অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কল্লোল মোস্তফা -
Melt Down – Three Mile Island

এইচবিওর চেরনোবিল মিনিসিরিজের রিভিউ লিখতে গিয়ে লিখেছিলাম যে, সিরিজটির একটা গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা বা সমস্যা ছিল- নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনাকে স্রেফ সোভিয়েত রেজিমের সমস্যার ফলাফল হিসেবে হাজির করা। সন্দেহ নেই, চেরনোবিল দুর্ঘটনার পেছনে তৎকালীন সোভিয়েত নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের ডিজাইন ত্রুটি ও নিরাপত্তা নিয়ে নানা অবহেলা ও লুকোছাপার ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এ থেকে যদি কেউ মনে করেন যে, পশ্চিমা দেশের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলো নিরাপদ, সেখানে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো অবহেলা করা হয় না, কোনো ধরনের লুকোচুরি করা হয় না, তাহলে সেটা ভুল ও বিপজ্জনক হবে।

সিরিজটির বিভিন্ন দৃশ্য ও সংলাপে নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনার ব্যাপারটি এমনভাবে হাজির করা হয়েছে যে পশ্চিমা নিউক্লিয়ার প্লান্টে এ ধরনের কোনো ঘটনা কোনো দিনই ঘটেনি বা ঘটতে পারে না। অথচ চেরনোবিলের সাত বছর আগেই ১৯৭৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থ্রি মাইল আইল্যান্ডে নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। পাঁচ পর্বের দীর্ঘ সময়ে যথেষ্ট সুযোগ ছিল সোভিয়েত কালচারের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রির নিরাপত্তা সংকট ও লুকোচুরির সংস্কৃতির বিষয়ে আলোকপাত করা। কিন্তু সে কাজটি না করার কারণে একটা গোটা ইন্ডাস্ট্রির অন্তর্গত সমস্যা স্রেফ একটা নির্দিষ্ট দেশের নির্দিষ্ট সময়ের সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে।

২০১৯ সালে প্রচারিত এইচবিওর চেরনোবিল মিনিসিরিজে নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রির যে দিকগুলো অনুল্লেখিত ছিল, সম্প্রতি প্রচারিত নেটফ্লিক্সের “মেল্টডাউন: থ্রিমাইল আইল্যান্ড” নামের লিমিটেড সিরিজে ঠিক সেই বিষয়গুলোর উপরেই আলোকপাত করা হয়েছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশের নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রির ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের থ্রিমাইল আইল্যান্ড নামের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সংগঠিত দুর্ঘটনার উপর ভিত্তি করে একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ডকুমেন্টারি নির্মাতা কিফ ডেভিডসন পরিচালিত চার পর্বের সিরিজটিতে।

সিরিজটিতে দেখা যায়, যে মানুষগুলোর ঘরের জানালা দিয়ে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের চিমনি দেখা যায়, তাদেরকে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপদ আপদ সম্পর্ক সামান্য ধারণা পর্যন্ত দেয়া হয়নি, প্রচার করা হয়েছে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নাকি স্রেফ চায়ের বড় কেতলীর মতো যেখান থেকে বাস্প তৈরী হয় যে বাস্প টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। দেখা যায় থ্রিমাইল আইল্যান্ড পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটার বহু আগে থেকেই বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ‌নানা ধরণের কারিগরি ত্রুটি, দুর্ঘটনা, লিকেজ ইত্যাদির তথ্য গোপন করেছে, সেফটি রিপোর্ট নিয়ে জালিয়াতি করেছে, নথিপত্র ধ্বংস করেছে যেন ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ না করতে হয়- যা এক পর্যায়ে দুর্ঘটনা ঘটার প্রেক্ষাপট তৈরী করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু নিয়ন্ত্রক সংস্থা এনআরসিও এসব বিষয়ে কোন গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি দুর্ঘটনার ১ম দিনেও কোম্পানি উদ্দেশ্যমুলক ভাবে হাইড্রোজেন বিস্ফোরণের মাধ্যমে আংশিক ভাবে রিঅ্যাক্টর কোর ধ্বংস হওয়ার তথ্য জনগণের কাছ থেকে গোপন রাখে। এই বিস্ফোরণের তথ্যটি গোপন রাখবার কারণে স্থানীয় জনগণকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত বিষয়ে দ্যোদুল্যমানতা তৈরী হয় তা অনেক বড় ধরণের ঝুঁকি তৈরী করেছিলো। রিঅ্যাক্টর কোরের আংশিক মেল্টডাউন না হয়ে যদি চেরনোবিলের মতো বিপর্যয় ঘটতো তাহলে এই লুকোচুরি ও গোপনীয়তার কারণে স্থানীয় জনগণকে অনেক বড় খেসারত দিতে হতো।

 রিঅ্যাক্টর কোরের পুরোপুরি মেল্টডাউন না হলেও চারপাশের মাটি পানি বাতাসে যে তেজস্ক্রিয়তা নির্গত হচ্ছিল সেটাও বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মেট্রোপলিটন এডিসনের(মেট-এড) কর্মকর্তারা গোপন রাখবার চেষ্টা করে। দুর্ঘটনার দিন প্রেস কনফারেন্সে স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে যখন জনগণকে আশ্বস্ত করা হচ্ছিল যে কোন ধরণের তেজস্ক্রিয়তার নি:সরণ ঘটেনি, সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে তখন একজন স্বীকার করে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিকটস্থ অঞ্চলের মাটিতে রেডিওঅ্যাক্টিভ আয়োডিনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সাংবাদিকদের জেরার মুখে বেরিয়ে আসে যে সরকার দুর্ঘটনার পর থেকে স্রেফ কোম্পানির মনিটরিং এর উপর নির্ভর করছে, কোম্পানির দেয়া তথ্য যাচাই করবার কোন ব্যবস্থা তখনো তাদের নেই! ফলে তেজস্ক্রিয়তার নি:সরণের মধ্যেই শিশুরা স্কুলে গিয়েছে, মাঠে খেলাধুলা করেছে, মানুষজন তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে গেছে।

দুর্ঘটনার পরপর প্ল্যান্ট অপারেটররা যেমন বুঝতে পারছিলেন না ঠিক কি ঘটেছে এবং তাদের করণীয় ঠিক কি হতে পারে, তেমনি মার্কিন সরকার, নিউক্লিয়ার রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ-এনআরসিকেও দেখা গেছে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। একদিকে বিদ্যুৎ কোম্পানির কর্মকর্তারা চোখ বুজে কোন সমস্যা নেই বলে মানুষকে আশ্বস্ত করতে চাইছে, অন্যদিকে আবার ঘোষণা করা হয় যে ১০ মাইলের মধ্যে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়া হতে পারে। পরস্পরবিপরীত ধর্মী পরামর্শ পেয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি বেড়ে যায়- কর্তৃপক্ষ একবার বলছে ইটের ঘরের জানালা খোলা রাখতে আবার বলছে সবার ঘরের জানালা বন্ধ করে দিতে। বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনাকারী প্রতিষ্টান বলছে তেজস্ক্রিয়তা নি:সরণ বন্ধ হয়েছে অন্যদিকে এনআরসি বলছে বন্ধ হয়নি। ঠিক কি পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা পরিবেশে ছড়িয়েছে তা সঠিক ভাবে নির্ণয় করতে না পারলেও সবাইকে আশ্বস্ত করা হয় যে স্বাস্থ্যগত কোন বিপর্যয় ঘটবার কোন কারণ নেই, ক্যানসার আক্রন্তের হার বৃদ্ধিরও আশংকা নেই। কিন্তু উক্ত এলাকার পানি দুধ ইত্যাদিতে তেজস্ক্রিয় আয়োডিন সনাক্ত হতে থাকে। নদীর পানিতে ভেসে উঠে মৃত মাছ। ১০ দিনের মাথায় সমস্ত ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়- মানুষ সব ফিরে আসতে শুরু করেন। ফিরে এসেই তারা গলা ব্যথায় আক্রান্ত হন, দেখা যায় মুখে ধাতব স্বাদ, চোখ জ্বালাপোড়া, ডায়রিয়া, বমি, চামড়ার অসুখ যা আসলে তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্তের লক্ষণ। মিডলটাউনের ১১ হাজার অধিবাসী তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যাপক চিন্তিত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে অধিবাসীদের অনেকেই থাইরয়েড, লিম্ফোমা সহ বিভিন্ন ধরণের ক্যানসারে আক্রান্ত হলেও এবং স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে দুই থেকে তিনগুণ বেশি ক্যানসার আক্রান্তের প্রমাণ পাওয়া গেলেও কর্তৃপক্ষ এসব ক্যানসারকে পরমাণু দুর্ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট বলে স্বীকার করেনি।

শুধু দুর্ঘটনার পরপর ঘটা অনিয়ম ও লুকোচুরিই নয়, সিরিজটিতে দেখানো হয়, দুর্ঘটনার কয়েক বছর পর যখন দুর্ঘটনার শিকার ইউনিটটির ক্লিন-আপ বা পরিস্কার করার উদ্যোগ নেয়া হয় সেখানেও দেখা যায় সময় ও খরচ বাচানোর জন্য ভয়াবহ সব ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনাকারী মেট-এড, পরিচ্ছন্নতার কন্ট্রাক্ট পাওয়া বহুজাতিক বেখটেল ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা এনআরসি। এসব অনিয়ম ও ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থানগ্রহণকারী কর্মী বা তথ্যফাঁসকারী হুইসেল ব্লোয়ারদের কন্ঠরোধ করবার জন্য মার্কিন নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রি কি ধরণের জঘণ্য কাজে লিপ্ত হতে পারে তার কতগুলো দৃষ্টান্তও এই সিরিজে দেখানো হয়েছে। সিরিজের প্রথম দুই পর্বে দুর্ঘটনা পরবর্তী তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করা হয় আর শেষ দুই পর্বে দেখা যায় কি করে সমস্ত ভয়ভীতি উপেক্ষা করে বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই একজন কর্মী কর্তৃপক্ষের ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকান্ডের তথ্য ফাঁস করে দিয়ে থ্রিমাইল আইল্যান্ডকে দ্বিতীয় আরেকটি বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে, যা থ্রিমাইল আইল্যান্ড দুর্ঘটনার ইতিহাসে সচারচর আলোচিত হয় না। যেমন আলোচিত হয় না এরকম আরো বহু হুইসেল ব্লোয়ার বা তথ্য ফাঁস কারীর কথা যাদের সাহসী তৎপরতার কারণে মার্কিন নিউক্লিয়ার ইন্ড্রাস্ট্রি বিভিন্ন সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

থ্রিমাইল আইল্যান্ড দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঘটনার উন্মোচন করবার জন্য পরিচালক মূলত ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য, ঐতিহাসিক ফুটেজ ও বিভিন্ন নথিপত্রের সাহায্য নিয়েছেন। নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মী-প্রকৌশলী, নিয়ন্ত্রকসংস্থা ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, ভুক্তিভুগী স্থানীয় অধিবাসীদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য কখনো পরপর প্রচার (জাক্সটাপোজ) করে আর কখনো পুনর্দৃশ্যায়ন(reenactment) করে ও বিভিন্ন ধরণের গ্রাফিক্সের সাহায্য নিয়ে জটিল বিষয়গুলোকে দর্শকের সামনে সহজভাবে তুলে ধরা হয়েছে। পরিচালক ডেভিডসন যেভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক-পরিচালক কোম্পানি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও প্রকৃয়াকে (ম্যাক্রো ন্যারেটিভ) দুর্ঘটনার ফলে ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিগত/পারিবারিক/সামাজিক অভিজ্ঞতার(মাইক্রো ন্যারেটিভ) সাথে জাক্সটাপোজ করেছেন, তাতে অনেক সময় বেশ নাটকীয় ও আবেগী পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সেই পারমাণবিক দুর্ঘটনায় মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র ফুটে উঠেছে।

এভাবে থ্রিমাইল আইল্যান্ড দুর্ঘটনা পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে কিফ ডেভিডসন পরিচালিত সিরিজটিতে গণতান্ত্রিক দেশ বলে বিবেচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার যে চেহারা ফুটে উঠেছে, তা মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য যেসব দেশে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে বা নির্মিত হচ্ছে, সেসব দেশের নাগরিকদেরকেও নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রির লুকোচুরি, গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা, প্রতারণা, জালিয়াতি ইত্যাদির ঝুঁকি বিষয়ে সচেতন হতে অনুপ্রাণিত করবে।

 

Read Previous

মাসুদ রানা জনপ্রিয় যে কারণে
মাসুদ রানা’র জনপ্রিয়তার কারণ: কতিপয় চিন্তাসূত্র

Read Next

দুটি ম্যাগাজিন আলোচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *