিদিন
দুপেয়েরা আহ্লাদিত
চোরাই পণ্যে নিজেরা টিলা হয় পাহাড় হয়
আর শিবঠাকুর ধ্যান ভেঙে
দুপেয়ের কর্মকাণ্ড দেখেন
হয়তো এক ফালি হাসিও তার
জঙ্গুলে মুখাবয়বে ফুটে ওঠে কখনোসখনো।
হাজার একর জমি লুটেপুটে
এখন ঢেকুর তোলে ঘৃণ্য মহাজন
তার চোখে আরো লোভ দেখি
লোল পড়ে জিহ্বা থেকে
চেটে খেতে চায় আরো ধানী জমি
শিবের পুকুর, পুকুরের পাড়, মন্দির
সব… সব কিছু…।
নির্মাই শিববাড়ি, শিবের পুকুর
একদিন শূন্য হয়ে যাবে?

রাত্রি-১

ঘুমের আড়াল থেকে বাঁশি শুনি রাতে
ঢেউয়ের পদধ্বনি অন্ধকারে আবার মাতাল
বাতাস এসে জানালায় শিস রাখে তার
পরিচিত মুখ মিশে গোপন পৃষ্ঠায় ।

রাত্রি-২

সদ্য জলে স্নান করা
ঘাসের শরীর ছুয়ে ছুটে এক ধুসর বিকেল-
নিজস্ব অন্ধকারে লুকিয়ে রাখে মেঘ
বিন্দু বিন্দু জল।
আবার অন্ধকার হাতছানি দেয়
আবার বাঁশরী বাজে ঐ পোড়া ঠোঁটে
মল্লার চন্দ্রিকায় রাত জমে থাকে।

রাত্রি-৩

তারপর অনন্ত রাত জল শব্দ, একা।
গড়িয়ে যাওয়া সবুজ কাণ্ড ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিরুদ্দেশে—
তারাজ্বলা আকাশ ছুঁয়ে আসা অবোধ্য
কথোপকথনে ঝরে এক দুই করে
যেন অশ্রু বিন্দু,
জানালায় দাড়ানো বৃক্ষ পত্রালিতে
তুলে আনে নীরব বেহাগ
এই অন্ধকারেও আগুনরঙা শাড়ি
উৎসবে দেখা মুখ হায়।
পুরাতন সাঁকো যদি নিভৃতে খুলে ফেলে
সমস্ত বন্ধন
প্রভাতে মানব নির্বাক
এই হওয়া ভালো, কোনো অভিযোগ নেই।
সব মুছে গেলে শুধু জল শব্দ
রাত জাগে একা নৈশ প্রহরী
জানালায়, পত্রালিতে কুয়াশার একক রোদন,
এই হওয়া ভালো।
উৎসবের দেবী মুখ চন্দ্রের আত্মজা।
অন্তিম পৌষ ভোর
গতরাত জানান দিয়েছে
এই ভোর চোখ খোলা তাই
পুকুর ছাড়ছে ধূম্র অযুত কুণ্ডলী
ভীস্মের রাত শেষ
এবার দাহ্য হবে অদৃশ্য শরীর
জলপরী কই থাকে
তার দেখা পাওয়া গেল না যে।
আগুন লাগল যতুগৃহে
হট্টগোলের মাঝে
জলের শব্দে নাচে আনন্দের স্রোত
কিশোর অবাধ্য হলো ঐ।
জল ছাড়ে ধূম্রকুণ্ড
ধূম্র ছাড়ে ভেজা লতা পাতা
অগ্নির জিহ্বা চাটে ধূম্রের ঢেউ
অগ্নিতে দৃষ্টি রাখে রাতুল কিশোর।

নিজের কথা আপনমনে

চমকে উঠার কথা না থাকলেও আজকাল
চমকে চমকে উঠি।

স্কেল পড়ার সাধারণ শব্দও বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়
মনে হয় এটাই বুঝি ধ্বংসের প্রথম আলামত,
এসব কাউকে শেয়ার করি না আর
সবার কাছে ছোট হতে হতে আমি নিজকে চিনতে পারি না আর
চোখে না পড়া ঘাস ফুলের মতো অবস্থা এখন আমার
সবাই নির্দ্বিধায় পদদলিত করে সকাল বিকাল
আমার কষ্ট দেখে নীরবে চোখের জল ফেলে সেলফের বই
যাদের কেজি দরে বিক্রির সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে এসেছি গত সপ্তায়
আসলে ওরাই প্রকৃত আপনজন
ওদের চোখের জল আমাকে আপ্লুত করে
ওরা আমার সন্তানদের মতো উঁচু গলায় কথা
বলে আমাকে বিব্রত করে না কখনো।

আমি আজকাল নিজেকে জঞ্জাল মনে করি, মনে করতে হয়।
এটাই ভবিতব্য বলে মেনে নিতে
প্রাণপণ চেষ্টাতে নিয়োজিত রেখে রেখে
স্বস্তি খুঁজি সকাল দুপুর।

 

+ posts

Read Previous

রূপান্তরের গল্পগাথায় কঠিন বাস্তবের আবরণে অতলান্ত বিষাদ

Read Next

রুদ্র সুশান্ত – যুগল কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *