‘আবে ওই মাঙ্গের পোলা, আমি তোর বস নাকি তুই আমার বস? পুলিশকে কী কওন লাগব আমি বুঝি না!’
হাসমত কমিশনারের সকাল শুরু হয় গালিগালাজ দিয়ে। সকাল সাতটায় উঠে ড্রইংরুমের ডিভানে বসে যে উচ্চস্বরে ফোনে কথা বলতে শুরু করে, সেটা চলে বাড়ি থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত।
সাবিহা কতদিন মানা করেছে। মেয়েরা বড় হয়েছে এখন। ভালো স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে। এই ধরনের ভাষায় বাসায় কথা বোলো না প্লিজ। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
হাসমতকে ফোনে কথা বলতে দেখে সাবিহা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ভোরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বারান্দার মেঝে ভিজে আছে। ধুলার আস্তরণ চুপসে গেছে। কেমন একটা সোঁদা গন্ধ চারদিকে। সাবিহার অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়।
হাসমত ওদিকে উচ্চসরে কথা বলে চলেছে।
‘এটা আছলে ডিপেন্ড করতাছে দুইজনের ইন্টিমেসির ওপর। কিল্লাইগা কথাটা কইছি, এখন বুঝতাছস?’
হঠাৎ করে হাসমতের কথার ‘ইন্টিমেসি’ শব্দটা কানে আটকে যায় সাবিহার। ইন্টিমেসি মানে হলো ঘনিষ্ঠতা। আজ ভোরে সাবিহা একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে। যার সঙ্গে কোনোদিন ইন্টিমেসি ছিল না, ভালোভাবে চিনতেই পারেনি, সেই মানুষটাকে স্পষ্ট দেখেছে ও।
স্বপ্নে সাবিহা দেখে, ও ঘন লম্বা চুল মেলে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। ভেতরে বেডরুম থেকে বের হয়ে এল এক অচেনা পুরুষ। বয়স পঁয়ত্রিশের ওপর হলেও চেহারায় একটা আলগা তারুণ্য আছে।
‘এই সাদা শার্টটা অনেকদিন ওয়্যারড্রোবে পড়ে ছিল। আজ পরলাম। কেমন লাগছে বল তো?’
অচেনা পুরুষ জানতে চাইছে সাবিহার কাছে। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছে সে। মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ। চেহারায় তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। শুধু চোখ দুটি সারাক্ষণ হাসছে। স্বপ্নে যেমন হয়, তেমনি কেমন যেন স্থবির হয়ে বসে আছে সাবিহা। তবে ও বুঝতে পারছে লোকটা কেন এভাবে ওর সঙ্গে কথা বলছে। ও এই লোকটার স্ত্রী। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? ও তো হাসমত কমিশনারের স্ত্রী। পুরান ঢাকায় যার নামে বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খায়।
স্বপ্নে লোকটা এরপর সাবিহাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। কপালে আলতো করে চুমু খায়।
‘অফিসে যাই সাবিহা। কিছু দরকার হলে ফোন কোরো। দরকার না হলেও কোরো।’
এভাবে বিদায় নেওয়া সাধারণত নতুন দম্পতিদের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু স্বপ্নের মধ্যেও সাবিহা বুঝতে পারে, ওদের বিয়ে হয়েছে অনেক আগে। তার মানে স্বপ্নে ওর স্বামী ভদ্রলোক খুব রোমান্টিক। সাবিহাকে খুব ভালোবাসে।
লোকটা চলে যাওয়ার পরে বুকের মধ্যে কেমন যেন খালি খালি লাগতে থাকে সাবিহার। ঘুম ভেঙে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরেও অচেনা পুরুষের গায়ের গন্ধ পায় যেন ও। খুব চেনা মনে হচ্ছে লোকটাকে। কিন্তু কোনোভাবেই মনে করতে পারছে না কে সে!
‘কই গেলা আলিফ-মীমের মা! বৃষ্টি দ্যাখতাছ নাকি!’
ভেতর থেকে হাসমত জানতে চায়। এই বাড়িতে বৃষ্টি দেখার মতো মানুষ যে একজনই আছে সেটা সবাই জানে।
বারান্দা থেকে ঘরের ভেতরে এসে হাসমতের দিকে তাকিয়ে একটা লাজুক হাসি হাসে সাবিহা। লজ্জার কারণ কী বুঝতে পারে না ও। বৃষ্টি দেখছে কিনা বলায় কি লজ্জা পেয়েছে!
‘হাসতাছ কেন?’ হাসমত একটু অবাক হয়ে স্ত্রীর মুখে লাজুক হাসি দেখে।
‘ওই যে বললে না, আমি বৃষ্টি দেখছি কিনা!’ আসলে শুধু হাসমতের কথা না, কী কারণে যেন মন উথালপাথাল করছে আজ সাবিহার।
‘কেউ না জানুক, মাগার আমি তো জানি, আমার বিবি একজন শায়ের! খালি এই ছংসারের কাজের চাপে কিছু লিখবার পারল না।’
হাসমতের কথার সঙ্গে একমত হতে পারে না সাবিহা।
‘কোথায় কাজ দেখলে তুমি! তোমরা সবাই বের হয়ে গেলে আমার তো সারাদিন কোন কাজই থাকে না।’
হাসমত ইশারা করে লিভিংরুমের ডিভানে এসে সাবিহাকে বসার জন্য।
‘আহারে আমার বিবি ছারাদিন একা থাকে! লও টাকা লও। বাছাতে না থাইক্যা পার্লারে, মার্কেটে ঘুরবা। ছুন্দর কইরা সাইজা থাকবা। সবার হিংছা হইব। কত ছুন্দর বউ আমার!’
সাবিহা জানে হাসমতের ভালোবাসার প্রকাশ যাই হোক, তাতে কোনো খাদ নেই!
আবার খাদ নেই ভাবেইবা কী করে! ওই পাশের ফ্ল্যাটে হাসমতের বড় বউ থাকে। তার আবার পাঁচ ছেলেমেয়ে। যার তিনজনই ছেলে। সাবিহার দুই সন্তানই মেয়ে। এজন্য সতীনের কত টিপ্পনি।
‘রোজা তো শুরু হবে আগামীকাল থেকে। বাড়ির সবার জন্য ঈদের কেনাকাটা শুরু করতে হবে। টাকা তো লাগবেই।’ হেসে বলে সাবিহা।
হাসমত বউয়ের গালে হালকা টোকা দিয়ে বলে ওঠে, ‘কত টাকা লাগবে আমারে খালি কইবা। আমার বিবির তো ছবার জন্য খুব মহব্বত। বেবাকের জন্য কিনাকাটা না করলে তার মন ভরে না।’
পুরান ঢাকার বিশাল দুর্গের মতো বাড়ি— হাসমত ভিলা। বংশাল এলাকার সবাই এক নামে চেনে বাড়িটাকে। ছয় তলা বাড়িতে হাসমতের বাবা আর মা, তিন ভাই তাদের পরিবার নিয়ে বিভিন্ন ফ্লাটে থাকে। কোনো ভাড়াটিয়া নেই।
এই বিল্ডিংয়ে সাবিহার ফ্ল্যাটটিই সবচেয়ে সাজানো গোছানো। মার্বল পাথরের মেঝে। পুরো ফ্ল্যাটের ফিটিংসগুলো চোখ ধাঁধায়। প্রত্যেক রুমে দামি দামি ফার্নিচার। দুই মেয়ে মিম আর আলিফের বন্ধুরাও অবাক হয়ে যায় এই বাসার সাজসজ্জ্বা দেখে।
মিম নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। আলিফ আগামী বছর ও লেভেল পরীক্ষা দেবে। মেয়েরা খুব লক্ষ্মী হয়েছে। সাবিহার মনে হয়, এই তো ওর জীবন।
ছত্রিশ বছর বয়সে এত প্রাপ্তি কজনের হয়! না হয় হাসমত কমিশনার কিডন্যাপ করে এনে বিয়ে করেছিল ওকে। কিন্তু, পড়াশোনা শেষ করে, বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করলেই কি জীবন এরচেয়ে বেশি সাজানো গোছানো হতো!
সব চলছিল ঠিকঠাক মতো। শুধু গত রাতে দেখা স্বপ্নটাই এলোমেলো করে দিতে চাইছে সবকিছু। এমন একটা স্বপ্ন কেনইবা দেখল আর স্বপ্নের মানুষটিইবা কে মাথায় আসছে না ওর।
সাবিহা রান্নাঘরে ঢোকে চায়ের জন্য। চা ও নিজের হাতে বানায়। সকালে এক কাপ কড়া চা না হলে ওর দিন শুরু হতে চায় না।
রান্নাঘরের জানালা দিয়ে সতীনের রান্নাঘরও দেখা যায়। হাসমতের বড় বউ বিলকিস জানালার শিক দিয়ে তেরছা চোখে দেখছে ওকে। সব সময়ই তার নজর থাকে সাবিহা কী করে তার ওপর। কিন্তু তার দিকে তাকালে দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। কখনও স্বাভাবিকভাবে কথা বলে না সে।
‘সাবিহা ভাবি, দেখেন, দেখেন স্পাই চলে এসেছে। কেমন আড়চোখে দেখতাছে আপনারে।’
জানালার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে এনে সাবিহার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে বাড়ির গৃহকর্মী হাবিবা। এই বাড়ির দীর্ঘদিনের বাধা লোক হাবিবা কাজে কর্মে পটু হলেও কথা বলে বেশি।
হাবিবা বিরক্ত হয়। এই ধরনের আলোচনা ওর কাছে অরুচিকর মনে হয় সব সময়। সাবিহার বিরক্তি ধরতে পারে না— ‘কালকে ছাদে আনোয়ারারে ধরছিল বিলকিস ভাবি। আমরা কী রানছি আইজকা, কোন তেল দিয়া রান্ধি, আপনে কোন কোম্পানির চা খান— জিগাইতেছিল… হা হা হা।’
‘হাবিবা কথা বন্ধ করে নাস্তার টেবিল সাজাও। হাসমত আর মেয়েরা এখনই খেতে বসবে।’
রান্নাঘর থেকে বের হতে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ায় সাবিহা।
‘কাল থেকে রোজা শুরু হবে। ছোলা আর ডাল ভেজাতে হবে। আমি দুপুরে মীনাবাজারে যাব। তার আগে কী কী কিনতে হবে তার একটা তালিকা কর।’
‘আমি অখনই সব চেক করতাছি ম্যাডাম।’ হাবিবা হেসে বলে। কথা শেষ করে গান গাইতে থাকে। মেয়েটা একটু পাগলি ধরনের।
সাবিহা চায়ের কাপ নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। হাতে পেপার নিয়ে আবার রেখে দেয়। কিছু ভালো লাগছে না। মাঝে মাঝে ওর এমন হয়। ঘর পালানোর ইচ্ছে জেগে ওঠে মনে। আসলে নিজেই জানে না ও, আসলেই কি ও সংসারী নাকি বৈরাগী!
স্বামী আর সন্তানরা ডাইনিং টেবিলে বসার আগে গৃহকর্মীরা নাস্তার টেবিল সাজিয়ে ফেলে। একেক জনের জন্য একেক রকম নাস্তা। হাবিবা পাগলি হলেও ভালোভাবে জানে, কে কী খেতে ভালোবাসে!
‘আম্মু, আজকে পেপারে মেইন খবর কী?’ বড় মেয়ে মিম জানতে চায়।
‘মেইন খবর? আমি আসলে ঈদসংখ্যার বিজ্ঞাপন পড়ছিলাম। ঈদ এলে সব পত্রিকা ঈদসংখ্যা বের করে। আমি আসলে দেখছিলাম, কোন পত্রিকা কার উপন্যাস বের করছে!’ সাবিহা উত্তর দেয়।
‘ঈদে ছবাই সাড়ি-জামা-স্যান্ডেল নিয়ে ভাবে। আর তুমার আম্মু আছে ঈদছংখ্যার লেখা নিয়া। এই জন্যেই কই ছবার থিকা আমার বউ আলাদা।’
খিচুড়িতে মাংসের ঝোল মাখাতে মাখাতে হাসমত বলে।
আগামীকাল থেকে রোজা শুরু হবে বলে হাসমতের খায়েশ হয়েছে সকালের নাস্তায় খিচুড়ি-মাংস খাবার।
সাবিহা সকালে ভারী কিছু খেতে পারে না। চায়ের সঙ্গে একটা টোস্ট বা বিস্কুট খায় সকালে। খাওয়া দাওয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য দুই মেয়ের মা হওয়ার পরেও ও বেশ হালকা-পাতলা আছে এখনও।
হাসমতের সপ্তাহের পাঁচদিন কাটে সাবিহার ফ্ল্যাটে। বাকি দুইদিন বিলকিসের ওখানে থাকলেও বড় বউয়ের আচার-আচরণ হাসমতের অভিযোগ অনেক।
সবাই চলে যাওয়ার পরে সময় নিয়ে গোসল করে কাপড় মেলতে ছাদে ওঠে সাবিহা। কারণে অকারণে ছাদে ওঠা ওর আসলে খুব পছন্দের কাজ।
সাবিহার বাসায় আসলে তেমন কোনো কাজ নেই। হাবিবাকে সকালে রান্নার নির্দেশ দিলে হয়। আনোয়ারা সারাদিন ঘুরে ঘুরে ধোয়া-মোছার কাজ করে। হাসমত পুরোনো ঢাকার মানুষ হলেও মেয়েরা সবাই ধানমন্ডিতে ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করেছে। ওদের অবস্থা না ঘরকা, না ঘাটকা।
ছাদে একটা ছেলের ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্য দেখে একটা কথা মনে হলো সাবিহার। ওর সময়ে ঘুড়িতে প্রেমপত্র পাঠানোর রেওয়াজ ছিল শুনে মেয়েদের সে কী হাসি!
আচ্ছা, কাল রাতে স্বপ্নে যাকে দেখল, সে এভাবে প্রেম নিবেদন করেনি তো!
২.
বাসায় ফিরে সাবিহা অষ্টম আশ্চর্যকে বসে থাকতে দেখতে পায়। বিলকিস বসে আছে মাথায় ঘোমটা দিয়ে। সাবিহাকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে যায। চোরা স্বভাবের মানুষ কিছুটা ভীতু স্বভাবের হয়।
‘সাবিহা, তোমাকে না বলেছিলাম কিছু পুরোনো কাপড় দিতে। আমার ভাইয়ের ছেলে নিতে আসবে। রাখছ?’ কোনো ধরনের ভূমিকা ছাড়া জানতে চায় বিলকিস।
সাবিহা একদম ভুলে গেছে। বিলবিস বলার পরে অপ্রয়োজনীয় তথ্য ভেবে মাথার স্টোর জমা রাখেনি।
‘স্যরি। কাপড় তো জমিয়ে রাখিনি। আপনার ভাগ্নে কি এখন আসবে?’
‘ও তো এই এলাকাতে থাকে। দক্ষিণবঙ্গে বন্যাদুর্গতদের সাহায্য করার জন্য ভাগ্নে আর ওর বন্ধুরা মিলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করছে। তুমি তো ভালো ভালো জামা হাবিবা আর আনোয়ারাকে দিয়ে দাও। ওদের না দিয়ে ভালো কোনো কাজে তো দিতে পারো।’
সাবিহার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে। ওর জিনিস কাকে দেবে সেটা কি বিলকিসের কথায় হবে! ও বুঝতে পারে আসলে একটা ঝামেলা বাধাতে সাতসকালে এসেছে বিলকিস।
‘কী বললেন বিলকিস ভাবি?’ হাবিবার কানে কথা চলে গেছে ইতোমধ্যে।
সাবিহা দ্রুত বেডরুমে ঢুকে যায় বিরক্তি ঢাকার জন্য। মহিলার এসব কথা না বললে হতো না। এজন্য ওনার বাসায় কোনো গৃহকর্মী বেশিদিন কাজ করে না।
ওপরের তাকের ড্রেস নামাতে গিয়ে অনেকদিন আগে কেনা লাল একটা ড্রেস খুঁজে পায় সাবিহা। ড্রেসটা সুন্দর হলেও ডিজাইনটা পুরোনো হয়ে গেছে।
‘লাল ড্রেস পরার পরে তুমি কানের পেছনে কাজলের পিট দেবে। নয়তো নজরে পড়ে যাবে কারও। লালে যে তোমাকে কী অসাধারণ লাগে তুমি তো জানো না!’
বিদ্যুত চমকের মতো সাবিহার মনে পড়ল খালেদের কথা। ওকে লেখা প্রথম প্রেমপত্রের শুরুতে ছিল কথাগুলো। গতকাল রাতে ওই খালেদকে স্বপ্নে দেখেছে ও। সারা শরীর কেমন যে ঝিমঝিম করে উঠল সাবিহার। তাকিয়ে দেখল, শরীরের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গেছে।
ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে সাবিহা দেখল, বিলকিস চলে গেছে। আনোয়ারা জানাল, হাবিবার সঙ্গে ঝগড়া করে রেগেমেগে চলে গেছে কিছু না বলেই। সাবিহা এই নিয়ে চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিল। আনোয়ারাকে দিয়ে কাপড়গুলো পাঠাল।
ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল সাবিহা। চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে ভাবতে লাগলো খালেদের কথা। বুকের মধ্যে অচেনা এক কষ্ট এসে মোচড়াতে লাগল। দুচোখ পানিতে ভরে গেল। সাবিহা বুঝতে পারছিল না, বলা নেই, কওয়া নেই, এ কোন আজব হাওয়া ভর করল ওর শরীরে।
তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে বসে সাবিহা। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইচ্ছে করছে, বৈরাগী হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। আর ফিরে আসে না সংসারী জীবনে। হঠাৎ করে এমন অস্থিরতা কেন ঘিরে ধরল বুঝতে পারে না ও। যে মানুষটাকে নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামায়নি, সব সময় অপমান-অবহেলা করেছে, সে কীভাবে এমন সুনামি হয়ে এল এই ভরদুপুরে!
ড্রাইভার জাহিদকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলে দ্রুত তৈরি হয় সাবিহা। পুরান ঢাকার নারিন্দায় ছোট বোনের বাসায় যেতে হবে। গাড়িতে যাওয়ার চেয়ে হেঁটে গেলে দ্রুত যাওয়া যায়! তবু গাড়ি ছাড়া কোথাও যায় না ও।
হঠাৎ করে অবেলায় বড় বোনকে দেখে অবাক হয়ে যায় আফিয়া।
‘একটা কল দিয়া আইবা না আপা। তাইলে ভালা কিছু রান্না করতাম!’
আফিয়া অবশ্য মনে মনে বুঝতে পারে সাবিহা জরুরি কিছু বলতে এসেছে। কেমন যেন উদভ্রান্ত দেখাচ্ছে ওকে।
কোনো ভূমিকা ছাড়া সাবিহা বলা শুরু করে—
‘আমার তো তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গেল। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগেই। মানে তোর তো মনে আছে হাসমত আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গেল!’
সাবিহা কেন হঠাৎ এই প্রসঙ্গ তুলছে বুঝতে পারছে না আফিয়া। ওর কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি!
‘তুমি হঠাৎ পুরোনো দিনে ফিরা গেলা যে আপা?’ আফিয়া দ্রুত হাতে বোনের জন্য লেবুর শরবত বানাতে বানাতে জানতে চায়।
‘তোর কি মনে আছে খালেদ নামে আমার এক প্রাইভেট টিউটর ছিল। ইংরেজিতে কাঁচা ছিলাম বলে আব্বা তাকে পরীক্ষার আগে রেখেছিল আমার জন্য। খুব সহজ করে টেনস আর ন্যারেশন পড়াত সে।’
কথা বলতে গিয়ে মনে মনে প্রার্থনা করে সাবিহা, আফিয়া যেন চিনতে পারে খালেদকে।
‘খালেদ ভাইকে চিনব না কেন? উনি তো অনেক আগে থেকে খেলাঘরের লাইব্রেরিতে বসতেন। হুমায়ূন আহমেদ, তিন গোয়েন্দার নতুন বই এলে তোমার জন্য সরিয়ে রাখতেন।’
‘তাই করতেন নাকি তিনি?’
‘কেন তোমার মনে নেই?’
‘অত স্পষ্ট মনে নেই। শুধু একটা ঘটনাই পরিষ্কার মনে আছে। একটা দীর্ঘ প্রেমপত্র লিখেছিল সে। সেটা দেখে মেজাজ খারাপ হলো! এত বড় প্রেমপত্র এই যুগে কেউ লেখে…!’
‘আর মেজাজ খারাপ করে মেজো ভাইকে বলে দিলে! একটা মনের সমস্ত আবেগ দিয়ে লম্বা একটা চিঠি লিখল, জানাল তার ভালোবাসার কথা আর তুমি তারে এভাবে অপমান করলা!’
‘তখন তো রূপের গর্বে অন্ধ ছিলাম। বুঝি নাই, কে আসল আর কে নকল! তারপর তো হাসমত আমাকে কিডন্যাপ করল দিনে-দুপুরে!’
‘তো আজকে এতদিন পরে তোমার হঠাৎ খালেদ ভাইয়ের কথা মনে পড়ল কেন আপা!’
‘খালেদ ভাই এখন কোথায় থাকে বলতে পারিস?’ মনে হচ্ছে এই উত্তর পাওয়ার ওপর সাবিহার জীবন-মরণ নির্ভর করছে।
‘আগে তো ফরিদাবাদে এক কলোনিতে থাকতেন। এখন কোথায় থাকেন জানি না।’
‘কে জানতে পারে?’
আফিয়াকে চিন্তিত দেখায়। সাবিহা ঢকঢক করে লেবুর শরবত গলায় ঢেলে চোখে রাজ্যের আকুলতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। সেই চোখের দিকে কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা বিভ্রান্ত আফিয়া। কী হলো আজ বড় বোনের?
‘আমার এক বান্ধবী ছিল না লতা, ও খালেদ ভাইয়ের কাজিন হয়। ও হয়তো বলতে পারবে।’
‘ফোন দে না প্লিজ লতাকে।’
‘মোবাইল ছিনতাই হওয়ার পরে সবার নম্বর হারিয়ে গেছে। লতার নম্বর নেই আমার কাছে এখন।’
‘তবে লতার বাসায় যাই চল। ওর বাসা চিনিস তো?’
‘চিনি। কিন্তু হঠাৎ করে ওর বাসায় গিয়ে খালেদ ভাইয়ের নম্বর চাইলে অবাক হতে পারে ও।’
‘কিছু একটা বানিয়ে বলব তখন।’
আফিয়ার ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে আসার সময় হয়ে গেছে। রান্না শেষ করতে পারেনি। গোসলও করা হয়নি। এই অবস্থায় আফিয়াকে জোর করে গাড়িতে ওঠায় সাবিহা।
‘আচ্ছা, তুমি এতদিন পরে খালেদ ভাইকে খোঁজার জন্য এত মরিয়া হয়ে গেলে কেন? মাপ চাইবা তার কাছে?’ আফিয়া গাড়িতে বসেই জানতে চায়।
খুব আস্তে করে হুম বলে চুপ থাকে সাবিহা। ওর মনের মধ্যে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
বাসায় গিয়ে পায় না লতাকে। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে ও। লতার শাশুড়ি জানায়, যখন তখন অবস্থা বেয়াইয়ের। ওনার কাছ থেকে লতার নম্বর নিয়ে ফোন করে আফিয়া।
বাবাকে নিয়ে প্রচণ্ড উদ্বেগের মধ্যে লতার কণ্ঠের বিস্ময় ওদের কান এড়ায় না। খালেদের নম্বর দিতে পারে না লতা। তবে বাসার নম্বর দিতে পারে। রজনী চৌধুরী রোডে থাকে এখন খালেদ।
আফিয়াকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে রজনী চৌধুরী রোডে ছোটে সাবিহা। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে যেতে অনুরোধ করে আফিয়া। কিন্তু ওকে কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায় সাবিহা।
রজনী চৌধুরী রোডে যে বাসার নম্বরটা দিয়েছে লতা, সেখানে আগে একটা পুরোনো বাড়ি ছিল। এখন সেটা ডেভেলপার দিয়ে ভেঙ্গে ছয়টা বিল্ডিং করা হয়েছে। প্রতিটি বিল্ডিং ছয়তলা, প্রতি তলায় চারটা করে ফ্ল্যাট, তার একটাতে থাকে খালেদ! সাবিহার চেহারায় দিশেহারা ভাব ফুটে উঠে।
বাসার গেটে একজন দারোয়ানকে দেখতে পায় সাবিহা। উদভ্রান্তের মতো তার কাছে ছোটে ও।
‘এখনো কোন বিল্ডিংয়ে খালেদ সাহেব থাকেন, বলতে পারবেন? উনি ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। এক ছেলের বাবা।’
শেষের তথ্যগুলো লতার কাছ থেকে পাওয়া।
দারোয়ান খুব অবাক হয়ে যায় সাবিহার প্রশ্নের ধরন দেখে। দামি পোশাকে আর দেখতে শুনতে ভালো ভদ্রমহিলা এভাবে কেন কাউকে খুঁজছেন দারোয়ান বুঝতে পারে না।
‘এখানে খালেদ নামে কে থাকেন, জানা নেই আমার ম্যাডাম।’
দারোয়ানের কথায় সাবিহার মনে হয় ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে! হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে ও। তাহলে কি খালেদ ভাইকে খুঁজে পাওয়ার কোনো আশা নেই। দারোয়ানের বিস্ময় যেন বাধ মানে না। কাঁদতে কাঁদতে দারোয়ানের হাত ধরে জড়িয়ে ধরে সাবিহা।
‘ভাই, আপনি আমার ধর্মের ভাই হন। যেভাবে হোক খুঁজে দেন তাকে। যত টাকা চান, আমি আপনাকে দেব।’ কথা বলতে বলতে হ্যান্ডব্যাগ থেকে দুই হাজার টাকা বের করে দারোয়ানের হাতে দেয় সাবিহা। লোকটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
দারোয়ানের নাম ফতেহ আলী। সত্যি বলতে কী, এমন ঘটনা তার জীবনে আগে কখনো ঘটেনি। কথা বলতে ভুলে গেছে যেন সে। কোনোক্রমে জানায়, খালেদ নামে কাউকে পেলে সে জানাবে।
সাবিহার বাসার থেকে মেয়ে আর মেয়ের বাপের বারবার ফোন আসছে। বাসায় ফিরতে হবে এখন।
সাবিহা বাসায় ফেরার পরে শুরু হয়ে যায় সবার প্রশ্নবান। ও আগেই বানিয়ে রেখেছিল, বলবে যে আফিয়ার ব্যাগ ছিনতাই হয়ে গেছে। তাতে মোবাইল, টাকা, ক্রেডিট কার্ড অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিল। এজন্য থানায় যাওয়া, জিডি করতে দিন পার হয়ে গেছে।
নিজের পাগলপারা অবস্থার কারণে হাসমতের চেহারায় অবিশ্বাসের ছাপ চোখে পড়ে না সাবিহার। রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে ফোন করে ফতেহ আলীকে।
‘পাওয়া গেছে খালেদ নামে কাউকে? ব্যাঙ্কে চাকরি করে, এক ছেলের বাবা, ওনাকে পাওয়া গেলে আমি আপনাকে আরও টাকা বখশিস দেব।’
‘ম্যাডাম, কোনো বখশিস লাগবে না। আপনি ওনারে খুঁইজা পাইলেই আমি খুশি। গেট দিয়া যেই ঢুকতাছে, তারেই জিগাইতিছি খালেদ নামে কাউরে চেনে কিনা!’
দারোয়ানের কথায় আবার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে সাবিহার। তবে কি ওখানে খালেদ থাকে না। কোথায় থাকে সে? এত বড় শহরে কোথায় খুঁজবে এখন তাকে?’
হাসমত ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে থতমত খেয়ে যায়। কী যেন মেলাতে পারে না।
‘কিছু বলতে চাইছ মনে হচ্ছে?’ সাবিহা বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আবার বসে পড়ে।
‘না আইজকা কি হাবিবার ছঙ্গে বড় বউয়ের কাইজ্যা লাগছে নাকি?’ যথাসম্ভব নরম কণ্ঠে বলার চেষ্টা করে হাসমত।
‘কেন তাতে কী হয়েছে?’ হাসমতের ঠিক উল্টো আচরণ করে সাবিহা। অত্যন্ত রূঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে ও।
হাসমতের কণ্ঠ দ্বিধাগ্রস্ত— ‘না মানে, বিলকিস বলছে এই বাড়িতে হাবিবা কাজ করলে ও থাকত না।’
সাবিহা এবার দাঁড়িয়ে গিয়ে স্বামীর মুখোমুখি হয়, ‘তোমার বড় বউকে বলে দিও হাবিবা না থাকলে আমিও এই বাসায় থাকব না। গৃহকর্মীদের সঙ্গে যারা ঝগড়া করে তাদের পক্ষ থেকে কথা বলতে তোমার লজ্জা করে না।’
কথা শেষ করে সাবিহা বারান্দায় ঝোলানো দোলনায় এসে বসে। হাসমতের চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পায়। বিলকিসের কাছে গেছে মনে হয়।
বারান্দায় বসে সাবিহা আবার ফোন করে ফতেহ আলীকে। কোনো খবর নেই। সাবিহার এত অস্থির লাগে। সব ভেঙ্গেচুরে ফেলতে ইচ্ছে করে ওর।
মিম আর আলিফ এসে উঁকি দিয়ে দেখে যায়। ওর ধারণা করে সৎমার কারণে মায়ের মন খারাপ।
বাথরুমে ঢুকে মাথায় পানি দেয় সাবিহা। প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। এমন সময়ে ফতেহ আলীর কল আসে ফোনে।
‘ম্যাডাম শিকদার খালেদ নামে একজনরে পাইছি। উনি ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। আপনি যারে খুঁজছেন, ওনার পুরো নাম কি?’ ফতেহ আলী জানতে চায়।
সাবিহার আসলে কোনোদিনই জানতো না খালেদ ভাইয়ের পুরো নাম কী ছিল! কোনোদিন সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি তাকে। হঠাৎ স্বপ্নটা সব এলোমেলো করে দিল।
বাসার গেটের সামনে পাড়ার লোকজনের সামনে মেজো ভাই খালেদকে থাপ্পড় দিয়েছিল। শার্টের কলার ধরে ঘাড়ধাক্কাও দেওয়া হয়। খালেদের অপরাধ ছিল সে সাবিহাকে ভালোবেসে একটা দীর্ঘ প্রেমপত্র লিখেছিল।
ভাবনার জাল ছিন্ন করে সাবিহা দ্রুত জানতে চায়, ‘পুরো নাম মনে নেই এখন। ওনাকে ফোনটা দেন না।’
ওই পাশ থেকে ফতেহ আলীর সঙ্গে কারো কথা হয়। ‘উনি আপনার নাম জানতে চাইছেন।’
‘বল সাবিহা। সাবিহা সুলতানা। দীননাথ সেন রোডে থাকত।’
ফতেহ আলী ওর নাম জানাচ্ছে কাউকে, ফোনের এ-পাশ থেকে শুনতে পায় সাবিহা।
‘সাবিহা, তুমি? কী ব্যাপার? এতদিন পরে?’ ফোনে খালেদের কণ্ঠটা কেমন নিরাসক্ত শোনায়।
‘খালেদ ভাই আপনাকে আমার খুব দরকার। একটা কথা জানা দরকার।’
‘আমাকে দরকার, কেন বল তো?’ খালেদের কণ্ঠে আন্তরিকতার অভাব বেদনার্ত করে সাবিহাকে।
‘আপনি কি এখন ওয়ারিতে আসতে পারবেন? প্লিজ!’
‘মাত্র তো অফিস থেকে বাড়ি ফিরলাম। বাসায় গিয়ে বউয়ের মেজাজ-মর্জি দেখে বলতে পারব।’
‘বেশিক্ষণ লাগবে না। প্লিজ আসেন না। আমি ওয়ারী আড়ংয়ের সামনে থাকব।’
ওই পাশের জনের কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দেয় সাবিহা। এতদিন পরে দেখা হলেও সাজগোজের কথা ওর মাথায় আসে না। সারাদিন যে সালোয়ার কামিজ পরা ছিল, সেটা পরেই বের হয়। ড্রাইভার চলে গেছে তারাবি নামাজ পড়তে। হাসমত মসজিদে গেছে সবার আগে, লোকদেখানো ধর্মকর্ম করতে। হাবিবাকে ‘আফিয়ার সঙ্গে থানায় যেতে হবে’ বলে রাত আটটায় বাসা থেকে বের হয়ে যায় সাবিহা।
রিকশা নিয়ে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঢোকে সাবিহা। অপেক্ষার উদ্বেগ কাটাতে কিছু খাবার অর্ডার দেয়। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। কিন্তু সেই খাবারও আসতে দেরি হবে।
বারবার ঘড়ির দিকে তাকায় সাবিহা। খালেদ ভাই কি আদৌ আসবে? একুশ বছর পরে ওনার চেহারা কি আগের মতো আছে! নাকি আরও সুন্দর হয়ে গেছে। ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে কেমন ঝিমঝিম করতে থাকে ওর মাথা।
সাবিহা সামনে তাকিয়ে দেখে সুবেশধারী একজন সুদর্শন লোক দাঁড়িয়ে আছে। এত বছর পরে দেখা হলেও ও এক ঝলকে চিনে ফেলে। স্বপ্নে তো এই ভদ্রলোককেই দেখেছিল ও।
‘সাবিহা, তুমি তো দেখি আগের মতো সুন্দর আছ?’ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে খালেদ।
অনেক কথা বলার থাকলেও সব গুলিয়ে যায় সাবিহার। কেমন যেন একটা অবশ করা অনুভূতি হয়।
‘আমি কি আসলেই আগের মতো আছি?’ কোনোক্রমে বলতে পারে সাবিহা।
‘তোমাকে দেখে বোঝাই যায় না মাঝখানে কেটে গেছে এতগুলো বছর।’ হাসিমুখে বলে খালেদ। কণ্ঠে কেমন যেন মাদকতা। ‘জরুরি কী বলবে বলেছিলে?’
‘আমি আপনার কাছে মাফ চাইতে এসেছি, খালেদ ভাই। আজ ভোর রাতে একটা স্বপ্ন দেখার পরে আমি আমার মধ্যে নেই। এত অস্থির লাগছে যে ভাষায় বোঝাতে পারব না। প্লিজ বলবেন, আমার এমন পাগলের মতো অবস্থা কেমন হলো?’
মুখে কিছু না বলে খালেদ টেবিলে রাখা থাইস্যুপের বড় বাটি টেনে নেয়। ছোট বাটিতে কয়েক চামচ স্যুপ নিয়ে মশলা মেশায়। তারপর সাবিহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘আগে কিছু খাও সাবিহা। মনে হচ্ছে সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি।’
খালেদের এই কথা যেন হৃদয়ের কোন তন্ত্রীতে স্পর্শ করে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে সাবিহা।
‘কেঁদো না, সাবিহা। একদিন তোমাকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসতাম। তোমার একটু দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কতো কিছু না করতাম। তুমি দেখেও দেখতে না। কোনোদিন যদি আনমনে-অবহেলায় একটু তাকাতে, নচিকেতার নীলাঞ্জনার মতো, তবে সেই দিনটা অন্যরকম হয়ে যেতো। রাস্তায় হাঁটতে গেলে মনে হতো আমি উড়ে উড়ে চলছি। আমার এই তীব্র ভালোবাসা এতদিন জমা ছিল প্রকৃতি নামের দুষ্টু মেয়ের সিন্দুকে। অনেকদিন পরে সেই সিন্দুক উন্মুক্ত হয়ে গেল তোমার সামনে। তুমি সেই ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে গেলে।’
সাবিহা বোধোদয় হল অতঃপর, কেন ও পাগল হলো এই অবেলায়!
‘আমি এখন কী করব?’ সাবিহার কণ্ঠে সারা পৃথিবীর আকুলতা।
খালেদ কিছু বলার আগে সাবিহার মোবাইল বেজে ওঠে তারস্বরে। তন্দ্রা কেটে যাওয়ার পরে সাবিহা বুঝতে পারে সারাদিনের ক্লান্তিতে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল ও।
ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে দারোয়ান ফতেহ আলীর নম্বর।
সাবিহা আবার ফোন করতে ফতেহ আলী শুষ্ক কণ্ঠে জানায়, ‘খালেদ সাহেব একটু আগে এসে বলে গেছেন, উনি আজ আর আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না।’